প্রতিটা মানুষের মধ্যে কিছু জেনেটিক সুপ্ত বৈশিষ্ট্য থাকে। কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে প্রকাশিত। তেমনি করে প্রতিটা মানুষের মধ্যে থাকে কিছু চরিত্রগত অপ্রকাশ্য (নট পাবলিক অর্থে) বৈশিষ্ট্য। প্রকাশিত শারিরীক বৈশিষ্ট্যের মতো কোনো মানুষ পরিচিত হয় তার প্রকাশ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে।
দেখা যায়, বাবা-মা এক ধরনের, অথচ বাচ্চারা হয়েছে অন্য ধরনের। এর কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় বের করার জন্য এই লেখা।
শুরুর কথাগুলোর আলোকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, কোনো সন্তান তার বাবা-মাকে দেখে মোট আট ভাগে। সে বাবা-মা’র রূপ দেখে আট প্রকারের। দুই জনের প্রকাশিত রূপ যোগ অপ্রকাশিত রূপ মিলে মোট ৪ প্রকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
প্রত্যেকটা ব্যক্তির প্রকাশিত রূপ, অর্থাৎ লোকটাকে বাইরের লোকেরা যেভাবে জানে, সেটার সবকিছু যে ভালো, এমন নয়। বরং আমরা জানি, ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের স্বভাব, কাজকর্ম ও বৈশিষ্ট্য যে কোনো মানুষের মধ্যে দেখা যেতে পারে। সে হিসাবে একজন মানুষের চরিত্র ও অভ্যাসগত রূপ বা বৈশিষ্ট্য হতে পারে ৪ ধরনের। প্রকাশিত ভালো বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশিত খারাপ বৈশিষ্ট্য এবং অপ্রকাশিত বা সুপ্ত ভালো বৈশিষ্ট্য ও অপ্রকাশিত বা অপ্রকাশ্য খারাপ বৈশিষ্ট্য।
তারমানে, বাবা ও মা হতে সন্তান হিসাবে একটা শিশু (৪+৪=) ৮ ধরনের বিহেভিয়ারেল প্যাটার্ন ইনহেরিট করে।
বংশগতি বিদ্যার আভাস দিয়ে কথাটা শুরু করেছিলাম। বংশগতিবিদ্যা বা জেনেটিক্স শুধু শরীরি বৈশিষ্ট্যাবলীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়। বরং, চরিত্রগত দিক থেকেও মানুষের মধ্যে এক ধরনের বংশগতির সূত্র কাজ করে।
এজন্যই দেখবেন, বাবা-মা এক ধরনের। অথচ, বাচ্চাটা অন্য ধরনের। সেটা ভালো-মন্দ যে কোনো ধরনেরই হতে পারে। বেশি সন্তান হলে তাদের মধ্যে গণিতের সেট থিওরি বা বিন্যাস-সমাবেশ সূত্রের মতো করে তাদের মধ্যে নানা ধরনের ক্যারেকটার সেটিং বা বিহেভিয়ারেল কম্বিনেশন হতে পারে। প্রসংগত উল্লেখ্য, বেশি সন্তান হওয়া সকল দিক থেকেই লাভজনক ব্যাপার।
এবার আসেন, আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে।
যারা চান, সন্তান ভালো হোক, তাদের জন্য জরুরি হলো নিজের অপ্রকাশ্য রূপ তথা একান্ত ব্যক্তিগত জীবনকে ভালোভাবে গড়ে তোলা। সকল প্রকার আচরণগত স্ববিরোধ হতে মুক্ত থাকার চেষ্টা করা।
আপনি যতই ঢাকার চেষ্টা করেন না কেন, আপনার সন্তানটি কিন্তু ঠিকই আপনার নন-পাবলিক ইনার ক্যারেকটার সম্পর্কে জেনে যায়। চিন্তা ও আচরণের অনিবার্যতার সূত্রানুসারে কেউ স্বীয় চিন্তাকে কখনো দমিয়ে রাখতে পারে না। আর কোথাও না হোক, একান্ত ব্যক্তিজীবনে সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অবচেতনে। বাট ইট ইজ আ মাস্ট।
বিবেক বা কনশেনস বলে একটা জিনিস সব মানুষের মধ্যেই আছে। তো, বিবেক নামক এই রেগুলেটরি অথরিটির কাজ হচ্ছে আমাদের অবচেতন মন তথা অপ্রকাশিত সত্তাকে রেগুলেইট করা, ব্যক্তিমানুষ কর্তৃক বিবেকের এই অথরিটিকে সচেতনভাবে মেনে নেয়া সাপেক্ষে।
মানুষ সাধারণত নিজের অবদমিত ইচ্ছার রূপায়ণ ঘটায় সন্তানদের মধ্যে। প্রায়শ এটি ঘটে আমাদের অবচেতনে। এর ডিপ-রুটেড কারণ হলো, আমাদের মধ্যে থাকে সুপ্ত দ্বৈত-ব্যক্তিসত্তা বা ডুয়েল পারসোনালিটি। নিজেদের এই স্প্লিট পারসোনালিটি সম্পর্কে সাধারণত আমরা সচেতন থাকি না।
সুস্থ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি হলেন তিনি যার দ্বৈত-ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তার সচেতন ও প্রকাশ্য অংশ যথেষ্ট শক্তিশালী বা ডমিন্যান্ট। এটি তাকওয়ার স্তর। যার ব্যক্তিত্ব আত্মবিরোধমুক্ত তিনি আছেন ইহসানের স্তরে। এ কথাটার তাৎপর্য হলো, স্প্লিট পারসোনালিটি বা দ্বৈত-ব্যক্তিসত্তা একটা অনিবার্য মানবীয় বৈশিষ্ট্য।
হ্যাঁ, আপনার মধ্যে যদি কোনো প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য খারাপ বৈশিষ্ট্য থাকে, এবং আপনি যদি বুঝতে পারেন, আপনার সন্তান সেটি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, তখন আপনি প্রথমত সেটাকে দমন করার চেষ্টা করবেন। দ্বিতীয়ত যদি তা সম্ভন না হয় তাহলে আপনার এই সমস্যাটিকে অস্বীকার করার চেষ্টা না করে বিষয়টি আপনার সন্তানের কাছে স্বীকার করে নিবেন। নিজেকে কিছুটা হেয় প্রতিপন্ন করা ব্যতিরেকে আপনার এই মন্দ স্বভাবকে গ্রহণ করা হতে নিজ সন্তানকে আপনি ফেরাতে পারবেন না।
আপনার সন্তান যদি আপনার কাছ হতে পাওয়া উক্ত খারাপ বৈশিষ্ট্যটি গ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে হতে পারে উক্ত খারাপ বৈশিষ্টসম্পন্ন হওয়ার জন্য আপনাকে সে ঘৃণা করবে। এমতাবস্থায় বাচ্চার সাথে আপনার কিছু না কিছু মানসিক দূরত্ব তৈরি হবে। জীবনের এক পর্যায়ে তা আপনাদের মধ্যকার পারষ্পরিক সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
নিজেরা যা-ই হোক, সন্তানেরা চায়, তাদের বাবা-মা যেন হয় এক একজন নিখুঁত চরিত্রের আদর্শ মানুষ। এই চাওয়াটা কতটা অযৌক্তিক, সেই আলোচনা পরে। বরং, আমি যা বললাম তা এক চরম বাস্তবতা। এটি নির্মম, কিন্তু সত্য। কেন জানি, বাবা-মা’র ব্যাপারে সব সন্তানের মন-মানসিকতা একই রকমের।
সন্তানেরা সাধারণত বাবা-মা’র মতোই হয়। কথাটাকে কনক্লুসিভলি না বলে ‘সাধারণত’ শব্দের মাধ্যমে একটা স্পেস রেখে বলার কারণ হলো, আচরণের ওপর পরিবেশ ও বংশগতির প্রভাবের মতো বাচ্চাদের গড়ে উঠার বিষয়টিও এককভাবে পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না।
ল অব আইডেন্টিটি বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সূত্রানুসারে প্রত্যেকটা মানুষই অনন্য সাধারণ। ইউনিক। প্রত্যেকের মধ্যেই স্রষ্টা বা প্রকৃতি বিশেষ ‘একটা কিছু’ দিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তি তার জীবনজুড়ে সেই জন্মগত নিয়তির পানেই ছুটে যায়। সুতরাং কে কী রকম হবে, তা এককভাবে কোনো ফ্যাক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।
পারিবারিক পরিবেশের সাথে সাথে সামাজিক পরিবেশও শিশুদের গড়ে উঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘সামাজিক পরিবেশ’ নামক এই বিশাল অবয়বটির মধ্যে আছে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ। এমনকি আন্তর্জাতিক পরিবেশ বা পরিস্থিতিও আপনাকে, আমাকে, আমাদের সন্তানদেরকে, আমাদের সবাইকে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে, নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই সব বৃহত্তর এরিয়াতে যারা ডমিনেন্ট, আপনার সন্তানটি স্বভাব-চরিত্রগত দিক থেকে তাদের অনুরূপ হওয়ার চেষ্টা করবে, এটিই স্বাভাবিক। বিশেষ করে, পারিবারিক পরিবেশে তারা যদি বাবা-মা’র মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত বৈপরিত্য দেখতে পায়।
অতএব, বুঝতেই পারছেন, সন্তান প্রতিপালন একটা জটিল ব্যাপার। সামাজিক ধাঁচে বাচ্চাদের ভালো করতে চাইলেই তারা সত্যিকারভাবে ভালো হয়ে উঠবে, এমন নয়। কেউ কাউকে ভালো করিয়ে দিতে পারে না। সত্যিকারভাবে ভালো হওয়াটা ভিতর থেকে হয়ে উঠার ব্যাপার। কাউকে ভালো করার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো তাকে ভালো হওয়ার পরিবেশ দিতে হবে।
মনে রাখবেন, আপনি যে রকম, আপনার সন্তানও সেরকম হবে। এটাই প্রবল সম্ভাবনা। আপনার সন্তানের মধ্যে কোনো খারাবি থাকলে আত্মসমালোচনা করে দেখেন, সেই খারাবিটা আপনার বা আপনার স্পাউজের মধ্যে আছে কিনা।
‘আমি যেমনই হই, আমার সন্তানটি যেন ভালো হয়’ – এটি আপনি চাইতেই পারেন। কিন্তু তা হবার নয়। কেননা, পানি উপরের দিকে যায় না। স্বাভাবিকভাবে পানি নিচের দিকেই প্রবাহিত হয়। তেমন করে মানুষ দেখে শিখে। নিছক শোনা কথায় মানুষ কনভিন্স হয় না।
আদর্শ ও মূল্যবোধ চাপিয়ে না দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা না করে সত্যিকারের ভালো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের মাধ্যমে সন্তান ও প্রিয়জনদের কাছে নিজেকে মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন। দেখবেন তারা অটোমেটিলি আপনাকে অনুসরণ করছে। আপনার মতো হয়ে উঠছে। এখন না হোক, জীবনের এক পর্যায়ে এসে তারা রিয়েলাইজ করবে। আপনাকে লাইটহাউজ হিসাবে মনে করবে। ফলো করবে।
উপরে যা বললাম, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে সহায়ক হিসাবে গড়ে না তুলে একা একা শুধু পারিবারিক পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে সন্তানাদির চারিত্রিক উন্নয়ন ঘটানো আপনার বা কারো দ্বারাই সম্ভব হওয়ার নয়। বিশেষ করে গ্লোবালাইজেশানের এই যুগে বিচ্ছিন্ন কোনো গ্রোথ এন্ড ডিভেলপমেন্ট অসম্ভব ব্যাপার।
তাই আসুন, পরিবার গঠনের সময়েই মনযোগী ও সতর্ক হই। সত্যিকারের ভালো মানুষদের বিয়ে করি। শারিরীক সৌন্দর্য, টাকা-পয়সা, সার্টিফিকেট ও দলীয় সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি যা-ই হোক না কেন, আপনার স্পাউজের মধ্যে যেন থাকে সত্যিকারের মানবিক মূল্যবোধ ও সঠিক জীবনবোধ। যে বিল্ডিংয়ের ডিজাইনেই ত্রুটি থাকে সেটাকে যতই রেনোভেইট করেন না কেন, গঠনগত সেই ত্রুটিকে সংশোধন করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠে না।
আসুন, আমাদের আশপাশের পরিবেশকে উন্নততর করার চেষ্টা করি। নিজের সন্তানাদির পাশাপাশি অপরের সন্তানকেও গড়ে তোলার চেষ্টা করি। এ ধরনের সহযোগিতামূলক সামাজিক পরিবেশের সুফল আপনিও পাবেন। আপনার সন্তানকেও অন্যরা হেল্প করবে, গাইড করবে। বিশেষ করে যখন সে থাকে আপনার চোখের আড়ালে বা আওতার বাহিরে।
বৈশ্বিক প্রাধান্য বা সভ্যতাগত উৎকর্ষতা অর্জন ব্যতিরেকে একা একা ভালো থাকা অসম্ভব। নিরপেক্ষতার ভান ধরে আপনি নিজেই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রায়োগিক কর্মকৌশলের বাহিরে যে নিরপেক্ষতা তা চূড়ান্ত রকমের ভণ্ডামি। মূল্য-নিরপেক্ষ বা value-neutral কোনো ভালো হতে পারে না। সত্যের পক্ষে যে দাঁড়ায় না, তার কোনো ভালো’র দাবি থাকতে পারে না। ভালো-মন্দের দিক থেকে এ জগৎ একটা বাইনারি সিস্টেম। ন্যায়ের ব্যাপারে যে নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয়, প্রকারান্তরে সে অন্যায়ের সমর্থক ও সহযোগী।
তাই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ ছাড়া প্রকৃত কল্যাণ অর্জন অসম্ভব। এ কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। সমাজের সবাই বুদ্ধিজীবী হবে না। সবাই উচ্চ স্তরের ন্যায়বোধ দ্বারা পরিচালিত হবে না। সবাই সত্যের সাক্ষী হবে না। একটা সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য হলো কিছু লোক অবশ্য সত্য-ন্যায়ের ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়াবে। কিছু লোককে হতে হবে সত্যের সাক্ষ্যদাতা। তেমন একজন সমাজকর্মী হতে পারেন আপনিও। সেক্ষেত্রে আপনাকে কাজটা শুরু করতে হবে নিজের একান্ত ব্যক্তিজীবন তথা পরিবার থেকে। এবং জগতসমূহের যিনি মালিক তাঁর খলীফা হিসাবে পুণর্গঠনের এই কাজটাকে বিস্তৃত করতে হবে বিশ্বব্যাপী।
বিপ্লবী হওয়া ব্যতিরেকে কেউ তেমন উন্নত মানের ভালো হতে পারে না। সব অন্যায়, মিথ্যা ও জুলুমের বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী বিপ্লবী হিসাবে, একজন আদর্শ সমাজকর্মী হিসাবে আপনাকে জানাই শুভেচ্ছা, স্বাগতম ও অভিবাদন। ব্যক্তি চরিত্রের ডমিন্যান্ট-ডরমেন্ট আসপেক্ট থেকে শুরু করে বৈশ্বিক বিপ্লব, এক কথায় মানবজীবনের যা কিছু প্রয়োজনীয় সব, আসুন, এক সূতোয় গাঁথি। মুক্ত হই সব বৈপরিত্য থেকে। ঋজু হই আপন ব্যক্তিত্বে। স্বচ্ছ হই আপন বিবেক ও মননের গঠনে। শুভ রাত্রি।
রাত ১২টা। এসই ১৫, দক্ষিণ ক্যাম্পাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।