এক ছাত্রের প্রশ্ন: প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও আমরা কোনকিছু সত্য বলে বিশ্বাস করি কেন?

উত্তর:
কারণ, “প্রমাণে”র কোনো প্রমাণ নাই। যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার যে কোনো কিছুতে আমরা শেষ পর্যন্ত অসীমতা, বৃত্তাবদ্ধতা কিংবা স্ববিরোধ – এই তিন অবস্থার কোনো না কোনো অবস্থাকে মেনে নিতে বাধ্য হই। এই “ঝামেলা” সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি বা না থাকি। এটি হলো মানবজাতির জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা epistemic predicament

প্রশ্ন: জ্ঞানতত্ত্বের বাইরে একটা প্রশ্ন করি। দর্শনে কি ব্যক্তি-ইশ্বর হতে পারে না? না, হলে কেন? আর ব্যক্তি-ইশ্বর যদি না হন তবে তার অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব তো আমাদের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কোন তাৎপর্য বহন করার কথা না। তাই যদি হয় তবে আস্তিকগণ কর্তৃক (ধর্মীয়) দর্শনের ইশ্বরের অস্তিত্ত্বের পক্ষের যুক্তিগুলো ব্যবহার করে লাভ টা কী?

উত্তর:
(১) দর্শন আর দার্শনিকের পার্থক্য:
দর্শন কোনো বিষয়ের সম্ভাব্য সব দিকের পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তিসমূহকে যথাসম্ভব সমভাবে তুলে ধরে, সব বিরুদ্ধ যুক্তিকে সমভাবে own করে। ব্যক্তি হিসাবে আমি বা আপনি বা যে কেউ যখন কোনো একটা বিশেষ দার্শনিক মত-পথকে সঠিক বিবেচনা করি, গ্রহন করি, তখন অনিবার্যভাবে আপনার-আমার অবস্থান বিচার-বিযুক্ত পর্যায়ে এসে ঠেকে। dogmatic হয়ে পড়ে। এর গত্যন্তর নাই। চিন্তার পদ্ধতি হিসাবে দর্শন সর্বদাই মুক্ত। কেউ যখন দর্শন পড়েন বা পড়ান তখন তাকে এই মুক্ত [from somewhat a ‘no-where position’] অবস্থানই নিতে হয়। যদিও ব্যক্তি হিসাবে প্রত্যেককে কোনো না কোনো দার্শনিক অবস্থানকে (অধিকতর) সঠিক অবস্থান হিসাবে মেনে নিতে হয়। এভাবে বিশেষ কোনো মতবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে ব্যক্তি-মানুষ শেষ পর্যন্ত এক ধরনের ‘প্রান্তিক’ অবস্থানে এসে পড়েন। বাস্তবতার এই অদ্ভূদ ধরনই হলো জ্ঞানগত সংকটাবস্থা বা epistemic predicament।

(২) দর্শনে ঈশ্বরের আলোচনা:
ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা দর্শনের দু জায়গাতে আসে। দর্শনের সমস্যাবলী আলোচনা করতে গিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষ-বিপক্ষ যুক্তিগুলো আলোচনা করা হয়। আবার ব্যক্তি-ঈশ্বরের সম্ভাব্যতা ও এর সংশ্লিষ্ট নানা দিক নিয়ে ধর্ম দর্শনে আলোচনা করা হয়।

(৩) দর্শনের বিষয়বস্তু:
দার্শনিক আলোচনার আওতা বহির্ভূত কোনো বিষয় নাই, হতে পারে না। তাই যে কোনো বিষয়ের দর্শন হতে পারে। দর্শন যেহেতু সবসময়েই কোনোকিছুর দর্শন, always a second-order subject, a specific methodology বিশেষ, তাই দার্শনিক পদ্ধতিতে আলোচনা করলে, approach করলে যে কোনো বিষয়ই দর্শনের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।

(৪) দর্শন কী?
কোনো বিষয়ের শুরুর আগে এবং শেষের পরে যেসব বিষয় আছে বা হতে পারে, সে বিষয়ের দর্শন হলো সেসব বিষয় নিয়ে এনগেজ হওয়া। তাহলে দর্শনের একটা বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলো:

  1. philosophy deals with the ‘big questions’। আলোচ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো প্রশ্ন করার অবাধ স্বাধীনতা যে কারো থাকতে হবে। তাহলে দর্শনের আর একটা বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলো:
  2. every one has to have the right to ask question, any question, even if it is a stupid question। কোনো প্রশ্ন যদি ভুল (wrong question) হয় তাহলে যুক্তি দিয়েই বুঝিয়ে দিতে হবে কেন এবং কীভাবে এটি ভুল বা category mistake। তাহলে দর্শনের তৃতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্যটিও আমরা পেয়ে গেলাম:
  3. any answer (response actually) has to be argument based। অতএব, যে কোনো মৌলিক বিষয়ে যদি অবাধ কিন্তু যুক্তি সংগত কিছু বলা হয় তাহলে তা দর্শন হবে। এই পদ্ধতির বাইরে আলাদাভাবে দর্শন বলে কিছু নাই।

(৫) fallacy of generalization:
দর্শনের পদ্ধতি আর ধর্মের পদ্ধতি আলাদা। যেভাবে দর্শনের পদ্ধতি আর বিজ্ঞানের পদ্ধতি আলাদা। যেভাবে দর্শনের পদ্ধতি আর সাহিত্যের পদ্ধতি আলাদা। এভাবে অপরাপর সবকিছু। সবকিছুরই একটা দার্শনিক ভিত্তি বা দিক আছে বটে তাই বলে সবকিছু দর্শন নয়। যেমন করে সবকিছুর মধ্যেই কিছু না কিছু পানি আছে। liquidity অর্থে। তারমানে সবকিছু পানি নয়। সবকিছুর মধ্যেই কিছু না কিছু বাতাস আছে। emptiness অর্থে। তারমানে সবকিছু হাওয়া নয়। ক, খ, গ, ঘ -এর মধ্যে যা কিছু আছে তার অন্যতম একটি উপাদান, ধরুন, ঙ যদি সবগুলোর মধ্যেই থাকে তার মানে এই নয় যে, ক=ঙ, খ=ঙ, গ=ঙ, ঘ=ঙ অথবা ক=খ=গ=ঘ=ঙ। এভাবে চিন্তা করাটা একটা fallacy বিশেষ, মার্ক্সবাদীরা যেমনটা করে থাকে।

(৬) is there any master-key?
মার্ক্সবাদীরা মনে করে অর্থনীতিই সবকিছুর মূল। তাদের যুক্তি হলো, জগতের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে অর্থনীতির একটা correlation দেখা যায়। অতএব, অর্থনীতিই সবকিছু ঘটায়। মূল কারণ। যদিও সেটি এক এক ঘটনায় এক একভাবে আছে। যেহেতু সেটি আছে, ছিল, তাই সেটিই কারণ। এভাবে একটা theory of everything নির্ণয় করা মানুষের চিন্তার একটি মৌলিক প্যটার্ণ। বলতে পারেন, a common paradigm of thought। (বিজ্ঞানবাদী-)প্রাণিবিদ্যাবিদগণের দৃষ্টিতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ হচ্ছে থিওরি অভ এভরিথিং। (বিজ্ঞানবাদী-)পদার্থবিদ্যাবিদদের দৃষ্টিতে string-theory বা M-theory হচ্ছে থিওরি অভ এভরিথিং। এভাবে God hypothesis হলো সৃষ্টিবাদী-আস্তিকদের থিওরি অভ এভরিথিং। থিওরি অভ এভরিথিং এর যত ধরনই হোক না কেন, সবই মূলত: begging the question fallacy’র আওতায় পড়ে।

(৭) পথও নাই, ফিরে যাওয়ারও পথ নাই:
philosophical propositions, truths and theories are always paradoxical । এই সূত্রানুসারে ফিলোসফিতে থিওরি অভ এভরিথিং বলে কোনো জিনিস থাকা অসম্ভব। এই কথাটিও ইটসেলফ প্যারাডক্সিক্যাল। কেননা, কোনো না কোনো থিওরি অভ এভরিথিং -এ পতিত হওয়াটা দর্শন পাঠের অনিবার্য পরিণতি …. !!! ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে এর উদাহরণ হলো: আপনি আস্তিক হবেন, (mono-theistic হোন কিংবা poly-theistic হোন), অথবা নাস্তিক হবেন, অথবা অজ্ঞেয়বাদী হবেন অথবা নির্বিকারবাদী (irrelevantist) হবেন। এই চার অবস্থানের বাহিরে পঞ্চম কোনো অবস্থান নাই, হতে পারে না। আপনি কোনো না কোনো ভাবে কোনো না কোনো দর্শন-তত্ত্বকে সঠিক মনে করে বাদ-বাকীদেরকে খারিজ করতে চাইবেন বা খারিজ-যোগ্য মনে করবেন। অথবা তাদেরকে ‘হিদায়াত’ বিতরণ করতে চাইবেন। তারমানে ডগম্যাটিক হবেন। জ্ঞানের ভিত্তিস্তরের এই স্ববিরোধ এমন এক বাস্তবতা যা আমাদের চাওয়া না-চাওয়া, মানা না-মানার ওপর নির্ভর করে না। we are always in a given-situation and with a very little power. আমাদের এই দুরাবস্থার জন্য ন্যাচার অথাব গড দায়ী ! তাহলে পথ কী, মুক্তি কীভাবে? এসবের মানে কী?

(৮) বিশ্বাস, যুক্তি ও মুক্তি:
মুক্ত হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা যুক্ত হই। বারে বারে ছুটে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ি। অন্যভাবে বললে, যুক্ত হয়েই আমরা মুক্ত-ভাব অনুভব করি। কে কিসের সাথের কীভাবে ‘যুক্ত’ হয়ে ‘মুক্তি’র স্বাদ নিতে চান, সেটি তার মন-মানসিকতার ব্যাপার। ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়্যাত। tendency ই সত্য ও ন্যায়কে determine করে। আমার কথা হলো, আদতে সবই বিশ্বাস, কোনোটি ‘যুক্তিসংগত’ বিশ্বাস, কোনোটি ‘অভিজ্ঞতানির্ভর’ বিশ্বাস, কোনো কোনোটিকে আমরা বলি ‘যাচাইযোগ্য’ বিশ্বাস। অপর-যুক্তিকে যখন আমরা কোনো মতেই গ্রহণ করতে পারি না তখন সেগুলোকে ‘অন্ধ’ বিশ্বাস হিসাবে ট্যাগ দিয়ে ধন্যবোধ করি। ব্যাপার হলো দিনশেষে সবই বিশ্বাস। অনেকটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বা স্বাক্ষর দেখে ব্যক্তিকে কনফার্ম করার মতো ‘সঠিক’ ব্যাপার। এ ছাড়াতো গত্যন্তর নাই। আইডেন্টিটি কার্ড আর ব্যক্তি কি আইডেন্টিক্যাল? নাকি পরিচয়-পত্র ব্যক্তির ‘ব্যক্তি’ হওয়াটার নিদর্শন মাত্র? উপায়ন্তর না দেখে নিদর্শনমাত্রকে (mere evidence) আমরা ‘প্রমাণ’ হিসাবে গ্রহণ করে, দাবী করে তৃপ্ত হই। শেষ পর্যন্ত abductive reasoning এর inference to the best explanation (IBE) এর ওপর ভর করে আমরা ‘প্রমাণ-যুদ্ধে’ লিপ্ত হই। গাজী হয়ে যার যার মতো করে ‘দ্বীন’ ও ‘খেলাফত’ কায়েম করি। কিংবা শহীদ হয়ে স্বার্থকতা বোধ করি।

অতএব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের ওই কথাটা মেনে নেয়াটাই বোধ হয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়, সময়ের দাবী: we have to believe to live, no matter what we believe. If it matters, it matters only the way of forming the beliefs or the belief-system.

Similar Posts

৩ Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *