গত ক’দিন হতে আবেগের ওপরে আমি ধারাবাহিকভাবে লেখালেখি করছি। আমি দেখানোর চেষ্টা করছি, আবেগই হলো শুদ্ধ মানবিক পরিচয়। অভিজ্ঞতা হতে জ্ঞান, জ্ঞান হতে বিবেকের গাইডেন্স অনুসারে জীবন পরিচালনার জন্য শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন, এসব কিছু গুরুত্বের দিক থেকে আবেগের অগ্রগামী হলেও আমাদের সব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বিবেক তথা অস্তিত্বের ভিত্তি হলো জীবন সম্পর্কে আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত বোধ বা অনুভূতি। এই অসংজ্ঞায়িত বোধ বা raw feeling-কেই আমি বলছি আবেগ।

গত পর্বে লিখেছিলাম, জন্মের কয়েক দিনের মাথায় মৃত্যুবরণকারী আমার মেজো ভাইয়ের জন্য, সদ্য সন্তানহারা মায়ের জন্য আমার ভাষাতীত দুঃখবোধ ও মনোকষ্টের কথা। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এ ধরনের ভাষাতীত কিছু অনুভূতি বা আবেগ কাজ করে। সে জন্যই আমরা রোবট নই, মানুষ। যারা যে আদর্শের অনুসারী তারা সেই আদর্শের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে ভীষণভাবে ফিল করে। এমনকি অপিরিচিত বা অনির্দিষ্ট কারো জন্যও মানুষ কখনো কখনো প্রচণ্ডভাবে ভাবাবেগ অনুভব করে।

আপাতদৃষ্টিতে বৈষয়িক বা বস্তুগত স্বার্থচিন্তার বাইরে মানুষের এই ধরনের একাত্মতার অনুভূতি বা সম্পর্কচিন্তার (belonging) কারণ হলো তার আবেগ।

অবশ্য আবেগের মাহাত্ম্য নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, বস্তুবাদে বিশ্বাসীরা বলবে, “এক এক ধরনের হরমোন এক এক ধরনের আবেগের জন্য দায়ী। বস্তু-অতিরিক্ত আবেগ বলে কিছু নাই।” কথাটা অনস্বীকার্য। সত্যিই তো, যখন আমরা বিমর্ষ হই, তখন আসলে সেই ধরনের হরমোন নিঃসরণের কারণেই তা হয়ে থাকে। যখন আমরা উৎফুল্ল হই, তখনও নির্দিষ্ট ধরনের হরমোনের প্রতিক্রিয়াতেই তা ঘটে থাকে। দেহ-মন সম্পর্কের এ ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াটা বাস্তব সত্য। যেমন করে সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসাও শারীরিক দিক থেকে এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণের ফল।

সমস্যা হলো, মাঝে মাঝে আমরা কিছু নিরেট সত্যের ওপর ভর করে কিছু ভুল বা মিথ্যার দাবি করি। Syllogism বা অনুপপত্তির ফরমেটে বললে, এ ধরনের ক্ষেত্রে premise বা আশ্রয়বাক্য(সমূহ) সঠিক হলেও গৃহীত বা অনুমিত conclusion বা সিদ্ধান্ত ভুল। এটি আমাদের চিন্তার ত্রুটির কারণেও হতে পারে। আবার আমাদের চিন্তাগত সক্ষমতার ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতার কারণেও হতে পারে।

মনে করি, কেউ ছুরিকাঘাতে নিহত হলো। হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই নিহত ব্যক্তির পাশে সেই রক্তমাখা ছুরি হাতে কাউকে দেখা গেল। এটুকু তথ্য বা উপাত্ত থেকে আপনি যুক্তিসংগতভাবে উক্ত ব্যক্তিকে হত্যাকারীও মনে করতে পারেন। আবার সমওজনের যুক্তির ভিত্তিতে তাকে উদ্ধারকারীও মনে করতে পারেন। দিগন্তে যদি আমরা কখনো পৌঁছতে না পারতাম, তাহলে ‘যুক্তিসংগতভাবেই’ আমরা জানতাম, “ও-ই যে ওইখানে দেখা যাচ্ছে দূরে আকাশ আর মাটি একসাথে মিশে গেছে। ওটি হলো point of singularity.” আসলেই কি তাই? সব বিষয়ে কি আমরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারি?

কথাগুলো বললাম, হরমোনের হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের দৃশ্যমান অপরিহার্য সম্পর্কের আলোচনাকে সামনে রেখে। দেহ-মনের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সত্য। এই তথ্য বা উপাত্তের ওপর নির্ভর করে দেহ-মনের দ্বৈততাও (dualism) প্রতিষ্ঠা করা যায়, reductionist অ্যাপ্রোচে চরম বস্তুবাদ বা চরম ভাববাদী অদ্বৈততাও (monism) প্রতিষ্ঠা করা যায়।

হরমোন আমাদের চিন্তার কারণ নয়, প্রভাবক। এটি আমার মত। হরমোন চিন্তা করে না। অথচ, চিন্তা করার জন্য হরমোন লাগে। যেমন করে কথা বলার জন্য আমাদের কণ্ঠস্থ স্বরনালী (vocal cord) দায়ী। আমাদের কথাবার্তা কণ্ঠনালী হতে উৎপন্ন হয় – কথাটা অর্ধসত্য। ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। আমরা জানি, কথার নির্দেশ আসে মস্তিষ্ক থেকে।

তো, মস্তিষ্ককে কথার এক নম্বর কারণ হিসাবে যিনি দাবি করবেন তাকে এই প্রশ্নটারও সন্তোষজনক জওয়াব দিতে হবে, কেন মস্তিষ্ক এক এক সময়ে এক এক কমান্ড দেয়? কেন অন্য রকম দেয় না? মস্তিষ্ক কি চিন্তা করে, নাকি চিন্তার জন্য মস্তিষ্ক লাগে? কণ্ঠনালীর মতো মস্তিষ্কও কি ঊর্ধ্বতন কারো কমান্ড বাস্তবায়নের অংগ? মনের স্বতন্ত্র ও সুপেরিয়র অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে তারা এই পর্যায়ে বলবে, মনই হচ্ছে আমাদের কমান্ড সেন্টার। মস্তিষ্ক হলো মনের নির্দেশ বাস্তবায়নকারী। এ বিষয়ে আমার প্রিয় তত্ত্ব হলো বার্টান্ড রাসেলের neutral monism আর থমাস একুইনানের hylomorphism। মন কী, কোথায় তার স্থিতি ইত্যাদি জটিল প্রশ্ন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে philosophy of mind নামে একটা কোর্স পড়িয়ে আমি এসব বুঝার চেষ্টা করছি। সেসব নিয়ে অন্য কোনো দিন আলাপ হবে।

হরমোন আমাদের আবেগের কারণ, যেভাবে কণ্ঠনালী আমাদের কথাবার্তার কারণ। এমনকি মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট সব এরিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও তাতে আপনি কোনো ভাষার অস্তিত্ব পাবেন না। রসায়নিক ভাষা নামক কিছু একটা যদি আবিষ্কার করেনও, তাতে করে আপনার আসল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হবে না। কেননা, মুখের ভাষা, ছাপানো ভাষা, সাংকেতিক ভাষা, রসায়নিক ভাষা, যে ভাষাই বলেন না কেন, কোনো ভাষার মধ্যেই অর্থ (meaning) intrinsically দেয়া থাকে না।

আমরা ভাষার মাধ্যমে ভাব বা অর্থ আদান-প্রদান করি। ভাষার কাঠামোর উপর সচেতন ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিসত্তা হিসাবে আমরা অর্থ আরোপ করি। ভাষা আর ভাব তথা বাক্যের গঠন (syntax) আর অর্থের (semantics) সম্পর্ক বাস্তবে অবিচ্ছেদ্য (necessary) হলেও তাত্ত্বিকভাবে তা অভিন্ন (identical) নয়। যেমন করে আমাদের হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসের পারষ্পরিক নির্ভরতা সত্বেও সেগুলো আলাদা জিনিস।

এতক্ষণে নিশ্চয়, হরমোন আর আবেগের সম্পর্ক কী, তা বুঝে গেছেন। স্যাটেলাইট টিভি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে যে ব্যক্তি অবগত নয়, প্লাটো প্রস্তাবিত গুহার রূপকের মতো সে তো ‘যুক্তিসংগতভাবেই’ মনে করবে, টিভি সেটগুলোই পর্দায় ভেসে উঠা অনুষ্ঠানমালার কারণ। সিগনাল বা ফ্রিকোয়েন্সি নামক কোনো উৎসকে সে কখনো স্বীকার করবে না। পরীক্ষা করে সে প্রমাণ করে দিবে, টেলিভিশনের মাদারবোর্ডে কিছু একটা বেশকম করা হলে স্ক্রিনে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পরে। তার মতে, এটি টেলিভিশন সেটের সহজাত ক্ষমতা, এটি নানা রকমের ছবি ও শব্দ উৎপন্ন করে যা আমাদের কাছে প্রোগ্রাম বলে মনে হয়।

বুঝা গেল, পূর্বাপর সম্পর্ক মাত্রই কারণ নয়। কারণের ধারাবাহিকতা আর ‘কারণ’, এক কথা নয়। তাই, কারণের ক্রমসোপান বুঝতে হবে। ‘the cause’ আর অন্যতম ‘necessarily contributing cause’ এর পার্থক্য না বুঝার কারণে এ ধরনের বিষয়ে লোকেরা অযথাই তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়।

এ ধরনের মৌলিক ও জটিল বিষয়ে কোনো না কোনো ধরনের স্ববিরোধিতা বা গোঁজামিল দেয়া ছাড়া আমাদের উপায় নাই। চেষ্টা করতে হবে, গ্যাপ ফিলাপের এই কাজটা যাতে অধিকতর যৌক্তিক হয়। যত প্রমাণই দেন না কেন, কোনো তু্চ্ছ বিষয়কেও ভালোভাবে বুঝতে গেলে ব্যাখ্যাগত অসংগতি অনিবার্য। একে আমি ঠাট্টা করে বলি, “ফুটা তত্ত্ব” বা paradoxical nature of truth। সব তত্ত্বই আদতে তালেগোলে ‘প্রমাণিত’ ফুটা তত্ত্ব। there is no flawless theory, if we dare to question the acceptance of the very foundation-principles of that theory.

মানবিক সীমাবদ্ধতার ফলে আমরা কখনোই ব্যাখ্যার ত্রুটি, অসংগতি বা স্ববিরোধিতা হতে মুক্ত হতে পারি না। তা সম্ভবও নয়। বস্তুগত ব্যাখ্যার অবশ্যম্ভাবী সীমাবদ্ধতার কারণে উদ্ভূত নলেজ গ্যাপকে পূরণের জন্য আমরা যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। সোজা কথায়, প্রমাণের অভাব আমরা যুক্তি দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করি। যুক্তি সব সময়ে একমুখী হয় না। যুক্তির বহুমুখিতাই ‘প্রমাণ’ করে আমাদের তথাকথিত সব প্রমাণই মূলত পছন্দনীয় যুক্তি মাত্র। প্রমাণ-প্রক্রিয়া যুক্তি দিয়ে শুরু হয় না, আবেগ দিয়ে শুরু হয়। একই বিষয়ে তাই বিপরীতমুখী যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। যার যার রুচি (taste) অনুসারে আমাদের কাছে যুক্তিগুলো প্রমাণ হিসাবে প্রতিভাত (plausible) হয়।

যুক্তির ভিত্তি হলো আবেগ। যুক্তির উপাদান হলো অভিজ্ঞতা। যুক্তির মাপকাঠি হলো বিবেক। বিবেকবোধও এক ধরনের ‘বিশুদ্ধ’ আবেগ।

দিনশেষে ব্যাখ্যা, বিশ্বাস, প্রমাণ, যুক্তি, জ্ঞান, যাচাই, দর্শন, মত, পথ, তত্ত্বসহ এ ধরনের সব টার্মই বস্তু-অতিবর্তী ব্যাপার-স্যাপার। নিরেট বস্তুর জগতে টার্ম বলে কিছু নাই। থাকার কথাও না। বস্তু কখনো নিজেকে বস্তু হিসাবে ভাবে না। বস্তু কেন দাবি করবে, সে বস্তু? কীভাবে করবে? কার কাছে সে দাবি করবে, “দেখো, আমি বা তুমি বস্তু-ই। এর অতিরিক্ত ‘কিছু’ না।”

যে ‘বস্তু’, নিজেকে ব্স্তু হিসাবে দেখে, তার এই বিশেষ ধরনের ‘দেখার’ ব্যাপারটাই কিন্তু বস্তু-অতিরিক্ত ফেনোমেনা। জড়বাদীদের জন্য মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, তারা বস্তুবাদকে সঠিক বলে ‘বিশ্বাস’ করে। তারমানে, তারা বিশ্বাস করে, বস্তুবাদ সঠিক, অর্থাৎ বিশ্বাস বলে কিছু নাই। তারমানে কি এই নয়, তারা বিশ্বাস করে বিশ্বাস বলে কিছু নাই? আশ্চর্য!

বস্তুবাদীদের মতে, মন আর আবেগের স্বাধীন অস্তিত্ব নাই। মন ও চেতনার স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাস যদি অধ্যাস (illusion) মাত্রই হয়, তাও তো তা উল্টো বস্তুবাদকেই খণ্ডন করে। কেননা, বস্তুর সংজ্ঞা অনুসারে নিরেট বস্তুর তো প্রহেলিকা বা অধ্যাসের মতো ভুল ধারণা থাকার সুযোগ নাই।

তারমানে, বস্তুবাদ যদি ততটাই বস্তুগত হতো তাহলে কাঠ, গাছ, পাথর, মাটি আর বাতাসকে যেমন সব মানুষ বস্তু হিসাবে মানতে বাধ্য তেমন করে সবাই বস্তুবাদকেও মানতে বাধ্য থাকতো। মজার ব্যাপার হলো, বস্তুবাদকে সবাই মানতে বাধ্য হলে তা শুরুতেই মাঠে মারা যেত। কেননা, বাদ তথা থিওরি বা ইজম হলো এমন কিছু যাকে আপনি গ্রহণও করতে পারেন। বাদও দিতে পারেন। যেই বাদকে বাদ দেয়া যায় না, তা বাদ (ism অর্থে) হতে পারে না।

আমরা জানি, বস্তুবাদ হলো বস্তু আর মনের সম্পর্ক বিষয়ক একটা তত্ত্ব বা মতবাদ। আর সব মতবাদের মতো এর পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি আছে। ব্যক্তির একান্ত আবেগ উৎসারিত জীবন ও জগত সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি বা world view-ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মতাদর্শগত অবস্থানকে নির্ধারণ করে।

মার্ডার কেইস একজাম্পলের মতো হরমোন আর আবেগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে আপনি বিপরীতধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জ্ঞানের পথ যেহেতু সব সময়ে একমুখী হয় না। তৎসত্বেও, সত্যতা আর জ্ঞানকে সর্বদাই এক বা একমুখী ভাবতে আমাদের ভালো লাগে। এটাও সত্যতা ও জ্ঞানের প্রতি আমাদের অন্তর্গত আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। আবেগের শেকড় আমাদের অস্তিত্ববোধে, জীবনবোধে। আবেগ কাজ করার জন্য রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি জরুরী। যেমন করে লেখার জন্য কাগজ, কলম বা কী-বোর্ড (অথবা, ভয়েজ কমান্ড?) জরুরী।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *