আমি জীবনবাদী বলেই
মৃত্যুর বাস্তবতাকে
কথা আর লেখনিতে
মাঝে মাঝে তুলে আনি।
মৃত্যুকে আমি ভয় পাই
বরং অস্বীকারই করতে চাই।
কিন্তু পারি না।
মৃত্যু আছে বলেই জীবন আছে
স্বপ্ন আছে, আবেগ আছে,
হারানোর ভয় আছে
জীবনের প্রতি ভালবাসা আছে।
মৃত্যু যদি না থাকতো
জীবন কি এতটা অর্থপূর্ণ হতো?
মৃত্যু আছে বলেই জীবনবাদিতা আছে
জীবনের প্রতি আছে সর্বোচ্চ মায়া
আছে বাঁচার প্রবল আকাঙ্ক্ষা।
‘ঈশ্বর কেন অমঙ্গল সৃষ্টি করেছেন?’
সন্দেহবাদীদের এ এক বিরাট প্রশ্ন
অমঙ্গল না থাকলেই যেন
জীবন সর্ব সুন্দর হতো।
আসলেই কি তাই?
মৃত্যু যদি না থাকতো
জীবনের ভারে এ পৃথিবী
কবেই নিষ্প্রাণ হয়ে যেতো।
হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে বলেই তো
আছে টিকে থাকার এই সহজাত প্রেরণা।
কেউ এখানে চিরদিন থাকে না
থাকতে পারে না।
সবাইকে যেতে হয়
যাওয়াটাই এখানে ব্যতিক্রমহীন, নিয়ম।
জানি কিন্তু মানতে পারি না।
অন্তরের গভীর থেকে জেগে উঠা
বেঁচে থাকার এই বিদ্রোহ
কখনো সফল হওয়ার নয়
জানি সবকিছু ফেলে
একদিন যেতে হবে
বাবার বয়সের হিসাবে
আরো বারো বছর পরে
বড় চাচার বয়সের হিসাবে
তেত্রিশ বছর পরে
শিশুকালে মৃত্যু-যবনিকার ওপারে
হারিয়ে যাওয়া মেজ ভাইয়ের হিসাবে
ইতোমধ্যেই পঞ্চাশ বছর বেশি বেঁচে আছি।
জীবনের এই একান্ন বছরের সাথে
আরো একান্ন বছর যে পাবো না,
তাতো একপ্রকারে নিশ্চিত বলতে পারি।
অতঃপর যেতে হবে
কিছুটা আগে অথবা খানিকটা পরে
যাওয়াটাই যেহেতু এখানকার ব্যতিক্রমহীন নিয়ম।
সকাল চলে যায়, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে
এরপর রাত আসে।
আসে নতুন সকাল, নতুন দুপুর, নতুন রাত।
জীবনের এই স্রোত অনির্বার।
এক জীবনের সমাপ্তিতে
আসে নতুন জীবন
একের ধ্বংসস্তুপ হতে
অপর এক নতুনের আবির্ভাব,
নিত্য অবিরত।
আমাদের পরে
অন্য মানুষেরা আসবে। জানবে,
এমনই আকুল ছিলো
জীবনপিয়াসী ওইসব মানুষেরা।
যেতে চায় নাই তারা
সুন্দর এই পৃথিবী হতে।
কিন্তু গেছে। বরং যেতে হয়েছে তাদের।
আসাটা সম্ভাব্য হলেও যাওয়াটা নিশ্চিত।
ইতোমধ্যেই জীবনের ওপাড়ে
পারি দিয়েছে আমার
কতো আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-পরিচিত।
এই হাত দিয়েই একে একে দাফন করেছি
নিকট-আত্মীয়-আপন এমন নয়জনকে।
না, আমি ‘হুজুর’ নই।
ছিলাম না এ কাজে অভিজ্ঞ কেউ।
প্রিয় কোনো স্বজনকে নিয়ে
ছেড়ে দেয়া ট্রেনের পিছনে
অন্ধ আবেগে ছুটে চলা শ্রান্ত বালকের মতো,
শুধু চেয়েছিলাম
আপনজনদের শরীরি স্পর্শ-অনুভবে পেতে,
যতোক্ষণ বেশি সম্ভব।
যদি এ লেখা তেমন কেউ কখনো পড়ে
যখন আমি থাকবো না, তখন
হয়তোবা খানিকটা আবেগ তাড়িত হবে
আশ্চর্য হয়ে ভাববে,
‘এরাও তো ছিলো এখানে আমাদেরই মতো।
তারা মৃত্যুর কথা বলতো, ভাবতো।
মৃত্যুকে অস্বীকার করে
জীবনকে উপভোগ করতে চাইতো।
কিন্তু পারেনি শেষ পর্যন্ত
আনন্দ উচ্ছ্বাসময় এ জীবনের
অন্যপাশে থাকা মৃত্যুর বাস্তবতাকে এড়াতে’।
জ্ঞান, ধর্ম, নৈতিকতা ও সমাজ –
এক কথায় সব কিছুই অসার, ব্যর্থ
জীবনবোধের এই বাস্তবতা যদি
কাউকে তেমন আলোড়িত না করে।
আত্মসত্তার অনুভবই হলো
মানুষের তাবৎ জ্ঞান, ধর্ম,
নৈতিকতা ও সমাজ চেতনার ভিত্তি।
ভাবতে ভালো লাগে
আমি মানে শুধু এই শরীরি আমি নই।
যেন দৃশ্যমানতার উর্ধ্বে ‘আমি’ অতিরিক্ত কিছু।
যিনি জীবনবাদী নন, জড়বাদী
নিঃসন্দেহে তিনি জীবনপথে বেভুল যাত্রী, পথহারা।
আমার চেতনা, বোধ অহর্নিশি বলছে,
জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে
এত সংক্ষিপ্ত সময়ে এই অস্তিত্বের সবটুকু
অনুভবের সবকিছু
চিরতরে শেষ হয়ে যেতে পারে না।
এই আমার জীবনবোধ আর বিশ্বাসের ব্যাপার।
বিশ্বাসই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে
যার বিশ্বাস যত দুর্বল
তার জীবনবোধও তত দুর্বল।
অস্তিত্ববাদী বিশ্বাসের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে
মানুষ ভাবে, সে ‘স্বাধীনভাবে’ ভাবছে …!
বিশ্বাস ছাড়া মানুষ ভাবতে পারে না,
বাঁচতে পারে না।
বিশ্বাসের ভিত মজবুত না থাকলে জ্ঞান অসম্ভব।
হোক সেটা জীবনের কোনো বিশেষ ধরন
অথবা বিশেষ কোনো ধরনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস,
হোক সেটা এ জীবনের পরে
কিছু আর না থাকায় বিশ্বাস।
এককথায়, বিশ্বাসহীন জীবন অসম্ভব।
হতে পারে, কেউ ভুল করে বিশ্বাস করে,
যেন বিশ্বাস বলে কিছু নাই।
বিশ্বাস না থাকার বিশ্বাসটাও কিন্তু
এক ধরনের বিশ্বাসই বটে।
অবিশ্বাসীরাও এক ধরনে আস্থা রাখে,
বিশ্বাস নিয়েই যাচাই করে
নির্ভর করে ‘নির্ভরযোগ্য’ কোনো ব্যবস্থার ওপর।
হতে পারে সেটা কোনো যুক্তিতে বিশ্বাস
কিংবা বিজ্ঞানে বিশ্বাস।
‘বিশ্বাসী হতে চাও, নাকি যুক্তিবাদী?’ –
এ’ ধরনের প্রশ্নমাত্রই ভুল, যুক্তিবিদ্যার ভাষায়
বৈকল্পিক অনুপপত্তি।
শুধু যুক্তি বলে কিছু নাই, থাকতে পারে না।
শুধু বিজ্ঞান বলে কিছু নাই, থাকতে পারে না।
হোক সেটা যুক্তি, হোক সেটা বিজ্ঞান
গ্রহণ করা তথা বিশ্বাস করার মধ্য দিয়েই
বিশেষ কোনো যুক্তি বা বিজ্ঞান জ্ঞান হয়ে উঠে।
জ্ঞানের পথে যুক্তি হলো হাতিয়ার,
বিজ্ঞান হলো পদ্ধতি।
এর কোনোটাই স্বয়ং সত্য বা জ্ঞান নয়।
সত্যতার সোপান অথবা জ্ঞানের উপায়ই
স্বয়ং সত্যতা বা জ্ঞান নয়।
সত্যতা হলো এক প্রকারের শুদ্ধ বিশ্বাস
জ্ঞান হলো বিষয়-বিষয়ীর মিথষ্ক্রিয়ার নির্যাস।
কোনো সত্যতাকে আমরা কখনো
পুরোপুরি পাই না।
সত্যতার অনুমিত ধারণাকে
আমাদের ভালো লাগা বিশ্বাস-বিশেষের
বৈধতা, অজুহাত বা দোহাই হিসাবে
আমরা ব্যবহার করি মাত্র।
‘নিরপেক্ষ সত্যতা’
মানবিক বিবেচনার উর্দ্ধে অতিবর্তী কিছু।
সত্যি কথা হলো,
‘আসল সত্যের’ কোনো পরশ পাথর
কারো হাতে নাই।
ক্ষুদ্র এ জীবনে এই অসহায় আমরা
কোনো সত্যকেই
পুরোপুরি ধারণ করতে পারি না।
সামনে যা কিছু পাই
‘প্রমাণ’ হিসাবে আঁকড়ে ধরে
ভাবতে ভালবাসি,
এই তো পেয়েছি, সত্যিকারের জ্ঞান আর
আসল সত্যকেই পেয়েছি …।
জাদুপুরীর মায়াবী হরিণের মতো
অধরা সত্যের পিছনে
আমরা জীবনভর ছুটে চলি।
এ জীবন যেন তেমনই
এক মায়াপুরির গোলক ধাঁ ধাঁ
যার মোহ কাটানো শেষ পর্যন্তও অসম্ভব।
জীবনের এই ‘বাস্তবতা’,
ছায়াবাস্তবতার মতো অর্ধসত্য বা খণ্ডিত হলেও
এ জীবন আর এই পৃথিবীর প্রতি
আমাদের ভালবাসা অকৃত্রিম ও অখণ্ড।
মেনে নিয়েছি আমরা এই ‘জীবন-মরণ খেলা’কে,
‘প্রবলেম অব এভিলে’র প্রতি-বাস্তবতার মতো
ভাল আর কল্যাণের ধারণা অর্থহীন,
মন্দ আর অকল্যাণের অনুপস্থিতিতে।
যেমন করে আমরা চাই,
বজ্রপাত হোক, বরং সেটি যথেষ্ট রোমান্টিকও বটে
যতক্ষণ না তা আমার
আপন কারো উপরে পতিত হয়।
তেমনি জানি, মৃত্যু অনিবার্য।
তাতে কী? যত বেশি বাঁচি
তত বেশিই তো লাভ।
জানিই তো যেতে হবে একদিন।
হ্যাঁ, যাবো।
তাই বলে বাঁচার এ অনিরুদ্ধ আবেগকে
কী করে অস্বীকার করি?
মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে।
তাই বলে কি জীবনবিরাগী হবো? না।
যতদিন আছি ভালোভাবেই থাকতে চাই
ঋদ্ধ মানবিক জীবনে আপদমস্তক
বাঁচার মতো করে বাঁচতে চাই
চাই স্বোপার্জিত মুক্ত জীবন
চাই অকপট ভালবাসা দিতে এবং পেতে,
জীবনকে অনুভব করতে চাই কানায় কানায়
কাজে লাগাতে চাই
মানবজন্মের এই অতিদুর্লভ সুযোগকে,
যতটুকু সর্বোচ্চ সম্ভব
জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে
পূরণ করে যেতে চাই,
হোক এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
আরোপিত, অর্জিত কিংবা অন্তর্গত।
পরবর্তী প্রজন্মকে বলে যেতে চাই,
জীবন এক পথের নাম,
যে পথে যাত্রীরা নিত্য নতুন
অথচ বিরতিহীন এ পথচলা অতিপুরাতন, অন্তহীন।
এ পৃথিবী আর এ জীবন
এক বিশেষ মহাজাগতিক ব্যতিক্রম।
এখানকার এই প্রাণপ্রবাহ
কোনো দৈব দুর্ঘটনা
বা অর্থহীন কিছু হতে পারে না। বরং,
অভিজ্ঞতা বলে, অতি অবশ্যই এ এক
মহাসুসামঞ্জস্যতার পরিণতি।
তাই, ভাবতে ভালো লাগে,
এখানকার এই সংক্ষিপ্ত জীবনেই
সবকিছু শেষ, এমন নয়।
দূরে কোথাও অন্য কোনো ছায়াপথ সৌরমণ্ডলে
অপেক্ষা করে আছে
অন্য এক পৃথিবী, অন্য এক জীবন।
কাউকে জোর করে এ’কথা বিশ্বাস করানোর মতো
কোনো ‘অকাট্য প্রমাণ’ আমার হাতে নাই,
আছে শুধু অস্তিত্ববোধের গভীরতম প্রান্ত হতে উৎসরিত
শুদ্ধ আবেগ, যুক্তি আর বিবেক-বুদ্ধির সাক্ষ্য।
জীবনবোধ ভিতর থেকে গড়ে উঠার ব্যাপার।
জীবনবোধ কোনো হস্তান্তরযোগ্য সম্পত্তি নয়।
জীবনের ধারবাহিকতায় প্রত্যেককে বিশ্বাস করতেই হবে,
এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই।
তাই, কেউ ভাবতেই পারে,
এ জীবনের পরে আর কিছু নাই
এখানেই সব শেষ।
সেটি তার নিজস্ব ব্যাপাার, একান্ত ভাবনা।
প্রত্যেকেরই আছে বিশ্বাসের অধিকার।
আমার তো বরং এ কথা ভাবতেই ভালো লাগে,
নিশ্চিত মনে হয়
এত সুন্দর এই জীবনের নির্ঘাত আছে
সুন্দরতর কোনো পরবর্তী কিছু।
ভাবতে ভালো লাগে,
সেই জীবনও হবে এ জীবনের মতো
রূপ, রস, গন্ধ ও বর্ণময়, মোহময় সুন্দর ….