কুসুম। আমার মা। নীতিবান ও বিদ্বান পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর হাতে নির্যাতিত এই মাতৃহারা কিশোরীকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই। তৎকালে এটাই ছিলো সামাজিক রীতি। আমরা দশ ভাইবোনের সবার বড় জনসহ এখনকার ষাটোর্ধ বয়সের সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত সুপার এলিট পেশাজীবীদের প্রত্যেকেই কিশোরী টিন-এজ মায়ের সন্তান। না, আমি টিনএজ বয়সে মেয়েদের বিয়ের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে লিখতে বসি নাই। আমার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, আমার মায়ের জীবন সম্পর্কে। তা নিয়ে আজ বলবো।
সৎমায়ের ঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ না থাকায়, সম্ভবত, পারিপার্শ্বিকতার অচলায়তনে আত্মসমর্পণ না করে তিনি জীবনকে নিয়েছিলেন কেবলি এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ হিসাবে। আমার দাদারা ছিলেন পাঁচ ভাই। আমার বাবা ছিলেন উনাদের যৌথ পরিবারে বড় ছেলে সন্তান। স্বভাবতই আমার মাকে তাই বাড়ির বড় বউ হিসাবে পুরো যৌথ পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। উনার ছয় নম্বর সন্তান অর্থাৎ সিরিয়ালে অনেক পরে হয়েও আমি দেখেছি, চাচারা আমার মাকে মায়ের মতো সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। আম্মা ছিলেন মেজাজী। কোনো চাচাকে দেখি নাই, কখনো উনার বকাঝকার কোনো উত্তর দিতে। বুঝতেই পারছেন, সরকারী চাকুরীজীবী স্বামীর আপন ও জ্ঞাতি ভাই-বোনদেরকে তিনি আপন সন্তানের মতো দেখাশোনা করেছেন।
এর প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। উনার সন্তান হিসাবে আমরা এখনো বাড়ির লোকদের কাছ হতে স্নেহ, সম্মান ও ভালোবাসা পাই। প্রত্যেককে তিনি সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তাদেরকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। একটা সৎ পরামর্শ দিয়ে হলেও তিনি মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন।
আপারা তিনজন হওয়ার পরে আমরা পর পর তিন ভাই। এরপর বোন। এরপর ভাই। এরপর বোন। এরপর ভাই। বড় আপা ছিলেন অতীব সুন্দরী। এলাকার স্কুলে উনার রোল নম্বর বরাবরই ছিলো এক। স্বাভাবিকভাবে, কিশোরী বয়স হতেই উনার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। একবার চাচাদের এ রকম একটা প্রস্তাবে আব্বা খানিকটা রাজীও হয়ে যান। তখন আম্মা বড় আপাকে দিয়ে আব্বাকে একটা চিঠি লেখান। শুনেছি চিঠির বক্তব্য এতটাই হৃদয়ছোঁয়া ছিলো যে, আব্বা নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন। বড় আপা CMC হতে ১৯৭৯ সালে ডাক্তারী পাশ করে এখন ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজে ফিজিওলজির হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট। ফুল প্রফেসর।
কথায় বলে, ‘আগের হাইল্লা যে দিকে যায়, পিছনের হাইল্লা সে দিকে যায়’। আমরা সব ভাইবোনেরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পড়ালেখা করে এখন সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এ’ কথা ঠিক যে, আব্বার অলআউট সাপোর্ট না পেলে আম্মা কিছুই করতে পারতেন না। কিন্তু আম্মা যদি দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ না হতেন, তাহলে আমাদের এত ভালোভাবে গড়ে উঠা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া, ভালো থাকা এসব আদৌ সম্ভব হতো না। আমার মা, কুলসুমা বেগম (কুসুম)-এর পক্ষে ছিলো বাবুনগর গ্রামের সবাই। উনাকে নিয়ে সবাই গর্ব করতেন। তিনি ছিলেন মডেল। বিশেষ করে নারীশিক্ষার দিক থেকে তিনি ছিলেন অগ্রণী, অদম্য, প্রেরণার বাতিঘর।
যে কারণে এই লেখার উক্ত শিরোনাম, তা হলো, বাপের বাড়িতে আম্মার অবস্থান ছিলো এর বিপরীত। সেখানকার অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন পাগলাটে স্বভাবের ও একরোখা জেদী মহিলা। দৃশ্যত তাঁর ‘অপরাধ’, তিনি মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে পড়াচ্ছেন। এ ধরনের ‘অবাস্তব’ কর্মকাণ্ডের জন্য উনার পিতৃপক্ষের কারো কারো কাছে তিনি ছিলেন কিছুটা অবহেলার শিকার। তাঁর ‘দোষ’, পিড়ির উপর পিড়ি দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে তিনি যেন আসমান ছুঁতে চাচ্ছেন।
নানা মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৭৫ সালে। নানাদের বাড়িটা আজ পর্যন্ত সংস্কার করা হয়নি। এখন সেটি ভেংগে পড়ার উপক্রম। না জানলে বাইরের কেউ মনে করতে পারে, ‘এই ফ্যামিলির কেউ তেমন লেখাপড়া ও আয়-উন্নতি করতে পারে নাই। তাই তাদের বাড়িঘরের এই অবস্থা’। আমার মা সব সময়েই চেয়েছেন উনার বাপের বাড়িতে একটা পাকা দালান হোক। মামা-খালারা কেউ আসছেনও না, ঘর তৈরীর কোনো কার্যকর উদ্যোগও নিচ্ছেন না। কোনো ঘর তৈরী করলে সেখানে আমাদের জন্য একটা কক্ষ বরাদ্দ রাখার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। সেজন্য কিছু খরচ দেয়ার প্রস্তাবও করেছি। উনারা এ ধরনের ‘অসম্মানজনক’ প্রস্তাবে বেরাজী। আমরা চাচ্ছি, এমতাবস্থায় আম্মার অংশটুকু আমাদের আলাদা করে দিলে আমরা সেখানে কিছু একটা করবো। সেটাও উনারা দিচ্ছেন না।
মামাতো ভাইবোনেরা চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের লোকাল কালচার হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। উনারা ঢাকা শহর ও ইউরোপ-আমেরিকাতে সুপ্রতিষ্ঠিত। গত বছর যখন কোরবানীর পরদিন আমরা সেখানে একটা গরু কোরবানী করতে গেলাম তখন আমাদের গাড়ীগুলো দেখে এলাকার কিছু লোক আমার সেজ দুলাভাইকে বলেছে, ‘এ বাড়িতে তো সচারাচর তেমন কেউ আসে না। এ রকম গাড়ি দেখলে আমরা মনে করি, উনারা বোধ হয় কাউকে দাফন করতে এসেছেন।’ কেমন দুঃখজনক কথা, ভাবতে পারেন?
এসব বিরোধের বিষয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত পারিবারিক বৈঠকগুলোতে প্রথম প্রথম আমার বড় আপাকে একসেপ্ট করার ব্যাপারে উনাদের কারো কারো আপত্তি ছিলো। কারণ, ‘ও তো মেয়ে। তাকে তো বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে।’ বড় আপা না থাকলে আমরা বসবো না, আমাদের পক্ষ হতে এমন সাফ কথা বলে দেয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত উনারা এ ধরনের মনোভাব হতে সরে এসেছেন।
আমার মা শুধুমাত্র শ্বশুর বাড়ির লোকজনের জন্যই করেছেন, এমন নয়। বাপের বাড়ির লোকদের জন্যও সাধ্যমতো করেছেন। আম্মার শ্বশুর বাড়ির লোকদের কাছ হতে আমরা যতটা সদ্ব্যবহার পাই, উনার বাপের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের কাছ হতো ওভারঅল আমরা ততটা স্বীকৃতি, স্নেহ, সম্মান ও ভালোবাসা পাই না। আমাদের সাথে উনারা কেমন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিসুলভ আচরণ করেন। আমরা নানার পরিচয় দেই, সেখানে যাওয়া-আসা করি, ইত্যাদিকে সরাসরি বাধা দিতে না পারলেও আমাদের কাটিরহাটে আসা-যাওয়ার বিষয়ে উনারা নিস্পৃহ ও নির্লিপ্ত। কাছের আত্মীয়দের এমন শীতল আচরণ আমাদেরকে আহত করে। অথচ, আমার নানা মাওলানা আহমদের সন্তানদের মধ্যে আমার মা এবং উনার সন্তানদের অবস্থা, আলহামদুলিল্লাহ, যথেষ্ট ভালো।
আমাদের প্রতি উনাদের উপেক্ষাসুলভ আচরণ থেকে মনে হয়, আমার মা যেহেতু পরিবারের মেয়ে সন্তান; তাই বিয়ে দিয়ে ফেলার পরে উনি ফ্যামিলি হতে অটোমেটিকেলি মাইনাস। তিনি যেন এখানে শুধুমাত্র নাইঅরি ছিলেন। নানার পুত্র ও ছেলের ঘরের নাতিরাই যেন মালিক-মেজবান। মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনি হিসেবে আমরা যেন শুধু মেহমান! সুশিক্ষিত ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও, মা, আপনার বাপের বাড়ির লোকদের অনেকেই এখনো পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা হতে মুক্ত হতে পারে নাই। অথচ, আপনি ছিলেন নারীবাদী। সারাজীবন আপনি এ ধরনের অন্যায় পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন…! তাই ভাবছি, কুসুম না হয়ে তিনি যদি কাসেম হতেন তাহলে তিনি আমাদের মা হতে পারতেন না বটে। কিন্তু, পিতৃগৃহে তিনি অন্তত পিতামাতার সন্তান হিসাবে সমমর্যাদার একজন তো হতে পারতেন।
ভাইবোনদের কেউ কেউ চায় না, আমি নানার বাড়িতে গিয়ে এ ধরনের অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। কিন্তু মন মানে না। আমার মা যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন, বড় হয়েছেন, জীবন সম্পর্কে যেখানে থেকে স্বপ্ন দেখেছেন, যে পুকুরে সাঁতার কেটেছেন লম্বা চুল পানিতে ছড়িয়ে, যে উঠানে উদোম হয়ে খেলতে খেলতে এক সময়ে ওড়না পড়া শুরু করেছেন, যেই ভিটা-বাড়ি, আঙিনাতে, দিঘীর পাড়ে আমার নানার মতো সৌম্য পুরুষকে সটান হেঁটে যেতে দেখেছি, যেখানে আছে মায়ের দিক থেকে আমার উত্তরসূরীদের কবর, যেই জায়গাটা এখনো ছবির মতো পরিপাটি, সুন্দর, সেখানে মাঝে মাঝে যাওয়া হতে নিজেকে নিবৃত করতে পারি না।
আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিজীবনে এমন কিছু কিছু বিষয় থাকে যেখানে আবেগই কাণ্ডারী। একমাত্র মানদণ্ড। সামাজিক সম্মানবোধ, বৈষয়িক লাভ-ক্ষতির সব হিসেব সেখানে অচল।
এই উঠোন হতেই এক সলজ্জ্ব কিশোরী বধূ হিসাবে ১৯৫২ সালের কোনো এক বিকেলে আমার মাকে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পাল্কিতে উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, মাঝে মাঝে সেই ফাঁকা উঠানে বসে আমি সেইসব দিনের কথা ভাবতে থাকি। ভেংগে পড়া রান্না ঘরে পরিত্যক্ত ঢেঁকিটা দেখে স্মরণ করার চেষ্টা করি, নানার পাশে এখানেই ছাঁচের উপরে বসে আমরা খেতে বসতাম। দেখলাম সেখানে একটা কাঠের সিন্দুক পড়ে আছে। বেশ বড়। এখনো লোহার মতো শক্ত। বড় আপাকে একবার সেটা নিয়ে বললাম, ‘সিন্দুকটা চোরে নেয়ার চেয়ে আমি বরং একটা ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে আসি।’ বড় আপা না করে দিয়ে বললেন, ‘তুই নিলে ওরা বলবে, কুসুমির ছেলেরা এসে সব নিয়ে যাচ্ছে। চোরে নিয়ে যাক। তাও ভালো। অন্তত কথা থেকে বাঁচা যাবে।’
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Fatima Khanam: Excellent. Many many doa for you. May Almighty Allah give you a happy and healthy life.
Mojibur Rahman Monju: খালাম্মার চেহারাটা এখনো চোখে ভাসে। লম্বা, সটান, অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব! কোন দ্বিধা পরোয়া নেই।
টিটু বলে যখন ডাক দিতেন মনে হতো কোন হেড মিস্ট্রেস যেন ছাত্রকে ডাকছেন…
Osman Gani: তোমার মা’র উপর একটা বই লেখা উচিত। যা পড়ে অনেকেই উপকৃত হবে। ভালই লিখেছ, এই লেখার সূচনা দিয়ে শুরু কর। উনি নারী সমাজের জন্য একজন সফল ও প্রকৃত উদাহরণ এবং অনুসরণযোগ্য।
Mohammad Mahfuzul Hoque: I do agree with Osman’s proposal. You have that potential and capacity. May Allah bless you.
Stay healthy and safe.
Jmenter Prise Katirhat Hathazary: নানার বাড়ির সবার ঐতিহ্য সফলতার কথা বলতে নিজের মাঝে আলাদা আনন্দ উপলব্ধি হয়। নানার বাড়ির সবার সফলতা, সুস্বাস্হ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
MD Khasru Azad: তোমার লেখাগুলো পড়ে খুব ভাল লাগল। বই লেখার বিষয়ে এগিয়ে যাও। ভাল থেকো।
Bhuian Monoar Kabir: Dear, Wonderful…
Mohammad Mozammel Hoque: স্যার, আপনি আমার লেখা পড়েছেন…! দোয়া করবেন, স্যার।
Bhuian Monoar Kabir: প্রিয় মোজাম্মেল, ধন্যবাদ। বেশীর ভাগই পড়ি ও শেখার চেষ্টা করি। সবাই ভাল থেকো। ঈদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা জেনো।
Shamsul Hossain: Khalamma was a wonderful lady with a keen sense of self-respect. I always cherish her memory and love and affection for us. May Allah grant her a high place in Jannat.
Mohammad Mozammel Hoque: H’ble dula vie, Dr. M Shamsul Hossain, I am really glad to see that you have read the write up. Have I said anything wrong? Anyway, as we did last year, we are going to sacrifice a cow day after Eid-day at Dalay, inshaAllah.