এক ঋদ্ধ পাঠক ধর্ম নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছেন। তিনি আমার প্রিয়। মুক্তচিন্তার অনুসারী। প্রশ্ন করেছেন পরশু দিন। মেসেঞ্জারে। গতরাতে উত্তর দিয়েছি। উত্তরটি সমঝদার পাঠকদের জন্য এখানে শেয়ার করছি।

প্রশ্ন: কেন বা কী প্রয়োজনে আল্লাহ নিজ প্রদত্ত ধর্মকে নিজেই বাতিল করলেন? এবং নতুন আরেকটি ধর্ম পাঠালেন?

তাহলে কি বাতিলকৃত ধর্মে কোনো গলদ ছিল? গলদ যদি না থাকে তাহলে একটি ধর্মেনিয়মকানুনের সাথে অন্য ধর্মের নিয়মকানুনের অমিল কেন?”

আমার উত্তর:

নতুন ধর্ম একচুয়েলি পুরনো ধর্মেরই নতুন রূপ। মানসিকতা, বুদ্ধিবৃত্তি, সহায়-সম্পদ, প্রতিবেশ ও পরিবেশের উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষার জন্য নতুন সংস্করণ। দ্বীন বা মূল বক্তব্য, যেমন তাওহীদ, রেসালত ও আখিরাতের ধারণার পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয় বা হয়েছে সেগুলোকে স্পেসিফিক সিচুয়েশনে অনুসরণ করার mode তথা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতে।

মানুষের ধর্ম যদি বস্তুর বস্তুগত ‘ধর্মের’ মতো হতো তাহলে তো মানুষ নিছক বস্তুই হতো। সে স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী হতো না। তাই, মানুষ-এর উচিত স্বীয় যুক্তি, বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান ও বিবেককে কাজে লাগিয়ে স্রষ্টা প্রদত্ত সর্বশেষ আপডেটকে ফলো করা। মানুষ তার ঔচিত্যবোধকে কাজে লাগায় কিনা তা যাচাই করাটা অর্থহীন হতো যদি বতিলকৃত ভার্শানগুলো অটোমেটিক্যালি এলিমিনেইট বা ভেনিশ হয়ে যেত।

প্রশ্ন: মজার ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীতে সেসব বাতিল ধর্ম এখনো বহাল তবিয়তে আছে, কোটি কোটি অনুসারীসহ।

আমার উত্তর:

অনুসারীদের দিক থেকে দেখলে দুনিয়াতে আজ পর্যন্ত ভ্রান্ত মত, পথ, তত্ত্ব ও আদর্শই দলভারী বা ব্রুট মেজরিটি। বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে ভুল জিনিসটা সঠিক হয়ে যায় না। যে কারণেই হোক না কেন, যে আদর্শকেই সঠিক মনে করা হোক না কেন, এককভাবে প্রতিটা আদর্শই সংখ্যালঘিষ্ট। আমি উদাহরণের দিকে গেলাম না।

প্রশ্ন: … যদি সাহায্য করতেন। আমার নিগূঢ় বিশ্বাস, আল্লাহ প্রশ্নকর্তাকে ভালোবাসেন। কার, আমরা কেউ তাঁর বিরুদ্ধে নই।

আমার উত্তর:

প্রশ্ন করাকে কোনো আদর্শই সর্বান্তকরণে এলাউ করে না। ধর্মের ক্ষেত্রে এটি অতীব বাস্তব, কিন্তু তিক্ত সত্য। অন্তত, ধর্মকে যেভাবে ধর্মবেত্তা ও ধর্মপ্রাণ লোকজনেরা প্রমোট করে, তাতে করে মুক্তচিন্তার অনুসারী কারো পক্ষে ধার্মিক হওয়াটা অসম্ভব-প্রায়। প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনার হাই ডোজ নিলে অবশ্য যে কোনো কূপমণ্ডুকতাকেই যৌক্তিক মনে হতে পারে। যেমনটা আমাদের সমাজে ধার্মিক লোকদের মধ্যে দেখা যায়।

আমি ধার্মিক নই। ধর্মপ্রিয়ও নই। ইসলাম আমার কাছে একটা আদর্শ, ধর্ম যেটির একটি অংশ। অবশ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেমন করে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস বা মস্তিষ্ক গুরুত্বপূর্ণ। আমি ইসলামকে অনুসরণ করি জীবননাদর্শ বা দ্বীন হিসেবে।

সূরা বাকারার পর পর দুটি আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি, নবী-রাসূলগণও স্বয়ং আল্লাহকে তাঁর কুদরতের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের জাগতিক বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। কোরআনে প্রচুর বর্ণনা আছে যেগুলো শুরু হয়েছে এইভাবে, ‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, এটি কী। হে নবী, তুমি তাদের বলে দাও …’

কিংবা এমন ব্যক্তির ঘটনা সম্পর্কে (তুমি কি চিন্তা করোনি) যে এক নগর দিয়ে এমন অবস্থায় যাচ্ছিল যে তা উজাড় অবস্থায় ছিল। সে বলল, ‘আল্লাহ এ নগরীকে এর মৃত্যুর পরে কীভাবে জীবিত করবেন?’ তখন আল্লাহ তাকে একশ’ বছর মৃত রাখলেন। তারপর তাকে জীবিত করে তুললেন ও জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এ অবস্থায় কতকাল ছিলে’? সে বলল, ‘একদিন ছিলাম কিংবা একদিন হতেও কম’ আল্লাহ বললেন, ‘বরং তুমি একশ’ বছর ছিলে, এক্ষণে তুমি তোমার খাদ্য ও পানীয়ের দিকে লক্ষ্য করো, এটা পচে যায়নি। আর গাধাটার দিকে তাকিয়ে দেখো, আর এতে উদ্দেশ্য এই যে আমি তোমাকে মানুষের জন্য উদাহরণ করবো। আবার তুমি হাড়গুলোর দিকে লক্ষ্য কর, আমি কীভাবে ওগুলো জোড়া লাগিয়ে দেই, তারপর গোশত দ্বারা ঢেকে দেই। এরপর যখন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো, তখন সে বললো, ‘এখন আমি পূর্ণ বিশ্বাস করছি যে আল্লাহই সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান’।” (সূরা বাকারা ২:২৫৯)

সেই ঘটনাটিও স্মরণ করো, যখন ইবরাহীম বলেছিল, আল্লাহ! তুমি কীভাবে মৃতকে জীবিত করো, তা আমাকে দেখাও। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি বিশ্বাস করো না? ইবরাহীম বলেন, বিশ্বাস তো করি। কিন্তু মনের সন্তুষ্টি প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, তাহলে চারটি পাখি নিয়ে তাদেরকে তোমার পোষ মানিয়ে নাও। তারপর তাদের খণ্ডিত এক একটি অংশ এক একটি পাহাড়ের ওপর রাখো। তারপর তাদেরকে ডাক দাও। তারা তোমার কাছে ছুটে চলে আসবে। জেনে রেখো যে আল্লাহ অতিশয় পরাক্রমশালী ও নিপুণ কুশলী” (সূরা বাকারা ২:২৬০)

ইমাম আবু হানিফার প্রধান দুই ছাত্র ছিলেন ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ। উনারা ইমামে আযম আবু হানিফা প্রদত্ত ফাতওয়া ও মাসআলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সাথে দ্বিমত করেছিলেন। মাদ্রাসা ব্যবস্থায় গুরুবাদী প্যাসিভ লার্নিং সিস্টেম হলো হালনাগাদের ফেনোমেনা।

কনক্লুডিং রিমার্ক:

কীভাবে বুঝবো কোন ধর্ম সঠিক?” শিরোনামের ভিডিওটি ইউটিউবে গত এক বছরে প্রায় ২৫ হাজার ভিউ হয়েছে। আমাদের মতো গরীবদের জন্য এটি খুশি হওয়ার মতো তথ্য বটে। যারা গালি দিয়েছেন তারা বক্তব্যটির প্রচার-প্রসারে সহায়তা করেছেন বলেই আমি মনে করি। এতে আমি কোন ধর্ম সঠিক সেটা না বলে সঠিক ধর্মটি খুঁজে নেয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো জরুরি, এই কথাটা বলার চেষ্টা করেছি। এটি একটি অনানুষ্ঠানিক আড্ডার অংশ। গুছিয়ে বলা কোনো সাজানো বক্তব্য নয়।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Tasha Moina: ইসলাম কি ফিলোসফি (আল্লাহ কী, কেন… এসব প্রশ্ন) সাপোর্ট করে?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ইসলাম যা বলে তা এক ধরনের ফিলোসফি বটে। যদিও সব ধরনের ফিলোসফি বা ফিলোসফিক্যাল আর্গুমেন্ট ইসলামসম্মত নয়।

Khan Muhammad Mostafa: ইসলামই সঠিক– এ কথার ভিত্তি কি আদৌ?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যুক্তি, কাণ্ডজ্ঞান ও বাস্তবতা।

Khan Muhammad Mostafa: আচ্ছা। তাহলে বাকিসব মিথ্যা স্যার?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যুক্তি, কাণ্ডজ্ঞান ও বাস্তবতার বিপরীত যা কিছু, তা বাতিলযোগ্য।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *