আসসালামু আলাইকুম, স্যার কেমন আছেন? একজন আমার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলো। আপনার কাছ থেকে যদি নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই খুবই কৃতার্থ হবো।

১. স্রষ্টা কি নিরাকার? যদি নিরাকার হয়েই থাকেন তাহলে নবীজি সা. মিরাজে তাঁকে দেখলেন কীভাবে?

২. কোরআন কী?

৩. গাছের পাতাও কি তাঁরই হুকুমে চলে? আপনার উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায়..

আমার উত্তর:

১. আকার বলতে আমরা যা বুঝি, অর্থাৎ বস্তুগত আকার অর্থে স্রষ্টা স্বয়ং আকার-নির্ভর নয়। তাঁর সত্তা এই অর্থে নিরাকার। মিরাজে নবীজি (সা) আল্লাহকে দেখেন নাই। দেখেছেন জিবরীলকে। আয়িশা (রা) কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছেন, কোনো চোখ তাঁকে দেখতে পারে না।

২. কোরআন আল্লাহর বাণী বা কথা। আরবীতে যাকে কালাম বলে। কোরআন নিজেই নিজেকে শ্রেণীবিন্যস্ত করে। সূরা ইমরানের ৭ নং আয়াত দ্রষ্টব্য। যেখানে বলা হয়েছে কোরআনে দুই ধরনের আয়াত আছে। সুস্পষ্ট অর্থবোধক। অস্পষ্ট অর্থবোধক। বলা হয়েছে সুস্পষ্ট আয়াতগুলো ‘উম্মুল কিতাব’ বা কিতাবের সারাংশ। লওহে মাহফুজে যে কোরআন আছে তা খুব সম্ভবত এই সারাংশ কোরআন।

৩. জগতের অতিবর্তী কোনো সত্তা যদি থেকে থাকেন, তিনি যদি জগতের সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালনাকারী হয়ে থাকেন, তাহলে জগতের ভিতরকার কোনো কিছু তাঁর হুকুমের বাইরে থাকবে বা কাজ করবে কীভাবে? ইচ্ছার স্বাধীনতা জগতের ভিতরকার ব্যাপার। ফ্রম গড টু ওয়ার্ল্ড, গড ছাড়া অন্য কোনো স্বাধীন সত্তা থাকাটা লজিক্যাল কন্ট্রাডিকশন তৈরি করে।

(উপরোক্ত প্রশ্নকারী) আরেকটা প্রশ্ন রাখি প্লিজ?

“যেহেতু সবকিছু তাঁরই হুকুমে হয়, সেহেতু অন্যায় কাজটিও তাঁর হুকুমেই হয়…” উক্তিটির বিশ্লেষণ কী হতে পারে?

আমার উত্তর:

ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, এগুলো সবই জাগতিক ব্যাপার। হিউম্যান ফেনোমেনা। জগতের বাইরে যিনি আছেন, তিনি যদি থেকে থাকেন, তাহলে তিনি জাগতিক ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডেরও উর্দ্ধে থাকবেন। এই অর্থে তাঁর পক্ষ হতে অন্যায়ের সম্ভাবনা না থাকায় তিনি অলওয়েজ অলগুড। তারমানে, অন্যায়, সেটা যে ধরনের অন্যায়-ই হোক না কেন, তা আমাদের দিক থেকে পার্টিকুলারলি অন্যায় বটে। আমরা যেহেতু সবকিছু জানি না, তা আসলেই অন্যায় কিনা, তা আমরা কীভাবে বলবো? আমরা যেসব অন্যায়কে আসলেই অন্যায় হিসাবে বলি তা আসলেই অন্যায়। তবে তা নিছকই আমাদের দিক থেকে।

ন্যায়-অন্যায়ের খোদার মানদণ্ড আর মানুষের মানদণ্ড যদি সমান হয়, তাহলে বলতে হয়, মানুষও এক ধরনের খোদা। বা, খোদাও এক ধরনের মানুষ।

আমরা জানি, মানি না মানি সেটা ভিন্ন বিষয়, গড হাইপোথিসিস অনুসারে খোদা আর মানুষ বা জগত, এ দুটো ভিন্ন ক্যাটাগরি। তাই, ন্যায় কিংবা অন্যায়, এই টার্মগুলোকে মানুষ যেভাবে বুঝে, হুবহু সেই অর্থে সেগুলোকে খোদার সত্তার ওপর প্রয়োগ করা যুক্তি-বুদ্ধির খেলাফ।

সবকিছু আল্লাহর হুকুমে হওয়াটা সঠিক হওয়া সত্ত্বেও ‘অন্যায় কাজটিও তাঁর হুকুমে হয়’ – এ কথাটা সত্যি নয়।

যেমন করে ২ + ২ = ৪ – এ কথাটা সত্যি। এর ভিত্তিতে আমি যদি বলি, আমি একজন ভালো মানুষ, এটি কি ঠিক হবে? আমরা জানি, একটা সত্য আর একটা সত্যকে শুধুমাত্র তখনই জাস্টিফাই করতে পারে যখন তা হয় প্রাসঙ্গিক বা ক্যাটাগরিক্যালি কোহারেন্ট। তাই, কোনো সঠিক প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো, “যেহেতু সবকিছু তারই হুকুমে হয়, সেহেতু অন্যায় কাজটিও তাঁর হুকুমেই হয়…” – এই কথাটারও প্রথম অংশ সঠিক। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ ভুল।

আল্লাহ না চাইলে আমরা অন্যায় কাজ করতাম না, মানে করতে পারতাম না, তা ঠিক। আল্লাহ চাইলে এই জগত না হয়ে অন্য জগত হতে পারতো। তাও সঠিক। কোনো কিছুকে সৃষ্ট না করলেও আল্লাহর আল্লাহ হতে বা থাকতে কোনো অসুবিধা হতো না। এটাও ঠিক। এভাবে, আমরা বহু প্রশ্ন তুলতে পারি। মুশকিল হলো, এই ধাঁচের প্রশ্নগুলোর মৌলস্বীকার্য হলো, আল্লাহও আমাদের মতো ‘একটা কিছু’ যার একান্ত সত্তাগত বিষয়াদি নিয়েও আমরা আমাদের মতো করে প্রশ্ন করতে পারি। এবং এসব প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলোকে যাচাই-বাছাই করার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতা আমাদের আছে।

আমার দৃষ্টিতে এই ধাঁচের প্রশ্নগুলোর এই যে আন্ডারলাইয়িং বেসিক এজাম্পশান, তা ভুল। কেননা, বাই ডেফিনেশন অর বাই হাইপোথিসিস, গড আর ওয়ার্ল্ড, এ দুটো হলো ভিন্ন ক্যাটাগরি। আপনার কথার মধ্যে যে ‘সবকিছু’ বলে একটা শব্দ আছে, এটির প্রপার আন্ডারস্ট্যান্ডিং না থাকার কারণে যতসব ফ্যালাশিয়াস আর্গুমেন্টের উদ্ভব ঘটে। এখানে ‘সবকিছু’ বলতে জগতের সবকিছু বুঝতে হবে। তাই, জগতের ‘সবকিছু’ হতে জগতের কারণ হিসাবে খোদাকে আলাদা হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। খোদা যদি জাগতিক ‘সবকিছু’র অন্যতম হোন, তাহলে সেই খোদার অস্তিত্বের জন্য আর একজন বড় খোদা লাগবে।

অথচ, ইসলাম প্রস্তাবিত গড হাইপোথিসিস অনুসারে খোদা হলেন জগতের বাইরে তথা অতিবর্তী ও একক এক পরমসত্তা। যে সত্তার ভালোমন্দ বিচার করার জন্য আপনার আমার মানদণ্ড অনুসারেই অনুরূপ একজন খোদা লাগবে। আর এই দুই খোদার মধ্যকার বিরোধ সমাধান যিনি করবেন তাকেও অনুরূপ ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একজন হতে হবে। অথচ, খোদার সংজ্ঞানুসারে, খোদা একজনই হতে পারে। যেমন করে, বৃহত্তম বৃত্ত দুটি হতে পারে না। যেমন করে, সর্বশেষ বিন্দুর পরে আর কোনো বিন্দু বা স্পেস হতে পারে না।

আমার এ কথাগুলোর যৌক্তিকতা আপনি স্বীকার না করে পারবেন না। বাস্তবে মানবেন কি মানবেন না, সেটা ভিন্ন বিষয়।

(প্রশ্নকারী) অনেক ধন্যবাদ স্যার।

(আমার উত্তর কনটিনিউড)

আমাদের কাজ হলো আমারদের অবস্থান থেকে জগতকে জানা। যে ধরনের প্রশ্ন আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ বা অসম্ভব করে তোলে, সেটা নিশ্চয়ই অবাস্তব ও আজগুবি প্রশ্ন। নিতান্তই ভুল প্রশ্ন।

আমাদের নিজেদের ও জগতকে জানতে গিয়ে আমরা ঈশ্বরের ধারণায় উপনীত হই। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় – এই সবকিছুকে দেখতে হবে আমাদের এম্পিরিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। যে গডকে আমরা জানি, যাকে আমরা বলতে পারি God for us এবং যে গড আমার জানার বাইরে, যাকে আমরা বলতে পারি God to Himself, এই দুই গড, এক দৃষ্টিতে, এক নয়। যদিও আদতে দুটাই সেইম গড।

আমাদের দিক থেকে আমরা গডকে যাচাই করতে পারি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে, তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। ‘সবকিছু আল্লাহর হুকুমে চলে’, এটি আমাদের দিক থেকে দ্রষ্টব্য। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যা আমাদের খণ্ডিত যুক্তি-মানদণ্ডে সঠিক মনে হওয়াই স্বাভাবিক, সে অন্যায়গুলোও তাহলে আল্লাহর হুকুমেই হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মধ্যকার সঠিক যুক্তিপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যদি আমরা দেখি, তাহলে এই আমরাই কনভিন্সড হবো, গড আর মানুষ, এই দুই ক্যাটাগরিকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে এক করে ফেলাটা এক ধরনের কনট্রাডিকশান বা লজিক্যাল ফ্যালাসি।

গড আর মানুষকে জ্ঞানতাত্ত্বিক মানদণ্ডের দিক থেকে এক ক্যাটাগরির হিসাবে বিবেচনা করে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্ট’র মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যকে গুলিয়ে ফেলাকে ইসলামে শিরক বা ঐশী অংশিদারিত্ব হিসাবে বিবেচনা করে।

সসীমের মানদণ্ডে অসীমকে বিচার করার চেষ্টা হলো নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক ও নির্বুদ্ধিতা।

*****

এই কথোপকথনটা ইনবক্সে হয়েছে। পরশু দিন। একজন অপরিচিত ফেইসবুক বন্ধুর সাথে।

এ বিষয়ে মাস কয়েক আগে একটা আলোচনা করেছি। একেবারে ভেংগে ভেংগে। বিস্তারিত। যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে তকদিরকে জাস্টিফাই করা সম্ভব কিনা এমন একটা চ্যালেঞ্জিং সিচুয়েশানে এই আলোচনাটা করেছিলাম। একেবারে কনক্লুসিভ ডিসকাসশান।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *