বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অসহিষনুতা মাত্রাতিরিক্তহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে সবারই যথেষ্ট উদ্বেগ লক্ষ করছি। এর প্রেক্ষিতে ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ (CSCS) “মৃত্যুদণ্ডই কি মুরতাদের একমাত্র শাস্তি?” শিরোনামে ড. তারেক রমাদানের একটা বক্তৃতার সংশ্লিষ্ট অংশ ট্রান্সক্রিপ্ট করে অনুবাদ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ড. জামাল বাদাবীর “Is Apostasy a Capital Crime in Islam?” লেখাটি। ইতোপূর্বে সিএসসিএস ড. জামাল বাদাবীর “অন্যান্য কমিউনিটির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক” শীর্ষক একটা অনূদিত খুতবা ছাপিয়েছে।
এইসব লেখালেখি পড়ে কেউ কি কোনো শিক্ষা নেয়? চেঞ্জ হয়? আমার মনে হয় না। বরং লোকদেরকে কথায় কথায় কাফির বলায় অভ্যস্থতা তথা যারা তাকফিরি মুভমেন্টকে ভুল মনে করে তারা এসব লেখা হতে নিজ নিজ লিবারেল অবস্থানের পক্ষে যুক্তি ও তথ্য খুঁজে পান।
এর বিপরীত অবস্থানে আছেন স্বীয় বিবেচনায় যারা নিজেদেরকে জিহাদি মনে করেন তারা। তারা একই কোরআন-হাদীস হতে সম্পূর্ণ বিপরীত উদাহরণ ও দলীল খুঁজে পান। যেমন করে ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে জাবারিয়া ও কাদারিয়া সম্প্রদায় পরস্পর ১৮০ ডিগ্রী উল্টা দলীল কোরআন ও হাদীস হতে উদ্ধৃত করেন। তাহলে কি, নাউযুবিল্লাহ, কোরআন কি পরষ্পর বিরোধী আয়াতের সমষ্টিমাত্র? কিছু বিজ্ঞানবাদী নাস্তিক-পাগল ছাড়া এমন দাবী কেউ করেন না।
তাহলে, দৃশ্যমান মতবিরোধের সমাধান কি? উত্তরটা খুবই সহজ, কাণ্ডজ্ঞান তথা আক্বলে সলীম।
যারা কথায় কথায় দলীল খুঁজেন তারা এটি প্রায়শই ভুলে যান, দলীল জ্ঞান দেয় না, সহায়তা করে মাত্র। দলীল হলো নক্বল। এ দৃষ্টিতে কোরআন, হাদীস, সীরাত, ফিকাহ – সবই নক্বল তথা রেফারেন্স। জ্ঞানের মূল উৎস হতে সঠিক জ্ঞান লাভ করায় আমাদেরকে এসব নক্বল-এর জ্ঞান গাইড করে। জ্ঞানের মূল উৎসটি হলো আক্বল যাকে আমরা কমনসেন্স বলি। এটি প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা দিয়ে দিয়েছেন। আদমের (আ) সন্তান হিসাবে আমরা তা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে লাভ করেছি।
এই যুক্তি-বুদ্ধি তথা কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ ব্যতিরেকে কোরআন-হাদীস বুঝার চেষ্টা করলে নিজ নিজ যে কেনো প্রকারের ভুল চিন্তা ও অপকর্মের পক্ষে কোরআন-হাদীসের দলীল বের করা সম্ভব (!)। কোরআন-হাদীস বুঝার সময়ে, বিশেষ করে এতদুভয়ের কোনো সূত্র উল্লেখ করার সময়ে আমরা এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সচেতন হই না। ফলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। মক্কী যুগ, মাদানী যুগের কথা আমরা ভাসা-ভাসাভাবে শুনেছি বটে, কিন্তু এর তাৎপর্য বুঝি না। মানি তো না-ই। একপক্ষ সবকিছুকে নিছক দাওয়াতী দৃষ্টিতে দেখেন। আর এক পক্ষ সবকিছুকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের মধ্যে প্রশাসনিক ও সামরিক দিক অনস্বীকার্যভাবে ইনক্লুডেড।
আমরা, বর্তমান বাংলাদেশ, আমরা কি মক্বী যুগে? না, মাদানী যুগে? কোরআন-হাদীসের মুয়ামালাতগত যে কোনো কিছু নিয়ে ডিল করতে গেলে এই প্রশ্নের সুরাহা করাটা অতীব জরুরী। দুঃখজনক হলো, যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করেন তাদের কোনো পক্ষই এই প্রশ্ন প্রপারলি এড্রেস করে না। আমার ধারণায়, তারা এই মৌলিক প্রশ্নের গুরুত্বই বুঝে না। যারা ‘ইসলামী আন্দোলনে’র অনুসারী হওয়ার দাবি করেন, তাদের রেটরিকে যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তব কর্মকাণ্ডে তারাও এই পর্যায় বা ধারাক্রমকে মানেন না, সেটি স্পষ্ট।
যাহোক, সূরা নিসার ১৩৭ নং আয়াতটি যারা বুঝেছেন তাদের মুরতাদের শাস্তি বিষয়ে কোনো বেসিক মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকার কথা নয়। কোরআনের এই মুহকাম আয়াতের আলোকেই বাদবাকী সবকিছুকে বুঝতে হবে। যতটুকু আমি বুঝি। এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “যারা একবার মুসলমান হয়ে পরে পুনরায় কাফের হয়ে গেছে, আবার মুসলমান হয়েছে এবং আবারো কাফের হয়েছে এবং কুফরীতেই উন্নতি লাভ করেছে, আল্লাহ তাদেরকে না কখনও ক্ষমা করবেন, না পথ দেখাবেন।”
আজকের বাংলাদেশে ধর, মার, কাট, জবাই করো – এসব আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার জন্য দুটা বিষয় দায়ী। (১) রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে গড়ে উঠা বিচারহীনতার সংস্কৃতি, (২) শাহবাগ চত্বরের উৎকট সব শ্লোগান-আন্দোলন। দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে প্রমোট করেছে, ফিউয়েলিং করেছে। যারাই এটি ঘটিয়েছেন, এখন হয়তো বুঝতে পারছেন, তারা ভুল করেছেন। এ বিষয়ে বললে অনেক কথাই বলা যায়। অনেকেই বলেছেন। আমার বর্তমান অবস্থানের কারণে আমি এ নিয়ে আর বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছি না। সমস্যাগুলোকে আমি গোড়া হতে সমাধানের চেষ্টা করছি। তাই।
চরমপন্থী হওয়া সহজ। মধ্যপন্থী হওয়া কঠিন। ইসলামে কোনো প্রকারের এক্সট্রিমিজম নাই। একমাত্র এক্সট্রিমলি ব্যালেন্স করা ব্যতীত। প্রফেসর ড. ইউসুফ কারজাভীর ভাষায় ‘ওয়াসাতিইয়া’ বা মধ্যপন্থা। এটি কোরআনেরই ভাষা। আমরা নির্মূলকরণ চাই না, মধ্যপন্থা চাই। মিলে-মিশে থাকতে চাই। দ্বিমতের মধ্যে ঐক্য তথা ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ চাই। এসব নতুন কথা নয়। যদিও কিছু মৌলিক কথা বার বার বলতে হয়। সদা স্মরণে রাখতে হয়। সমাজ হলো বৈচিত্রের জায়গা, সবাইকে এক করে ফেলার জায়গা নয়। আমাদের ঐক্য বিশ্বাসে, কর্মে নয়। এই বিশ্বাসেরও বিভিন্ন মাত্রা ও স্তর আছে। বিভিন্ন ধরনের উপলব্ধি আছে। আসলে উপলব্ধি মাত্রই বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিশ্বাসের স্বাধীনতা সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত, আমি, আপনিসহ প্রত্যেক ব্যক্তির বেঁচে থাকার উপায়। জোর করে বিশ্বাস করানো যায় না। বিশ্বাস গড়ে উঠে। যুক্তির মোকাবিলায় তলোয়ার, চাপাতি, বোমা বা গুলি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এটি বুঝতে হবে।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Zillur Rahman: স্যার, বাংলাদেশ মূলত কোন অবস্থায় পড়ে মাক্কী না মাদানি? জিহাদি সংগঠন কুরআনের বিভিন্ন অংশ থেকে তাদের প্রয়োজনমত আর দাওয়াতি সংগঠন তাদের প্রয়োজনমত আয়াতের রেফারেন্স দেয়, আয়াতগুলোর নাযিলের প্রেক্ষাপটকে একপাশে সরিয়ে রেখে!
Mohammad Mozammel Hoque: আপনিই বলুন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি অনুসারে আমরা মক্কী যুগের পর্যায়ে, না মাদানী যুগের পর্যায়ে?
Engr Md Atikur Rahman: এটা আমিও আপনার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছি। জানাবেন আশা করি ।
Mohammad Mozammel Hoque: “আমরা একটা mixed society-তে বাস করছি। দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আমরা বসবাস করছি। এখানে higher level-এর কোনো কোনো বিষয় আমরা easily করতে পারছি। যেমন আমরা জুমআর নামাজ পড়তে পারছি। কিন্তু ঐ level-এর জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য কোনো কোনো বিধি আমরা মানতে পারছি না। যেমন আমরা ‘হদ’ [দণ্ডবিধি] কায়েম করতে পারছি না। যদি সাব্যস্ত করা হয় যে, আমরা মক্কি যুগে আছি তাহলে আমরা কি জুমআ বাদ দিব? যাকাত বাদ দিব? হিজাব বাদ দিব? আমরা কি সুদ গ্রহণ করব?” (ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা – http://cscsbd.com/275)
আবদুল্লাহিল মামুন: আমরা ধরেই নিচ্ছি এসব হত্যাকান্ডের সাথে একসট্রিমিস্ট একটা ব্রাঞ্চ জড়িত। যারা ইসলামকে ভিন্নভাবে ব্যাখা করে। অথচ আমরা বৈশ্বিক রাজনীতির হালচাল, এসব হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে কে কি খায়েস মিটাতে চায়, প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারী কারা এসব তথ্যর উদগাটন করছি না। তা নিয়ে আলোচনাও করছি না। মিডিয়া খাওয়ায় জঙ্গীবাদ। ইসলামী সন্ত্রাসী। তাই নিজেদের বাচানোর একটা নিম্ন হীন মানের কৌশল নিয়ে আমরা এগুচ্ছি।
Mohammad Mozammel Hoque: হ্যাঁ, অনেক স্টেকহোল্ডাররা এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। কে কোন অংশ ফোকাস করছে, সেটি হলো ব্যাপার। প্রতিটা কিছুর পার্টিকুলার এর পাশাপাশি হলিস্টিক এপ্রোচ থাকে।
Mahmudur Rahman: আপনি জ্ঞানের মুল উৎসকে আক্বল বলেছেন। জানি না কতটা যুক্তিযুক্ত। তবে ড. রামাদান In the footsteps of the Prophet বই এর এক জায়গায় বলেছেন-
Islam does not establish a closed universe of reference but rather relies on a set of universal principles that can coincide with the fundamentals and values of other believes and religious traditions (even those produced by a polytheistic society such as that of Mecca at that time.
Dr. Ramadan here referring hilf al-fudul which Prophet (sm) acknowledged terms of this pact long after revelation had begun). Islam is a message of justice that entails resisting oppression and protecting the dignity of the oppressed and the poor, and Muslims must recognize the moral value of a law or contract stipulating this requirement, whoever its authors and whatever the society, Muslim or not.
Akhtar Kamal: শুধু আল কোরানকে বিশ্বাস ও জ্ঞান চরচা, কোরানের উপর চিন্তা গবেষণা করে মজহাবি ফেরকা পরিত্যাগ করতে পারলেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। ইয়াজিদ, উমায়াইয়া ও আব্বাসীয় শাসন আমলে শাসকদের বেতনভুক আলেমসমাজের কোরানের অপব্যাখ্যা ও ভূয়া হাদিস রচনা ও তা সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারাও এর জন্য দায়ী।
Rimil Huda: আমি তোমাদের মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে তৈরী করেছি । কুরআন (২/১৪৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসুল (স) বলেছেন, “তোমাদের পূর্বে যারাই চরমপন্থা অবলম্বন করেছে তারাই ধংস হয়েছে”। তিনি এটা তিনবার বললেন। (মুসলিম: ২৬৭০)
Shahidul Hoque: যাদের চাপাতি দিয়ে কোপাতে সদা হাত ইশপিশ ইশপিশ করে, তাদের থেকে মধ্যপন্থী আক্কল আশা করাটা চোরকে ধর্মের কাহিনী শুনিয়ে সাফ-সুত্র করার প্রচেষ্টার মতই বৃথাকর্ম মাত্র।
Mohammad Mozammel Hoque: “এইসব লেখালেখি পড়ে কেউ কি কোনো শিক্ষা নেয়? চেঞ্জ হয়? আমার মনে হয় না। বরং লোকদেরকে কথায় কথায় কাফির বলায় অভ্যস্থতা তথা তাকফিরি মুভমেন্টকে যারা ভুল মনে করে তারা এসব লেখা হতে নিজ নিজ লিবারেল অবস্থানের পক্ষে যুক্তি ও তথ্য খুঁজে পান। “
Farid A Reza ধন্যবাদ। আমরা কুরআন-হাদীস না বুঝে, মহানবীর (সা) জীবন না জেনে ফতোয়ার মালিক হয়ে যাই। ইসলাম এখন বেওয়ারিশ সম্পত্তি। ব্যক্তিগত, সামষ্টিক এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনে আমরা ইসলামকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করছি।