বিয়ের ব্যাপারে দেখতে হয়, এই সম্পর্কের মাধ্যমে আমি কী কী সুবিধা পেতে যাচ্ছি। ডিভোর্সের ব্যাপারে দেখতে হয় উল্টা দিক থেকে।

ডিভোর্সের দিকে যাওয়ার আগে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে সেপারেশানের মাধ্যমে স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে আমার কী কী অসুবিধা হতে পারে, তা নিয়ে। সেই অসুবিধাগুলোকে আমি কীভাবে কাটিয়ে উঠবো সে ব্যাপারে আমার বাস্তবসম্মত চিন্তা ও পরিকল্পনা থাকা জরুরী।

ডিভোর্স দিলে আমি এই এই নগদ লাভ করবো, তাই আপাতত বের হয়ে পড়ি। পরে কী হবে তা পরে ভাবা যাবে, অথবা একটা কিছু তো হবেই — এই ধরনের চিন্তা থেকে যারা ডিভোর্সের দিকে যায়, অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তারা শেষ পর্যন্ত রিগ্রেট করে।

দেখা যায়, বিয়ের সময়ে লোকেরা, বিশেষ করে মেয়েরা এবং তাদের পক্ষের লোকজন, আগেভাগেই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নিয়ে ওভারকনসার্নড হয়ে পড়ে। তারা ধরেই নেয়, এই বিয়ে নাও টিকতে পারে। তখন কী হবে, এই ধরনের ভুল চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিতে থাকে।

এখনকার সময়ে, বিশেষ করে শিক্ষিত মহলে, কমবেশি পারস্পরিক অবিশ্বাস নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুরু হয় বিয়ে নামক একটা আস্থা ও ভালবাসার সম্পর্ক। বিয়ের শুরুতে অনাস্থার যে বীজ রোপণ করা হয় দাম্পত্য কলহজনিত অনুকূল পরিস্থিতিতে অনেক সময়ে তা বিষবৃক্ষ হয়ে উঠে।

মেয়েদের দিক থেকে বিয়ের সম্পর্ককে পোক্ত করার ব্যাপারে একটা প্যারাডক্স কাজ করে।

হিসেব নিকেশ করে বিয়ের সম্পর্ক না করলে সেই সম্পর্ক (নিরাপদ অর্থে) মজবুত হয় না। আবার স্বামীর ওপর স্ত্রীর কার্যকর নির্ভরতা বা ডিপেন্ডেন্সি না থাকলে কোনো পারিবারিক সম্পর্ক সুন্দরভাবে টিকে থাকতে পারে না। ট্রাডিশনাল জেন্ডার রোল যেখানে উপেক্ষিত সেখানে বিয়েটা লিভ টুগেদারের বেশি কিছু নয়।

মেয়েরা এজন্য এমন পুরুষকে বর হিসেবে পেতে চায় যার কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। জামাই-বউ সমান সমান অথবা জামাইয়ের কাছ হতে বউ বেশি, এই ধরনের দাম্পত্য সম্পর্ক হওয়াটাই দুষ্কর, কোনোক্রমে হলেও তা ভালো হওয়াটা অসম্ভব-প্রায়। চাইলে যেমন আপনি ফিজিক্সের নিয়ম ভাঙতে পারেন না, তেমন করে চাইলেই আপনি রিলেশনাল ফিজিক্সের কোনো নিয়মকে লঙ্ঘন করতে পারেন না।

পুরুষেরা যেমন বাইনেচার পলিগেমাস, তেমন করে মেয়েরা বাইনেচার হাইপারগেমাস। ক্রসকালচারালি অ্যান্ড হিট্রিকেলি ইটস ট্রু। নো ওয়ান ক্যান ডিনাই ইট। ইট ইজ দেট মাচ্চ সিম্পল অ্যান্ড ইনএভিটেবল।

কথায় কথায় লোকজন আজকাল, বিশেষ করে মেয়েরা, টক্সিক রিলেশানের কথা বলে। কীসে কীসে যে তাদের মধ্যে টক্সিসিটি তৈরী হয়, তা আল্লাহ মা’লুম। টক্সিক রিলেশানের যেসব লক্ষণ ও উপাদান নিয়ে তারা সদাউদ্বিগ্ন ও অভিযোগ-প্রবণ থাকে সেগুলোকে যদি আমরা আসলেই টক্সিক হিসেবে ধরে নেই, তাহলে মানতে হবে আমাদের ইমিডিয়েট আগের জেনারেশন পর্যন্ত নর-নারীর দাম্পত্য সম্পর্কগুলো ছিল, নারীদের দিক থেকে, টক্সিসিটির এক একটা বিশাল ডিব্বা বা ডিপো।

আমাদের আগের জেনারেশনের নারীরা ছিল নির্যাতিত, এটি নারীবাদী বয়ান। বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ব এই ন্যারেটিভকে সমর্থন করে না মোটেও।

আমার বাবার সাথে আমার মায়ের সারাক্ষণ ঝগড়া লেগে থাকতো। একজন শুরু করছে তো চলছেই। আরেকজন না পারতে চুপ থাকলেও ফাঁকেফুকে যুঁতসই উত্তর দিতে দেরী হতো না এতটুকু। হ্যাঁ, আমি আর আমার অপর আট ভাই-বোন আমরা ফাইটিং কাপলের সন্তান। অথচ, কী আশ্চর্য, এখনকার হিসেবে অন্তত মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই সবদিকে মাশাআল্লাহ অনেক ভালো ছিলাম, এবং এখনো আছি।

এখনকার কাপলদের মতো যত সব আজগুবি ভালবাসার হিসেবেনিকেশে দিনরাত্রি মগ্ন থাকার মতো অবসর আগের জেনারেশনের লোকদের ছিল না। তাদের জীবনে ছিল স্ট্রাগল এবং রিয়েল সোশ্যাল এনগেইজমেন্ট। দাম্পত্যজীবন ছিল তাদের জন্য সুখ ও শক্তি পাওয়ার একমাত্র সোর্স। তাদের কোনো অল্টারনেটিভ ছিল না।

আমার মা মারা যাওয়ার সময় আমি টানা ছয় দিন ছয় রাত উনার বিছানার পাশে শুয়ে-বসে ছিলাম। কেনসার মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় তখন তিনি খুব একটা কথা বলতে পারতেন না। আমি কয়েকবার উনাকে জিজ্ঞাসা করেছি, এই কঠিন সময়ে কার কথা আপনার মনে পড়ছে? প্রত্যেক বারই উনি একই উত্তর দিয়েছেন।

হাতের দু’আঙ্গুল তুলে অতি কষ্টে উনি বলেছেন, ‌‌‍“দু’জনের কথা। আমার বা’জান আর তোর বাবা।”

আমার ওয়াইফকে জিজ্ঞাসা করলে আমার ধারণায় উনি বলবেন, অনেক খারাপ ব্যবহার তিনি আমার কাছ হতে পেয়েছেন। অথচ আমি ছাড়া উনার জীবন অচল। বিয়ের পর হতে উনার জীবনের যত সুখ আর অর্জন তা সব আমার কাছ হতে বা আমার সহায়তায় উনি পেয়েছেন।

অধিকাংশ স্ত্রীর কাছে স্বামী হচ্ছে পৃথিবীর প্রিয়তম ব্যক্তি।

উহুদ যুদ্ধের পরে এক মহিলাকে খবর দেয়া হলো তার ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। শুনে তিনি সবর করলেন। এরপর বলা হলো তার পিতা শাহাদাত বরণ করেছেন। এবারও তিনি সবর করলেন। এরপর তাকে জানানো হলো তার স্বামীও শহীদ হয়েছেন। এ’কথা শোনামাত্রই তিনি চিৎকার করে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। কাজে কাজেই …!

দাম্পত্যজীবন, একটা জটিল সমীকরণের ব্যাপার। কনজুগাল লাইফের কেমিস্ট্রি বাইরের লোকেরা বোঝা অসম্ভব-প্রায় ব্যাপার। এখানে প্রচলিত সব যান্ত্রিক যুক্তি অচল। দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হয় satisficing পদ্ধতিতে। অন্ততপক্ষে optimal পদ্ধতিতে।

তাই কথায় কথায় বিয়ে ভাঙা যায় না। আবার সনাতনীদের মতো এটি কোনো আধ্যাত্মিক ও অচ্ছেদ্য সম্পর্কও নয় যে এটি কোনোক্রমেই ভাঙা যাবে না। বিয়েটাকে সহজভাবে নিতে হবে। তালাককে দেখতে হবে একটা অগত্যা বিবেচনা হিসেবে ।

আমাদের সমাজে কথায় কথায় পুরুষেরা যেভাবে স্ত্রীদেরকে তালাক দেয় তা আমি ন্যায্য বলে তো মনে করিই না, এমনকি শরীয়তসম্মত বলেও মনে করি না। ‌‌‌‌‘তালাকের যেসব বিধান আপনি জানেন না’ – এই শিরোনামে একটি বিস্তারিত লেখায় প্রচলিত তালাক প্রথার থিওলজিকেল প্রবলেমগুলো তুলে ধরেছি। পড়ে দেখতে পারেন।

মন্তব্য

আব্দুল্লাহ আল আমিন: আমি পারিবারিক ব্যাপারে আইনী সহায়তা দেই। আমি দেখি খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ে ডিভোর্স দেয়া হয়। যেমন, হাসবেন্ড করোনার টিকা নিয়েছে, ওয়াইফ এজন্য ডিভোর্স দিবে। কারণ ওয়াইফ করোনার টিকা নেয়ার বিরুদ্ধে। এই গত মাসের ঘটনা। ছেলেরাও একই রকম কাজ করে, অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ে ডিভোর্স দেয়।

আমাদের জেনারেশনের কোনো বিষয়কে সাধারণভাবে ডিল করার ক্ষমতা কম। তারা ছোট ব্যাপারকে বিশালভাবে চিন্তা করে বড় বানায়ে ফেলে।

ফরিদুল আলম: দাম্পত্য জীবনটা হলো মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ব্যাপার। মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া ছাড়া হয় না। ঝগড়া হলে মনে হয় একে নিয়ে আর ঘর করা যাবেনা। ঝড় থেমে গেলে, রাগ পড়ে গেলে মনে হয় একে ছাড়া চলেই না।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *