জুবায়ের (ছদ্মনাম) মেট্রিকে গোল্ডেন এ-প্লাস। ইন্টারে প্রাইভেট না পড়ায় এক সাবজেক্টের প্র্যাকটিকেলে তাকে নম্বর কমিয়ে দেয়ায় সেই সাবজেক্টে এ-প্লাস পায় নাই। এ ছাড়া বাকি সব সাবজেক্টে এ-প্লাস। অজ্ঞাত কোনো কারণে ‘ভালো’ কোথায় ভর্তি হতে না পেরে চবি ফিলোসফিতে ভর্তি হয়েছে। এখন সে আউট গোয়িং।
ফার্স্ট ইয়ারে ৭টা ক্লাস করেছে। ও বললো, স্যার-ম্যাডামেরা সংশ্লিষ্ট বিষয়টা না বুঝিয়ে ক্লাসে শুধু লিখতে বলে। বিরক্ত হয়ে সে আর ক্লাস করে নাই। পরীক্ষার আগে নানাজনের সুপারিশ নিয়ে তাড়াহুড়া করে ফরম ফিলাপ করেছে। ১ম বর্ষ হতে এ পর্যন্ত প্রত্যেক পরীক্ষায় সে কয়েক সাবজেক্টে ফেইল করেছে। এগুলো সে বিশেষ পরীক্ষা নামক চবিতে প্রচলিত এক অদ্ভূত সিস্টেমের সুবিধা নিয়ে টাকাপয়সা খরচ করে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তীতে ইয়ার লস ছাড়াই পাশ করেছে। অনার্সের রেজাল্ট জিপিএ ৪-এর মধ্যে ৩-এর একটু বেশি।
ভার্সিটিতে প্রতিটা পরীক্ষায় সে ইংরেজীতে উত্তর লিখেছে। ইংরেজী জানলেও ফিলোসফিক্যাল টার্মগুলো সম্পর্কে ক্লিয়ার কনসেপ্ট না থাকায় খুব একটা লিখতে পারে নাই। চট্টগ্রাম থেকে অনেক দূরে তার বাড়ি। থাকে শহরে। যথেষ্ট স্মার্ট ও সুদর্শন এই ছাত্র দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে আমার কয়েকটা ক্লাস করেছিলো। সেই সুবাদে আমার কাছে এসেছে। জীবন সম্পর্কে এ পর্যায়ে সে খানিকটা হতাশ। বাবা-মাকে বলেছে, সে এখানে ইংরেজী বিভাগে পড়ে। গত তিন-চার বছর হতে সে বাড়ি হতে টাকা আনে না। টিউশনি করে।
বর্তমানে সে দুইটা টিউশনি করে। ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট। সপ্তাহে ৩ দিন। ১ ঘণ্টা করে পড়ায়। একটাতে ১০ হাজার টাকা পায়। আরেকটাতে ৮ হাজার। তাকে বললাম, এই সব টিউশনি করতে গিয়ে তো তোমার অনেক পড়াশোনা করতে হয়, তাই না? সে বললো, না স্যার, ইন্টামিডিয়েট পর্যন্ত সায়েন্সের যে কোনো স্টুডেন্টকে আমি যে কোনো সাবজেক্ট পড়াতে পারি। টিউশনির লাইনে তার নাকি যথেষ্ট সুনাম। যেখানে টিউশনি করে সেখানকার গার্জিয়ানরা জানে সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যার ছাত্র। ও বললো, আমি ফিলোসফিতে পড়ি, এটি জানলে সাথে সাথে আমার টিউশনিগুলো চলে যাবে।
বললো, স্যার, আজকে অমুক স্যারের ক্লাস করেছি। কিছু বুঝি নাই। তাই লেকচার না শুনে আমি স্মার্টফোন থেকে একটা পিডিএফ পড়ে সময় কাটিয়েছি। ও আমার কাছে জানতে চাইলো, ও কি জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে? এখন তার কী করা উচিত? ইত্যাদি। ঘণ্টাখানেক ওকে সময় দিয়ে বাসায় ফিরলাম। ভাবলাম, এই ছাত্রের এই পরিণতির দায় বিভাগের একজন শিক্ষক হিসাবে আমিও তো এড়াতে পারি না। একটা স্টুডেন্ট দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গরহাজির। অথচ, কর্তৃপক্ষ হিসাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নতির যুগে আমাদের কোনো খবর নাই, ট্নেশন নাই…! স্টুডেন্টরা বুঝলো কি বুঝলো না, পড়লো কি পড়লো না, পরীক্ষার খাতায় কী লিখলো, সত্যিকারের কোয়ালিটি ছাড়া এ ধরনের কাগুজে রেজাল্ট দিয়ে তারা কী করবে, এসব নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যাথা নাই। কখনো আমরা জানার চেষ্টা করি নাই, এ রকম একটা মেধাবী স্টুডেন্ট কেন ক্লাস করছে না, ফেইল করছে…!
বিভাগ কি আমাদের শুধুমাত্র ‘দুই পয়সা কামানোর’ জায়গা? বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কি নিছকই একটা চাকরী? মানবিকতা ও নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু কি নাই? আমাদের ছেলেমেয়েরাও তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
শিক্ষক হিসাবে সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদিতে আমরা ডেফিনিটলি বঞ্চিত। কিন্তু তাতে করে এই ছাত্রটিকে যে আমরা এভাবে ইগনোর করলাম, বঞ্চিত করলাম, তা কি বৈধতা পেয়ে যাবে? এ রকম ছাত্র কি আর নাই? এ ধরনের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কি আমাদের বিশেষ কোনো করণীয়-কর্তব্য নাই?
নিয়মিত ক্লাস করা, বিষয় হিসাবে বিভাগের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ (core) শাখাগুলোর একটাকে গড়ে তোলা, বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসভুক্ত কোর্স-ম্যাটেরিয়েল ব্যবহার করে পড়ানো, ছাত্রছাত্রীদেরকে পারতপক্ষে ‘না’ না করা, বরং যথাসম্ভব সহযোগিতা করা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে স্টুডেন্টরা, ধারণা করছি, আমার ব্যাপারে যথেষ্ট পজেটিভ। কিন্তু, তাতে কী লাভ? প্রতিনিয়ত আমি ফিল করি, আসল যে বিষয়, লেখাপড়া, তাতে তারা গড়পরতা খুব দুর্বল ও অনাগ্রহী। টেক্সটের কিছু না বুঝেও তারা নির্বিকার। পরীক্ষা পদ্ধতির গতানুগতিকতার বদৌলতে এখানে ফেইল করার সুযোগ নাই। [এ পাশ + ও পাশ = পাস।] অনার্স থার্ড ইয়ারে এখন philosophy of mind বিষয়ে thought চ্যাপ্টার পড়াচ্ছি। লক্ষ করলাম, চিন্তা-যুক্তির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের তেমন কোনো চিন্তা নাই। ক্লাসে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার তেমন কোনো প্রস্তুতি নাই।
গত ক্লাসে জিজ্ঞাসা করলাম, টেক্সটের পুরো সফট কপি, চ্যাপ্টারের সিনোপসিস ইত্যাদি আমার একাডেমিক সাইটে আপ করে রাখার পরেও কেন তারা পড়াশোনা করে আসে না? এ বিষয়ে খানিকক্ষণ তাদের সাথে আলাপ করে জানলাম, তারা পরীক্ষা না থাকলে কোনো ক্লাসের জন্যই কখনো বাড়ি হতে পড়ালেখা করে আসে না। পুরো আর্টস ফ্যাকাল্টির সব বিভাগেই নাকি এই অবস্থা!
ভাবতে পারেন, কী ভয়াবহ তথ্য? এ নিয়ে কোথাও কিছু বলবো, এমন সুযোগ নাই। শিক্ষকরা দিনরাত নিজেদের সুবিধা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত। তাদের গবেষণা ইত্যাদিও পদোন্নতি তথা বেতন বৃদ্ধির ‘মহান’ লক্ষ্যে নিবেদিত। বেশ কিছু দিন আগে কোথায় যেন লিখেছিলাম, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে হরেক রকম শিক্ষক। কিছু আছেন আমলা-শিক্ষক। কিছু আছেন কামলা-শিক্ষক। কিছু শিক্ষক একদা-শিক্ষক। বর্তমানে যেন তারা শিক্ষা-কর্মকর্তা। কিছু শিক্ষকের ক্লাস নেয়ার সময় নাই। ‘গবেষণা-বাণিজ্যে’ তাঁরা দিনরাত ব্যস্ত। কিছু শিক্ষকের মনোভাব ও আচার-আচরণ বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট বা ডেমোনেস্ট্রেটর বা টিএ’র (teaching assistant) মতো। তারা জনপ্রিয় শিক্ষকদের অন্যতম। জ্ঞান অর্জন নয়, ছাত্রদের পাস করার কাজে গাইড করাকেই তারা দায়িত্ব মনে করে। এরা মুখস্তবিদ।
আমি গোবেচারা এক নিরীহ ‘বর্ণহীন’ শিক্ষক। শুধু জানার জন্য পড়াশোনা করি। বিষয়ভিত্তিক মুক্ত আলাপ-আলোচনা পছন্দ করি। নামাজের জায়নামাজ আর ক্লাসের ডায়াসকে প্রায়-সমমানে পবিত্র জ্ঞান করি। রুটিন মোতাবেক ক্লাস না নিলে বেতন হালাল হবে না বলে মনে করি। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে ক্লাসে আসার দুঃসাহস করি না।
এত ক্যাটাগরির রং-বেরংয়ের শিক্ষকদের ভীড়ে আমি তুচ্ছ। সহকর্মীদের নানান কিসিমের ক্রেডেনশিয়াল আর দাপটের চোটে ভীত। এতসব জ্ঞানী-মানী ও ততধিক বাকপটু গবেষকদের প্রবল তোড়জোড়ের সামনে নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হয়। যখন ‘রাজনীতি’ করতাম, অন্যতম শিক্ষক নেতা ছিলাম তখন ‘ক্ষমতা’ ছিল। বলাবাহুল্য, রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের কিছু না কিছু দাপট থাকে। বিবেকের তাড়নায় সব ছেড়ে-ছুঁড়ে এখন আমি রাস্তায়। গণমানুষের একজন। ভাবছি, বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে এ রকম আরো কতো জুবায়ের আছে, কে জানে…! এখানে সবাই নিজ নিজ আখের গুছানোর কাজে ব্যস্ত। এত বড় প্রতিষ্ঠানে কে কার খবর রাখে।
জ্ঞানের ভারে গর্বোন্নত সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান রকম চেতনাসমৃদ্ধ এই শিক্ষক সম্প্রদায় সম্পর্কে জুবায়েরদের মতো ছাত্ররা কী ভাবে, জানি না। শুধু জানি, কোনো বিভাগে কেউ কেউ বিশেষ কোনো দিক থেকে ‘ভালো শিক্ষক’ হওয়া আর as a department কোনো বিভাগ ডেভেলপ করা, এক কথা নয়। ডিপার্টমেন্টের সুষম উন্নয়নের জন্য একাডেমিক লিডারশীপ লাগে। রাজনীতি আর পদোন্নতির হাতিয়ার এখানে অচল।
এ ধরনের ‘অনাকাংক্ষিত’ লেখার জন্য আমাকে কতটুকু বা কী ‘ক্ষতিপূরণ’ দিতে হবে, জানি না।
জাতির মেধাবী সন্তান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ স্বায়ত্বশাসনের এতটা অপব্যবহার করবেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ এটি বুঝতে পারে নাই। যাদের কথা ছিল নৈতিক হওয়ার, মূল্যবোধ গঠনে নেতৃত্ব দেয়ার, তারা এখন গণহারে আইনের ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে সুবিধাবাদিতায় লিপ্ত। এসব দেখে প্রমথ চৌধুরীর সেই বিখ্যাত কথাটা মনে পড়ছে, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নহে।’ কথায় বলে, ‘হাজার বছর ঝর্ণায় ডুবেও জল পায়নাকো নুড়ি…!’
কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভর্তি-উৎসব’ নিয়ে আমার “আইন ও নৈতিকতার মিথষ্ক্রিয়া বনাম বিপরীত অনুপাত সম্পর্ক” শিরোনামের একটা পুরনো লেখাও এ প্রসঙ্গে পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে আমার একটা অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ইউটিউব লিংক: