তিউনিশিয়ার আন-নাহদার বিবর্তন, জামায়াত ও তাবলীগের বিরোধ, কমিউনিস্ট ফরহাদ মজহারের ইসলামপ্রীতি ও জামায়াতের সংস্কারবাদী ধারা নিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জারে এক তরুণের সাথে আমার আলাপ। অন্তত মাস ছয়েক আগের। ড্রপবক্সের পেন্ডিং রাইটসআপ ফোল্ডারে পড়েছিলো। প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে দিলাম।

প্রশ্ন-১: আপনি আপনার লেখায় বলে আসছেন প্রত্যেক সংগঠনের রিফর্ম প্রতিষ্ঠাকালীন থিওরী, মেটাথিওরীর মধ্যে থেকেই হয়। কোনো সংগঠনই প্রতিষ্ঠাকালীন প্যারাডাইম অফ থটসের বাহিরে যেতে পারে না। তাহলে তিউনিশিয়ার আন-নাহদা কীভাবে ইসলামিক মুভমেন্ট (Political Islam) থেকে মুসলিম ডেমোক্রেটে ট্রান্সফর্ম করলো?

উত্তর: আন-নাহদার বিষয়টা আমার আরও জানতে হবে। তবে, আন-নাহদাকে জামায়াত বা ইখওয়ানের মতো ইসলামিক মুভমেন্ট ভাবলে সম্ভবত ভুল হবে। কেননা, যদ্দুর জানি, আন-নাহদা প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারতো না। অনুকূল পরিবেশে তারা ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে নিয়েছে। এবং রাজনীতিকে একমাত্র এজেন্ডা হিসাবে গ্রহণ করেছে।

যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি দুটোই প্রকাশ্য থাকবে, সেখানে রাজনীতি ক্রমান্বয়ে মুখ্য হয়ে উঠবে। যেমনটা জামায়াতের ক্ষেত্রে হয়েছে। আন-নাহদা সরলভাবে সত্যটাকে স্বীকার করে নিজেদের অবস্থানকে পরিষ্কার করেছে। বাংলাদেশে জামায়াতের যা করা উচিত বলে আমি এ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখায় ইতোমধ্যে বলেছি।

প্রশ্ন-২: তাবলীগ জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে কোনো অথরিটির সাথে যথাসম্ভব কনফ্লিকশন এড়িয়ে জনমানুষের আকীদাগত পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সামাজিক আন্দোলন ‘তাবলীগ’ অপরাপর ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ হিসাবে বিদ্যমান সর্বাত্মকবাদী ধারার জামায়াতে ইসলামীর সাথে কনফ্লিকশনে জড়িয়ে যাচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবেই। জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের পুরাতন প্রপাগান্ডা তো আছেই, অতি-সাম্প্রতিক নিজেদের অন্তর্কলহে জামায়াতের ইন্ধন খুঁজে পাচ্ছেন তারা কাকতালীয়ভাবেই। অর্থাৎ সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার কমিটমেন্ট দেয়া দলটি একটা সময়ে এসে ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যথাসম্ভব কনফ্লিকশন এড়িয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার যে কথা আপনি বলছেন, তা সময়ের আবর্তনে ইচ্ছাকৃতভাবে তাবলীগের মতো সংঘর্ষপ্রবণ হয়ে উঠবে না তো?

উত্তর: ‘সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়িয়ে চলো (no conflict with any authority)’ (https://mozammelhq.com/no-conflict-with-any-authority/) শীর্ষক রচনায় আমি কনফ্লিক্ট-ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কথা বলেছি। ফর্মূলা দিয়েছি। যুক্তি দিয়েছি। উদাহরণ দিয়েছি। তো, বাধাকে এড়িয়ে যাওয়ার এই ফর্মূলাকে কেউ যদি ভুল মনে করেন তাহলে তাকে যুক্তি দিয়েই সেটা বুঝাতে হবে। আমার কথাগুলো যদি বাস্তবতা ও কোরআন-সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়ে থাকে, অথচ কোনো বিশেষ সংগঠন এটি ফলো করছে না, তখন কী করা যায়? এটি তাদের ব্যর্থতা। এ নিয়ে আর এখানে কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। অহেতুক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এর মাধ্যমে নিজেকে হকপন্থী হওয়ার দাবি করাটা, একটা নেতিবাচক প্রবণতা। লেখাটিতে বিস্তারিত বলেছি।

প্রশ্ন-৩: ফরহাদ মজহার যেভাবে ইসলামকে অধ্যয়ন করেন, কৌশলগত কারণে ইসলামপন্থার সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলেন, এমন আরো অনেকেই তো এ দেশে আছেন। ব্যক্তি ফরহাদ ‘ভাই’কে বিবেচনায় না রেখে আমরা ফরহাদ মজহারকে একটা ট্রেন্ড হিসাবে নিলে এটা তো দেখতে পাই যে, একসময়ে কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ বিষয় ‘ইসলাম’কে তারা এখন মার্ক্সিজমের প্রিজম দিয়ে দেখা শুরু করেছেন, ইসলাম নিয়ে তাদের মানসিকতার এক ধরনের বিবর্তন ঘটেছে। আমরা কি এই আশা রাখতে পারি না যে বিবর্তনের এই ধারায় কমিউনিস্টদের মধ্য থেকে একটা অংশ তৈরি হবে যারা ইসলামকে অধ্যয়ন করবে ইসলামিক প্রিজম দিয়ে, এর আকর গ্রন্থগুলো থেকে?

উত্তর: কমিউনিস্টরা সমাজের অপরাপর বহু বাতিল মত-পথের একটি। তাদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গিও অপরাপর সব দাওয়াতী পক্ষের চেয়ে বিশেষ বা বেশি কিছু নয়। তাই, তাদের ব্যাপারে কেউ আশা রাখতেই পারে। সেটা সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব ব্যাপার। আমি সরলভাবে এটুকু বুঝি, ইসলাম বা যে কোনো আদর্শের সাথে যারা কৌশলগত আচরণ করে ও এ ধরনের কৌশলগত সম্পর্ক রাখে বা দেখায়, তারা কখনো সেই আদর্শকে গ্রহণ করবে না। তাদের চেয়ে বরং সংশ্লিষ্ট আদর্শের যারা প্রকাশ্য আদর্শিক বিরোধী তারা ভালো। বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলা করা যায়। আগ্রহীদের বুঝানো যায়। কিন্তু কৌশলীদের কনভিন্স করা যায় না। যেমন করে ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়। কিন্তু ঘুমের ভান করা মানুষকে জাগানো যায় না।

প্রশ্ন-৪: জামায়াতের চিন্তাশীল, প্রাজ্ঞজন মাত্রই বুঝেন, আপনার ভাষায় “জামায়াতের মেয়াদোত্তীর্ণগোলকায়িত আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে অনুপযোগী কর্মকৌশলের জন্য এর দ্বারা বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় অসম্ভবকিন্তু একটি শক্তিশালী ধারা হিসাবে এটি লং টাইম কন্টিনিউ করবে।” কিন্তু যারা ভিন্ন ধারায় ইসলামের জন্য কাজ করতে চান তারা পূর্ণদ্যমে কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত জামায়াতের সাথে থাকা উচিত নয় কি? এক্ষেত্রে পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভীকে উদাহরণ হিসাবে নিতে পারি।

উত্তর: নতুন ধারা ও নতুন উদ্যমে যারা কাজ করবেন, তারা যদি উদ্যোক্তা ও সংগঠক পর্যায়ের হয়ে থাকেন তাহলে তাদের উচিত পুরাতন ও অচল ধারা হতে যথাশীঘ্র বের হয়ে আসা। আর তারা যদি সাধারণ মানের অনুসারী হয়ে থাকেন, তাদের জন্য ভালো হলো পুরাতন ঠিকানায় অবস্থান করা। অন্ততপক্ষে নতুন উদ্যোগ দাঁড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত। একা থাকার চেয়ে কোনো না কোনো দিকে লেগে থাকা নিরাপদ। বিচ্ছিন্নতা ঝুঁকিপূর্ণ। নিজের ওপর আস্থা ও তেমন সক্ষমতা না থাকলে বেটার কোনো ধারায় সম্পৃক্ত থাকাই শ্রেয়। তবে সবসময় চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে। নিজের বিবেক-বুদ্ধি কারো কাছে বন্ধক রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে, দায়-দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *