হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা লিবারেল-মডারেট-ডেমোক্রেটিক-সেন্ট্রিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ধারা ক্রমান্বয়ে শক্তি অর্জন করবে। কয়েকটা রাজনৈতিক দল এই উদার-আধুনিক-গণতান্ত্রিক-মূলধারার-জাতীয়তাবাদী ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তারাই অদল-বদল করে ক্ষমতায় যাবে।

কদ্দিনে এটি ঘটবে?

আনুমানিক পনের বছরের মধ্যে এমন একটা পর্যায় সূচিত হবে।

এই দশ-পনের বছর কীভাবে যাবে?

না, তা বলা যাবে না। আমার ধারণা নাই বলে বলা যাবে না, এমন নয়। বরং I know it, as much as I see this write-up, right now. চলমান রাজনীতির সাথে কোনো প্রকারের সংশ্লিষ্টতা না রেখে এর পরবর্তী পর্যায়ের জন্য আজকের দিনে করণীয় কী, তা নিয়ে এনগেজড হয়ে থাকার ব্যাপারে আমার সেলফ-কমিটমেন্টের কারণে আজকে থেকে পনের বছরের মধ্যে মোর স্পেসিফিকেলি খুব সম্ভবত: কী কী ঘটবে তা নিয়ে মন্তব্য করা হতে বিরত থাকলাম।

নতুন এই বাংলাদেশে ইসলামপন্থার অবস্থা কী দাঁড়াবে?

এটি নির্ভর করছে বর্তমান ইসলামপন্থীরা ইসলাম সম্পর্কে কোন ধরনের আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে এডপ্ট করবে তার ওপর। এটি নিশ্চিত যে, রাজনীতি, সামাজিক অংগন, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কিংবা ধর্মীয় ধারা, কোনো সেক্টরেই শুদ্ধতাবাদী কোনো ইসলামী দল এ দেশে খুব বেশি আগাতে পারবে না।

কারণ, ওই যে মধ্যবর্তী (centrist) একটা স্থিতিশীল ধারার জন্য ভবিষ্যতের বাংলাদেশ প্রস্তুত হচ্ছে। বিভিন্ন ধারার চরমপন্থার বিকাশ আরো কিছুদিন যাবত, ক্ষেত্রবিশেষে তীব্রতর হয়ে বা অব্যাহত থেকে আগামী এক যুগের অনধিক কালের মধ্যে সেসব ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে।

ভবিষ্যতের এই বাংলাদেশপন্থী রাজনীতিতে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী ‘অরাজনৈতিক রাজনৈতিক শক্তি’গুলোর অবস্থা কী হবে? এরা সবাই কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

আসলে বাংলাদেশে লোক সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে এখানে একটা কিছু প্রতিষ্ঠিত হলে শেষ পর্যন্ত তা টিকেও থাকে। আগামী এক দশক পরে একটা সত্যিকারের উন্নয়নশীল বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক ও ‘অরাজনৈতিক রাজনৈতিক’ কোনো ধারা বা দলের বিলুপ্তি ঘটবে না। বরং সেগুলো প্রভাবক হিসাবে কাজ করবে। সোজা কথায়, সাইড লাইনে থেকে খেলবে। মূল মাঠে থাকবে কোনোদিকেই কট্টর নন এমন ধরনের খেলোয়াড়েরা।

বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে ‘রাজনীতি করবো না বলে’ এ রকম একটা রাজনৈতিক বক্তব্য বা বিশ্লেষণ দেয়ার মানে কী?

হ্যাঁ, বাংলাদেশ বর্তমানে একটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ ব্যাপারে ঠিকই বলেছেন। বেশ ক’বছর আগেই আমি বলেছিলাম ‘কোনো প্রকারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রাখবো না।’ এখনও এর ওপরেই কায়েম আছি। তাই এই পোষ্টে বিশ্লেষণ আছে, মন্তব্য আছে, করণীয় নিয়ে পরামর্শ আছে। কিন্তু, খেয়াল করলে দেখেবেন, এতে কিছু বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতের এই বাংলাদেশে ইসলামপন্থা নিয়ে যারা কাজ করবে তাদেরকে পথ দেখানো, অন্ততপক্ষে বলার দায়িত্বপালন করা ও আগ্রহীদের চিন্তায় সহায়তা করার জন্য এই লেখা।

ইসলামপন্থা বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র তথা সবকিছুতে বরাবরই একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসাবে ছিলো। আছে ও থাকবে। কথিত এই মূলধারাতেই থাকবে। তবে কথা হলো, সেটি একটা ফ্যাক্টর বা কার্ড হিসাবে থাকবে, নাকি ভবিষ্যতের এই বাংলাদেশের ধরন-গঠনটাই হবে এক ধরনের ইসলামপন্থা। এটি নিয়ে আমার আগ্রহ।

আমি চাই বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির মূল গঠন ও ধরনটাই হোক ইসলামী বা ইসলামপন্থা-নির্ভর। সেক্ষেত্রে সেই ধরনের সম্ভাবনাময় ইসলামপন্থাকে হতে হবে বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামপন্থাসমূহের চেয়ে মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ একটা ‘ওয়াসাতিয়্যা’ বা মধ্যপন্থী, মোলায়েম ও উদার ও ইনক্লুসিভ বৈশিষ্ট্যের ইসলামপন্থা।

ইসলামের দিক থেকে এ ধরনের ওয়াসাতিয়্যা অবস্থান নেয়ার সুযোগ বা স্কোপ, ক্ষেত্র ও কর্মপদ্ধতি কী হবে তা নির্ধারণের কাজেই আমি সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’র মাধ্যমে স্বনিয়োজিত।

এ দেশে ইসলাম কীভাবে এসেছিলো?

তৎকালীন বিদ্যমান সামাজিক অসমতা ও জুলুমের বিরুদ্ধে সাম্য ও ন্যায়বিচারের খুবই সিম্পল মেসেজ নিয়ে এদেশে ইসলাম এসেছিলো। প্রচারিত হয়েছিলো। বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বর্তমান ‘আঁতেল ইসলামপন্থীদের’ মতো অতো বুদ্ধিবৃক্তিক প্যাঁচগোছ নিয়ে আসলে ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ এই অর্থহীন আস্ফালন করার মতো পরিস্থিতির আদৌ উদ্ভব হতো না। এটি নিশ্চিত।

এখনো এখানে ইসলামের দিক থেকে যথাসম্ভব সহজ করে কাজ করতে হবে। ‘সহজ করো। কঠিন করো না। আশাবাদী করে তোলো। ঘৃণার সৃষ্টি করো না।’ আল্লাহর রাসূলের (স.) এই হাদীসকে বেইজ করে আগাতে হবে।

বাংলাদেশে মক্কার ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করলেই হবে। মদিনার ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ লাগবে না। না, ‘আপাতত লাগবে না’ – এমনও নয়। মদিনার ইসলাম বা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ কখনো লাগবে না বা এর দরকার নাই – এমনও নয়। বরং এই প্রসংগটাকেই মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। আযিমত বা সর্বোচ্চ মানকে আপনি নিজে নিজে পারলে প্র্যাকটিস করুন। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য রুখসত তথা ন্যূনতম মানকে তুলে ধরুন। কাজের ইসলামে আসুন। বকোয়াজগিরির মজ্জাগত স্বভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করুন।

জাতিকে আগে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হিসাবে গড়ে তুলুন। স্কুল পাশ করান। তারপর না হয় কাউকে কাউকে গ্রাজুয়েট-বিশেষজ্ঞ হিসাবে গড়ে তুলবেন।

যে দেশের লোকদের মধ্যে মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর গণ-ঘাটতি প্রকট, সে দেশের লোকদেরকে কীভাবে ইসলামী নৈতিকতার আওতায় আনা বুঝতে পারছি না।

আসলে ইসলাম মানেই বা কী? এটি কি নিয়ম-কানুনের একটা সমষ্টি তথা bundle of rules? নাকি, ইসলাম হলো একটা জীবন দৃষ্টি বা life view? এই অতিসরল, অতিমৌলিক ও অবুদ্ধিজীবীসুলভ প্রশ্নটা কেন জানি আবার, বার বার করতে ইচ্ছা করছে …!

আমাদের দেশে ইসলাম, ইসলামাইজেশান, ইসলামী রাষ্ট্র – এসব নিয়ে এমন সব অর্ধসত্য তৈরি করা হয়েছে যাতে লোকেরা মনে করে মেয়েরা পর্দা করবে, ছেলেরা দাঁড়ি-টুপি পরে নামাজ পড়বে, সুদ থাকবে না, ঘুষ চলবে না, দুর্নীতি হবে না – তাহলে ইসলাম কায়েম হয়ে গেলো। এসব কাজ ইসলাম কায়েমের একটা উচ্চতর পর্যায় বটে। তো এসব যখন মক্কী ও প্রাথমিক মাদানী যুগে ছিলো না, তখন কি ইসলাম ছিলো না? অথবা সেসব ইসলাম অপূর্ণ ছিলো?

যা হোক এসব নিয়ে আমার ‘ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা‘ শিরোনামে পুরনো লেখা আছে। আগ্রহী পাঠককে সেটি পড়ার আহ্বান জানাই।

তাহলে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কনসেপ্টটাকে নতুন করে বুঝতে হবে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি মনে করি, ইসলামী রাষ্ট্র ধারণাটা নিয়ে রিথিংক করা উচিত। ইসলামী রাষ্ট্র কোনো একক ধারণা নয়। এটি আছে নাকি নাই, সেটাই মূল প্রশ্ন, ব্যাপারটা এমন নয়। রাষ্ট্র ধারণা মানেই একটা যৌগিক ও জটিল ধারণা। ইসলামী রাষ্ট্র ধারণাও একটা বহুমাত্রিক ফেনোমেনন। যেমনটা সচরাচর মনে করা হয় সেভাবে আছে বা নাই জাতীয় কোনো ব্যাপার নয়।

বছর তিনেক আগে সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটা বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, এখন যাকে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সিভিল স্টেট বলি তা যদি ইসলামবিদ্বেষী না হয় তাহলে সেটিও এক হিসাবে একটা ইসলামী রাষ্ট্র বটে।

অতএব, এতক্ষণে বিদগ্ধ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অদূর ভবিষ্যতের বাংলাদেশও একটা ইসলামী রাষ্ট্র হবে, যদিও তা বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্রধারণা মোতাবেক হবে না।

ইসলামী রাষ্ট্র ধারণার প্রচারক ও বিরোধী উভয় পক্ষ মনে করেন, যে রাষ্ট্রে ইসলামী দণ্ডবিধি, অর্থনৈতিক বিধিবিধান ও যুদ্ধ অর্থে জিহাদ কার্যকর আছে কেবলমাত্র সেই রাষ্ট্রই ইসলামী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সম্পর্কে এ ধরনের বাইনারি ধারণা ভুল। শুধু আমি নই, আল ফারাবীও তো রাষ্ট্র ধারণার সিম্পল বাইনারিকে বাদ দিয়ে উনার রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। আমি এর ডিটেইলসে যাচ্ছি না। তবে আমার এই সম্পর্কিত লেখালেখি থেকে আগ্রহী পাঠক কিছু ধারণা লাভ করবেন।

আপনার কথা লোকেরা কি শুনে? অথবা, কেন শুনবে?

না, আমার কথা লোকেরা শুনে না। অনেকের কাছে আমি পৌঁছতে পারি নাই। কেউ কেউ ইসলাম সম্পর্কেই প্রকাশ্যে বা ভেতরে ভেতরে এলার্জিক। কেউ কেউ আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা করছেন। তাতে আমি কী করতে পারি? বসে তো থাকতে পারি না। তাই না? জানি, আমাদের দেশীয় ইসলামিস্ট ইয়াং এন্ড ওল্ড বুদ্ধিজীবীরা আমার মতো মফস্বল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদেরকে গোনে না। কোনো কথা আমার কাছ হতে শোনার পরিবর্তে তারা বিশ্বখ্যাত একাডেমিক মেগাস্টারদের কাছ হতে বা তাদের বরাতে শুনতে চান। কমফোর্ট ফিল করেন। আমার লক্ষ্য যেহেতু মনন ও সমাজ পরিবর্তন, তাই নিজের এই অবমূল্যায়ন নিয়ে আমার খুব একটা ক্ষোভ নাই।

তাহলে আপনি conceptual clarity ‘র ফিল্ডে কাজ করতে চান?

একজেক্টলি। আমি চাই কিছু করার বা কিছু করার চেষ্টা করার আগে মানুষের কাছে ধারণাগুলো ক্লিয়ার হোক। আগে তো ঠিক হোক এই বিল্ডিংয়ে কারা থাকবে, কীভাবে তারা থাকতে চায়। এরপরে উপযুক্ত সরঞ্জামের প্রাপ্যতার বিষয়কে বিবেচনায় রেখে সেই বিল্ডিংয়ের নকশা করা হোক। তারপরের কাজ হচ্ছে এক একটা দিকের লোকেরা এক একটা কাজে লিপ্ত হওয়া। এক এক ধরনের প্রকৌশলী ও মিস্ত্রীরা এক এক ধরনের কাজ করবে। তাহলেই কেবল একটা বিল্ডিং গড়ে উঠবে।

ভবিষ্যতের একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার কাজে সবাই মিলে রাজনীতি কপচানোর বদঅভ্যাসকে বাদ দিতে হবে।

রাজনীতি ছাড়া তো কিছু হয় না। অথচ আপনি রাজনীতি বাদ দেয়ার কথা বলছেন?

হ্যাঁ, রাজনীতি ছাড়া শেষ পর্যন্ত কোনো কিছু টিকে থাকতে পারে না। তো ভাই, অর্থনীতি ও যুদ্ধ-জেহাদেরও তো মৌলিক বা অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। ‘জান্নাত তরবারীর ছায়াতলে অবস্থিত’ – রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা এই ধরনের নস তথা কোরআন-হাদীসকে তালগোলে এড়িয়ে চলে। অথচ দাবি করেন, তারা পূর্ণাঙ্গ ইসলামে হয়তো আছেন, অথবা তারাই কেবল ‘পূর্ণাঙ্গ ইসলামের’ কথা বলেন।

এ দেশের জেহাদপন্থী ইসলামিস্টরা তাদের এ সংক্রান্ত ইসলাম-বুঝের দিক থেকে অর্থাৎ কনসার্নড আন্ডারস্ট্যন্ডিংয়ের দিক থকে ভুল বা মিসগাইডেড হলেও রাজনৈতিক গণতন্ত্রী ইসলামিস্টদের স্ববিরোধের তুলনায় তারা অকপট ও সিনসিয়ার – এ কথা নিশ্চিত।

তাহলে ইসলাম বাস্তবায়নের তরীকা কী হবে? বা হওয়া উচিত?

দেখুন, আল্লাহর রাসূল (স.) এর জন্য নবুয়তি জিন্দেগী ছিলো ২৩ বছরের। আমরা সেটি জানি। এর মধ্যে মক্কী যুগ ১৩ বছরের। মাদানী যুগ ১০ বছরের। তো আমাদের বাংলা অঞ্চলে বা বিশ্বের বর্তমান ও অনাগত কালে যে কোনো অঞ্চল বা দেশে এই ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠাকরণ পর্যায়’ কি ১৩+১০=২৩ ফর্মূলা মেনেই হতে হবে বা হবে?

হতে পারে, কোনো দেশে মাক্কী যুগ ১৩০ বছর। হতে পারে না? গাছকে গোড়া হতে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। পুঁজামণ্ডপের কলাগাছের মতো বসিয়ে দিলে গাছ হবে না। এভাবে তুলে এনে বসিয়ে দেয়া তথা চাপিয়ে দেয়া সত্য দিয়ে সমাজ গঠন হয় না। গাছের মতো চারা থেকে গড়ে উঠতে হয়। উপযুক্ত মৃত্তিকা লাগে। আবহাওয়া লাগে।

তাহলে এতো বছর যারা এ দেশে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করেছেন, এখনো যারা একটা উল্লেখযোগ্য শক্তি বটে, আপনি বলতে চাচ্ছেন তারা ভুল পদ্ধতিতে কাজ করেছেন? তাহলে তারা দৃশ্যমান এতো বিরাট সফলতা লাভ করলো কীভাবে?

হ্যাঁ তাদের বাস্তবায়নের তত্ত্ব (application theory) ভুল ছিলো। আর সফলতার কথা বলছেন? ভাবুন তো যে পুকুরে অনেক বেশি মাছ থাকে সেখানে ফাঁটা জালেও কতো বড় মাছ উঠে …! শুনুন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার এ দেশে ইসলাম হলো একটা পপুলার ব্র্যান্ড। যারাই ইসলামের নামে কাজ করেছেন বা করছেন বা করবেন, তারা সফলতাই লাভ করবেন। কোন সেক্টরে কতো বেশি বা কম সফলতা লাভ করবেন, তা শুধু দেখার বিষয়। এ দেশে ইসলামের নামে কোনো কাজে মার্কেট-আউট হওয়ার সুযোগ নাই।

শুনতে খুবই রূঢ় শোনালেও পদ্ধতিগত দিক থেকে ইসলামপন্থীদের ইসলাম কায়েম সংক্রান্ত ধারণাটাই একটা গ্রস-মিসটেক। আগাগোড়া ভুল। যারা ইসলাম কায়েম করতে চান, তাদের মধ্যকার উদীয়মান সংস্কারবাদীরা মনে করেন, রাজনৈতিক ইসলাম বাদ দিয়ে সামাজিক ইসলাম চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে। আসলে এই ইসলাম, সেই ইসলাম – এসব বাদ দিয়ে অখণ্ডভাবে শুধুমাত্র ‘ইসলাম’কেই ব্র্যান্ডিং করুন, একটা অখণ্ড ধারণা হিসাবে। এরপরে তা বাস্তবায়নের কাজে আপনার প্রতিভা ও কর্মক্ষেত্র অনুসারে কাজ করুন।

তাহলে ইসলামী বা মুসলিম ঐক্য ধারণার ব্যাখ্যাটা আপনার দৃষ্টিতে কেমন হওয়া উচিত?

ইসলামী বা মুসলিম উম্মাহ তথা তাওহীদ ধারণার এককত্ব হলো চেতনাগত। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নিজ পটেনশিয়ালিটিকেই বিবেচনা করুন। নিজে যা করতে পারেন, সর্বোচ্চ পরিমাণে সেটিই করুন। সবাই মিলে কিছু একটা করার চিন্তা বাদ দিন। সমচিন্তার কাজগুলো আপনাআপনিই একটা structural unity গড়ে তুলবে। তাই যে কোনো ধরনের সাংগঠনিক এককত্বের চিন্তা একটা নেতিবাচক, রীতিমতো ব্লাকহোল টাইপের ধ্বংসাত্মক চিন্তা। অন্যদের দিকে তাকানো মানে ফাঁকি দেয়ার, কাজ না করার পথ তৈরি করা।

ধারণাগত অখণ্ডতা বা সামঞ্জস্যতাকে বাস্তবায়নগত সাংগঠনিক ঐক্যের সাথে মিলিয়ে বা গুলিয়ে ফেলবেন না। তাওহীদের ধারণা স্বয়ং পরম-ঐক্যের ধারণা। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সাথে, ইবাদাতের রিচুয়্যালগুলোর সামঞ্জস্যতার সাথে একে ভজগট পাকাবেন না। “তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না” – আল কোরআনের এই ধরনের বাণীগুলোর অর্থ হলো তাওহীদ চেতনা হতে তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না।

সামাজিক সংগঠন ও প্রশাসনিক সংগঠন ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য কী?

সাংগঠনিক একতা ও ঐক্য সংক্রান্ত কোরআন ও হাদীসের নসগুলোকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দিক থেকে বুঝতে হবে। মোট কথা হলো, সামাজিক বিষয়গুলো অন্তর্গত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে অতি অবশ্যই বহুমাত্রিক, ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র-উদ্যোগ নির্ভর। নানামুখী। অথচ প্রশাসনিক তথা রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো সর্বদাই ক্রমসোপানমূলক ও এককেন্দ্রিক। রাজনীতি কি প্রশাসনিক বিষয়? ধর্মীয় বিষয়গুলো কি প্রশাসনিক চরিত্রের? না, তা নয়। রাজনীতি হলো এক ধরনের মুয়ামালাত তথা সামষ্টিক আচরণের বিষয়। সুতরাং রাজনীতির ক্ষেত্র তো বটেই কোনো ধরনের সামাজিক উদ্যোগ বা কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বর্তমান আধুনিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দরকার নাই।

এ ধরনের সর্বাত্মকবাদী (totalitarianistic) রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। ভবিষ্যতর বাংলাদেশে কেউ চাক বা না চাক, এক ধরনের বহুত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এটি শুধু রাজনীতি নয়, প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনার বাইরে সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের প্লুরালিস্টিক সিস্টেম গড়ে উঠবে। কারণ, এটি সময়েরই দাবি।

ভবিষ্যত বাংলাদেশের নায়ক বা নির্মাতা কারা?

ভবিষ্যত বাংলাদেশের নায়ক বা নির্মাতা আমরাই। দেশের আ-ম জনতা। সোশ্যাল মিডিয়াতে যাদেরকে মশকরা করে ‘ম্যাংগো পিপল’ বলা হয়, তারা। সাধারণ লোকেরাই একটা মধ্যপন্থী বাংলাদেশ নির্মাণ করবে। এ দেশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা বার বারই তাদের মতো করে আদর্শ চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। কৃত্রিম জাতিসত্ত্বা নির্মাণ করতে চেয়েছে। ভার্সিটিওয়ালারা একভাবে চেয়েছে। মাদ্রাসাওয়ালারা অন্যভাবে চেয়েছে। বাস্তব হচ্ছে, দেশের মানুষ কোনোটাকে পুরোপুরি খারিজ বা গ্রহণ করে নাই। করবেও না। আমিও চাই, এ দুই ধারাই থাকুক। প্রত্যেক ধারা নিজের সদর্থক বা ইতিবাচক দিকগুলোকে দিয়ে সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখুক। তাই উন্নয়নের বিকল্প হিসাবে কোনো ধরনের আদর্শায়ন বা ideolization এর আমি বিরোধী।

জীবনমানের দিক থেকে উন্নত অবস্থার কাছিকাছি পর্যায়ে এবং মতাদর্শগত দিক থেকে মধ্যপন্থী হিসাবে গড়ে উঠা এই ভবিষ্যত বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে ইসলাম কি একটা নিছক শ্লোগান, ঐতিহাসিক আবেগ ও পরিচিতি হিসাবে ব্যবহৃত হবে, নাকি অন্তর্গতভাবে সেটি এই জনগোষ্ঠীর টেকসই আইডেন্টিটি হিসাবে সক্রিয় থাকবে, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব আজকের দিনে সক্রিয় ইসলামপন্থীদের ওপর বর্তায়।

শেষ পর্যন্ত আমি আশাবাদী।

পোস্টটির ফেইসবুক লিংক

এ সংক্রান্ত আগের পোস্ট: বাংলাদেশে রাজনীতির হাল-চাল: সংঘাত নিরসনের উপায়

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *