গেছিলাম হাটহাজারী সদরে একটা কাজে। আজ সন্ধ্যায়। একা। কাজ শেষে ইউনিক হাসপাতালের অপজিটে একটা চায়ের দোকানে বসেছি। নান রুটি দিয়ে চা খাচ্ছিলাম চট্টগ্রামের ভাষায় বোরাই বোরাই। অর্থাৎ চায়ের মধ্যে নানের টুকরা চুবিয়ে চুবিয়ে। আমার টেবিলের অপজিট সাইডে ওরা বসছিল। আবদুল্লাহ আর শফি। তাদের বাড়ি জোবরা। হ্যাঁ, ড. মুহাম্মদ ইউনুস খ্যাত তেভাগা খামার, জোবরা। ওরা এসছে মোটর সাইকেলের টায়ার কিনতে।

শফির বয়স কুড়ি। আব্দুল্লাহর তেইশ। শফি দু’বছর হতে ট্রাক চালায়। আব্দুল্লাহর আছে লাইট ডেকোরেশনের দোকান। দু’জনে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। শফির মাসিক আয় পঞ্চাশ হাজার প্লাস। আবদুল্লাহ’র আরেকটু বেশি। দু’তিন বছরের মধ্যে তারা বিয়েশাদী করার চিন্তাভাবনা করছে। ওরা জোর করে আমার বিলও দিয়ে দিছে। তাদের ছবি নিয়ে লিখবো, তাতে তাদের সম্মতি আছে কিনা তা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা খুশী।

তাদেরকে বললাম, ‘কাজ না করে তোমরা যদি এখন ইন্টার বা ডিগ্রিতে পড়তে তাহলে তো তোমরা উল্টা মা-বাবা হতে টাকা নিতে? মাসে কমচে কম দু’চার হাজার?’ তারা আমার সাথে একমত হলো।

কেইস স্টাডি ২

মাসখানেক আগে আমার বড় আপা এক পারিবারিক আড্ডায় বললেন, ‘দেখ, ছেলেগুলোর চেয়ে মেয়েগুলো লেখাপড়ায় কতো সিরিয়াস, ইত্যাদি ইত্যাদি ….’। বড় আপা রিটায়ার্ড মেডিকেল প্রফেসর। আমি উনার পরের আরো চার জনের ছোট। তাও উনার মুখের ওপরে বললাম,

‘পড়ালেখা নামক এই ফ্যান্টাসিতে সময় অপচয় করার সুযোগ ছেলেদের নাই। তাদেরকে ফ্যামিলি প্রোভাইড করতে হয়। ছোট বয়সে বাবা-মায়ের। এরপরে নিজের।’ বুঝতেই পারছেন, উক্ত পারিবারিক আড্ডায় এই ইস্যুতে তখন কথা আর আগায় নাই।

কেইস স্টাডি ৩

আমার সেল ফোনে ‘আবুল কালাম খেজুরের রস’ এভাবে কালাম ভাইয়ের নাম সেইভ করা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রেল গেইটের কাছে উনার বাড়ি। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে ‘মুরাতে’ যাওয়া আসা করেন। পাহাড়কে চট্টগ্রামের ভাষায় মুরা বলে। ওখানে উনার গরু আছে। খেত-খামার আছে। লোকেরা খেতের পাশে একটা চালার মধ্যে গরু বেঁধে আসে। কেউ চুরি করে না।

তো, হাটহাজারী যাওয়ার জন্য বের হয়েছি দক্ষিণ ক্যাম্পাসের বাসা হতে। কালাম ভাই তখন মুরা থেকে ফিরছেন। নিপবনের সামনে থেকে উনাকে জিপে তুলে নিলাম। উনার সাথে আলাপে জানলাম, উনার গরুগুলোর মধ্যে একটা বড় বৃষ, মানে ষাড় আছে। বললেন, উনার ছোট ভাই এইটাকে আগামী কোরবানিতে জবেহ করার জন্য রেখে দিতে বলেছেন। তাই বিক্রি করেন নাই।

ওই ভাই উনার দু’জনের ছোট। ক’বছর হতে ডুবাই থাকে। সেখানে ওর গাড়ির গ্যারেজ আছে। সে যখন ছোট ছিল তখন তাকে কালাম ভাই গাড়ির গ্যারেজে কাজ করতে দিছিলেন। সে ভাই ইতোমধ্যে গণ্ডা চৌদ্দ লাখ করে চব্বিশ গণ্ডা জায়গা কিনেছে। আমাদের এখানে দুই শতকে এক গণ্ডা।

কখনো কোনো গাড়ির গ্যারেজে গেলে সাথে যদি আমার ওয়াইফ গাড়িতে থাকে সে অবাক হয়ে যায়। আমাকে বলে, ‘দেখছো, ছোট ছোট ছেলেরা কীরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছে …!’ প্রি-টিন এইজ এবং আর্লি টিন এইজের এই ছেলেরা বাড়ি হতে দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। গ্যারেজের পক্ষ থেকে তাদেরকে বেলা এগারোটা আর বিকেল পাঁচটার দিকে নাস্তা দেয়া হয়। হেল্পারদের কোনো বেতন নাই।

ইন দেয়ার লেইট টিন এইজ, তারা এক একজন মিস্ত্রী হয়ে উঠবে, এই আশায় সপ্তাহে ছয়দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করে।

একদিন আমার সামনে এক মিস্ত্রী গাড়ির চাকা খুলতে দেরী হওয়াতে এক হেল্পার ছেলেকে ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো। আমি কিছু না বলা সত্বেও মিস্ত্রী আমাকে ওজরখাহী করলো, ‘স্যার, আমরাও এভাবে মার খেয়ে খেয়ে কাজ শিখছি। এটাই এখানকার নিয়ম।’

হেল্পারদের বাবা-মা তাদের ছেলেদেরকে কাজে পাঠানোর ব্যাপারে সিরিয়াস। তাই তো দেখবেন, গ্রামের স্কুলগুলোতে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা বেশি।

কেইস স্টাডি ৪

আজ আমার একটা ‘পরীক্ষার ডিউটি’ ছিল। প্রথম বর্ষ বি.এ. (সম্মান) পরীক্ষার আজ প্রথম মূল পরীক্ষা। পুরাতন কলাভবন ৩২৭নং কক্ষে পরীক্ষা শুরুর আগে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সত্যি করে বল তো, অন্য কোনো ‘ভাল সাবজেক্টে’ চান্স না পাওয়ার কারণ ছাড়া ফিলসফিকে পছন্দ করে ভর্তি হয়েছো, এমন কি কেউ আছো?’।

বলাবাহুল্য, তারা ছিল নিরুত্তর। তারপর আমি বললাম, ‘একটা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়তে হবে। এই সাবজেক্ট এসছে। তাই এখানে পড়তে আসা। তাই তো?’ গেজ ইট, তাদের সবার উত্তর ছিল হ্যাঁ-সূচক। ফিলসফি একবছর পড়ে তারা কী বুঝছে তা জিজ্ঞাসা করার সময়ও ছিল না, মনমানসিকতাও ছিল না।

পেশাগত কর্মজীবনের মোহনায় এসে পল সায়েন্স আর সয়েল সায়েন্সের মধ্যে থাকে না কোনো পার্থক্য‌। একাকার হয়ে যায় ফিজিক্স আর ফিলসফি। mp3 হয়ে ওঠে সব কঠিন কঠিন সাবজেক্টে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা উচ্চশিক্ষিত পন্ডিতদের(?) সার্বক্ষণিক সঙ্গী।

এখন আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন-

এহেন শিক্ষার কী মানে? বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত উচ্চশিক্ষা কি মোটেরওপরে একটা টোটালি ফেইলড প্রজেক্ট?

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Shakil Mia: শিক্ষা মানে কী? শিক্ষা মানে হচ্ছে শাসক গোষ্ঠীর আদর্শকে নাগরিকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া কৌশল মাত্র। শাসক গোষ্ঠী নিজের সুবিধা মতো সিলেবাস তৈরি করে। যেখানে শ্রেণী বিভাজনকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। আর যাই হোক সব মানুষের কল্যাণ অন্তত শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব নয়।

Mohammad Mozammel Hoque: শিক্ষা বলতে আমরা কি বুঝি বা কি বুঝায়, সেইটা আগে মিনিমাম ক্লিয়ার হওয়া উচিত। তারপর এই আলোচনাটা আসে, শিক্ষা কি সফল, না ব্যর্থ?

Khondoker Ahmed Zakaria: একেবারে ফেইল বলা যাবে না। তবে উদ্দেশ্যহীন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে তাই পড়ি। কী পড়ি তা অধিকাংশই বুঝি না। অবশ্য অনেকের ভালো একটা ফলাফল করার উদ্দেশ্য থাকে।

Mohammad Mozammel Hoque: শিক্ষা যদি হয় কাজের জন্য তাহলে এক বিবেচনা। আর শিক্ষা যদি হয় শুধুমাত্র শিক্ষার জন্য, একটা বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা হিসেবে, তাহলে অন্য ধরনের বিবেচনা।

কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় ফিজিক্স এবং ফিলসফি এক হয়ে গেছে, পলিটিক্যাল সায়েন্স এবং সয়েল সাইন্স এর মধ্যে কোন তফাৎ নাই, ওশানোগ্রাফিও যা জিওগ্রাফিও তা, তাহলে বুঝতে হবে কোথাও আমাদের বড় ধরনের একটা ভুল হচ্ছে।

Sharfuddin Ahmed: শিক্ষার উচ্চতা অনেক। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই ফ্রড

Mohammad Mozammel Hoque: উচ্চতায় নিয়ে যায় সে শিক্ষা কোন শিক্ষা? নিশ্চয়ই এটি প্রচলিত শিক্ষা নয়। বদরুল আহসানের ভাষায়, (formal) education is certified ignorance

Ataur Rahman Emon: বাংলাদেশের অনার্স মাস্টার্স করেও সাধারণত ৮০-৮৫% ছাএছাএীরা মাইক্রোসফট অফিস, এক্সেল, ইমেইল করা এবং স্ট্যান্ডার্ড সিভি ই তৈরি করতে পারে না। কঠিন সত্য হচ্ছে এসব টুলস এর ৮০-৯০% উপযোগিতা হচ্ছে নিদেনপক্ষে ক্ল্যারিকাল ওয়ার্ক ( কপি পেস্ট টাইপ কাজ) সেই নূন্যতম যোগ্যতা তৈরি করতেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অক্ষম। এক ছোট ভাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ও লেভেল ( SSC সমমান) শেষে সঙ্গত কারনেই পড়াশোনা ইস্তেফা দিয়ে দেশে একটি কলসেন্টার এ জব করে। সেখানে কাজ হচ্ছে বিদেশিদের কাজের সাপোর্ট দেয়া । সে এখন টিম লিডার। একটি বড় টিম চালায়।

এক বন্ধু একবার তার বাসায় দাওয়াত দিছিল তার সব সনামধন্য ইন্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের। সবাই মোটামুটি তখন পড়াশোনা শেষের দিকে। ওই বন্ধুর বড় ভাই একজন গাড়ির মেকানিক এবং মধ্যপ্রাচ্যে গাড়ির গ্যারেজ আছে। উনি মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ এর মত নামি দামি গাড়ির কাজ করেন। প্রসঙ্গক্রমে উনি গাড়ির মেকানিকাল ও টেকনিক্যাল কিছু বিষয় বলতেসিল যেগুলো সাথে থাকা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাএের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল,এমনকি বেশিরভাগ টারমিনলজি ই বুঝতে পারতেছিল না।

আর এক বন্ধু শিল্পপতির ছেলে বিদেশ থেকে স্থাপত্য বিষয়ে পড়ে এসে বাবার ডেভেলপার ব্যবসা দেখাশোনা করে। তার টেকনিক্যাল জ্ঞান এতটা ভাল না যেহেতু সে প্র্যাকটিকালি কাজ করে নি,বাবার ব্যবসায় বসে গেসে, ব্যবসার ব্যবস্হাপনা করে। সে একেকটা প্রজেক্টে নূন্যতম কোটি টাকার নিচে প্রফিট করে না। সে সিভিল ইন্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট সহ অন্যান্য অফিসিয়ালদের অনায়াসে চালায় কারন সে ছোট থেকে ব্যবসা বান্ধব একটা পরিবেশে ছিল।

পড়াশোনা ও জ্ঞান এর ক্ষেএ, প্রয়োগ এবং উপযোগিতা রাষ্ট্র না বুঝলে যা হয় আরকি.. এই ফেইল প্রজেক্ট!!

Sakib Khan: আমার ক্ষেত্রে দেখেন… আমার চাচাতো ভাই আর আমি সমবয়সী!

আমরা একইসাথে JSC দিই ১৩সালে। আমার চাচাতো ভাই তখন পড়ালেখা ছেড়ে ৩ বছর অটোমোবাইল গ্যারেজে কাজ শিখে (১৬ সালের শেষ পর্যন্ত) আমি তখন চট্টগ্রাম পলিটেকনিকে চান্স পেলাম। ১৭সালের দিকে আমার সে চাচাতো ভাই দুবাই যায়! আমি ডিপ্লোমা শেষ করে বের হতে হতে সে বিদেশে একটা গ্যারেজের মালিক!!! এখন আমার মাসিক ইনকাম ১৪হাজার (ফ্রেশার ইঞ্জিনিয়ার) সেই চাচাতো ভায়ের মাসিক ইনকাম ৮০-৯০হাজার। এখন আমার মনে হচ্ছে জেএসসির পর থেকে আমার টোটাল ১০বছর+পড়ালেখার খরচ পুরোটাই লস প্রজেক্ট!!!

Mazharul Islam: খুব সুন্দর লিখেছেন স্যার। উচ্চশিক্ষা নামের মরীচিকার পেছনে বিভ্রান্ত পতঙ্গের মত ছুটছে আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা। ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট, অথচ সবাই না বোঝার ভাণ করে সদলবলে ছুটছে এবং ছোটার জন্য সকল প্রকার ব্যাবস্থাপনা যোগান দিচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, বলছেও না, করছেও না। বলতে গেলেই এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন এলিয়েন। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই টের পাওয়া যায়, ‘কম শিক্ষিত খেটে খাওয়া’ লোকেরা উচ্চশিক্ষাকে একপ্রকার ছাগলামি মনে করে।

সেই কম শিক্ষিত খেটে খাওয়া লোকেরাই সমাজের প্রকৃত চালিকাশক্তি। আর আমরা উচ্চশিক্ষিতরা প্রধানত ‘বুলশিট জব’ নিয়ে ব্যস্ত আছি। এবং উচ্চশিক্ষা একটা ‘পঞ্জি স্কীম’ ছাড়া আর কিছুই না। এবং সমাজকে অকর্মণ্য বানানোর কারখানা।

 

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *