নাস্তিক্যবাদীদের অভিযোগ, মহানবী মুহাম্মদ (সা) ছিলেন একজন নারী নির্যাতনকারী, ধর্ষক। কেননা, তিনি একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। যুদ্ধে নিহত সেনাপতির মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে এগুলো হলো বৈবাহিক ধর্ষণ।

ধর্ষণ মাত্রই খারাপ, অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বৈবাহিক ধর্ষণকে তাই সমর্থন করার কোনো কারণ নাই। কোনো ব্যক্তি যত বড় মহাপুরুষই হোন না কেন, তিনি যদি ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণের মতো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তাকে এ জন্য অভিযুক্ত করা যাবে।

যেসব ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈবাহিক ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটার সমূহ আশঙ্কা থাকে, তার মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিবাহ কিংবা যুদ্ধে সদ্য নিহত শত্রু সেনাপতির কন্যাকে বিয়ে করার ঘটনাগুলো হতে পারে অন্যতম পটেনশিয়াল এরিয়া অব ইনসিডেন্ট।

নাস্তিকদের অভিযোগটাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার জন্য আমি ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। বাস্তবতা হচ্ছে, বিয়ে হলো প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপার। বিয়ের সংজ্ঞানুসারেই, অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে হতে পারে না। ইসলামিক শরীয়াহ মোতাবেক অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকার অভিভাবক কর্তৃক তাদের বিয়ে সম্পাদন করার বিষয়টিতে ‘ইজাব-কবুলের’ সুযোগ না থাকায় সেটাকে বাহ্যত বিয়ের মতো মনে হলেও মূলত তা হলো বিয়ের প্রস্তাবনাতুল্য। সে জন্যই ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বর-কনে তাদের অভিভাবকদের মাধ্যমে সম্পাদিত এই বাল্যবিয়েকে চাইলে বহাল রেখে পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে কার্যকরও করতে পারে, অথবা চাইলে তা বাতিলও করে দিতে পারে।

আয়েশার (রা) সাথে মহানবীর (সা) এ ধরনের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। হযরত আয়েশা (রা) যখন রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সংসার শুরু করেন তখন তাঁর বয়স কত ছিল, সেটা নিয়ে হাদীসে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা আছে। সেটা আমার আজকের আলোচনার বিষয় নয়। ওই সকল বর্ণনায় সর্বনিম্ন যে বয়সসীমা উল্লেখ করা আছে তাতেও কিন্তু এই কথাটা পরিষ্কার করে বলা আছে, যখন তিনি সংসার শুরু করেন তখন তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলেন।

যে কোনো বয়সের প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নর-নারীর মধ্যে অন্যান্য পারিপার্শ্বিক শর্তপূরণ সাপেক্ষে বৈবাহিক সম্পর্ক হতে পারে। এটি ইসলামের মূল অবস্থান। যৌনতা নিয়ে এখনকার মুসলিম সমাজে যে ধরনের সুড়সুড়িমূলক মনোভাব ও অস্বাভাবিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়, সেটা এখনকার যুগ ও সংস্কৃতির প্রভাব মাত্র। অপরাপর বস্তুগত ও জৈবিক প্রয়োজনের মতো যৌনতাকেও ইসলাম অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে। এজন্যই দেখা যায় প্রফেট মুহাম্মদ (সা) বিয়ে করেছেন নানা বয়সের নারীকে। এর মধ্যে আছে আয়েশার (রা) মতো সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক নারী। আছে উম্মে সালামার (রা) মতো প্রৌঢ় বয়সের নারী। এসব বিয়ের পিছনে আছে রাজনৈতিক কারণ, আছে সামাজিক কারণ। সর্বোপরি, আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো, মানুষ যে কারণে বিয়ে-শাদী করে সেই কারণেই তিনি এসব বিয়ে করেছেন।

একাধিক বিয়ে করে তিনি অন্যায় করেছেন, এমন অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণত করা হয় না। যৌবনোত্তীর্ণ বয়স্ক নারীকে বিয়ে করা তাঁর ঠিক হয়নি, এমন অভিযোগও উত্থাপিত হয় না। তাঁর দাম্পত্য জীবন নিয়ে যেসব অভিযোগ করা হয়, এসবের মূল পয়েন্ট হচ্ছে দুটি: (১) তিনি আয়েশাকে (রা) অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে করেছেন এবং (২) খাইবার যুদ্ধে নিহত শত্রু সেনাপতির স্ত্রী সাফিয়াকে (রা) স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

যিনি তখনকার প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিবেশে নারী অধিকারের কথা অত্যন্ত জোরেশোরে বলেছেন, কিছুটা অশ্লীল শোনালেও যিনি পরিষ্কার ভাষায় নিজ অনুসারীদেরকে বলেছেন, ‘যৌন সম্পর্কের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত না করে কোনো নারীর সাথে তোমরা যৌন সম্পর্ক করবে না’, পুরুষ হিসেবে যিনি ছিলেন অত্যন্ত হ্যান্ডসাম, মানুষ হিসেবে যিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম, আমরা ধারণা করতে পারি তিনি স্বীয় দাম্পত্য জীবনেও সফল দাম্পত্য সম্পর্কের এসব ফর্মূলাকে যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন। তাই তো দেখা যায়, অভাব অনটনের কিছু অভিযোগ ছাড়া ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে তাঁর ঘর-সংসার ও দাম্পত্য জীবন ছিল তেমনই সুখের।

এটি আমাদের নিছকই সুধারণা– এমন নয়। ইতিহাস থেকেও আমরা ঠিক এই সত্যটাই খুঁজে পাই। যে বালিকা-বধূ বা নিহত সেনাপতি-স্ত্রীর প্রতি নাস্তিক্যবাদীদের এতো কৃত্রিম দরদ, তারা নিজেরা ছিলেন অত্যন্ত সুখী। তাদের সুপারস্টার স্বামীর প্রতি ভীষণ অনুরক্ত।

এবার আসেন সফিয়াকে (রা) স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা বিষয়টি। নাস্তিকেরা এ বিষয়ে ফলস ইমোশান ক্রিয়েট করে বলে, “দেখো, যার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে যে নারীর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে মাত্র দিন কয়েক আগে, বাবা নিহত হয়েছেন এর আগে, সে কীভাবে হত্যাকারী সেনাপতির স্ত্রী হিসেবে সানন্দে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে?” নারী চরিত্র, ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে যাদের কোনো জ্ঞান নাই, এ ধরনের ফলস এলিগেশন ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা তাদের মুখেই শোভা পায়।

নারী চরিত্র নিয়ে কথা বলায়, হতে পারে, আলগা নারীবাদীরা এখন ‘হা হা রে রে’ করে উঠবেন। সে যা-ই হোক, আমরা যখন ‘নারী চরিত্র’ বা ‘পুরুষ চরিত্র’– এরকম করে কোনো একটা কমিউনিটি সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু বলি, তখন ওই ক্যাটাগরির ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে কিছু কথা বলি। এর মানে এই নয় যে এই সম্প্রদায়ের ইচ এন্ড এভরিওয়ান এ রকমই হবে। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। কিন্তু ব্যতিক্রমকে ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।

আমরা দেখি, অগত্যা পরিস্থিতিতে দুর্বলেরা সাধারণত থাকে শক্তিমান বিজয়ীর পক্ষে। প্রকৃতির জগতেও আমরা এটা দেখি। মনুষ্য সমাজের বাস্তব ঘটনাচিত্রেও এটি দেখা যায়। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষ যা  দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিরূপ পরিস্থিতিতে মানুষ সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে সে অন্তর থেকে গ্রহণ করে নেয়। মানুষের এই অভিযোজন ক্ষমতার বাস্তবতা আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে।

এর সাথে আছে আর একটা জিনিস। যেটা এই ধরনের আলোচনায় কেউ সাধারণত খেয়াল করে না। সেটা হলো ইসলাম। ইসলামের যে মতাদর্শগত বিপুলতা ও ব্যাপকতা, ইসলাম যে জীবনবোধের কথা বলে এবং অনুভবের গভীরতম স্থানে সেটার যে অনস্বীকার্য আবেদন, সেটা হযরত সাফিয়ার (রা.) মনে কেমন প্রভাব তৈরি করতে পারে, সেটা আমরা সঙ্গত কারণেই অনুমান করতে পারি। ‘উম্মুল মুমিনীন’ হিসাবে উনার পরবর্তী জীবনকে বিবেচনায় রাখলে এটি আমরা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। একজন সাধারণ সৈনিকের দাসী হয়ে থাকার পরিবর্তে পুরো এলাকার এক নম্বর মানুষটির স্ত্রী হওয়ার যে বিরল সুযোগ ও সম্মান তিনি পেয়েছিলেন, তাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমি এতক্ষণ যা কিছু বললাম এর কোনোটাই কিন্তু কনক্লুসিভ বক্তব্য নয়। যা প্রকাশিত হয়েছে তার বাইরে কোনো ব্যক্তির বেডরুমের ঘটনা তথা একান্ত ব্যক্তিজীবন সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু আমাদের সঠিক বুঝতে পারার কথা নয়। তাই, নাস্তিকেরা কোত্থেকে ও কীভাবে মহানবী মুহাম্মদের (স.) দাম্পত্য জীবনে বৈবাহিক ধর্ষণের আলামত খুঁজে পেল, সেটা আমার বুঝে আসছে না। এ বিষয়ে তারা যা বলে সেগুলো ব্যক্তি-বিদ্বেষপ্রসূত বিশেষ নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ হতে দেখা অনুমান মাত্র। অকাট্য প্রমাণ জাতীয় কিছু নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রত্যেক পক্ষ নিজ অবস্থানের অনুকূলে যুক্তি ও প্রমাণ খুঁজে পায়। নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ অবশ্য সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বীয় কাণ্ডজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ঘটনার বাস্তবতা অনুধাবন করার চেষ্টা করে। এভাবেই আমি এ দুটি ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেছি।

এর পূর্ববর্তী রিলেটেড পোস্ট: দাসীর সাথে মালিকের যৌন সম্পর্ক হলো এক ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক

ফেইসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Misbah Mozumder: ইসলামবিরোধীদের আরো কিছু অভিযোগের মধ্যে একটা হচ্ছে– পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ ও সাওদাকে (রা.) যৌবন শেষ হওয়ার পর তালাকের চিন্তা। এ বিষয়টি সম্পর্কেও আলোচনা চাই।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমি প্রধান দুইটা আপত্তি বা অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছি। এইগুলোতে যে কনভিন্স হবে তার কাছে ওইগুলো আর সমস্যা হিসাবে মনে হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছা নাই। যয়নবকে (রা.) বিয়ে করার ব্যাপারটা তাঁর দাম্পত্য অভ্যাস ও নীতির সাথে সম্পর্কিত। সেটি হলো, বিয়ের ব্যাপারটাকে আমাদের সমকালীন আধুনিক সমাজের মতো এতটা হিপোক্রেটিক সেন্সিটিটিভিটির সাথে না নিয়ে বিষয়টা খাওয়া-পরা ও ঘুমানোর মতো স্বাভাবিক একটা বিষয় হিসাবে নেয়া।

আমাদের সমকালীন আধুনিক সমাজ প্রাপ্তবয়স্কদের যৌনচেতনাকে স্বাভাবিক হিসাবে অনুমোদন করে। তাই ছেলে-মেয়েদের প্রেম করাকে খারাপ মনে করে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অজুহাতে যৌনচেতনা নিবৃত্তির স্বাভাবিক উপায় তথা বৈবাহিক সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত করে। বরং সর্বোপকারে বাধাগ্রস্ত করে। এই ধরনের প্রকৃতিবিরুদ্ধ পারভার্টেড সমাজব্যবস্থা তাঁদের সময় ছিল না। ধারণা করতে পারি, থাকলেও তাঁরাও সেটা মেনে চলতেন না।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীদের একান্ত ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে নানা ধরনের আপত্তি তোলার গোড়ার কারণ হলো জীবন ও জগত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতা। এটি paradigmatic problem, একচুয়েলি।

Misbah Mozumder: আমি এই দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, বিশেষ করে সাওদার (রা.) বিষয়টি নিয়ে। সাওদা (রা.) যদি নিজের সময়টা আয়েশার (রা) জন্য না দিতেন, তাহলে তিনি তালাকপ্রাপ্ত হতেন এবং নিঃস্ব হয়ে যেতেন। অথচ রাসূল (সা.) তো মানবতার নবী!?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এই কথাগুলোর সোর্স এন্ড অথেনটিসিটি কী?

Misbah Mozumder: নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে আমাদের যে বুঝ…

“সূরা নিসার ১২৮ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসির (রহ.) একটি হাদীস বর্ণনা করেন: “রাসূল (সা.) সওদা (রা)-এর নিকট তালাকের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। তিনি তখন আয়েশা (রা)-এর নিকট বসেছিলেন। রাসূল (সা) সেখানে প্রবেশ করলে সওদা (রা) বলেন, ‘যে আল্লাহ আপনার উপর স্বীয় বাণী অবতীর্ণ করেছেন এবং স্বীয় সৃষ্টির মধ্যে আপনাকে মনোনীত করেছেন তাঁর শপথ! আমা ফিরিয়ে নিন। আমার বয়স খুব বেশি হয়ে গেছে। পুরুষের প্রতি আমার কোন আসক্তি নেই। কিন্তু আমার একান্ত ইচ্ছা যেন কিয়ামতের দিন আমাকে আপনার একজন স্ত্রী হিসেবে উঠানো হয়।’ রাসূল (সা) তাতে সম্মত হন এবং তাকে ফিরিয়ে নেন। তখন সওদা (রা) বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার পালার দিন ও রাত আপনার প্রিয় স্ত্রী আয়েশা (রা.) কে দিয়ে দিলাম।”

Masudul Alam: স্বয়ং এই রেফারেন্সটি সাওদা (রা) সম্পর্কিত নাস্তিকদের দাবির বিপরীত। এই রেফারেন্স মোতাবেক, আল্লাহর রাসূলের (সা) সাথে সাওদার (রা) সমস্যা মিটমাট হয়ে যাওয়ার পরেই কেবল সাওদা (রা) তাঁর পালা আয়েশাকে (রা) দিয়ে দেন। তার মানে, এই রেফারেন্স অনুসারেই আয়েশাকে (রা) সাওদার (রা) সময়টুকু দিয়ে দেয়ার সাথে তালাকের সম্পর্ক নেই।

লেখাটির ফেইসুবক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *