গোপন বিয়ে এক বিদঘুটে ব্যাপার। বিয়ে হলো ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রকাশ্য ঘোষণা। সেটাই যদি গোপন থাকে তাহলে সেটা বিয়ে হয় কীভাবে? অপরদিকে, বিয়ের শর্তগুলো যদি পূর্ণ করা হয় তাহলে সেটা ‘বিয়ে নয়’ এমনটি হয় কীভাবে!
সামাজিকভাবে বিয়ে করতে না পারা, পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিতে অবিবাহিত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে এই ধরনের গোপন বিয়ের ঘটনা ঘটে। আবার, দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাওয়া বিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে এবং এই ধরনের পুরুষদের বিয়ে করার ব্যাপারে নারীদের ক্ষেত্রে গোপন বিয়ের ঘটনা ঘটে।
এবার সমস্যার গোড়াতে আসেন।
প্রাপ্তবয়স্ক একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে সবকিছু করতে পারে, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে পরিচিত হতে পারে না। এই যে নিতান্তই বিরূপ সামাজিক বাস্তবতা, এটি কি কোনোভাবে কাম্য হওয়া উচিত? অথচ, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপারটা এমনই হচ্ছে। তরুণদেরকে প্রতিনিয়ত উস্কানি দেয়া হচ্ছে, অথচ তাদেরকে সঠিক পথে চলতে দেয়া হচ্ছে না, এই যে ক্যারিয়ারিজমের দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়ন, শেষ পর্যন্ত গোপন বিয়ে ছাড়া এর আর কি পরিণতি হতে পারে?
যৌনতার ক্ষেত্রে মানুষ, বিশেষ করে পুরুষ মানুষ বৈচিত্র্যপ্রিয় ও অ্যাডভেঞ্চারাস। প্রাণীজগতে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ও ধর্মে তাই পুরুষদের বহুবিবাহের অনুমোদন ও উদাহরণ দেখা যায়।
কোনো এলাকায় নারী পুরুষের অনুপাত যদি সমান সমান হয়ে থাকে তাহলেও সম বয়সের পুরুষের তুলনায়—
(১) আগে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া,
(২) প্রজননকাল দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া,
(৩) পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণের বাধ্যবাধকতা না থাকা,
(৪) তুলনামূলকভাবে পরিচিত এলাকায় বসবাস করা অর্থাৎ দূর দেশে গমন না করা,
(৫) একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির একাধিক সন্তান ধারণ করতে না পারা,
(৬) সন্তানের প্রতি অধিকতর মায়া,
(৭) তুলনামূলকভাবে দীর্ঘজীবী হওয়া,
(৮) অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার ও সম্ভাবনা কম হওয়া এবং
(৯) নানা দিক থেকে ফিজিক্যালি দুর্বল হওয়ার কারণে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে অধিকতর নির্ভরশীল হওয়া,
এ ধরনের বিবিধ কারণে যে কোনো সমাজে বিয়ের ময়দানে নারীদের উপস্থিতি পুরুষদের তুলনায় বেশি লক্ষণীয়। এটাই স্বাভাবিক।
কথার কথা, কোনো সমাজে ১৮-২০ বয়সের পুরুষের সংখ্যা ১০ এবং নারীর সংখ্যা ১০ হলে বিয়ের ময়দানে পুরুষের সংখ্যা হবে ১০ এর চেয়ে ৩/৪ কম এবং নারীর সংখ্যা হবে ১০ এর চেয়ে ৩/৪ বেশি। অলওয়েজ। বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নারী-পুরষের পারিবারিক ব্যবস্থা যেখানকার এক্সক্লুসিভ সামাজিক বৈশিষ্ট্য সেখানে (উপরে বর্ণিত ফ্যাক্টরগুলোর কারণে) প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা বিয়ের ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে ইতিবাচক থাকার কথা। এ ধরনের সমাজে বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী নিছক ব্যক্তিগত প্রয়োজনের বাইরেও নানাবিধ সাপোর্ট পেয়ে থাকে। ওভারঅল নারীদেরকে এ ধরনের সাপোর্ট দিতে গিয়ে পুরুষেরা বিয়ের ময়দানে পিছিয়ে পড়ে। একপক্ষ এগিয়ে থাকে আর এক পক্ষ পিছিয়ে থাকে। এর ফলে উপরে যা বলেছি, বিয়ের ময়দানে বিবাহ ইচ্ছুক নারীর সংখ্যা বৈবাহিক দায়িত্বপালনে সক্ষম পুরুষের তুলনায় বেশিসংখ্যক হয়ে থাকে।
এই সহজ হিসাবের সহজ পরিণতি হলো নানা ধরনের বিবাহবহির্ভূত ‘সম্পর্ক-চর্চা’ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া অথবা পুরুষের বহুবিবাহ।
যে সমাজে পুরুষের বহুবিবাহকে অত্যন্ত নিন্দনীয় হিসেবে গণ্য করা হয় সেখানে পুরুষেরা গোপনে বিয়ে করবে অথবা পরকীয়া করবে এবং স্ত্রী থাকা পুরুষদেরকে যেসব নারীরা স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে চায় তারা এ ধরনের গোপন বিয়েতে সম্মত হবে অথবা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়াবে, এটাই স্বাভাবিক।
ওয়েস্টার্ন প্যারাডাইমকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়ে, ইন্ডিয়ান প্যারাডাইমের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে কার্যত বসবাস করে, বিয়ে কিংবা যে কোনো বিষয়ে আমরা যদি ইসলামী শরীয়াহর শর্ত পূরণ করে চলতে চাই তাহলে তা শেষ পর্যন্ত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না, একটা না একটা গ্যাঞ্জাম লাগবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, সাহাবীদের সমাজে বহুবিবাহ ছিল কিন্তু গোপন বিয়ে ছিল না। আবার একাধিক বিয়ে নিয়ে যে সোশ্যাল স্টিগমা, সেটাও তো তখন ছিল না। সহজ বিয়ের পরিবেশে কেউ যখন ব্যভিচার করবে কিংবা গোপন বিয়ে করবে, তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তার আগে জরুরি হলো সহজ বিয়ের পরিবেশ তৈরি করা।
কোনো কিছু সমর্থন বা বিরোধিতা করার সময়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে, আসলে ঠিক কোন অবস্থান থেকে আমি এটিকে সমর্থন বা বিরোধিতা করছি। নিজের বেসিক প্যারাডাইম সম্পর্কে সব সময় সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতাকে বেসিক প্যারাডাইমের আলোকে গড়ে তোলার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হবে।
নিছক সামাজিক বাস্তবতার দোহাই দিয়ে কোনো একটা ব্যবস্থা নেওয়ার পরিণতি হবে ঝড়ের মোকাবেলায় দিক হারিয়ে চলতে থাকা জাহাজের মতো। ঝড়ের মোকাবেলা করতে হবে। একই সাথে দিক হারিয়ে ফেলাও চলবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। একই সাথে পরিস্থিতির আলোকে স্বল্পমেয়াদী ও নগদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ডেমেইজিং টেনডেন্সি হতে বের হয়ে আসতে হবে।
সমাজ এক দিনে গড়ে ওঠে না, কিংবা একদিনে ভেঙ্গে যায় না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী ও নিরন্তর প্রচেষ্টার ব্যাপার। আপনি যেভাবে কাজ করবেন আপনার সামাজিক বাস্তবতা ক্রমান্বয়ে সেভাবে গড়ে ওঠে। একজন সমাজকর্মী হিসেবে আমার এই কথাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করবেন। ভুল বুঝবেন না, অনুরোধ করি।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Nazia Nabi: নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে, বিয়ের সব শর্ত পূরণ করে যদি কোনো ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে তাহলেই তো তা বৈধ সম্পর্ক। এখন তারা এটা গোপন করলো না প্রকাশ করলো সেটা তাদের ব্যাপার। এই দম্পতি যদি যেনা থেকে বাঁচার জন্য বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কে বৈধতা আনে এবং সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূলতা থেকে বাঁচার জন্য সেই বিয়ে গোপন করে তাহলে সমস্যা কোথায়?
কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা যদি পরিবারের অসম্মতির কারণে বিয়ে না করে ব্যভিচার করে সেটা ভালো নাকি পরিবার, সমাজ অসম্মতি প্রকাশ করলেও, বিয়ের শর্তপূরণ সাপেক্ষে বিয়ে করে বৈধ মিলন ভালো? এ ক্ষেত্রে তারা বিয়েটা গোপন রাখলে সমস্যা কোথায়?
আমি মনে করি বিয়েটাকে কঠিন করে দেখিয়ে, গোপন বিয়ের ট্যাগ লাগিয়ে পরকীয়া, ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে।
“গোপন বিয়ে”। বিয়ে আবার গোপন হয় কীভাবে? মুসলিম রীতির কথা বলি— একজন কাযী, দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি মুসলিম শরীয়া অনুযায়ী দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে করে তাহলেই তো সেটা পূর্ণতা পেলো। একে অন্যের জন্য বৈধ হলো। ৩ জন (কাযী, ২ জন সাক্ষী) উপস্থিত থেকে দুই জনের বিয়ে হলো। ৫ জন তো জানলোই। গোপন হলো কীভাবে? এখন কি ঢাক ঢোল পিটায়ে জানান দিতে হবে যে আমরা বিয়ে করেছি, সব জৈবিক কার্যকলাপ করার জন্য সমর্থন স্বরূপ আপনাদের জানাচ্ছি?
বিয়ে, বিয়েই। এটা গোপন হোক বা প্রকাশ্য, যদি ধর্মীয় সকল শর্ত পূরণ হয়।
তাহিরা আলী: ভাইয়া, দুই, তিন অথবা চার বিবাহ জায়েজ। সুরা নিসার তিন নং আয়াতে এই নির্দেশ আছে। কিন্তু ওই আয়াতের আরো একটি অংশে আল্লাহ বলেছেন ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কথা। আগে আমরা দেখতাম একই ঘরে দুই তিন সতিন একই সাথে বসবাস করতো। কারণ তাদের চাহিদার ব্যাপারে তাদের স্বামী সচেতন থাকতেন। কিন্তু বর্তমান সমাজে দেখা যায় দ্বিতীয় বিয়ের পর স্বামী তার পরের স্ত্রীর দিকেই বেশি ঝুঁকে যায়। প্রথম স্ত্রীর চাহিদা, অধিকার ও স্থান সম্পর্কে একদম উদাসীন হয়ে পড়ে। এজন্য এখনকার যুগে মেয়েরা স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে চায় না।
দ্বিতীয় বিবাহ বা বহুবিবাহের কনসেপ্টের পাশাপাশি আপনার লেখায় বহুবিবাহ সামলানোর জন্য ছেলেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো নিয়ে লিখলে ব্যাপারটা আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হবে ইন শা আল্লাহ।
Mohammad Mostafijur Rahman ShahAlam: তাহিরা আলী, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আপনি সূরা নিসার ৩ নং আয়াতের কথা বলেছেন, সেইসাথে পরবর্তীতে সুরা নিসারই ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কী বলেছেন সেটাও ভেবে দেখবেন আশা রাখি। ইনসাফ করার ব্যাপারটি ক্লিয়ার হতে এই পোস্টটি পড়তে পারেন।
Muhammad Sajal: বাংলাদেশে গোপন বিয়ের প্রধান কারণ সামাজিক। বাংলাদেশের হিন্দু ফ্যামিলি প্যারাডাইমে অবস্থান করা প্রো-সেক্যুলার সমাজ মানুষকে এই ধরনের কাজে বাধ্য করে।
বিধবা বিয়ে, ডিভোর্সি বিয়ে এবং দরিদ্র-অসহায় নারীদের বিয়ে করার ক্ষেত্রে সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্ত নারীরাই মূলত কঠিনতম বাধার সৃষ্টি করে থাকেন। এনাদের অনেকে আবার তথাকথিত নারীমুক্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত। দুঃখজনক দ্বিচারীতা।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশী পুরুষদের বৃহত্তর অংশের যথেষ্ট মানসিক অপরিপক্কতা থাকে, ফলে তারা পারিবারিক জীবনে আদল-ইনসাফ কায়েমে ব্যর্থ হয়। হোক তা একজনের সাথে বা দুইজনের সাথে।
বিধবাদের বাংলাদেশে কেন বিয়ে হয় না? সহজ, সধবারা বিধবাদের জায়গা দেয় না। একজন ৪০ বছর বয়সী বিধবাকে বিয়ে করতে পারে একজন কাছাকাছি বয়সের পুরুষ। কিন্তু সধবারা সুযোগ দেয় না। বরঞ্চ তাকে সতীত্ব রক্ষার নসিহত দিয়ে বাকি জীবন পার করতে বলে।
এই হিন্দু প্যারাডাইম খুব সহজে দূর হবার কোন সম্ভাবনা আমি দেখি না।
Shamim Noor: ১। সমসাময়িক বাস্তবতার নিরিখে, বিবাহ ও সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য যে লেভেলের পারস্পরিক সমঝোতা এবং সত্যিকার অর্থে সেক্রিফাইসিং মেন্টালিটি পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে থাকা দরকার, সেটা পরিবারগুলোর মধ্যে অনেকটাই ধ্বংসের মুখে। ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, ক্রিটিকাল এনালাইসিস করে, বহুবিবাহ কনসেপ্টটি শুধু একপাক্ষিকভাবে পুরুষদের ব্যাপার তা আমার কাছে আর মনে হয় না। বহুবিবাহ বিষয়টি, ব্যক্তি বা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি থেকে সরে এসে, গবেষণা করলে হয়তো দেখা যাবে, বিয়ে না করেও শারীরিক চাহিদা পূরণের মনোবাসনা (বিকৃতভাবে friends with benefits) মেয়েদের বেলায় ও প্রযোজ্য হতে পারে। আপনার একটি লেখায় পড়েছিলাম, কোনো মেয়ে, মি. সেভেন্টিকে পেলে মি. সিক্সটিকে নিয়ে থাকতে চাইবে কেন? বা থাকবেনা। বিষয়টি প্রেম বা সংসারের বেলায়ও যদি নারী পুরুষের মধ্যে ঘটতে থাকে, তাহলে কখনোই স্ট্যাবল থেকে সংসার করা হবে কিনা, তা নিয়ে আমি সন্দিহান স্যার! সমস্যার এটা একটা দিক।
২। আবার, অন্য একটা বিষয় হলো, যে বা যারা ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে বহুবিবাহকে অনুসারীদের কাছে বয়ান করেন, তারাই-বা কেন তাদের স্ত্রীদের কাছে দ্বিতীয় বিয়ের কথা কনভিন্সিং ওয়েতে বলতে বা বুঝাতে পারেনা? গত কয়েক মাসে যে ক’জন ধর্মীয় ব্যাখ্যা দানকারীদের ঘটনা মিডিয়াতে আসলো তাদের কেইসগুলো আসলেই ক্রিটিক্যালি দেখার যথেষ্ট সুযোগ আছে। যাদের কাছ থেকে অনুসারীরা শিখবেন, তারাই ইনফ্যাক্ট এসব বিষয় নিজেদের লাইফে ডিসেন্টভাবে পালন করতে পারছেন না! দ্বিতীয় বিয়ের এতোই প্রয়োজন হলে, নিজের ইচ্ছের কথাতো অন্তত নিজের বউকে বলতে পারে আগে (বিয়ে হোক, বা না হোক)। শেয়ার করলে তো আর সংসার ভেঙে যাবেনা?
৩। সর্বোপরি, দু’পক্ষের এমন বহু হিডেন দোষ, মানসিক বিকৃতিপনা এবং অমীমাংসিত বিষয়কে চাপা রেখে, বিবাহ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে খুব সহজে সহজ করার কথা হিতে বিপরীত ফলাফলই বয়ে আনবে বলে মনে করি। নবী-রাসূলদের জামানার যে সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিলো, তা তো এখন আর নেই। বরং আমি মনে করি, বিয়ে, সংসার এসব ব্যাপারে খুব বেশি সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে না পারলে, এমন একটি জায়গা থেকে নিজ দায়িত্বে, নিজেকে নিজে বুঝ দিয়ে কেটে পরা উচিত। মাঝে মধ্যে তো মনে হয়, আধুনিক এই সময়ের মানুষগুলো বিবাহকে কথায় কথায় আরো সস্তা ও সহজই করে ফেলেছে। এই বিয়ে করে ফেলছে, আবার মন চাইলেই তা ভেঙে ফেলছে। তাই আমি মনে করি সহজ বিয়ে নয়, বরং বিবাহ পরবর্তী যে গুরু দায়িত্ব আছে সেটাই বরং আলোচনার বিষয় হওয়া উচিৎ।
Mohammad Ishrak: বিয়ে সংজ্ঞানুসারেই সামাজিক বিষয়। কাজেই সমাজের অজ্ঞাতে বিয়ে oxymoron জাতীয় ব্যাপার। ফেকাহর যে ফাঁক-ফোকর দিয়ে গোপন বিয়ে করা হয় সেটা বিয়ে জিনিসটা কত সহজ সেটার জন্যই মূলত আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় গোপন বিয়ে এবং ব্যভিচারের মধ্যে কোনো তফাত করা যাবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, স্বাভাবিক অবস্থা বিদ্যমান আছে কিনা।
Waky Mahmud: একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। গোপন আসলে কতটুকু ওপেন না হওয়া বুঝাবে? আমার পরিবার জানে, আমার গোত্রপতি জানেনা। কিংবা আধুনিক সময়ে আমি ফেসবুকে প্রচণ্ড সরব। কিন্তু সেখানে রিলেশনশিপ অপশন চেঞ্জ করিনাই বিয়ের পরেও। এতে আমি আমার ফেসবুক কমিউনিটিতে এখনো সিঙ্গেল। এখন কতটুকু ওপেননেসকে আমরা গোপন হিসেবে ঠাহর করবোনা?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: গোপন কিংবা প্রকাশ্য বিয়ের সীমারেখা আমরা যাই নির্ধারণ করি না কেন, আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ইসলামী শরিয়াহ বিয়ের তথা প্রকাশ্য বিয়ের সাক্ষ্য হিসেবে ন্যূনতম দু’জন পুরুষের উপস্থিতিকে শর্ত করেছে।
Waky Mahmud: এই লুপেই পড়ে আজকে এটা ভাইরাল টপিক। সাম্প্রতিক সময়ের কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক লিডার বা ভাইরাল ধর্মীয় বক্তা তার বিয়েতে হয়তোবা (নট কনফার্মড) শরিয়তকে পূর্ণতা দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তার খ্যাতির ব্যাপ্তির সমান বিষয়টিকে পাবলিক করেননি। ফলে একই জিনিস তার ব্যক্তিগত পার্স্পেক্টিভে প্রকাশ্য, পাব্লিকের পার্স্পেক্টিভে গোপন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইসলামী শরিয়াহ যেটাকে ফরয-ওয়াজিব করে নাই সেটাকে কোনো কালচারাল কনটেক্সটে ফরয-ওয়াজিব বানিয়ে নেওয়া যাবে না। আবার মিনিমাম নেসেসারি রিকোয়ারমেন্ট দেয়া হয়েছে যে বিষয়ে কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে সাময়িকভাবে সেই রিকোয়ারমেন্ট এর অতিরিক্ত কিছু সামাজিকভাবে আবশ্যকীয় করে নেওয়া, এটা হতে পারে।
যেমন, পুরুষেরা সতর ঢাকার অতিরিক্ত হিসাবে জামা কাপড় পরিধান করে। এই অতিরিক্ত জামা কাপড় পরাকে কেউ যদি ফরজ করে নেয় বা সে রকম দাবি করে তাহলেই সমস্যা।
মুবাহ, সুন্নত ও ওয়াজিব, এগুলোর সিরিয়ালিটিকে মেন্টেইন করতে হবে। কোনো সুন্নতকে কেউ যদি হারাম করে ফেলে তখন ওই সুন্নত পালন করাটা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। আবার কোনো মুবাহ তথা অনুমোদিত কাজকে কেউ যদি সুন্নত/ওয়াজিব বানিয়ে ফেলে তাহলে সেই মুবাহ কাজটিকে যথাসম্ভব বাধাগ্রস্থ করার মাধ্যমে সেটাকে সেটার উপযুক্ত সামাজিক অবস্থানের ফিরিয়ে আনতে হবে।
Abdul Muttakin: তিনি প্রথম স্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় বিয়ে গোপন করেছিলেন। অথচ কোনো এক কারণে আমাদের অনেকের ধারণা দ্বিতীয় বিয়ে অবশ্যই প্রথম স্ত্রীর অনুমতিসাপেক্ষ হতে হবে। আমাদের এমন ধারণাকে কাজে লাগিয়ে সরকার তার প্রতি নিবর্তনমূলক নীতি গ্রহণ করেছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টিকে গোপন করা একটা অ-ফৌজদারি অপরাধ। এটি একটা নিন্দনীয় কাজ। এই ধরনের নিন্দনীয় কাজ কেউ করলে তাকে তাযির করা (অর্থাৎ সংশোধনমূলক মৃদু শাস্তির ব্যবস্থা করা) যেতে পারে। এবং মানুষ এ ধরনের নিন্দনীয় কাজ যদি ব্যাপকভাবে করে তাহলে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কী সমস্যা হয়েছে, যার কারণে মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু, প্রথম স্ত্রী কিংবা কারো কাছ থেকে গোপন করার কারণে দ্বিতীয় বিয়েটি বাতিল হবে না।
মোঃ কামাল: বিয়ে একটা সামাজিক বিষয়। সেখানে গোপনীয়তা থাকবে কেনো?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অতএব, এ ধরনের সমস্যা যদি থাকে, সেটার জন্য যদি নিছক ব্যক্তি দায়ী হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর এটার জন্য যদি সমাজব্যবস্থা দায়ী হয় তাহলে আগে সমাজ ব্যবস্থাকে ন্যূনতম মানে সংশোধন করতে হবে। সহজ বিয়ের পরিবেশ তৈরি না করে গোপন বিয়েকে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করে সেটাকে বাতিল করা এবং শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ সুস্থ সমাজ গঠনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে।