ইচ্ছার স্বাধীনতা হলো নৈতিকতার অপরিহার্য সত্য বা most fundamental moral postulate। আমাদের দিক থেকে এটি empirical fact বা অপরিহার্য বাস্তবতা।

জড় মাত্রেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা সর্বাবস্থাতেই সুনির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হবে। কোনো কিছু যদি জড় বা বস্তু হয়ে থাকে তাহলে সেটার কোনো ইচ্ছা বা ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকতে পারে না। যা যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হবে। হতে বাধ্য।

ম্যাথমেটিকসে যে chaos theory’র কথা বলা হয় তা শুধু নামেই chaotic। বাস্তবে chaos বলতে বিপুল জটিলতাকেই বুঝানো হয়। কোয়ান্টাম প্রবাবিলিটিও অনিশ্চিত কিছু নয়। যে প্রবাবিলিটি কাউন্টেবল তা মূলত অনিশ্চিত নয়। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিশ্চয়তার ধরন ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের নিশ্চয়তার মতো নয়।

মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকার মানে হলো মানুষ নিছক জড় নয়। অর্থাৎ, মানুষের শরীরী জড় বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি আমি বিশেষ ‘একটা কিছু’ যা অ-জড় বা extra-material। মনোদর্শনে যাকে মন বলা হয়। ধর্মীয় অর্থে মনের ঊর্ধ্বতন স্তর হলো আত্মা।

এ পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি, মানুষের নৈতিক প্রেরণা, সেটা যত ভালো বা খারাপই হোক না কেন, অন্যের নৈতিক অবস্থান আমার দৃষ্টিতে যতই ভুল হোক না কেন, প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্গতভাবে (intrinsically) থাকা এই নৈতিক প্রেরণার স্বরূপ বা বাস্তবতা হলো, এটি আদতে একটি অ-বস্তুগত ফেনোমেনা। এরই সাথে অনুরূপ অবস্তুগত ফেনোমেনা হিসাবে আমরা পাই জগত পরিচালনার নিয়মাবলীকে।

বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলোকে আমরা বস্তুগতভাবে প্রকাশ করতে পারি। যেমন, কাগজের উপরে কলম দিয়ে একটা সূত্র লিখতে পারি, বা গলার স্বর ব্যবহার করে এই সূত্রটিকে বলতে পারি। এভাবে একটা সূত্রকে আমরা নানাভাবে প্রতীকায়িত করে প্রকাশ করতে পারি। এরমানে এই নয় যে, সূত্রটির কাগজে লেখা ভাষাগত প্রকাশ বা গলার স্বর ব্যবহার করে বলা, এগুলোর কোনোটির সাথে উক্ত সূত্রের সম্পর্ক অভিন্ন বা identical। বরং, ভাষায় প্রকাশটা হচ্ছে সূত্রটা সম্পর্কে আমাদের ধারণা বা জ্ঞানের নিছকই কার্য-উপযোগী বহিঃপ্রকাশ। স্বয়ং সূত্রটা হলো ভাষাতীত এক বিশেষ বাস্তবতা। একটা অবস্তুগত সত্য।

গণিতের নিয়মাবলীও অবস্তুগত সত্য। অবশ‍্য, সামগ্রিকভাবে গণিতের সবকিছুই অবস্তুগত বা নৈর্ব্যক্তিক কিছু। ইংরেজিতে যেটাকে আমরা abstract বলি।

তো, নৈর্ব্যক্তিকতার কমন উদাহরণ হিসাবে এখানে আমি নৈতিকতা, বৈজ্ঞানিক নিয়ম ও গণিতের কথা বলেছি। এছাড়াও বস্তু-অতিরিক্ত বহু সত্তার কথা আমরা বলতে পারি।

প্লাটোর মতো ভাববাদীরা বলবে, বস্তু-অতিরিক্ত যে সত্তা, যেটাকে তিনি আইডিয়া হিসাবে বলেছেন, তা-ই হলো আসল সত্তা। world of ideas is the real idea। বস্তুজগত হচ্ছে ভাব বা ধারণার জগতে যা আছে সেটার বহিঃপ্রকাশ বা ফেনোমেনা মাত্র।

এরিস্টটলের মতে, জগতের সবকিছু হচ্ছে আকার ও উপাদানের সমন্বয়। উপাদানহীন কোনো আকার হতে পারে না, বা আকারবিহীন কোনো উপাদান হতে পারে না। জগতের বহির্ভূত সত্তা হওয়ার কারণে ঈশ্বর হচ্ছেন একমাত্র সত্তা যার কোনো বস্তুগত উপাদান নাই। তিনি বিশুদ্ধ আকার। God is such an Entity, which is matter-less Pure Form।

এ পর্যায়ে আস্তিক-নাস্তিক উভয় পক্ষ স্বীকার করে, বস্তুজগত এসেছে অবস্তুগত কিছু নিয়ম থেকে। এটি তো বুঝা গেল। কিন্তু নিয়মগুলো এসেছে কোত্থেকে? কেন এসেছে? এভাবে কেন এসেছে? অন্য কিছু হলো না কেন? একেবারে কিছু না হলেই বা কী ক্ষতি ছিলো?

এ ধরনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তরে মানুষ এ পর্যন্ত যা পেয়েছে বা পাবে তাকে আমরা মোটা দাগে দুটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি:

(১) প্রকৃতি ও
(২) ঈশ্বর।

এই দুইটা অপশনের বাইরে তৃতীয় কোনো ‘উত্তর’ পাওয়া অন্টোলজিক্যালি অসম্ভব। প্রকৃতি নামক এই প্রপঞ্চের প্রকৃতি বা inner characteristics সম্পর্কে যদি আমরা জানার চেষ্টা করি, তাহলে অবশ্যম্ভাবীভাবে আমরা কোনো না কোনো ফর্মে ঈশ্বর-ধারণায় উপনীত হতে বাধ্য।

যারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন, তারা প্রকৃতি সম্পর্কে ঠিক তা-ই বিশ্বাস করে, ঈশ্বরবিশ্বাসীরা সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর সম্পর্কে যা বিশ্বাস করে।

মজার ব্যাপার হলো, প্রকৃতি-বিশ্বাসী ও ঈশ্বর-বিশ্বাসী উভয় পক্ষের কাছেই উপরে উল্লেখিত অস্তিত্ববাদী মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু হুবহু একই। নিয়মগুলো কোত্থেকে এসেছে? এই প্রশ্নে উভয় পক্ষের উত্তর হলো ‘জানি না’। কেন এসেছে? ‘জানি না’। এভাবে কেন এসেছে? ‘জানি না’। অন্য কিছু হলো না কেন? ‘জানি না’। একেবারেই কিছু না হলেই বা কী ক্ষতি ছিলো? স্যাডলি, আস্তিক নাস্তিক উভয় পক্ষের কাছে এটিসহ এ ধরনের যাবতীয় প্রশ্নের একমাত্র plausible বা যুক্তিসংগত উত্তর হলো, ‘জানি না’।

এজন্যই বিশেষ করে তাকদীর সংক্রান্ত বিষয়ে ইদানীং আমি ‘ঐশী অজ্ঞেয়বাদ’ বা divine agnosticism তত্ত্বের কথা বলছি। অর্থাৎ খোদা কেন খাদ্যচক্রসম্পন্ন তথা hierarchical form-এ এই জগতটা তৈরি করলেন? কেন তিনি সবাইকে সমভাবে সুখী করলেন না? বা করবেন না? এগুলোর কোনো সঠিক উত্তর আমাদের কাছে নাই। থাকার কথাও নয়।

এমনকি, যুক্তি ও জ্ঞানবিদ্যার মৌলিক নিয়ম (ontological method of understanding) অনুসারে সেগুলো আমাদেরকে বুঝার জন্য দেয়া হলেও সেগুলো আমাদের বুঝতে পারার কথা নয়। কারণ, প্রত্যেকে কোনো বিষয়কে তার মতো করেই বুঝে বা বুঝতে পারে। ঢেলে দেয়া হলেও বোতলের মধ্যে সাগরের পানি ততটুকুই ঢুকবে যতটুকু বোতলের মধ্যে স্থান সংকুলান হয়। সেজন্য পরমসত্তা বা ঈশ্বর ব্যতীত আসলেই আসল বলে কিছু নাই বা হতে পারে না। এ বিষয়ে আমার ‘is there any really real reality?’ শীর্ষক একটা লেখা আছে। শিরোনামটা ইংরেজিতে হলেও লেখাটা বাংলায়।

যা আমরা জানি না, কিন্তু চাইলে জানতে পারি, তা হলো সংশয়বাদী অবস্থান বা skeptic position। আর যেটা আমরা আদৌ জানতে পারি না, দিলেও নিতে পারবো না, কনসিভ করতে পারবো না, প্রসেস করতে পারবো না, হজম করতে পারবো না, যা আমাদের ক্যাপাসিটির বাইরে, তাকে আমরা বলি অজ্ঞেয়। তাই, অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়, এই দুইটা আলাদা বিষয়। সংশয়বাদের দৃষ্টিতে কোনো বিষয় অজ্ঞাত হতে পারে। কিন্তু যা অজ্ঞেয় তথা not knowable তা জানার দাবি করাটা নিতান্তই বোকামি।

এই দৃষ্টিতে দেখলে বুঝবেন, আমাদের দিক থেকে আমরা খোদার অস্তিত্ব ও আমাদেরকে তিনি কীভাবে ডিল করছেন তা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারলেও তিনি আসলেই কেমন, বা বিশেষ কোনো নিয়ম বা ফেনোমেনা কেন এভাবেই তৈরি করেছেন, তা ‘সঠিকভাবে’ আদৌ আমরা জানতে পারি না। যেহেতু, প্রকৃতি কিংবা ঈশ্বর এগুলোকে আমাদের বিবেচনা-ক্ষমতার বাইরে রেখেছেন, তাই।

সে জন্যই খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করার পরে তাকদীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করতে হাদীসে বলা হয়েছে। আমরা খোদার সিফাত তথা আমাদের জন্য প্রযোজ্য ঐশী গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে আমাদের দিক থেকে, আমাদের মতো করে সীমিতভাবে জানতে পারি। কিন্তু খোদার জাত বা স্বগতঃসত্তা সম্পর্কে আমরা আদৌ জানতে পারি না। তাই, আপনার-আমার করণীয় হচ্ছে এ জগতকে আমরা যেভাবে পেয়েছি, যেভাবে এটি হয়েছে, আছে, সেভাবেই এটাকে জানা, বুঝা ও এতে প্রত্যেকের অবস্থান অনুযায়ী যথোচিত ভূমিকা পালনের চেষ্টা করা।

আমাদের কগনিটিভ সিনসিয়ারিটি ও এথিক্যাল অনেস্টির একমাত্র দাবি হলো সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ও বলবৎকৃত আইন-কানুন ও নিয়মাবলীকে অকুণ্ঠ চিত্তে মেনে নেয়া ও যথাসম্ভব মেনে চলা। category mistake বা fallacious সব আজগুবি প্রশ্ন করা হতে বিরত থাকা।

আমাদের যুক্তি-বুদ্ধির দাবি হলো, লিমিটেড এনটিটি হিসাবে নিজেদের তুচ্ছতা বা insignificance-কে অকপটে স্বীকার করে নেয়া। আমাদের দিক থেকে বাস্তব সত্য বা এমপেরিকেল ট্রুথ হিসাবে যেসব ক্ষমতা আমাদের আছে তা যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা। যা আমাদের আওতাবহির্ভূত তা নিয়ে অহেতুক ভাবিত না হওয়া। আওতাবহির্ভূত বিষয়ে অযথা পণ্ডিতি ফলানোর চেষ্টা না করা। প্রকৃতির নিয়ন্তা হিসেবে স্রষ্টার কাছে সর্বান্তকরণে আত্মসমর্পণ করা।

আলোচনাটির ইউটিউব লিংক

Similar Posts

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *