ফিলোসফি কোনো বিষয়ে কনক্রিট কিছু একটা দেয়, দেয়ার কথা বা দেয়া উচিত – ফিলোসফি নিয়ে আমার দৃষ্টিতে এর যে কোনোটার চেয়ে বড় ধরনের ভুল বুঝাবুঝি আর হতে পারে না।

দেশের জিডিপিতে ফিলোসফির কোনো অবদান নাই। ফিলোসফাররা একটা কলমও বানায় নাই। বসে বসে খাওয়া ছাড়া তাদের জেনুইন কোনো ‘অবদান’ নাই। এ কথা সত্য। মানছি।

তবে ভেতর থেকে ফিলোসফির ‘গুতাগুতি’ বা তাড়না না থাকলে বানরের একটা প্রজাতি আজকের মানুষ মর্যাদায় পৌঁছতো না, এ কথা নিশ্চিত। ডারউইনিয়ান বিবর্তন তত্ত্ব সারভাইবালের কথা বলে। সুপ্রেমেসি করার টেনডেনসির ব্যাখ্যা দ্যায় না। মঙ্গল গ্রহে নাসা কর্তৃক নভোযান পাঠানোর মধ্যে নিশ্চয় তেল-গ্যাসের ইজারা পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই।

আপনি বলবেন, এসব আবিষ্কার ও গবেষণা তো বিজ্ঞানের ব্যাপার। হ্যাঁ, তাই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক হয় কিসের নেশায়? সেটি নিশ্চয় বিজ্ঞান নয়। য়েনসার ইজ প্লেইন এন্ড সিম্পল, জ্ঞান-গবেষণা-আবিষ্কারের এই নেশারই অপর নাম ফিলোসফি। ফিলোসফি মানে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা love of wisdom। (অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণমূলক) পদ্ধতির কারণে জ্ঞানচর্চা বিশেষ বিজ্ঞান হয়ে উঠে। বৈজ্ঞানিক হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমানুষটার ভেতরগত প্রেরণা বা ‘পাগলামি’টা পিওর ফিলোসফি।

দর্শনের সাথে জ্ঞানের অন্যান্য শাখার আলোচনা অন্য পর্বের জন্য তোলা রইলো। আপাতত দর্শন জিনিসটাকে বুঝি।

তিন কারণে কোনোকিছু দর্শন হয়ে উঠে। এর প্রথম দুইটা পরিচিতিমূলক ও তৃতীয়টা মূল বৈশিষ্ট্য। (১) বেসিক ইস্যু অথবা কোয়েশ্চন নিয়ে ডিল করা, (২) মুক্ত আলোচনা তথা প্রশ্ন করার অবাধ স্বাধীনতা থাকা ও (৩) পক্ষে-বিপক্ষে যা-ই বলা হোক না কেন, তাতে যুক্তির সমর্থন থাকা। যুক্তি বলতে এখানে আর্গুমেন্টকে বুঝানো হচ্ছে।

ফিলোসফি কোনো বিষয়ে কেবল একটা কথা বলে না। একক কোনো সমাধানও ফিলোসফি দেয় না। দেয়ার কথাও না। দিলে বা কেউ দিয়েছে বলে দাবি করা হলে সেটি ফিলোসফি হিসাবে গণ্য হবে না। ফিলোসফি দেয় আর্গুমেন্ট। ফিলোসফিতে কোনো প্রমাণ নাই। গ্রহণযোগ্য আর্গুমেন্টকে সাধারণ মানুষের বুঝার জন্য প্রমাণ হিসাবে বলা হয়। সিডি’র প্রচলন হওয়ার পরে গ্রাম্য আমেজে একে অনেকটা সিডি-ক্যাসেট বলার মতো।

কোনো কিছুর অস্তিত্ব নিয়ে চার ধরনের কথা হতে পারে: আছে, নাই, জানি না অথবা আলোচনাটাই অর্থহীন। ফিলোসফি সবগুলো অপশনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। দিনশেষে আপনাকেই কোনো একটা অপশনকে বেছে নিতে হবে। এ ছাড়া গত্যন্তর নাই।

তাই, দর্শন গোঁড়ামীমুক্ত হলেও দার্শনিক অবস্থান মাত্রই গোঁড়ামীযুক্ত বা ডগমেটিক। কারণ, যখনই আপনি একটা নির্দিষ্ট অবস্থানকে বেছে নিয়ে অপরাপর সব যুুক্তি, সম্ভাব্যতা ও অবস্থানকে কার্যত বাতিল করে দেন, তখন আপনি আর মুক্ত নন। আপনি তখন একটা পক্ষ। আপনার বিবেচনায়, সত্যের পক্ষ।

আবার কোনো পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষ থেকে পার পাবেন, এমনটাও হবার নয়। নিরপেক্ষও একটা পক্ষ। দুনিয়াটা এক অর্থে দর্শনের কাছে শুরু থেকেই বিক্রীত (sold-out)। কোনো প্রমিন্যান্ট ফিলোসফিক্যাল স্কুল এডভোকেসি করে নাই, এমন মত-পথ আপনি বা কেউ খুঁজে পাবে না। যে পথেই যান না কেন, কোনো না কোনো ফিলোসফির পথেই আপনাকে যেতে হবে।

দর্শনের দরকার নাই। দর্শন মৃত। দর্শন কখনো জেনুইন কোনো বিষয় ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি দর্শন বিষয়ে যা-ই বলেন না কেন, তা যদি এ ধরনের চরম নেগেটিভ মন্তব্য বা দাবিও হয়, তাতে দর্শনের বৈধতার ও অপরিহার্যতার কোনো হেরফের হয় না। কারণ, আপনি যা-ই বলেন না কেন, তার পিছনে আপনি যুক্তি খাড়া করবেন, ‘প্রমাণ’ দিবেন। যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কথা বলাই হলো আদি, অকৃত্রিম ও নির্ভেজাল দার্শনিক প্রক্রিয়া।

দেখা যাচ্ছে, দর্শনকে ফেলতে ফেলতে, কাটতে কাটতে দর্শন আরো বেড়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন দর্শন তৈরী হয়ে পড়ছে। কী বিপদ…! ভাবুন তো, বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আবু হামিদ আল গাযালী দার্শনিকদের ওপর বিরক্ত হয়ে তাদের বাছাই করা ২০টা ভুল কথার ওপর একটা কিতাব লিখলেন। নাম দিলেন ‘দর্শনের খণ্ডন’ (তাহাফাতুল ফালাসিফা)। আর, কী মুশকিল, এই বইয়ের জন্য তাঁকেই কিনা জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও মুসলমানদের মধ্যে সর্বকালের সবচেয়ে বড় দার্শনিক উপাধি দেয়া হলো…!

তাহলে দর্শন থেকে তো রেহাই নাই দেখছি…! ভারী বিপদ! আসলেই বিপদ বড় ভারী। রেহাই নাই। এক ধরনের দার্শনিক যুক্তি দিয়ে মানুষ খোদাকে অস্বীকার করে। আবার না দেখা সত্বেও অন্য আরেক ধরনের দার্শনিক যুক্তি খোদার প্রতি মানুষ তার বিশ্বাসকে অমোঘ করে তোলে।

দর্শন হলো একটা পদ্ধতি। স্বয়ং কোনো পরিণতি নয়। যে পথে আপনি যেতে চান, দর্শন আপনাকে পথ দেখাবে। পক্ষ, বিপক্ষ বা নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের দায় দর্শনের নয়, আপনার। সেটি কৃতিত্বের ব্যাপার হোক বা ভর্ৎসনার কারণ হোক, তাতে দর্শনের কিছু আসে যায় না।

দর্শন সব সময়ে কোনো কিছুর দর্শন। philosophy is always a second-order subject. philosophy is always philosophy of something. এমনকি ফিলোসফিরও ফিলোসফি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাকে মেটা-ফিলোসফি বলা হবে। Google এ সার্চ দিয়ে দেখেন। ফিলোসফি অব ফিলোসফি ধরনের কিছু পান কিনা।

আসলে অর্থপূর্ণ যে কোনো কিছুই ফিলোসফি যদি সেটিকে মো-র থিওরিটিক্যালি দেখা হয়। মাছ যেমন পানিতে ডুবে থাকাকে অনুভব করে না, যেমন করে আমরা বাতাসে ডুবে আছি মনে করি না তেমন করে দিন-রাত দর্শন চর্চা করেও মানুষ, এমনকি উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও অনেকে মনে করে, ফিলোসফি আর তেমন কি…! তাদের আক্ষেপ ও অভিযোগ হলো, ফিলোসফি কনক্রিট কিছু দেয় না…!

হ্যাঁ, ফিলোসফি কনক্রিট কিছু দেয় না। কতো আর দিবে…!? এত এত সাবজেক্ট সব তো ফিলোসফি হতেই বের হলো। নাকি, ভুল বললাম? কোনো বিষয় সম্পর্কে ভুল করে হোক, শুদ্ধ করে হোক, যেভাবেই হোক না কেন, কোনো কিছু সম্পর্কে ‘সবাই’ একমত হয়ে গেলে ফিলোসফি তাকে অনতিবিলম্বে আপন সীমানা হতে বের করে দেয়। যেমন করে বড় হওয়ার পর মুরগী ছানাগুলোকে মা-মুরগী ঠোকরিয়ে তাড়িয়ে দেয়। সংশ্লিষ্ট ওই বিষয়ে মতৈক্য পোষণকারীরা জ্ঞানের একটা নতুন ও স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে তখন নিজেদের মতো করে (জ্ঞানচর্চার) সংসার শুরু করে।

বিজ্ঞান হলো ঐক্যমতের বিষয়। দর্শন হলো দ্বিমতের জায়গা। আপনি মেপে মেপে কোনো কিছুর মান সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারবেন। অন্য যে কোনো সাবজেক্টে। যদিও এক এক ডিসিপ্লিনে মাপামাপি এক এক রকমের। ফিলোসফিতেও মাপামাপি আছে। সে জন্য স্কেলও আছে। পার্থক্য হলো, ফিলোসফিই একমাত্র ডিসিপ্লিন যেখানে মাপামাপির সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট স্কেলটাকেও চ্যালেঞ্জ করা যায়, পুরো ব্যাপারটা নিয়েই প্রশ্ন করা যায়। উত্তর থাকুক বা না থাকুক, প্রশ্ন তোলা যায়। অন্তত এমন প্রশ্ন করার অধিকার থাকা তো চাই – মাপকাঠীর মাপ কী?

পদার্থ আছে কিনা, এই প্রশ্ন পদার্থবিদ্যায় করা যাবে না। এটি সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। অথচ, ফিলোসফির লেজিটেমেসি নিয়েও আপনি প্রশ্ন তুলতে পারবেন। নো প্রবলেম। যথাসম্ভব যুক্তি খাড়া করে বললে সেটিও দিন শেষে দর্শন চর্চায় অবদান রাখবে, কিংবা হবে নতুন একটা ফিলোসফি।

ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Enayet Ullah Patwary: “তবে ভেতর থেকে ফিলোসফির ‘গুতাগুতি’ বা তাড়না না থাকলে বানরের একটা প্রজাতি আজকের মানুষ মর্যাদায় পৌঁছতো না, এ কথা নিশ্চিত।” Please explain this clearly.

Mohammad Mozammel Hoque: যদি ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদকে তর্কের খাতিরে সঠিকই ধরে নেয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন হতে পারে কিছু কিছু বানর কেন অন্য রকম হলো? এর উত্তর বিবর্তনবাদের মধ্যে নাই। বিবর্তনবাদীদেরকে সমর্থন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং এটি দেখানো যে, ইন আইদার সিচুয়েশান, ফিলোসফি ইজ আ মাস্ট।

আপনি আমার লেখা পড়েন দেখে ভালো লাগলো। দোয়া করবেন।

Zillur Rahman: কি বিপদ!!! 😀

Mohammad Mozammel Hoque: বিপদটা কী? বুঝতে পারলাম না। একটু ব্যাখ্যা করবেন?

Zillur Rahman: “তাহলে দর্শন থেকে তো রেহাই নাই দেখছি…! ভারী বিপদ! আসলেই বিপদ বড় ভারী। রেহাই নাই।” স্যার, আপনার লেখারই অংশ এটা

Mohammad Mozammel Hoque: ওহ, তাই! হ্যাঁ, আসলেই রেহাই নাই। ব্যাপারটা যেন, চোখ দিয়েই সব দেখে কিন্তু চোখকে দেখে না। তাই, মনে করে, ‘সরাসরি’ই তো দেখি, চোখ নামের ‘বাহুল্যে’র দরকার কী? ফিলোসফি নিয়ে লোকদের তাচ্ছিল্য এমনই হাস্যকর। সমস্যা হলো আমরা যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফিলোসফি চর্চা করি তারা সাহস করে সত্য কথাটা বলি না। বরং যেন এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগি!!!

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *