১. বিজ্ঞান থাকতে ফিলোসফি কেন?

আজ আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো। সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক। টপিকটি বেশ বর্তমান সময়ের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞান কী?

বিজ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান। পর্যবেক্ষণ ছাড়াও জ্ঞান অর্জনের আরো কয়েকটি উপায় রয়েছে। এর একটা হচ্ছে যুক্তি-বুদ্ধির ব্যবহার বা argumentation। আরেকটি হচ্ছে বিশ্বাসভিত্তিক জ্ঞান। অনেকে মনে করেন, বিশ্বাস ও জ্ঞান হচ্ছে পরস্পরের সাথে সম্পর্কহীন ও পরস্পর বিপরীত দুইটা বিষয়। যারা এটা মনে করেন, তারা এটাও মনে করেন যে জ্ঞান হলো প্রমাণনির্ভর কিছু। বিশ্বাস প্রমাণনির্ভর নয়।

পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের দৃষ্টিতে, জ্ঞান হচ্ছে যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস। তাই জ্ঞান মাত্রই এক প্রকার বিশ্বাস। তবে বিশ্বাসমাত্রই জ্ঞান নয়। কোনো বিশ্বাসকে জ্ঞান হতে হলে সেই বিশ্বাসকে হতে হয় সত্য ও যাচাইকৃত বা যাচাইযোগ্য।

বিশ্বাস হলো জ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য উৎস।

জ্ঞান হলো কোনো অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার ফলাফল বা পরিণতি। জ্ঞান কগনিটিভ এজেন্সী নিয়ে কাজ করে। কগনিটিভ এজেন্ট কে? সোজা কথায় এই প্রশ্নের উত্তর হলো, কগনিটিভ এজেন্ট হচ্ছে সে যার প্রশ্ন আছে। যে প্রশ্ন করে। জানতে চায়। নিজের মতো করে।

বইয়ের কোনো প্রশ্ন আছে বলে আমরা মনে করি না, যদিও বইয়ে অনেক প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনা থাকে। পানির গ্লাস, টেবিল কিংবা গাছেরও কোনো প্রশ্ন নেই। অন্ততপক্ষে আমরা তা জানি না। তাই, যখন আমরা জ্ঞান কিংবা কগনিটিভিটির কথা বলি, তখন আসলে আমরা মানুষের কথাই বলি।

একমাত্র মানুষেরই নানা বিষয়ে প্রশ্ন থাকে। সেই প্রশ্ন সঠিকও হতে পারে, আবার ভুলও হতে পারে।

উত্তরের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। উত্তর সঠিক কিংবা ভুল, দুটার যে কোনোটাই হতে পারে। আবার, এমনটিও হতে পারে, হয়তো সেই প্রশ্নটিই ভুল বা অযৌক্তিক। একজন ব্যক্তির কগনিটিভ এজেন্ট হবার প্রমাণ হচ্ছে, কোনো না কোনো বিষয়ে তার প্রশ্ন ও অনুসন্ধিৎসা থাকা। বিশেষ ধরনের কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবার জন্য আমরা পর্যবেক্ষণের উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করি।

আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জ্ঞান থেকে শুরু করে দর্শন ও বিজ্ঞানের জ্ঞান এভাবেই শুরু হয়।

বস্তুজগত সম্পর্কিত কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে বিজ্ঞান ‘what’ প্রশ্নকে ডিল করতে গিয়ে ‘how’ ফরম্যাটে সেটার উত্তর দেবার চেষ্টা করে।

বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা আসলে আমাদের সামনে তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ এবং সেগুলোর ফলাফল তুলে ধরে। সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তারা কোনো কিছু সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা ও যুক্তি প্রদান করেন। একজন বিজ্ঞানী বা গবেষক যা জানে তা আসলে পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণই হচ্ছে মূলভিত্তি।

কোনো প্রশ্নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান যেভাবে ‘what’ প্রশ্নের মাধ্যমে আগায় এবং ‘how’ ফরম্যাটে উত্তর দেবার চেষ্টা করে, দর্শন কিন্তু সেভাবে কাজ করে না। দর্শন ‘what’ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে ‘why’ ফরম্যাট অনুসরণ করে। কোনো কিছু কীভাবে হলো সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কোনো কিছু ‘কেন’ হলো, কেন অন্যরকম না হয়ে সেরকমই হলো, দর্শন সেইটা বুঝার চেষ্টা করে। এ কাজ করতে গিয়ে দর্শন কিন্তু বিজ্ঞান দ্বারা অনুসৃত ‘how’ ফরম্যাটকে অবহেলা ও অগ্রাহ্য করে না, কিংবা বাতিল করে দেয়না।

দর্শন নিয়ে অনেকের মাঝেই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, দর্শন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে খাটো করে দেখে কিংবা সন্দেহের চোখে দেখে। আসলে তা নয়।

প্রকৃতপক্ষে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে দর্শন প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি বিজ্ঞানের আওতাকে ছাড়িয়ে যায়। একটা পর্যায়ে গিয়ে স্বভাবতই বিজ্ঞান থেকে জ্ঞানগত শাখা হিসাবে দর্শন নিজেকে স্বতন্ত্র করে নেয় এবং নিজের মতো করে জীবন ও জগতকে জানার চেষ্টা করে। দর্শনের এই স্বাতন্ত্র্যকে অনেকে ভুল বুঝে।

তারা মনে করে, ‘আমার কোনো পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন নেই, কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রয়োজন নেই, আমি শুধু ভাববো আর চিন্তা করবো। এটাই দর্শন।’ কিন্তু না, এটা আসলে দর্শন নয়।

কোনো বিষয় বা টপিক নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক, বিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞানীরা কী বলে সেটা সার্বিকভাবে জেনে নেয়াটা হলো দর্শনের প্রথম কাজ। এর পরের ধাপে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো মৌলিক প্রশ্নকে মোকাবেলার করার দিকে দর্শন এগিয়ে যায়। সেই বিষয় বা টপিকটিকে আরো বৃহত্তর বা সূক্ষ্মতর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করে। এভাবে দার্শনিকরা কোনো বিষয়ের গভীরে যাবার চেষ্টা করে। এভাবেই তারা জ্ঞানের পরবর্তী ধাপে উপনীত হয়। তারা কোনো বিষয়ের একদম গোড়ার প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধান করে। যেমন: এটা কেন হলো? এরকমই কেন হলো? ইত্যাদি।

how, or why?

কোনো বিষয় নিয়ে ‘how’ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে কখনই ‘why’ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। দর্শন তাই ‘why’ নিয়ে কাজ করে। আর এ প্রক্রিয়ায় কাজ করতে গিয়ে দর্শন আমাদের সামনে অনেকগুলো বিকল্প উত্তর উপস্থাপন করে। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একই ডাটা বা তথ্য অনুসরণ করে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব, বিপরীতধর্মী, এমনকি পরস্পরবিরোধী তত্ত্বও গড়ে উঠতে পারে। একই পর্যবেক্ষণের আলোকে পরস্পরবিরোধী যুক্তি বা দাবির উঠে আসতে পারে।

দর্শন সবসময় যুক্তি ব্যবহার করে।

কগনিটিভ এজেন্ট হিসেবে আমরা যুক্তির মাধ্যমেই কোনো কিছুর সম্ভাব্যতা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা বিচার করি। বৃহত্তর বা সূক্ষ্মতর যেই লেভেলে দর্শন কাজ করে সেই লেভেলে পর্যবেক্ষণ সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাই, যুক্তিই সেখানে একমাত্র হাতিয়ার আর বাহন হিসাবে কাজ করে।

তাই যুক্তির মাধ্যমেই দর্শন জীবন ও জগত সম্পর্কে আমাদের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।

দর্শন এমন একটি বিষয় যেটি কোনো প্রশ্নের জবাবে আমাদেরকে শুধু একটিমাত্র উত্তর প্রদান করে না। বরং, বিভিন্ন ধাঁচের যুক্তির ধারায় আমাদের সামনে কয়েকটি বিকল্প উত্তর উপস্থাপন করে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন রকম। যে উত্তর বা ব্যাখ্যা পর্যবেক্ষণ দ্বারা সবচেয়ে বেশি সমর্থিত হয়, সেটাকেই তখনকার বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় সঠিক হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।

বলাবাহুল্য, যুক্তি কখনো একক ধাঁচের বা চরিত্রের হয় না। দৃষ্টিকোণ ভিন্ন হলে একই বিষয়ে যুক্তিও ভিন্ন হবে। তাই, কোনো বিষয় বা প্রশ্নে দর্শন অনেকগুলো বিকল্প উত্তর হাজির করার মাধ্যমে প্রতিটি উত্তরের সবলতা ও দুর্বলতাগুলোকে সমভাবে তুলে ধরে।

প্রশ্ন হতে পারে, যুক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিসম (counter-balanced) পরিস্থিতিতে তো প্রতিটি উত্তর বা অপশনের সমর্থনেই যুক্তি পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে মানুষ কোন উত্তর বা অপশনটি বেছে নিবে?

প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে, তার কাছে যে যুক্তিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় সেটি বেছে নেওয়া। ব্যক্তি কিংবা দার্শনিক হিসেবে আমরা যুক্তির ভিত্তিতেই কোনো অপশনকে প্রেফার করি বা বেছে নেই। যদিও আমি জানি, অন্যরা যে অপশন বেছে নিয়েছে, সেটির পক্ষেও যুক্তির সমর্থন আছে। যদিও আমার দৃষ্টিতে তা দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য।

বৈকল্পিক পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের পছন্দের অপশনটিকে বেছে নেয়ার কারণ হলো, এটাই আমাদের কাছে একমাত্র সঠিক অপশন কিংবা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর বলে মনে হয়েছে। আমরা যখন এভাবে কোনো একটি অপশনকে বেছে নেই, তখন ঠিক কোন শক্তি আমাদেরকে সেই অপশনটা গ্রহণ করতে প্ররোচিত করে? কোন জিনিসটার কারণে আমরা বিশেষ এই অপশনটাকেই একমাত্র সঠিক অপশন বলে মনে করি?

অ্যাবডাক্টিভ লজিকের ভাষায়, আমরা এটাকে ‘সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকে বেছে নেওয়া’ বা ‘Inference to the best explanation (IBE)’ বলে থাকি। অনেকগুলো অপশন বা দার্শনিক ব্যাখ্যা থেকে যার যার বিবেচনা মোতাবেক আমরা একেকজন একেকটা অপশন বা ব্যাখ্যাকে বেছে নেই বা নিতে বাধ্য হই।

আমরা সবাই যদিও একই পৃথিবীতে বাস করি, প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করি, তবুও আমাদের চিন্তাধারা, মতাদর্শ, দার্শনিক অবস্থান প্রভৃতি ব্যক্তিভেদে আলাদা, বিপরীতধর্মী, এমনকি পরস্পরবিরোধীও হয়ে থাকে। ওয়ানস এগেইন, এটা কেন হয়?

কোনো একটি প্রশ্নের উত্তরে দর্শন কেন একটিমাত্র উত্তর প্রদান করে না?

আমরা জানি, দার্শনিক উত্তর মাত্রই অন্তর্গতভাবে অমীমাংসিত বা প্যারাডক্সিক্যাল। philosophical problems are perennial and philosophical propositions are paradoxical in its true nature. এর মানে হচ্ছে, যুক্তির দিক থেকে সব উত্তরই প্রতিসম বা সমান। ব্যক্তির ইনটেনশন বা নিয়তই ঠিক করে, কোনটাকে সে সঠিক বা ‘প্রমাণ’ হিসাবে গ্রহণ করবে।

সৃষ্টিগতভাবে মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। যুক্তি-বুদ্ধি তার হাতিয়ার। কোনো কিছু বলার সময়ে আমরা কোনো না কোনো যুক্তি দিয়েই তা বলার চেষ্টা করি। আমরা এটাও দেখি, অন্য কেউ সেই একই যুক্তি ব্যবহার করে হয়তো এমন কিছু বলছে যেটা আমার (দার্শনিক) অবস্থানের বিপরীত। এমনকি সে এই যুক্তি দিয়েই হয়তো আমার অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছে, এমনকি বাতিলও করে দিচ্ছে!

দর্শনের এই পিকিউলিয়ার এন্ড প্যারাডক্সিকাল বৈশিষ্ট্য মানবজাতির জন্য আশির্বাদ।

নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কোনো কিছু বেছে নেবার সুযোগ দর্শন আমাদেরকে দিচ্ছে। দর্শনের কারণেই আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কোনো কিছু বেছে নিতে পারি, নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। ফিলোসফির অনুপস্থিতিতে আমরা রোবট হয়ে যেতাম। কিংবা হতাম অবলা প্রাণী, অথবা কাঠ, পাথর, জড়।

প্রশ্ন হতে পারে, দর্শনে তো আমরা পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি– এ দুটি ব্যবহার করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তাহলে কেন আমরা দিনশেষে অনেকগুলো অপশন থেকে একটি অপশনকেই বেছে নেই? পূর্বেই বলেছি, এটা আসলে আমাদের মানসিকতা বা এটিচুডের পার্থক্যের কারণে। যেটাকে জ্ঞানতত্ত্বে ‘belief’ বা বিশ্বাস হিসেবে অভিহিত করা হয়। কোনো কিছু সঠিক হিসেবে গ্রহণ করার পেছনে আমাদের বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এর উপর ভিত্তি করেই আমরা অনেকগুলো অপশন থেকে একটাকে বেছে নেই।

যে বিশ্বাসের পেছনে পর্যবেক্ষণ কিংবা যুক্তির কোনো সমর্থন থাকে না সেই বিশ্বাসকে বলা হয় ডগম্যাটিক বিলিফ বা অন্ধবিশ্বাস। আর যে বিশ্বাসের পেছনে পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তির সমর্থন থাকে সেই বিশ্বাসকে ‘জ্ঞান’ হিসেবে ধরা হয়।

অতএব, প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের জন্য বিজ্ঞান অপরিহার্য।

তবে, ‘what’ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বিজ্ঞান যেহেতু ‘how’ প্রক্রিয়াতে অগ্রসর হয় সেহেতু এটাকে আমরা চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নিতে পারি না।

কগনিটিভ এজেন্ট হিসেবে আমরা নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করি। কোনো বিষয়ে দুয়েকটা উত্তর পেয়েই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাই না। এটা কেন, ওটা কেন, এটা এ রকম কেন, ও রকম নয় কেন– এ রকম নানা ধরনের প্রশ্ন আমাদের মনে সবসময় উঁকি দেয়। এভাবেই আমরা আসলে কোনো প্রশ্নের কেন’র উত্তর খুঁজে পেতে চাই। হোয়াই ফরফ্যাটে তথা কেন’র উত্তর পাওয়ার জন্য স্বভাবতই আমরা যুক্তিচর্চা তথা দর্শনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হই।

প্রথম পর্বের ফেসবুক লিংক

২. ইসলামের মূল প্রস্তাবনা হলো পিউর অ্যান্ড কোর ফিলোসফি

যারা ফিলোসফি বোঝে না, সেটি তাদের সমস্যা। ইসলাম ও দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে আমার কিছু লেখা আছে। এখানে তাই দ্বিরুক্তি এড়িয়ে এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলতে চাচ্ছি।

আগেই বলেছি, দর্শন কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তরেই আপনাকে একটিমাত্র অপশন বা উত্তর প্রদান করবে না। বরঞ্চ, দর্শন আপনাকে একটি সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে সহায়তা করবে এবং পাশাপাশি আপনাকে বিকল্প অপশন বা উত্তরগুলোও দেখিয়ে দিবে।

তবে, দর্শন আমাদেরকে যে বিকল্প অপশনগুলো প্রদান করে সেগুলো অসীম সংখ্যক হবে না। বরং সীমিত। কারণ, যুক্তির ভিন্নতা থাকলেও মানবীয় যুক্তির মৌলিক কাঠামো ভিত্তিগতভাবে সুনির্দিষ্ট এবং উপরি পর্যায়ে তা একটা নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে সীমায়িত।

সীমিত কয়েকটি অপশনের মধ্যে যে কোনো একটি অপশন বেছে নিতে হয়, এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, অন্য কোনো অপশন না নিয়ে আমরা কেন একটি বিশেষ অপশনকেই বেছে নেই? কোন শক্তির সাহায্যে বা প্ররোচনায় আমরা এটা করে থাকি?

এই প্রশ্নের একমাত্র গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো, এক্ষেত্রে ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর হলো আমাদের বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো অপশন বেছে নেবার জন্য জীবন ও জগত সম্পর্কে আমাদের ইনস্টিংক্টিভ বেসিক প্যারাডাইম বা অন্তর্গত মৌলিক জীবনবোধ– যাকে আমরা এক কথায় বিশ্বাস বলি, তা মূল ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বাসই আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। বিশ্বাসই জ্ঞানগত সিদ্ধান্তের মূল নিয়ামক।

আমরা জানি, বিশ্বাস থেকেই ধর্মের উৎপত্তি।

যে কোনো ধর্মের মূলে রয়েছে বিশ্বাস। তবে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো– বিশ্বাস হচ্ছে এমন কিছু, যেটার জন্য কোনো পর্যবেক্ষণ কিংবা যুক্তির প্রয়োজন নেই। এই ধারণাটি সত্য নয়।

আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে আমরা যদি এই বিষয়গুলোর সাথে ইসলামের তুলনা করি তাহলে দেখবো, কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা তোমাদের চারপাশের ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করো।

এই যে আকাশ, বাতাস, চাঁদ, সূর্য, পাখি, বৃক্ষ, ফলমূল– এ সবগুলোই তো আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা জানি, কোরআনের বেশিরভাগ সূরাই মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। মক্কী যুগের ইসলামে শরীয়ত বা তেমন কোনো বিধিবিধান ছিলো না। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাতের মতো মৌলিক বিষয়গুলোই তখন ইসলামে ছিলো। নবুয়তের দশম বছরে মহানবী (সা.) মেরাজে গমন করেন। সেখানে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আদেশ লাভ করেন।

মক্কী যুগে অপশনাল রোজা ও শেষের দিকে নামাজের মতো অল্প কয়েকটি বিষয় ছাড়া আর তেমন কোনো কিছুই বাধ্যতামূলক ছিলো না।

তাহলে, মক্কী যুগে মুসলমান হওয়া সাহাবীদেরকে কেন সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানুষ হিসেবে মনে করা হয়? সেটা তাদের বুঝজ্ঞান এবং ঈমান ও আকীদায় দৃঢ় বিশ্বাসের কারণেই। তাওহীদ, রেসালাত এবং আখিরাতের মতো ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো। তাওহীদ, রেসালাত এবং আখিরাতের আলোচনায় কোরআনে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্যবার মানুষের পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন এবং এরপর তিনি যুক্তি প্রদান করেছেন।

ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে এই ধর্ম সম্পর্কে আমার বুঝজ্ঞান বেশ ভালো বলেই আমি বিশ্বাস করি।

ঈমান এবং আকীদার মতো ইসলামের মৌলিক বা কোর বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের দার্শনিক সমাধান বা kind of philosophical outcome। পরম সত্য আছে কিনা, না থাকলে এই প্রশ্নটা আমাদের মনে আসে কেন? থাকলে তা আমরা কোথায় ও কীভাবে পাবো? বাস্তবতা আসলে কী? পরম বাস্তবতা বলে আসলে কি কিছু আছে?

এ ধরনের প্রশ্নগুলোর এক ধরনের উত্তর হচ্ছে তাওহীদ বিশ্বাস বা mono-theism। তাওহীদ বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র পরম বাস্তব। তিনি না থাকলে এ পৃথিবীর অস্তিত্ব লাভ হতো না।

সৃষ্টিকর্তা একজন নাকি বহু, সৃষ্টিকর্তা আছেন কিনা, অথবা তিনি অবতার হিসেবে পৃথিবীতে এসেছেন কিনা– এসব প্রশ্নের উত্তরে ইসলামের নিজস্ব একটি অবস্থান রয়েছে। সেটা হচ্ছে– সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর আছেন। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো অংশীদার নাই।

এইগুলো আসলে একেকটা মেটাফিজিক্যাল বা অধিবিদ্যক ইস্যু।

ঈশ্বর পৃথিবীতে ওহী নাযিল করেছেন মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য– এটাও আসলে ফিলোসফিক্যাল বিষয়। ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন, তাহলে মানুষ কীভাবে তাঁর সাথে সম্পর্কিত হবে, কীভাবে তাঁর কাছ হতে হেদায়েত লাভ করবে, তা নিয়ে ইসলাম যা বলে সেটাকে আমরা নবুয়তের ধারণা হিসাবে জানি।

‘প্রকৃতির সন্তান’ হিসাবে মানুষ তৈরি করেছে এই অর্থে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে প্রাকৃতিক ফেনোমেনা বা প্রকৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করলে এবং শরীয়তকে প্রকৃতিসম্মতভাবে জীবন পরিচালনার গাইডলাইন হিসেবে ধরলে আমরা বলতেই পারি, নবুয়তের ধারণা হলো এক ধরনের সামাজিক দর্শন।

এই ধারার বিশ্ব-দর্শন বা প্যারাডাইম অনুসারে ঈশ্বর হচ্ছেন প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্তা। যারা ফিলোসফি বোঝেন, উত্তর বা প্রস্তাবিত সমাধানের সাথে একমত হোন বা না হোন, তারা বুঝেন যে এই সকল প্রশ্ন ও বিষয় আসলে খাঁটি ফিলোসফিক্যাল কোয়েশ্চন ও ইস্যু। দর্শনের মূল শাখা হচ্ছে মেটাফিজিক্স। আর এগুলো তো মেটাফিজিক্সেরই প্রশ্ন। এই মেটাফিজিক্যাল প্রশ্নগুলোর কিছু সুনির্দিষ্ট উত্তর ইসলাম আমাদেরকে দেয়।

এ কাজে ইসলাম জ্ঞানতত্ত্বের প্রচলিত পদ্ধতিতেই অগ্রসর হয়। যেমন, জ্ঞান অর্জন ও যাচাইয়ের প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর সহায়তা নেয়। যখন যেখানে যেটা প্রযোজ্য হয় বা হতে পারে তখন সেখানে সেটার সাপোর্ট নেয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তা হতে পারে অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি বা স্বজ্ঞা বা সাক্ষ্য কিংবা অথরিটি।

ইসলামের বাইরেও ফিলোসফিতে আমরা এই প্রশ্ন ও ইস্যুগুলোর আরো কিছু বিকল্প সমাধান বা উত্তর দেখতে পাই। অটোনোমাস কগনিটিভ এজেন্ট বা বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আমি এভেইলেবল উত্তরগুলোর মধ্য কোনো একটিকে গ্রহণ করি। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন সেই অপশনটাই বেছে নেই? আমি বিশ্বাসীই বা কেন?

‘আমি বিশ্বাস করি, তাই বিশ্বাসী, কোনো প্রকার কারণ ছাড়াই, এটা আমার কাছে ভালো মনে হয়, সুতরাং এটা ভালো’– অনেকে এ রকম চিন্তা করে। অনেক ধার্মিক ব্যক্তিও এরকম চিন্তা করে থাকেন। আমার দৃষ্টিতে এটি অগ্রহণযোগ্য, ধর্মবিরোধী ও বোকামীসুলভ অন্ধ চিন্তা।

নিজের ব্যাপারে বলতে পারি, একজন ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে আমি বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে অনুসরণ করার কারণ হলো, আত্মসত্তা, জীবন ও জগত সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ ও অনুমান আমাকে বাধ্য করে বিশেষ কিছু যুক্তিকে গ্রহণ করতে। শক্তিশালী ‘why’ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য একটি সঠিক ও সুস্পষ্ট উত্তর বেছে নেয়ার কাজে আমার পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা আমাকে পথ দেখায়।

অন্য কোথাও আমি আমার ‘why’ প্রশ্নের উত্তর পাই না। আমি যখন কোরআন পড়ি, ওহী সম্পর্কে ধারণা লাভ করি, মহানবীর (সা.) জীবন সম্পর্কে জানি; তখন আমার কাছে সেগুলো সঠিক, গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। এ কারণেই আমি ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করি।

এবার আসুন, ‘বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্ম’ নিয়ে আলোচনার সারাংশ আলোচনা করা যাক।

দ্বিতীয় পর্বের ফেসবুক লিংক

৩. দর্শন কীভাবে বিশ্বাসব্যবস্থা বা ধর্ম হয়ে উঠে (how philosophy ends up in belief system or religion)

বিজ্ঞান কাজ করে পর্যবেক্ষণের সাহায্যে। পর্যবেক্ষন আমাদেরকে যুক্তির দিকে নিয়ে যায়। আর যুক্তি তখনই সিদ্ধান্ত অথবা জ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হয় যখন সেটা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে বা বিশ্বাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠে।

পর্যবেক্ষণ, যুক্তি এবং বিশ্বাস– এ তিনটি বিষয়ের সমষ্টিই হচ্ছে জ্ঞান। এটি সমকালীন পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের কথা বা agreed point।

কিন্তু একই বিষয় পর্যবেক্ষণের পরও বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করতে পারে। আর মানুষের সহজাত দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার মাত্রাও এক নয়। আবার একেক ব্যক্তির মন-মানসিকতাও একেক রকম। এ কারণে বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিভেদে পার্থক্য লক্ষ্যনীয়। এ কারণেই দর্শনের জগতে এত আইটেম। আপনি যদি কোনো একটা রেসিপিতে পরিবর্তন আনেন, তাহলে নতুন আইটেম তৈরি হবে।

আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মসত্তা, জীবন ও জগত নিয়ে বিশেষ কিছু দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কোনো কিছু পর্যবেক্ষণের পর আমরা সেটা নিয়ে সে ধরনের যুক্তিই প্রদান করি যেগুলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিলে যায়। আর সে কারণে একই বিষয়ে একেকজনের জ্ঞানও হয় একেক রকম। আমার জ্ঞানের সাথে আপনার কিংবা অন্য কারো সাথে আমাদের জ্ঞানের মিল হতেও পারে, নাও হতে পারে।

একই পৃথিবীর আলো বাতাসে থেকেও আমাদের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা ও বৈপরিত্য। আবার, একই বিষয়ে একেকটি ডিসিপ্লিন আমাদেরকে একেক রকম জ্ঞান দান করে। ধর্মও সেরকম একটা ডিসিপ্লিন। ধর্মের ক্ষেত্রে, একেক জনের মতামত একেক রকম হওয়া বা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।

আপনি যদি দর্শনের কথা বলেন, এক্ষেত্রে কিন্তু আপনার অপশন খুবই সীমিত। প্রতিটি ধাপেই আপনাকে যুক্তির সাহায্যে এগুতে হবে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আপনার অপশন আরো বেশী সীমিত। কারণ, সবকিছু আপনাকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে।

যারা নিজেদেরকে ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’ দাবি করে থাকেন, আমি তাদেরকে বলি বিজ্ঞানবাদী বা scienceist। তারা, মানে বিজ্ঞানবাদীরা যুক্তি দেন, ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে খুব সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়, কোনো বিষয়ে এটা যে উত্তর প্রদান করে সেটাতে ততটা মতপার্থক্য দেখা যায় না, যতটা অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায়। সুতরাং, আমাদের উচিত বিজ্ঞানকেই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা।’

হ্যাঁ, বিজ্ঞান আমাদেরকে খুব সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়, এটা সত্যি। তবে এর কারণ হচ্ছে, বিজ্ঞান আসলে খুব সীমিত পরিসরে কাজ করে। কোনো কিছু ‘কীভাবে’ ঘটে বিজ্ঞান সেটা নিয়ে কাজ করে। আর এক্ষেত্রে বিজ্ঞান সাহায্য নেয় পর্যবেক্ষণের। কিন্তু, আমরা যখন কোনো কিছু ‘কেন’ ঘটে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে চাই তখন সে প্রশ্নটির সদুত্তর প্রদান করা বিজ্ঞানের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর কারণ হচ্ছে, ‘why’ প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য সাবজেক্টিভিটির দরকার হয়। প্রয়োজন হয় যুক্তির। উপযুক্ত যুক্তিকে খুঁজে নিয়ে তা গ্রহণ করতে হয়।

আর যুক্তি এবং পর্যবেক্ষণ, এ দুটি এক বিষয় নয়। যদিও এ দুটি বিষয় মিউচুয়্যালি এক্সক্লুসিভ বা কন্ট্রাডিক্টরিও নয়। তবে, আলাদা বিষয়।

যুক্তির পরিসর অনেক বিস্তৃত।

আর সে কারণেই যুক্তি আমাদেরকে অনেকগুলো অপশন প্রদান করে। কগনিটিভ এজেন্ট বা মানুষ হিসেবে আমরা একইসাথে সব অপশনকেই গ্রহণ করে নিতে পারি না। বিদ্যমান অপশনগুলো থেকে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হয়। আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘আমি অপশনগুলোর কোনোটাই গ্রহণ করবো না।’ এক্ষেত্রেও কিন্তু আপনি একটি অবস্থান গ্রহণ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন, যেটাকে আমরা বলি ‘নিহিলিস্টিক’, ‘এগনস্টিক’ কিংবা ‘স্কেপটিক’ অবস্থান।

কোনো জোটেই যদি আপনি না থাকেন তাহলে আপনি জোটনিরপেক্ষ জোটের সদস্য!

সংগত কারণেই, জীবন ও জগতের রহস্য উন্মোচনের কাজে বিজ্ঞানের চাইতে দর্শনের পরিসর অধিকতর বিস্তৃত। বিজ্ঞানের তুলনায় দার্শনিক মত বা বিকল্প বেশি। আবার দর্শনের চেয়ে ধর্মের পরিসর ও প্রদত্ত অপশন আরও বেশি। কোনো অপশন গ্রহণ করার জন্য দর্শন আমাদেরকে পরামর্শ বা নির্দেশ প্রদান করে না। বরং, আপনি যদি কোনো একটি অপশনকে চাপিয়ে দেন বা কাউকে গ্রহণ করে নিতে বাধ্য করেন, তাহলে আপনি আসলে দর্শনের শিক্ষার বিপরীত কাজটিই করলেন।

এর কারণ হচ্ছে, দার্শনিক কোনো আলোচনায় আপনি সম্ভাব্য এমন কোনো কিছুকে বাদ দিতে পারেন না, যা যুক্তি দ্বারা সমর্থিত। হোক তা আপনার দৃষ্টিতে দুর্বল যুক্তি। যে কোনো ফিলোসফিক্যাল ইস্যুর জন্য এটি প্রযোজ্য।

ফিলোসফিতে প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে অনেকগুলো গ্রুপ, পয়েন্ট, স্কুল বা ধারা ও থিওরি থাকে। সবগুলোর পেছনে বা সমর্থনেই থাকে নিজ নিজ প্যাটার্নের যুক্তি।

দার্শনিক হিসেবে কেউ যদি অভিজ্ঞতাবাদী (empiricist) হয়ে থাকে, তাহলে তিনি স্বভাবতই বুদ্ধিবাদীদের যুক্তিগুলোকে বাতিল করে দিবেন। একইভাবে কেউ যদি বুদ্ধিবাদকেই (rationalism) বেশি ভালো মনে করে, তাহলে তিনি অভিজ্ঞতাবাদকে বাতিল করে দিবেন। কিন্তু, দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমি জানি, দর্শনের প্রতিটি অপশনের পক্ষেই যুক্তির সমর্থন রয়েছে।

গোঁড়ামিমুক্ত, অবাধ ও স্বাধীন জ্ঞানকাণ্ড হিসাবে দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যকেই আমরা আসলে অগ্রাহ্য (violate) করি যখন আমরা একজন ব্যক্তি বা দার্শনিক হিসেবে দিনশেষে বিশেষ কোনো একটি অপশনকেই বেছে নেই। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, আসলে আমাদেরকে অবশেষে সেটাই করতে হয়। কারণ, কোনো একটি বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট অবস্থানকে করণীয় বা অনুসরণীয় হিসাবে বেছে নেওয়া ছাড়া আপনি অগ্রসর হতে পারবেন না।

আপনি দর্শনের ক্লাসে বিভিন্ন অপশন নিয়ে কথা বলতে পারেন, সেগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, বিকল্প অপশন দেখাতে পারেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত একজন মানুষ হিসেবে আপনি অবশ্যই কোনো না কোনো অপশন বেছে নিয়ে কোনো একটি পার্টিকুলার অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য। তেমনিভাবে আপনার শিক্ষার্থীরাও কোনো না কোনো অবস্থানের সাথে অবশেষে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে বাধ্য। বাস্তব জীবনে যেহেতু আমরা নিরপেক্ষ বা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না।

ট্রাজেডিটা হলো, এ রকম সুনির্দিষ্ট একটি অবস্থান গ্রহণ করার মাধ্যমে আসলে আমরা অবাধ, স্বাধীন, গোঁড়ামিমুক্ত ও নিরপেক্ষ জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে দর্শনের যে বৈশিষ্ট্য সেটাকেই কার্যত বাতিল বা অগ্রাহ্য করি। আমরা কেন এটা করি? এই প্যারাডক্স বা ডিলেমার সমাধানই বা কী?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করলে আপনি বুঝবেন, আসলে মানুষ হিসেবে আমাদের কগনিটিভিটির মূলে রয়েছে বিশ্বাস তথা স্বতঃপ্রণোদিত বা অন্তর্গত ইচ্ছাশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির অনস্বীকার্য ভূমিকা। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের স্বতন্ত্র জ্ঞানজগত বা congnitivity গড়ে ওঠে। আর তাই, জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা তথা জ্ঞান-দাবির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বাসকে কোর আইডেন্টিফায়ার ও জাস্টিফায়ার হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।

তৃতীয় পর্বের ফেসবুক লিংক

৪. সমকালীন পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্ব অনুসারে বিশ্বাস হলো জ্ঞানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ

সবশেষে আমি আপনাদের খুব চমকপ্রদ একটি তথ্য দিতে চাই। ‘belief’ বা ‘বিশ্বাস’ শব্দটি জ্ঞানতত্ত্ব সংক্রান্ত বই কিংবা লেখায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ। আপনি যেখান থেকে ইচ্ছা জ্ঞানতত্ত্বের একটি বই বা আর্টিকেল নিয়ে ‘belief’ লিখে সার্চ দেন, তাহলে দেখবেন, এই শব্দটি বহুল ব্যবহৃত শব্দের একদম শীর্ষেই রয়েছে।

তবে, জ্ঞান অর্জন প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে দর্শনের অনেক শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষকরাও ততটা সচেতন নয়। বিশেষ করে যারা সমকালীন জ্ঞানতত্ত্ব পড়ে নাই।

পুনশ্চ, বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ধর্ম গড়ে ওঠে। সেই বিশ্বাস ডগম্যাটিকও হতে পারে, আবার পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিবোধের সমর্থন নিয়েও হতে পারে। কোনো বিশ্বাস যখন পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিবোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, সেটা হচ্ছে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস তথা জ্ঞান উৎপন্নকারী বিশ্বাস বা knowledge making belief।

‘জ্ঞান হচ্ছে যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস’– এই কথাটি এক শিষ্যকে প্লেটো প্রায় ২০০০ বছর আগে বলে গেছেন।

১৯৬৩ সালে এডমুন্ড এল গেটিয়ার ‘Is justified true belief knowledge? (যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস মাত্রই কি জ্ঞান?)’ শিরোনামে তিন পৃষ্ঠার একটি ছোট্ট আর্টিকেল লিখেন। সেখানে তিনি এটা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে কিছু বিষয় ভাগ্যক্রমেও সত্য হয়ে যেতে পারে। যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস তথা JTB-তত্ত্ব অনুসারে সেই ভাগ্যানুমান বা lucky guess-ও কারো কাছে ভুলক্রমে জ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদিও আমরা জানি, যথার্থভাবে যাচাই করা ছাড়া নিছক অনুমাননির্ভর কোনো ‘জ্ঞান’ প্রকৃত জ্ঞান হতে পারে না।

তাহলে এর সমাধান কী?

JTB-র প্রস্তাবনাকে সঠিক করার জন্য অনেক প্রস্তাবনাই দেওয়া হয়েছে। তবে, জ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিকেরা একমত হতে পারেন নাই। গেটিয়ারের প্রশ্নটির মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে সমকালীন জ্ঞানতত্ত্বের যাত্রা শুরু হয়েছে। যদিও জ্ঞানতত্ত্ব বা জ্ঞানের যাত্রা আসলে তখন থেকেই শুরু হয়েছে যখন মানব সভ্যতার উন্মেষ তথা মানুষ ফিলোসফি চর্চা শুরু করেছে।

‘ফিলোসফি’ শব্দটার ভিত্তিই জ্ঞান। আমরা জানি, দুটি গ্রীক শব্দ থেকে ‘ফিলোসফি’ শব্দটি এসেছে। একটি হচ্ছে, ‘ফিলোস’ (philos) এবং আরেকটি হচ্ছে ‘সোফিয়া’ (sophia)। এগুলোর অর্থ করলে দাঁড়ায় জ্ঞানের জন্য ভালোবাসা।

চিন্তাবিদ হিসাবে যাদেরকে আমরা দার্শনিক বলি– এদের সবাই জ্ঞানের ব্যাপারে কথা বলেছেন সেই আদিকাল থেকেই। হয়তো গ্রীক যুগের আগ থেকেই এর চর্চা হয়ে আসছে। আসলে সঠিক সময়টা আমরা কেউ জানি না।

এই আলোচনায় আমরা বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেছি। এই তিনটি প্রধান জ্ঞানকাণ্ডের মধ্যকার এ সম্পর্কটি আসলে ক্রমসোপানমূলক বা hierarchiacal নয়। বরং, সমতলধর্মী বা horizontal।

বিজ্ঞান অথবা দর্শন, কিংবা
বিজ্ঞান অথবা ধর্ম, কিংবা
দর্শন অথবা ধর্ম– বিষয়টি এ রকম নয়।

বিজ্ঞান আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। বিজ্ঞান দিয়ে শুরু করলেও সত্যানুসন্ধান প্রক্রিয়ার অগ্রগতিতে আমরা এক পর্যায়ে জীবন ও জগতের বৃহত্তর সত্যকে জানার জন্য পরবর্তী লেভেল তথা ‘why’ প্রশ্নের মুখোমুখি হই বা হতে বাধ্য হই।

এ পর্যায়ে দর্শন আমাদেরকে যুক্তির হাতিয়ার তুলে দেয়। যার সাহায্যে আমরা কিছু প্রকল্প বা বিকল্পকে নির্ধারণ করি। অবশেষে এর মধ্য হতে কোনো একটা বিকল্পকে আমরা একমাত্র সত্য হিসাবে গ্রহণ করি।

আমাদের দর্শনচর্চা অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি আমরা কোনো একটি বিশেষ দার্শনিক অবস্থানে নিজেদের আইডেন্টিফাই না করি। আগেই বলেছি, ক্লাইমেক্স অব ট্রাজেডি হলো, আমরা যখন অপরাপর বিকল্পগুলোকে বাতিল বা অগ্রাহ্য করে একটা সুনির্দিষ্ট দার্শনিক অবস্থান গ্রহণ করি তখন আমরা প্রকারান্তরে দর্শনের যে নিরপেক্ষ ও মুক্ত আবহ তথা ফ্রিনেস, সেটাকেই অগ্রাহ্য করি।

বিশেষ দার্শনিক অবস্থানকে ‘দ্যা অনলি ট্রুথ’ হিসাবে গ্রহণ করাটা হলো আসলে বিশেষ কোনো বিশ্বাস-ব্যবস্থার উপর আস্থাশীল হওয়ার নামান্তর। এই দৃষ্টিতে দর্শন শেষ পর্যন্ত একজন দার্শনিকের কাছে এক ধরনের ধর্মে পরিণত হয়, বিশ্বাসব্যবস্থাকে যদি আমরা ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবে মনে করি। যদিও এই ধর্মের বিশেষ কোনো রিচুয়্যাল থাকে না। এর পরিবর্তে (বিশ্বাসের পাশাপাশি) থাকে ধর্মের অপর প্রধান বৈশিষ্ট্য এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা বা sense of transcendence।

শেষ পর্বের ফেসবুক লিংক

আলোচনাটির ভিডিও লিংক:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *