সাম্প্রতিক মিশর পরিস্থিতিসহ দেশ-বিদেশের নানা ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাতের প্রেক্ষিতে আমার মতো অনেক ইসলামপন্থীর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে– ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ হিসাবে কোনটি সঠিক? গণতন্ত্র নাকি জিহাদ? অনেকে গণতন্ত্রের চরম বিরোধী। আবার অনেকেই সরকার পরিবর্তনের অপরিহার্য পন্থা হিসাবে (ইসলাম কায়েমের জন্যও) গণতান্ত্রিক পন্থার একনিষ্ঠ সমর্থক।
মিশরে কী হচ্ছে, তুরস্কে কী হয়েছে, তিউনিশিয়ার পরিস্থিতি কী, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি কী, বাংলাদেশে কী হচ্ছে– এসব বিষয়ে আশা করি কোনো আলোচনার প্রয়োজন নাই। পৃথিবীর সর্বত্র ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যতসব ষড়যন্ত্র চলছে, ধরে নিচ্ছি সচেতন পাঠকমহল এসব সম্পর্কে অবগত আছেন। সর্বত্রই ইসলাম প্রতিষ্ঠা নিয়ে রাজনৈতিক ইসলামের পক্ষশক্তি চরম অরাজক, বিশৃংখল ও সংশয়পূর্ণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করে যাচ্ছে।
জিহাদের মর্যাদাসূচক সব নস বা দলীলের ভিত্তিতে যথার্থই বলা যায়, সেক্যুলার অথরিটির অধীনে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে (টেকসইভাবে) ইসলাম প্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব নয়। জিহাদই হচ্ছে দ্বীন কায়েমের সুন্নাহভিত্তিক পদ্ধতি। অন্যদিকে যেভাবে বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে, এখন এই বৈশ্বিক-গ্রামে ক্ষমতা অর্জনের একমাত্র স্বীকৃত পন্থা হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এর ধরন যাই হোক না কেন, এর বাহিরে বোমা মেরে, হামলা করে ইসলাম বা কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা অবাস্তব ও দিবাস্বপ্নের মতোই অর্থহীন। যেখানে যেখানে দ্বীন কায়েমের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের কারণেই এই শক্তি অর্জন ও আশাবাদ সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছে। অতএব, গণতন্ত্রই (এর সমর্থকদের মতে) বর্তমান সময়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার একমাত্র (?) পদ্ধতি। আসুন, আমরা অতি সংক্ষেপে এই দুই বিরোধপূর্ণ অবস্থানকে মূল্যায়ন করি।
প্রথমেই আমরা জিহাদ-পক্ষের বিরোধিতা করবো। ‘বর্তমান সময়ে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি গণতন্ত্র নাকি জিহাদ’ ধরনের আলোচনার সময় সার্বক্ষণিকভাবে আমরা মূল্যায়ন করবো রাসূল মুহাম্মদ (সা) নির্ধারিত সুন্নাহকে। রাসূল (সা) মক্কায় জিহাদের অনুমতি দেননি অথবা পাননি। এটি জানা কথা। কিন্তু কেন? সোজা কথায় এর উত্তর হচ্ছে, জিহাদ করতে হলে পার্শ্ববর্তী কোনো না কোনো ভূখণ্ডে ইসলামের সমর্থনে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম থাকা চাই, যাকে এখন আমরা ইসলামী রাষ্ট্র বলছি। স্বীকৃত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো গ্রুপবিশেষ বা মুসলিম জনসমষ্টি শরয়ী অর্থে জিহাদ করতে পারে না। রাসূল (সা) মাদানী জিন্দেগীতে কিছু গুপ্ত হত্যা করানো সত্ত্বেও জিহাদের অন্যতম মূল শর্ত হলো জিহাদ ঘোষণাকারী কর্তৃপক্ষকে একটা স্বীকৃত রাজনৈতিক (রাষ্ট্র) শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এর অনুপস্থিতিতে অবশ্য যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত থাকবে। তা হবে জিহাদতুল্য, জিহাদ নয়। জিহাদ ঘোষণা ও পরিচালনার জন্য এই (রাষ্ট্রীয়) কর্তৃপক্ষ পাওয়ার বা কায়েম করার পদ্ধতি কী? এ প্রশ্নের উত্তরে গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছু পাবেন না। দাওয়াতী কাজ স্বয়ং একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয় কি?
এবার আসুন, গণতন্ত্রপন্থার সমর্থকদের দুর্বলতাগুলো আমরা এক নজরে দেখি। গণতন্ত্রবাদীদের অন্যতম বড় সমস্যা হলো, তারা এ কথা বেমালুম চেপে যান, অথবা পারতপক্ষে স্বীকার করেন না যে, ‘তথাকথিত মদীনা রাষ্ট্রের’ গোড়াপত্তন হয় সংখ্যায় অতি ক্ষুদ্র ইসলামপন্থীদের হাতে। মদীনা সনদ স্বাক্ষরকালে তৎকালীন ইয়াসরিবে মুসলিম সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশেরও কম ছিলো। কীভাবে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা (রাসূল মুহাম্মদ (সা)) স্বীয় মতাদর্শের অনুকূলে একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পেরেছিলেন, যাকে আমরা মদীনা রাষ্ট্র বলছি? এখানে আমাদের প্রচলিত অর্থের গণতন্ত্র স্পষ্টতই অচল নয় কি? রাসূলুল্লাহ (সা) হতে শুরু করে খলিফাতুল মুসলেমিনগণ পরিচালিত সামরিক অভিযানসমূহের মাধ্যমে যে সকল জনপদে ইসলাম কায়েম করা হয়েছিল তার সাথে আধুনিক গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক আছে কি? গণতন্ত্র ও জিহাদ – এ দুটোর কোনোটাই যদি সুন্নাহর সমার্থক না হয়, তাহলে আমরা কোন পন্থা অনুসরণ করবো?
এ প্রশ্নের আমি কোনো উত্তর দেবো না। লেখাটি পড়া শেষে পাঠক নিজেই নিজ পন্থা নির্ধারণ করবেন। এ বিষয়ে আমরা কেবল খানিকটা সম্পূরক আলোকপাত করতে চাই। আমাদের মতে, ‘গণতন্ত্র নাকি জিহাদ’ টাইপের প্রশ্নগুলোই অবান্তর। রাসূল (সা) জীবনের অধিকাংশ সময় চরমভাবে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও জিহাদ করেননি। কেন? কারণ, জনমত, ব্যক্তি ও মতামত গঠন তথা চিন্তার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে একটা শক্তিকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস গড়ে উঠার জন্য তিনি অপেক্ষা করেছেন। তৎকালীন গোত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ প্রভাবশালীর সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য অপেক্ষা করেছেন। ইয়াসরিবে এক ধরনের প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের প্রচলন করে একটা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম করেছেন। ওহীর অপরিহার্যতার বিষয়গুলো ছাড়া বাদবাকি সব বিষয়ে জনমতকে অনুসরণ করেছেন। খলিফাগণ যেসব সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছেন তাও জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে নিয়েছেন, যা বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমে দেখা যায়।
এই আলোচনার কারণে কারো মনে হতে পারে, প্রকারান্তরে আমরা গণতন্ত্রকেই সমর্থন করছি। এটি ভুল। ইসলাম গণতন্ত্র দিয়ে হয় না। গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলামী বিপ্লব – সোনার পাথরবাটির মতোই স্ববিরোধী অবাস্তব বিষয়। জিহাদ মানে যেমন সম্ভাব্য যে কোনো পন্থায় সংঘর্ষ ও হামলার নাম নয়, তেমনি জনগণের সার্বভৌমত্বভিত্তিক কোনো মতবাদ, তা যতই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, ইসলামী বা ইসলামসম্মত হতে পারে না। ইসলামের মধ্যে গণতন্ত্রের সমর্থন আছে। তাই বলে ইসলাম মানে (পাশ্চাত্য অর্থে) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। ইসলাম কায়েম করতে হবে সুন্নাহ অনুমোদিত পন্থায়, যাতে গণতন্ত্রের স্পষ্ট সাযুজ্যতা পরিলক্ষিত হয়। এই গণতন্ত্রকে জনমত বা জনসমর্থন অর্থে বুঝতে হবে। দুই-তৃতীয়াংশ জনসমর্থন বলতে আমরা যা বুঝে থাকি। এ ধরনের গণতান্ত্রিকতার সমর্থনে অনেক নস বা কোরআন-হাদীসের দলীল বিদ্যমান।
জিহাদ বা শক্তিপ্রয়োগ হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য অপরিহার্য শর্ত। যেখানে যুক্তি ও নৈতিকতায় কাজ হয় না, সেখানে শক্তিই সর্বোত্তম যুক্তি ও নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ দাবি নয় কি?
উপরের আলোচনা হলো, ইসলাম যারা কায়েম করতে চান তারা গণতন্ত্র ও জিহাদ সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন সে বিষয়ে। আপনারা যারা দ্বীন ইসলাম কায়েম করতে চান, তাদের সব সময় স্মরণ ও বিবেচনায় রাখতে হবে, যে জমিনে আপনারা ইসলামভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চান সেটির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, এর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গঠনকাঠামো ও বিদ্যমান বাস্তবতাকে। হক কায়েম করত গেলে তাগুতী শক্তি বিরোধিতা করবে, বাধা দিবে। এটি সত্যি। তাই বলে অবুঝের মতো অনর্থক গণ্ডগোল লাগিয়ে, পার্শ্ব ইস্যুতে জড়িয়ে ও অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি করে নিজেকে হকের পথের মুজাহিদ ভাবলে বা দাবি করলে ভুল হবে।
রাসূল (সা) তৎকালীন ইয়াসরিবের সমাজ ব্যবস্থাকে ইন্টিগ্রেটেড করে যেভাবে সফল হয়েছিলেন আমাদেরকে সেটি সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। মুসার (আ) মুজিযাভিত্তিক ব্যবস্থার চেয়ে ইউসুফের (আ) সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি এখন অধিক বাস্তবধর্মী নয় কি? তাত্ত্বিকভাবে বর্তমানে সুলাইমাইনের (আ) মডেলও কার্যকরী হতে পারে (?), যদিও তা সুদূর পরাহত। বর্তমান বাংলাদেশে শেখ রেহানা বা জয়, কিম্বা তারেক জিয়া যদি ইসলামী আন্দোলনে যোগ দিয়ে এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাহলে, হয়তোবা, কিছু একটা হবে। স্থায়ী কর্মপন্থা বা পলিসি হিসাবে এ ধরনের দাওয়াহর উপর নির্ভর করার সুযোগ নাই। অবশ্য সর্বাবস্থায় ব্যক্তিগত দাওয়াহ অব্যাহত রাখতে হবে।
আমরা ইসলামপন্থীরা ইসলাম কায়েমের জন্য গণতন্ত্র নাকি জিহাদ বিষয়ে বিতর্ক করি। কখনো কখনো এসব আলোচনা বা বিতর্ক এক ধরনের শ্রেণীগত বিভ্রান্তিতে (category mistake) রূপ নেয়। ইসলাম যেভাবে প্রচার করতে হবে ইসলাম প্রতিষ্ঠাও সেভাবে হবে। ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম প্রচারে জোর করা বা বাধ্যবাধকতার অবকাশ থাকে না। আর সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় জোর করা বা শক্তিপ্রয়োগের সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা থাকে। যদিও তা প্রচার বা দাওয়াতী কাজের যথাসম্ভব পূর্ণতার পরবর্তী ধাপেই কেবলমাত্র বাস্তবায়নযোগ্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরের আলোচনার এক পর্যায়ে আমরা ‘তথাকথিত মদীনা রাষ্ট্র’ বলেছি। এতে অনেকে আহত হবেন। আমিও হয়েছিলাম। এখন আমরা আধুনিক রাষ্ট্র বলতে যা বুঝি তা তৎকালীন মদীনাকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় ছিল না। এক ধরনের এপলোজেটিক ট্রেন্ডের প্রভাবে আধুনিক ইউরোপে বিকাশলাভকারী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাথে আমরা মদীনাকেন্দ্রিক হুকমাতের বৈশিষ্ট্যাবলী মিলিয়ে ‘প্রমাণ’ করার চেষ্টা করি যে মদীনা মডেল ছিলো আমাদের এই সময়ে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুরূপ একটা ‘রাষ্ট্র’! যেসব বৈশিষ্ট্য মিলে যায় সেসবের কথা আমরা খুব বলি; অথচ যেসব বৈশিষ্ট্য মিলে না, সেসবকে আমরা বেমালুম চেপে যাই।
ইসলামের সাথে সব মত-আদর্শের কিছু না কিছু মিল বা সাদৃশ্য আছে। এতদসত্ত্বেও ইসলাম হলো একটি একক, অনন্য ও স্বতন্ত্র মতাদর্শ! সব ধরনের মত ও আদর্শের সব ভালো দিক ইসলামে আছে। আর সব মন্দ দিকগুলোকে ইসলাম বাতিল করেছে। তাই, ইসলামকে ইসলামী আদর্শ বলাই ভালো। ইসলামকে ধর্ম বলার কোনো সুযোগ নাই। যদিও কতিপয় ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য (ইবাদতের বিষয়গুলো) হলো ইসলামের প্রাণ। যতই আপনি শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি দাবি বা প্রমাণ করেন না কেন, ইসলামকে ধর্ম বলার সাথে সাথে ধর্মের সব খারাপ দিকগুলোর দায়দায়িত্বও ইসলামপন্থীদের কাঁধে চাপবে। তাছাড়া ইসলামের অপরিহার্য রাজনৈতিক দিকগুলোকে কীভাবে এই তথাকথিত ধর্মীয় ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যবিধান করবেন? ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামী শাসনতান্ত্রিকতা বলা যেতে পারে। ইসলামী গণতন্ত্র বা হালাল পুঁজিবাদ জাতীয় হাস্যকর কথাবার্তা নিজেদের মধ্যে না বলাই ভালো।
এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
আবু সাইফ: “ইসলামকে ইসলামী আদর্শ বলাই ভালো। ইসলামকে ধর্ম বলার কোনো সুযোগ নাই। যদিও কতিপয় ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য (ইবাদতের বিষয়গুলো) হলো ইসলামের প্রাণ।”
ঝড় উঠতে পারে। সংক্ষিপ্ত হবার কারণে সারকথাটুকু অনেকের কাছে অস্পষ্ট রয়ে যাবে বলে মনে হয়। যারা এ ময়দানের কর্মী তাদের আগে বোঝা/বোঝানো দরকার। তা না হলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কী করে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: পুরো লেখাটা একসাথে বিবেচনা না করে মিস কোটেশন করলে ভুল বুঝাবুঝি হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি যা বুঝি তাই বলেছি। দেখা যাক সমালোচনা কী হয়। ব্লগে লিখে সব বিষয় ক্লিয়ার করা যাবে না। তৎসত্ত্বেও এ ধরনের গণমাধ্যমে আমাদের লিখতে হবে। এগুলো আমাদের চিন্তাকে নাড়া দেয়। ভাবতে শেখায়। এখানে দ্বিমত করা সহজ। কোনো সবল ধারণা গঠনে দ্বিমতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ভালো থাকুন।
তারাচাঁদ: গভীর চিন্তাভাবনা করে লেখা এই প্রবন্ধ। আধুনিক ‘সভ্যতা’ বা মতবাদের বেশকিছু মানবিক বা যৌক্তিক দিক আছে, যা ইসলামের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র পরিভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে আমরা এর ভালো-মন্দ সব একত্র করে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না। আবার আধুনিক সভ্যতার অনেক কিছুই ইসলাম থেকে ধার করে নেয়া। আমরা তাযাক্কুর, তাফাক্কুর ভুলে গিয়েছি। ইসলামের যে পরিভাষাগুলো ইসলামবিরোধী অমুসলিমদের জন্য আবিস্কার করা হয়েছিল, গৌণ কিছু বিষয়ে শুধুমাত্র ভিন্নমত পোষণের কারণে সেই গালিগুলো অহংকারবশত অন্য মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহারে ব্যস্ত আমাদের মুসলিমগণই, সেখানে বিশ্বসভ্যতায় ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান কী, তা খুঁজে দেখবার সময় কোথায়?
আরো দুই একবার না পড়ে মন্তব্য করা যাবে না। কারণ, বুদ্ধিমান মানুষ আগে অন্তর দিয়ে অনুভব করে, পরে মন্তব্য করে; আর আহাম্মক বাচালের মতো মন্তব্য করে বসে, পরে অন্যের কাছে তিরস্কৃত হয়।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সখি: তার মানে আপনি বর্তমানের এই বৈশ্বিক-গ্রামে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চাদর গায়ে দিয়ে কৌশলে ক্ষমতা অর্জন করতে চান। অতঃপর ক্ষমতায় যেয়ে ইসলামের রুদ্রমুর্তি (জেহাদ, গনিমত, জিজিরা কর) ধারণ করবেন, এই তো?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এইসব কথিত রুদ্রমূর্তির আদল কি আপনি আগ্রাসনবাদী বিশ্বশক্তির মধ্যে দেখেন না? আমেরিকা বলুন, রাশিয়া বলুন, চীন বলুন অথবা প্রতিবেশী ভারতের কথাই ধরুন, কর্পোরেট সংস্কৃতির আড়ালে যার যেখানে শক্তি আছে সে কি সেখানেই আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে না? শক্তির বৈশিষ্ট্য হলো তা আধিপত্য বিস্তার করবেই। এর অন্যথা অসম্ভব। যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ দিয়ে এই শক্তি প্রয়োগ কতটুকু সমর্থনযোগ্য– তাই হলো ব্যাপার।
সখি: আপনার কথা যদি মেনে নিই তা হলে তো যুক্তি, বুদ্ধি বা বিবেচনাবোধ বলে কিছু নেই। ওরা বাঘ হয়ে মানুষের ঘাড় মটকে খাচ্ছে, তার বিপরীতে আপনি ছল/চাতুর্য করে ক্ষমতার পরশ পেয়ে শেষমেশ ইসলামী কুমির হয়ে মানুষের নলি ছিড়ে খাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
ব্যাপারটা আসলে মোটেও তা নয়। কর্পোরেট বলেন আর যাই বলেন, গণতন্ত্র আছে বলেই ‘তালেবানদের বৌদ্ধ মুর্তি ধ্বংস এবং ইরাকের আবু গ্রেইব কারাগারে বন্দি নির্যাতন’ এই দুই মেরুর চিত্র পাশাপাশি দেখতে পারি। এবং যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ খাটিয়ে সন্ত্রাসী বিন লাদেন বা সার্বিয়ান কশাই মিলোসেভিকের শাস্তি অন্তত নিশ্চিত করা যায় (সবক্ষেত্রে ১০০% সফল তা বলি না)।
আর গণতন্ত্রকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কখনো ইসলামী লেবাস নিতে হয় না। কিন্তু অগণতান্ত্রিক ইসলামকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গণতন্ত্রের লেবাস নিতে হয়। এখানেই কর্পোরেট সংস্কৃতির (আপনার ভাষায়) সাথে ইসলামের পার্থক্য। ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আসুন না, আমরা ব্যাপারটার একদম গোড়াতে গিয়ে দেখি। গণতন্ত্র অনেক কিছুর ভিত্তি। মানলাম। কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত্তি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি পপুলার কতগুলো কথা বলতে পারেন, যার একটিও যাচাইয়ের পর জ্ঞান-বুদ্ধির ধোপে টিকবে না। সেসব রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনার বিষয়।
আপনার মন্তব্যের ঠিক পরেই জনাব মোহাম্মদ নুর উদ্দীনের মন্তব্যের উত্তরে দেয়া এই অংশটুকু খেয়াল করুন:
“গণতন্ত্রের সমর্থনকারীরাও দাবি করেন না যে গণতন্ত্র একটা ভালো ও সুষম পদ্ধতি। ভেতরের দিক থেকে তা অনেকটাই বায়বীয়। এর ঘোষণা বা ক্লেইমের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নাই। সেজন্য একেক দেশে গণতন্ত্র একেক ধরনের। গণতন্ত্রের দাবিদারেরা একে মন্দের ভালো হিসাবে দাবি করে থাকেন। তাদের মতে, গণতন্ত্র হলো একটা চেতনা। ক্ষমতা পরিবর্তনের পদ্ধতি। জনমতের এক ধরনের স্বীকৃতি। এর কোনো স্বীকৃত গঠনকাঠামো নাই। বলতে পারেন, গণতন্ত্র হলো কিছু তরল পদার্থের মতো। যে কোনো পাত্রে তা রাখতে পারেন।”
বিবেচনাবোধ কিছু মানুষের কাছে ইসলাম উপস্থাপিত জীবনাদর্শকে সঠিক বলে প্রত্যয়ন করেছে, তারা মুসলিম। কিছু মানুষের কাছে তা সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি বা তারা ইসলাম উপস্থাপিত জীবনাদর্শকে সঠিক বলে মনে করেনি। তারা অমুসলিম।
ইসলাম বনাম গণতন্ত্র – এ ধরনের আলোচনায় আমাদের দেখতে হবে এতদুভয়ের মধ্যে মিল কতটুকু আর অমিল কতটুকু। আমি মিলের জায়গাটা দেখিয়েছি। অমিলের ক্ষেত্রও নির্দেশ করেছি। আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হতে ইসলাম কোনো কিছু ধার বা গ্রহণ করার প্রসংগ এজন্য আসে না যে, ইসলাম এসেছে আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বহু পূর্বে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রীরা ইসলাম হতে নিয়েছে কিনা সে বিষয়টা এই পোস্টের জন্য প্রাসংগিক নয় বিধায় এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করছি না।
নবী মুহাম্মদ (সা) প্রচারিত ইসলাম যেমন একেবারে নতুন বা আকাশ থেকে পড়া কোনো বিষয় নয়। তেমনি গণতন্ত্র বা যে কোনো মতবাদই একেবারে একশ ভাগ আনকোরা নতুন নয়। প্রতিটা আদর্শ ও তত্ত্বের পূর্বাপর ধারাবাহিকতা থাকে। দেখতে হবে এতে নতুন কী উপাদান আছে। একই জিনিসকে মানুষ কিছুদিন পর পর নতুন নতুন নাম দেয়। এটি মানুষের বৈচিত্র্যপ্রিয়তার ফলশ্রুতি।
আপনি ইসলামপন্থীদের গণতন্ত্রের লেবাস পরার কথা বলে বিদ্রুপ করার চেষ্টা করেছেন। বোধহয় বোঝাতে চেয়েছেন, ইসলামপন্থীরা গণতন্ত্রের কথা কেন বলবে? তারা সবসময় সবকিছুতে শুধু ইসলাম ইসলাম করবেন। আপনি একটা অতি সরল ও জনপ্রিয় ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন। ইসলামপন্থীদেরও একটি অংশ ব্যাপক হারে এই ভুলই করছে।
ইসলাম বলে না, সর্বক্ষণ আপনি সবকিছুতে ‘ইসলাম’ নাম বা ব্র্যান্ডকে ব্যবহার করবেন। শুধুমাত্র ঈমানের প্রসংগে ইসলামকে দাবি করা অপরিহার্য। বাদবাকি কাজ ইসলামী ভাবধারা (নিয়ত) বজায় রেখে ইসলামী নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে থেকে করলেই হলো।
ইসলামের এই একোমোডেটিভ ও প্লুরালিস্টিক বৈশিষ্ট্য অনন্য। যে কোনো আদর্শের ভালো দিকগুলোকে সে ধারণ করে বা করতে পারে। এর গঠনকাঠামো খুব ফ্লেক্সিবল। শুধুমাত্র মূলনীতিই সে বলে। ইবাদতের বিষয়াবলী ছাড়া মুয়ামালাতের কোনো বিষয়ে সে কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোকে আরোপ করে না। ইসলামের বিশ্বজনীনতার এটিই উৎস। বিশ্বদৃষ্টিগত (ইউনিভার্সাল) বিষয়গুলো ছাড়া যে কোনো আদর্শের গঠনমূলক ও প্রায়োগিক দিকগুলো সংশ্লিষ্ট নামেই গ্রহণ করার ব্যাপারে ইসলামের কোনো বাধা নাই। সার্বজনীন জীবনাদর্শের জন্য এটিই তো স্বাভাবিক। তাই না?
নিজস্ব কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ না থাকায় গণতন্ত্রের মতো একটি পদ্ধতিগত বিষয়কে স্বয়ংসম্পূর্ণ মতবাদ হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে। এর সাথে সেক্যুলারিজমকে জুড়ে দিলে এটি একটা পূর্ণাঙ্গ মতবাদ হতে পারে বটে। সেক্যুলারিজমকে আরোপ বা গ্রহণ করলে আপনাকে সরাসরি নাস্তিক্যবাদকেও গ্রহণ করতে হবে। এভাবে একটি প্রায়োগিক পদ্ধতিকে যখন পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক মতবাদ হিসাবে দাবি করা হয় তখন একটা ক্যাটাগরি মিসটেক বা শ্রেণীগত ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
গণতন্ত্রের সাথে সেক্যুলারিজমকে, সেক্যুলারিজমের সাথে এথিইজমকে মিশ্রণের ফলে পিউরিটানিক ইসলামপন্থীদের মননে গণতন্ত্র সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর বেশি বড় হয়ে গেল বিধায় দুঃখ প্রকাশ করছি। কোটেশন আউট অফ দ্য কনটেক্সটের ফ্যালাসি হতে মুক্ত থাকার চেষ্টা করে আসুন বিষয়গুলোকে সমন্বিতভাবে বিবেচনা করি। ভালো থাকুন।
সখি: অনেক লম্বা মন্তব্য, যাক।
আসলে মোজাম্মেল ভাই, আপনি ইসলাম ধর্মের বিশ্বজনীনতা যতটা সহজ সরল ভাবছেন! ইসলাম আসলে তার ধারেকাছেও নয়। ইসলাম ধর্মের ঈমান আমান, জীনব বিধান বা রাষ্ট্রের ধারণা খুবই সংকীর্ণ ফ্রেমে বাঁধা, যা থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হওয়ার সুযোগ নেই। মূলগ্রন্থ আল কোরআন ও সহীহ হাদীসনামায় যার কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধু মাত্র মোমিনদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী কাফেরদের উপর তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য লানত দেয়া হয়েছে। তাদের সামাজিক মর্যাদাকে অভিশপ্ত করা হয়েছে। এক কথায় ইসলামী রাষ্ট্রে অবিশ্বাসীরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় অবিশ্বাসীদের জন্য কোনো স্থান রাখা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ইসলামের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ স্বয়ং অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাসের বস্তু কাবা ঘরে রাখা পবিত্র মূর্তিগুলো ভেংগে চুরমার করে দিয়েছেন। এসব মূর্তি অন্যত্র সরিয়ে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা তিনি করেননি। অথচ মক্কার কাফেররা হাজার বছর ধরে এই মূর্তিগুলোর পূজা-অর্চনা করে আসছিল। মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে এভাবে পদলিত করার ইতিহাস অন্য কোনো ধর্মের ইতিহাসে আছে কিনা আমাদের জানা নেই। তাছাড়া গৌতম বুদ্ধ বা যিশু খ্রীষ্টের মানবিক উদারতার কাছে নবী হজরত মুহাম্মদের চারিত্রিক গুণাবলী দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। গৌতম-যিশুর অহিংস নরম বাণীর তুলনায় নবীর বাণী/আদেশসমূহ সামরিক ফরমান টাইপের। রীতিমত মার্শাল ল।
তাই, আবারো বলছি বর্তমান গণতন্ত্রের উন্নততর বিকল্প কী হতে পারে তা অবশ্যই বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণার বিষয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিধান যে অগ্রহণযোগ্য, আউট ডেটেড তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধন্যবাদ আবারো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি ইসলামকে প্রচলিত অর্থে একটা ধর্ম হিসাবে দেখছেন। যা আমি মনে করি না। লোক-ইসলাম ধর্মকেই সমর্থন করে। মানুষের মধ্যে একটা সহজাত ধর্মীয় প্রবণতা আছে। ক্যারেন আর্মস্ট্রংসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের লেখাতে তা পেয়ে থাকবেন। ইসলামের সাথে ধর্মের মিল যত আছে, অমিল তারচেয়ে বেশি। এসব ধর্মবিরোধিতা ও বৈষয়িকতার জন্য মুক্তমনা ব্লগের এক পোস্টে একজন ব্লগার মুহাম্মদকে (সা) তার ধারণায় তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ ‘নাস্তিক’ হিসাবে চিহ্নিত করে আলোচনা করেছে, বছর দেড়েক আগে দেখেছিলাম।
আপনি ইসলামকে যতটা রিজিড হিসাবে দেখছেন, তা প্রশ্ন ও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। সংখ্যায় ৭/৮টির বেশি নয় এমন বিশ্বাসগত কিছু বিষয় এবং নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতের মতো কিছু বুনিয়াদী ব্যবহারিক বিষয় ছাড়া ইসলামের সকল বিষয় গ্রহণ ও প্রয়োগযোগ্যতার বিষয়ে প্রেক্ষিত বিবেচনা ও ক্রমধারা অবলম্বন অপরিহার্য।
আপনার ধারণায় ইসলাম একটি ধর্মমাত্র বিধায় আপনার বিবেচনায় বুদ্ধের বা যিশুর অহিংস বাণীর আবেদন আপনার কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে। ইসলাম এগুলোর মতো ধর্মমাত্র নয়– এ কথার বড় প্রমাণ হলো এর বৈষয়িক সংশ্লিষ্টতা ও জাগতিক সক্ষমতা। ইসলামে না থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামের মধ্যে গড়ে উঠা তথাকথিত আলেম সমাজ নামক যাজক শ্রেণী (প্রিস্ট ক্লাস) দুনিয়ার জীবনের নগণ্যতার একদেশদর্শী বয়ান করে করে ইসলামের বৈশ্বিক সক্ষমতাকে (গ্লোবাল ক্যাপাসিটি) সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেলেছে। এ জন্যই এক পোস্টে বলেছিলাম ‘ইসলাম মাস্ট বি রেসকিউড ফ্রম ইটস রিলিজিয়ন ইমেজ’।
আপনি ইসলামের ডমিনেটিং ক্যারেকটার সম্পর্কে বলেছেন। আচ্ছা বলুন তো, বর্তমান পাশ্চাত্যে কেন উচু করে মিনার বানাতে দেয় না, আজান দিতে দেয় না, ঘরের আঙ্গিনায় কোরবাণী করতে দেয় না? কেন হিজাবের উপর একে একে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে? কারণ, পাশ্চাত্যের জীবনবোধের সাথে সেসব মিলে না। খ্রীষ্টবাদ বলুন আর পাশ্চাত্যবাদ বলুন, তাদের আদর্শই তাদের এলাকাতে ডমিন্যান্ট। এটিই স্বাভাবিক। ইসলাম যদি স্বতন্ত্র একটা আদর্শ হয়, তার অনুসারীদেরও সে অধিকার ও বৈশিষ্ট্য থাকার কথা। কী বলেন?
ইসলামী রাষ্ট্রের একক কোনো রূপ নাই। এটির গ্রাজুয়্যাল ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন স্তর আছে বা হতে পারে। এটি এমন নয় যে, এটি আছে অথবা নাই– এই দুই বাইনারির একটা হবে। ব্যক্তিগত ঈমান আছে বা নাই– এই দুইয়ের কোনো একটা হবে। ঈমানের ক্ষেত্রে মাঝামাঝি কোনো স্তর নাই। কিন্তু সামাজিক ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্রের কিছু মূলনীতিগত বৈশিষ্ট্য ছাড়া সাধারণভাবে স্তরবিন্যাস (হায়ারার্কি) আছে, থাকবে।
ইসলামী রাষ্ট্র হতে হলে এতে অমুসলিমদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে, জিযিয়া দিতে হবে ইত্যাদি ভুল ধারণা। নবী মুহাম্মদ (সা) প্রতিষ্ঠিত মদীনা রাষ্ট্রের মধ্যে এসব ছিলো না। ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে জিযিয়া আরোপিত হয়েছে বটে। এখন জিযিয়া বা অমুসলিমদের উপর যুদ্ধকর না বাতিল হয়েছে, না তা ফরজ আছে। যদি তাই হয়, তাহলে জিযিয়া আরোপ ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা শর্ত নয়।
ইসলামের কিছু কিছু বিষয় আছে, যা মুসলমান মাত্রকেই মানতে হবে। সে সম্পর্কে উপরে বলা হয়েছে। আপনি জানেন, জুমার দিন যোহরের চার রাকাতের পরিবর্তে একটা খুতবাসহ দুই রাকাত নামাজ পড়াকে প্রচলিতভাবে জুমার নামাজ বলা হয়। এই জুমার নামাজ ছাড়া রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলীর মধ্যকার সকল বিষয়ই প্রেক্ষিত ও প্রয়োজনীয়তা-বিবেচনা সাপেক্ষে বাস্তবায়নযোগ্য। সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ইসলামী শরীয়াহর মধ্যে রয়েছে নানাবিধ বিকল্প।
ইসলামকে লোক-ইসলাম থেকে আলাদাভাবে জানা ও বুঝার (বা উদ্ধার) করার উপায় হলো এর মূল মডেল ও উৎস হতেই তা জানা ও বুঝার চেষ্টা করা। ধন্যবাদ।
সখি: না মোজাম্মেল ভাই, শত মত, শত ফিতনা, শত বিভক্তির এক ইসলাম নিয়ে এত প্যাচাপ্যাচির কী দরকার? দিন বদলে গেছে, ইসলামের কোথাকার কোন মদীনা রাষ্ট্র, যার স্থায়িত্ব এক্সপেরিমেন্টাল পিরিয়ডও পার করতে পারেনি, তা নিয়ে আজকের দিনে গবেষণা করার মত gist বলতে কিছু নেই। সময়ের অপচয় মাত্র। আর সবচেয়ে বড় কথা, গত ১৪৫০ বছরেও ইসলাম কোথাও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। আর এটাই ইসলামের সবচেয়ে বড় ডেড ইস্যু, অসারতা। ধন্যবাদ আপনাকে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি ইসলামপন্থীদের বিভক্তির কথা বলেছেন। আচ্ছা বলুন তো, দুনিয়ায় এমন কোন মতবাদ বা আদর্শ আছে, যার ব্যাখ্যা নিয়ে অনুসারীদের মধ্যে মতবিরোধ নাই? যে মতাদর্শ বিশ্বসভ্যতায় বিপুল অবদান রেখেছে, মানব সমাজে পরিমাণ ও গুণগতভাবে উল্লেখযোগ্য অবস্থান অর্জন করেছে, অদ্যাবধি যা বিশ্লেষকদের মতে বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনার উৎস হিসাবে পরিগণিত, আপনি সেটিকে বলছেন এক্সপেরিমেন্টাল পর্যায় পার হতে পারেনি, কোথাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি! হতে পারে আপনি একমত হচ্ছেন না, বা আপনার ভালো লাগছে না। আপনি কোনো কিছু সমর্থন না করলে তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসবেন, এটি কি ঠিক?
সখি: বাহ! বেশ তো? আপনার সাথে সংলাপ ভালোই লাগছে। হ্যাঁ, আধুনিক গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের মাঝে কোনো বিভক্তি নেই। আর যৎসামান্য থাকলেও তা ইসলামের মত মারমার/কাটকাট অবস্থা নয়। আর আমি কখনো ইসলাম ধর্মবিশ্বাসের কথা বলিনি। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস হিসেবে ইসলাম অবশ্যই আর ৪/৫টি ধর্মবিশ্বাসের মতোই সফল। পৃথিবীতে এখনো কোটি কোটি মুসলমান আছে। আর ধর্মবিশ্বাস মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। বিশেষ করে মরনের পরে খোদ কোরআনে বর্ণিত বিচিত্র সব শাস্তির ভয়, অন্যদিকে জান্নাতের অনৈতিক ভোগবিলাস, পুরুষের যৌন উন্মাদনা এসবের ভয়/মোহ তো আছেই।
কিন্তু ইসলাম ধর্মবিশ্বাস আর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এক নয়। বাংলাদেশে ৯০% ভাগ মানুষ মুসলমান, কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশ কি সফল ইসলামী রাষ্ট্র? তবে এটা ঠিক ইতিহাসের পাতায় মধ্যযুগীয় মুসলমানদের অবদান আছে। বিশেষ করে গণিত বা চিকিৎসাশাস্ত্রে সেই আমলের কিছু কিছু হেকিম, দরবেশ, পর্যটক, কবিরাজ এদের কথা এখনো শোনা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় মুসলমানরা আহামরি কিছু ছিল না। সম্রাট অশোখ, খলিফা হারুনুর রশীদ, কিং রিচার্ড অথবা ভারতে পৃথ্বীরাজ বা আকবর বাদশা এরা সবাই ছিল গতানুগতিক মধ্যযুগীয় ক্ষমতালোভী, উচ্চাভিলাসী রাজাধিরাজ। আর যদি ইসলামের খোলাফায়ে রাশেদীনের কথা বলেন! তা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনার কথা মতো ধরে নিলাম, ইসলাম ধর্ম দিয়ে হবে না, বর্তমানে তা চলবে না। বেশ তো, তাহলে একটা আদর্শ তো লাগবে? বিদ্যমান থাকলে সেটি কোনটি? না থাকলে তা কোথায় বা কীভাবে পাবেন?
আপনি যে ধর্ম-ইসলামকে জানেন, সেটি কি আসল ইসলাম? এমন কোন আদর্শ আছে যার একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ টেক্সট আছে? আপনি যদি ধর্ম হিসাবে ইসলামের অবস্থান হতে কথা বলতে থাকেন তাহলে আমার সাথে আপনার মিলবে না। আমি ইসলামকে ধর্ম হিসাবে দেখি না। যদিও মুসলিম হিসাবে পরিচিতরা অধিকাংশই ইসলামকে ধর্ম হিসাবে জানে ও মানে। আমি ধর্মের পক্ষে নই।
সখি: ধন্যবাদ। আমি আগেই বলেছি, বর্তমান গণতন্ত্রের উন্নততর বিকল্প কী হতে পারে তা অবশ্যই বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণার বিষয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিধান যে অগ্রহণযোগ্য, আউট ডেটেড তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি বলেছেন: আপনি যে ধর্ম-ইসলামকে জানেন, সেটি কি আসল ইসলাম? আমারও একই প্রশ্ন– আসল ইসলাম কী বস্তু?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইসলাম কী বস্তু, তা এর উৎসসমূহের মধ্যে আছে। আই মিন, কোরআন, হাদীস, রাসূল মুহাম্মদের (সা) জীবনীর মধ্যে ইসলামকে পাবেন। এর অনুসারীদের মতবিরোধ ও পদস্খলনের মধ্যে ইসলামকে খুঁজলে ভুল করবেন। যেভাবে কেউ সমাজতন্ত্রকে জানতে চাইলে তাকে মার্ক্স-এঙ্গেলসের মধ্যে খুঁজতে হবে। লেনিনকে মাওবাদীরা মানবে না। স্ট্যালিনের কথা নাইবা বললাম।
সখি: না ভাই, কোনো কাঠ-মওলানার মুখের কথাকে ইসলাম মনে করি না। আমি কোরআন, হাদীস, রাসূল মুহাম্মদের জীবনীর মধ্যেই ইসলামকে বিবেচনা করি। আর সে কারণে সমস্যা থেকেই যায়। যেখানে স্বয়ং নবী মোহাম্মদ mercilessly অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের মূর্তি ধ্বংস করেছেন, কাফেরদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অভিশপ্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, কোরআন ও সহীহ হাদীসনামায় এ কথাগুলো পর্যায়ক্রমে অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে স্পষ্ট ভাষায় বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মুমিনদের তাগাদা দিয়ে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে কাফেরদের মন ও অন্তর ধ্বংস (সীলমোহর) করে দেয়া হয়েছে। তো? ভাবতে অবাক লাগে মোজাম্মেল ভাই! এই ইসলামকেই আপনি ২১ শতকে বিকল্প ভাবছেন? হায় হায়!!
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সব আদর্শকে যান্ত্রিক ও আক্ষরিকভাবে সমবিবেচনায় নিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা– একটা অবাস্তব ও অসম্ভব বিষয়। কোনো মতাদর্শ যখন কোনো জনপদে কর্তৃত্ব অর্জন করে তখন তা অপরাপর মতাদর্শের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে। এটিই স্বাভাবিক। কথা হলো উক্ত বিজয়ী আদর্শ অন্যান্য মতাদর্শের বিষয়ে কতটুকু সহনশীল ও একোমোডেটিভ, তা দেখা। কারোর দৃষ্টিতে ইসলামের সহনশীলতার মাত্রা কম হতে পারে। সেজন্য তিনি এই মতাদর্শকে সমর্থন নাও করতে পারেন। অন্য যারা সেটিকে সমর্থনযোগ্য মনে করছেন তাদের অস্তিত্ব ও অবস্থানকে স্বীকার করার মানসিকতাও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের থাকাটা জরুরি।
ল অব কন্ট্রাডিকশন অনুযায়ী একইসাথে কোনো কিছু (প্রেক্ষাপট পরিবর্তন না হওয়া সত্ত্বেও) সত্য এবং মিথ্যা উভয়ই হতে পারে না। ইসলাম যেহেতু দাবি করে, কাবা হলো নবী ইব্রাহিম (আ) প্রতিষ্ঠিত সমজিদ, তখন ইসলাম বিজয়ী শক্তি হওয়ার পরেও কাবা ঘরে মূর্তি থাকা কীভাবে মানা যাবে? মুসলিম শক্তি যদি অমুসলিমদের স্বপ্রতিষ্ঠিত মন্দির বা মূর্তি ধ্বংস করতো তাহলে আপনি আপত্তি উত্থাপন করতে পারতেন। এ বিষয়ে আপনি তালেবানদের উদাহরণ টানলে ভুল করবেন। কারণ, যে কোনো আদর্শের অনুসরণ ও বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে ভুল ও বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়। এর দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আদর্শ কেন বহন করবে? বুশের অপকর্মের দায়-দায়িত্ব গণতন্ত্র বা জর্জ ওয়াশিংটন কেন নিবেন? স্ট্যালিনের স্বৈরাচারের দায়-দায়িত্ব কার্ল মার্ক্স বা সমাজতন্ত্র কেন নিবে? আপনি যখন সরাসরি কোরআন-হাদীসের অধ্যয়ন করা সত্ত্বেও ইসলামের মতাদর্শিক আধিপত্যশীলতাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করছেন তখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি?
মোহাম্মদ নুর উদ্দীন: এ বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া দরকার। অনেকেই কনফিউশনে ভোগেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: গণতন্ত্র যতক্ষণ পর্যন্ত একটা পদ্ধতি ততক্ষণ পর্যন্ত তা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গণতন্ত্রকে একটা স্বতন্ত্র আদর্শ হিসাবে বিবেচনা করা হলে তা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। নবুয়তের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে (বর্তমানে) ক্ষমতার পরিবর্তন প্রক্রিয়া হিসাবে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নাই। পক্ষান্তরে নীতি-নৈতিকতা নির্ধারণের জন্য গণতান্ত্রিকতাকে অবলম্বন করার কোনো সুযোগ ইসলামে নাই। শরীয়াহর কোনো স্পষ্ট হুকুম জনরায় দিয়ে গঠন, পরিবর্তন বা বাস্তবায়ন হতে পারে না। এটি এ জন্য যে, শরীয়াহর প্রণেতা হলেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। ঊর্ধ্বতন অথরিটি হিসাবে তাঁর ফয়সালা মেনে নেওয়াটা, এক অর্থে, গণতান্ত্রিকতারই অংশ।
তাছাড়া, গণতন্ত্র স্বয়ং কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অবিতর্কিত মতবাদ নয়। প্লাটোর যে বইয়ের (দি রিপাবলিক) নামে দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহের নামকরণ করা হয়েছে, তিনি গণতন্ত্রকে চরমভাবে অপছন্দ করেছেন। আমাদের এক শিক্ষক একটা অতি সংক্ষিপ্ত গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন। শিরোনাম হলো: গণতন্ত্র একটি অলীক ধারণা। বুঝুন এবার!
গণতন্ত্রের সমর্থনকারীরাও দাবি করেন না যে গণতন্ত্র একটা ভালো ও সুষম পদ্ধতি। ভেতরের দিক থেকে তা অনেকটাই বায়বীয়। এর ঘোষণা বা ক্লেইমের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নাই। সেজন্য একেক দেশে গণতন্ত্র একেক ধরনের। গণতন্ত্রের দাবিদারেরা একে মন্দের ভালো হিসাবে দাবি করে থাকেন।
তাদের মতে, গণতন্ত্র হলো একটা চেতনা। ক্ষমতা পরিবর্তনের পদ্ধতি। জনমতের এক ধরনের স্বীকৃতি। এর কোনো স্বীকৃত গঠনকাঠামো নাই। বলতে পারেন, গণতন্ত্র হলো কিছু তরল পদার্থের মতো। যে কোনো পাত্রে তা রাখতে পারেন। কোনো ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় কারো না কারো দ্বারা মনোনীত হতে হয়। যেমন নবীরা আল্লাহর দ্বারা মনোনীত হন। খলিফাগণ জনগণ দ্বারা মনোনীত হন। প্রশাসকরা খলিফা ও শূরা দ্বারা মনোনীত হন। এভাবে পুরো প্রক্রিয়া।
জিহাদ হলো বিদ্যমান কর্তৃত্বকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা। এ ধরনের কর্তৃত্ব বা অথরিটি জিহাদের মাধ্যমে মাল্টিপ্লাইড বা সম্প্রসারিত হতে পারে। প্রাথমিক বা মূল কর্তৃত্ব/ব্যবস্থা যুদ্ধ অর্থে জিহাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো নজির ইসলামে নাই। মদীনাতে রাসূল (সা) সিস্টেম ম্যানেজমেন্টকে কাজে লাগিয়ে একটা কর্তৃত্ব বা ব্যবস্থা (নেজাম) প্রতিষ্ঠার পর একে টিকিয়ে রাখা ও সম্প্রসারণের জন্য জিহাদ করেছেন। শুধু জিহাদের মাধ্যমে কোনো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
সমস্যা হলো, আমরা কোরআন-হাদীসের বর্ণনাগুলোকে সেসবের আন্তঃসম্পর্ক ও শানে নুযূল বা প্রেক্ষিত ও ধারাবাহিকতার নিরিখে বিবেচনা না করে সেগুলোর ফেসভ্যালু তথা বাহ্যিক/আক্ষরিক অর্থকেই মূল অর্থ হিসাবে মনে করি, প্রচার করি। এর ফলে একটা তালগোল পাকানো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রচুর কোরআন হাদীস জানা সত্ত্বেও কেউ সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যেতে পারেন, যদি তিনি কম্প্রিহেনসিভলি নবুয়তী জিন্দেগী নিয়ে না ভাবেন, না বুঝেন।
ইবনে হাসেম: বুঝতে চেষ্টা করছি। এই রাজনীতির আলোচনায়, যেখানে প্রতি এক কি দুই বাক্য পরেই একই শব্দ বা শব্দসমষ্টি তার পূর্বব্যক্ত স্ট্যাটাস হতে সরে আসে, সেখানে কোনো একটি শব্দ বা শব্দসমষ্টিকে সঠিকভাবে রূপ দিয়ে অন্তর দিয়ে ধারণ করা কষ্টকর। অন্তত আমার মতো রাজনীতির অন্দর-বাহির বিষয়ে অনভিজ্ঞ লোকের জন্য তা সত্যিই একটি কঠিন বিষয়। এটাও বুঝি, এই বিষয়টি সম্বন্ধে যতক্ষণ লোকদের ক্লিয়ার ধারণা না হবে, ততক্ষণ তার দ্বারা কোনো একটি মতের পক্ষশক্তি হয়ে কাজ করা সঠিক অর্থে সম্ভব নয়। তাই, আপনার লিখিত এ মূল্যবান পোস্টটি আরো কয়েকবার পাঠ করার আশা রেখে আপাতত শেষ করছি। এই ব্যাপারে আল্লাহ আপনার পরিশ্রমকে কবুল করুন, এই প্রার্থনা।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কোনো কিছুকে খাঁটি হিসাবে পেতে হলে সেটিকে টেস্টিংয়ের মধ্য দিয়ে উৎরিয়ে আসতে হয়। কোনো তত্ত্ব সঠিক হওয়ার জন্য এর তীক্ষ্ণ সমালোচনা খুবই জরুরি। একপক্ষীয় ঢোল পিটিয়ে কোনো কিছু প্রচার করা যায়, কিন্তু সেসব টিকে না। আমিও চাই ইসলাম কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হবে, কীভাবে একে টিকিয়ে রাখা হবে তা নিয়ে ইসলামপন্থীরা খোলা মনে ভাবুক, বিতর্ক করুক এবং এক ধরনের মানসিক ম্যাচুরিটি অর্জন করুক। আমার বক্তব্য সমর্থন করতে হবে, এমন কোনো কথা নাই। যদিও আমি মনে করি, আমি ঠিক কথাই বলেছি।
শামিম: আমিও জানতে চাই। এই বিষয়টা নিয়ে আমার মনেও চিন্তার উদ্রেক হয়েছে অনেকবার। ইদানীং এক গ্রুপকে দেখছি, যারা জিহাদ ফি সাবিল্লাহ বা ইকামতে দ্বীনের বিরুদ্ধে কথা বলে, মোটামুটিভাবে বলা যায়। জিহাদের কথা বললে বলে– আমীর নাই, তাই জিহাদ করা যাবে না! রাজনৈতিক আকীদার কথা বললে বলে ইসলামে রাজনীতি করা যাবে না (উনারা অবশ্য রাজনীতিকে গ্রুপিং বলে)।
আমার পড়ালেখা খুব কম, যতটুকু বুঝেছি, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিলো রাসূলের (সা) বড় টার্গেট। রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা না হলে ইসলামে পুরোপুরিভাবে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। কারণ, রাষ্ট্র ডিরেক্টলি বা ইন্ডিরেক্টলি আমাদের কন্ট্রোল করছে। এখন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিস্টেমটা কী হতে হবে? রাসূল (সা) প্রথমে মানুষ তৈরি (organizing people) করেছেন, ইসলামের শিক্ষা দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন, রাষ্ট্রে পুরোপুরি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ এই গ্রুপ্টা দেখি কোনো না কোনোভাবে এড়িয়ে যায় রাজনৌতিক আকীদাটা।
জিহাদের ব্যাপারে আমীর নাই, তবে আমীর কেনো বানানো হচ্ছে না? এখন কি সব মুসলিম দেশ থেকে একজন আমীর বানানো সম্ভব? আমার মনে হয় না। ব্যাপারটা নিয়ে আমিও জানতে চাই। প্রিয়তে রাখলাম, দেখি কে কী মন্তব্য করে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক:
এতায়াত ও জিহাদ: কোনো জনপদে প্রকাশ্যে ঘোষিত ও প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি ও অনুমোদন ছাড়া শরয়ী জিহাদ (কিতাল অর্থে) হতে পারে না। আক্রান্ত হলে জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিরোধের অধিকার সব সময়ই বহাল থাকে। আপনার ঘরে ডাকাত পড়লে আপনি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার অধিকার রাখেন। যদিও তা জিহাদ নয়। জিহাদতুল্য। এতে মারা গেলে আপনি শহীদ (শাহাদাতে হুকমী) গণ্য হবেন।
রাষ্ট্র, ঈমান ও ইসলাম: রাষ্ট্র, ঈমান ও ইসলামের মধ্যকার অন্তসম্পর্ক হলো– রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা থাকা ঈমানের কোনো অঙ্গ বা অংশ নয়। যদিও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার, প্রতিষ্ঠিত থাকলে তা বহাল রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা অপরিহার্য। ন্যূনতম ইসলামের জন্য রাষ্ট্র অপরিহার্য শর্ত নয়। পূর্ণাঙ্গ ইসলামের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক।
মোহাম্মদ মামুন রশীদ: এই সংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি আলোচনায় যে ব্যাপারটি কখনোই আনা হয় না তা হচ্ছে পুনঃনির্বাচনের বিষয়টি। আপনার লেখাটি থেকে যদি ধরে নেই, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমেই ইসলাম কায়েম করা হবে এবং পরবর্তীতে জিহাদের মাধ্যমে তা বজায় রাখা হবে, তাহলে তা অনেকটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। এখানেই আসে পুনঃনির্বাচনের প্রশ্নটি।
যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো ইসলামী দল ক্ষমতায় আসে তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হবার পরে পুনরায় নির্বাচন হলে যদি অনৈসলামিক দল ক্ষমতায় আসে তাহলে সেক্ষেত্রে তা মেনে নেয়া যাবে কিনা? আপনি উপরে বলেছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম কায়েমের ক্ষেত্রে জোর খাটে। যদি তাই হয় তাহলে একবার ইসলামী দল ক্ষমতায় আসার পরে জনমতের ভিত্তিতে অনৈসলামিক দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় কি? যদি না যায় তাহলে, প্রথম থেকেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েমের আর্গুমেন্ট ভেংগে পড়ে।
আর এই ব্যাপারে আপনার কাউন্টার আর্গুমেন্ট যদি হয় শুধুমাত্র ইসলামী দলগুলিকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে, তাহলে তাতে খলিফা উসমান ও আলীর (রা) নির্বাচনের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কসরতের প্রয়োজন কি?
স্বীকৃত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো গ্রুপবিশেষ বা মুসলিম জনসমষ্টি শরয়ী অর্থে জিহাদ করতে পারে না। আপনার এই কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। সালাফদের মধ্য হতে ইসলামের শ্রেষ্ঠ আলেমদের মতামত এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ উলটো। এই ক্ষেত্রে অফেন্সিভ এবং ডিফেন্সিভ জিহাদের রুলিং প্রযোজ্য। জিহাদের অন্যতম মূল শর্ত হলো জিহাদ ঘোষণাকারী কর্তৃপক্ষকে একটা স্বীকৃত রাজনৈতিক (রাষ্ট্র) শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ওপরের কথাটি শুধুমাত্র অফেন্সিভ জিহাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ডিফেন্সিভ জিহাদের ক্ষেত্রে নয়। এর অনুপস্থিতিতে অবশ্য যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত থাকবে। তা হবে জিহাদতুল্য, জিহাদ নয়। মুসলিম ভূখণ্ড আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার তাগিদে যুদ্ধ করলে (আমীরের অনুপস্থিতিতে) তা জিহাদ নয় কেন? এই ক্ষেত্রেও আলেমদের মতামত সম্পূর্ণ উলটো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে হুবহু অনুসরণ করে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা যাবে– এটি অসম্ভব। আপনার উত্থাপিত পুনঃনির্বাচনের বিষয়টি এর প্রমাণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই কোনো আদর্শবিশেষকে স্থায়ীভাবে বহাল রাখার, একে টেকসই করার ব্যবস্থা আছে বা থাকে। পুনঃনির্বাচন এতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। সংবিধান হলো এই সুরক্ষা। গণভোট বা দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে এটি সম্ভব। আমাদের দেশে বর্তমান সরকার যেভাবে সংবিধানের পরিবর্তন ঘটিয়েছে এতে মনে হতে পারে সংবিধান যেন কাগজের একটা ছেঁড়া পাতা। এটি আমাদের ও আমাদের দেশের সংবিধানের দুর্বলতা। গণতন্ত্রের দুর্বলতা নয়। বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান চাইলেই আমূল পরিবর্তন করা যায় না।
এক মেয়াদে সরকার গঠন করলেই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব– এটি একটি অবাস্তব ধারণা। তাহলে কি দুই, চার বা পাঁচ মেয়াদে তা সম্ভব? না, ওভারহোয়েমিং মেজরিটি ছাড়া কোনো মেয়াদেই তা সম্ভব নয়। এ ধরনের ব্যাপক গণভিত্তি থাকলেও কর্তৃত্ব কায়েম সম্ভব নাও হতে পারে, মিশরের সর্বশেষ ও আলজেরিয়ার বিগত পরিস্থিতি এর প্রমাণ।
আবদুল্লাহ গুলের এ কথাটা খুব প্রমিন্যান্ট। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে একটা গাড়ি। যেটি দিয়ে আপনি অনেক দূর যেতে পারবেন। এক পর্যায়ে আপনাকে এটি হতে নামতে হবে। তাই গণতন্ত্র দিয়ে অগ্রসর হবেন, শক্তি সঞ্চয় করবেন। গণবিস্ফোরণের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। যাকে বলে বিপ্লব। ইরানের বিপ্লব ও গণতন্ত্রকে একটা (একমাত্র নয়) মডেল হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
গণতন্ত্রের প্রতি সহনশীলতা বা গণতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া মানেই মিছিল করা, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নয়। তুরস্কের ফতেউল্লাহ গুলেন কখনো মিছিল বা নির্বাচন করেননি। অথচ গুলেন মুভমেন্টের সমর্থনে বর্তমান একে পার্টি ক্ষমতায় আছে। আমাদের বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর তালগোল পাকানো রাজনীতি ও গণতান্ত্রিকতা দেখে বিভ্রান্ত না হওয়াই ভালো।
ইরান বা তুরস্কের গণতান্ত্রিক মডেল ছাড়াও ইসলাম প্রতিষ্ঠার আর একটা মডেল হতে পারে। এই প্রস্তাবিত মডেল গণতান্ত্রিক মডেল হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়, সম্পূরক। তা হলো সিস্টেম ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ইসলামপন্থীদের আধিপত্য সৃষ্টি। মালয়েশিয়াকে আমি মডেল বলবো না, উদাহরণ বলবো। তাদের জাতিগত পার্থক্যভিত্তিক পারস্পরিক সমঝোতাকে একটা ভালো কৌশল বলা যায়। এখানেও সাংবিধানিক কাঠামোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান।
ইসলামপন্থীরা পাঁচ বছরের এক মেয়াদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলে ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ধারণা যেমন স্পষ্ট ভুল ও একদেশদর্শিতা তেমনি ইসলামী সরকার একবার প্রতিষ্ঠিত হলে তা ওয়ানস ফরএভার হবে– এমনটি ভাবাও এক ধরনের অবাস্তব প্রান্তিকতা।
খেলাফতকে যদি ইসলামী রাষ্ট্রের অপরিহার্য শর্ত বিবেচনা করা হয়, যদি ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাসন-কর্তৃত্বকে রাজতন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলা যায়– তখন খিলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল ছিলো না। অথচ, (রাজতান্ত্রিক) খলিফা সুলাইমান কর্তৃক মনোনীত উত্তরাধিকারী ওমর বিন আবদুল আজিজকে (রহ) যথার্থ অর্থেই খলিফা হিসাবে গণ্য করা হয়। তিনি জনসমর্থনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেননি। রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় এসেছেন। আমাদের আধুনিক পরিভাষায় যাকে বেনিভোলেন্ট ডিক্টেটর বলা যায়।
এসব কথার উদ্দেশ্য হলো এ কথা বোঝানো যে, নামে খিলাফত বা খলীফা ব্যবহার করা হলেই তা শরয়ী খিলাফত বা খলীফা হবে এমন কোনো কথা নাই। আবার প্রকৃতপক্ষে শরয়ী খিলাফত হতে হলে খিলাফত বা খলিফা এই নাম থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই।
ইসলামী শাসনতন্ত্র, যাকে আমরা রাষ্ট্র বলছি, তা নির্ধারিত হবে এর বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র দিয়ে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মতো শুধুমাত্র নাম বা ঘোষণার কোনো মূল্য নাই। জন-জবাবদিহিতা ও ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের এক ধরনের প্রতিশ্রুতি ছাড়া গণতন্ত্রের যেমন নির্দিষ্ট কোনো রূপ নাই তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনারও নির্দিষ্ট কোনো একক পদ্ধতি ও কাঠামো নাই। পোশাকের মতো আছে কিছু মূলনীতি।
পরিশেষে আপনি অফেনসিভ ও ডিফেনসিভ জিহাদের পার্থক্য দেখিয়ে বলেছেন, ডিফেন্সিভ ওয়ারের জন্য কর্তৃপক্ষ লাগবে না। আমি এ কথার সাথে আংশিক একমত। কেননা, আত্মরক্ষার অধিকার সহজাত। কন্ডোলিজা রাইসের প্রি-অ্যম্পটিভ স্ট্রাইকের কনসেপ্টকে যদি আত্মরক্ষামূলক ধরা হয় তাহলে তো পৃথিবীতে কখনো কোনো অফেনসিভ ওয়ার হয়েছে– এ কথা বলা যাবে না। জিহাদ ফরজ। অথচ ফিতনা হারাম। দুটোর বাহ্যিক অবস্থা তো একই রকমের। অর্থাৎ আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে হামলা বা প্রতিহত করা।
জিহাদ হলো স্বচ্ছ, ফিতনা হলো গোপন। জিহাদের কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত ও কোনো না কোনো ভূখণ্ডের উপর কর্তৃত্বশীল। আর ফিতনাকারীরা হয় কোনো গ্রুপভিত্তিক ও সমাজবিচ্ছিন্ন। জিহাদ ঘোষণা ও পরিচালনার থাকে বোধগম্য যুক্তি। আর ফিতনাকারীদের পুঁজি হলো হঠকারিতা। জিহাদ ও ফিতনার উপর পৃথক আলোচনা হতে পারে। আমাদের সবসময়ে ভাবতে হবে, কী এমন ব্যাপার যাতে একই ধরনের কাজ কোনো সময় ফরজ (যেমন– জিহাদের বেলায়), আবার কী এমন ব্যাপার যাতে তা কোনো সময় ফিতনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে হারামের আওতায় পড়ে?
ঈগল: মামুন ভাই, স্যার আসলে গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ আস্থাও রাখতে পারছেন না, আবার ত্যাগও করতে পারছেন না। মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছেন। আর এর মধ্যবর্তী অবস্থানটা আমার মাথায় ঢুকছে না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কোনো না কোনো দিকে যেতে হবে, কোনো সমন্বয় হবে না। কেবলমাত্র একটিই ঠিক হবে– এ ধরনের চিন্তাভাবনাগুলো হলো প্রান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। ইসলাম হলো ভারসাম্য। দুনিয়াতে এমন কোনো আদর্শ নাই যার সবকিছু খারাপ। ইসলামে আছে সব আদর্শের ভালো দিকগুলো। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাক্টিভ হতে অসুবিধা কোথায়?
বুলেন: আপনার লিখার প্রথম অংশ আর শেষের দিকে একটু অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করছি। প্রথমেই, প্রচলিত পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে নাকচ করে দিয়ে ‘লেটস প্লে উইথ গণতন্ত্র’– এই আহবান জানানো হয়েছে। শেষের দিকে এসে ইসলামী গণতন্ত্রের বিরোধিতা করা হয়েছে। এই অবস্থায় সহজে উপসংহারে পৌঁছা সম্ভব কীভাবে?
আমি যতটুকু বুঝি, গত শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাজনৈতিক ইসলামের বিজয়ের চেষ্টা কোথাও গণতন্ত্র দিয়ে, কোথাও শক্তি প্রয়োগের জিহাদ দিয়ে, কোথাও ট্র্যাডিশনাল বাদশাহী দিয়ে, কোথাও মিলিটারি দিয়ে, আবার কোথাও বিপ্লব দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে। সফলতা নিরীক্ষণ করে উপযুক্ত পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মনে হয় না এখনো হয়েছে। তবে এই ব্যাপারে মনে হয় উপসংহারে আসা যায় যে, যেই পদ্ধতি নিয়েই আসতে চান না কেন, অন্য একটা সেক্যুলার দলের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার পথটা ততটা মসৃন নয়।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশেরই পুরোপুরি সমাধান পাশ্চাত্য মডেল দিতে পারছে না। গণতন্ত্র আর স্যেকুলারিজম পাশ্চাত্যের যে কোনো দেশেই এডপ্ট করলে মোটামুটি সমাধান আসে, কিন্তু মুসলিম বিশ্বে এর উল্টা হয়। এমনকি মুসলিম বিশ্বেরও এক দেশের মডেল আরেক দেশে কাজ করতে দেখা যায় না, রাজতন্ত্র আর ডিক্টেটরশিপ ছাড়া! যতই শূরার সাথে গণতন্ত্র মিল বলে চিত্কার করি না কেন, শূরার মূল্য বোঝার মত মানসিকতা এখনো মুসলিম বিশ্বে তৈরি হয় নাই। আর এই বিষয়টা ইসলামপন্থীদের আগে সেক্যুলাররা বুঝে। তাই তো, শূরা আর শরীয়া মিলিয়ে সুন্দর করে আরবদেরকে বাদশাহী খাওয়ানো হচ্ছে। অনেক দেশেই ইসলামী রাজনীতির সুযোগ করে দেয়ার নামে মিলিটারি খাওয়ানো হচ্ছে। অনেক দেশেই পার্লামেন্টারি শাসনের মুলা ঝুলিয়ে ডিক্টেটরশীপ খাওয়ানো হচ্ছে। আর আমাদের দেশে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে কীভাবে পারিবারিক রাজতন্ত্রের গণতন্ত্র গিলিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিচ্ছে। আমি যতটুকু বুঝি, জিহাদ আর গণতন্ত্রের মধ্যে সমীকরণ তৈরি করার সহজ উপায় হচ্ছে, রাজনৈতিক ইসলামের বিজয়কে ‘ইসলামের বিজয়’ হিসেবে রিপ্রেজেন্ট না করে ‘রিজিম চেইঞ্জ’ নামে তুলে ধরা!
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ইসলামের বিজয় বলতে ইসলামের ধারক-বাহকদের বিজয়। আমাকে প্রফেসর আবদুন নূর স্যার একদিন চবি দক্ষিণ ক্যাম্পাসের মসজিদের সামনে আরও অনেকের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করলেন, “বলো তো দেখি, মদীনা সনদের কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ও ইসলামী শরীয়াহকে একমাত্র আইন হিসাবে দাবি না করা সত্ত্বেও একে ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান বলা হয় কেন?” তখন আমি এর যে উত্তর দিয়েছিলাম তাতে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। উত্তরটি ছিলো এ রকম– মদীনা সনদের কোথাও তৎকালীন ইয়াসরিবকে মদীনা নামকরণ করে একে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় নাই। ইসলামী শরীয়াহকেও একমাত্র আইন হিসাবে ঘোষণা করা হয় নাই। তৎসত্ত্বেও তাকে ইসলামী রাষ্ট্র ও এই সনদকে ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান বলা এ জন্যই যথার্থ যে, ইসলামী শরীয়াহ আইনকে ল অব দ্য ল্যান্ড হিসাবে সবাই মেনে নিয়েছিল এবং মুসলমানদের নেতাকে জনপদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষ হিসাবে গ্রহণ করে নেয়া হয়েছিল। গোত্র ও সম্প্রদায়সমূহ নিজস্ব নেতৃত্ব ও বিধি-বিধান দিয়ে পরিচালিত হবে। পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ে মুহাম্মদকে (সা) সালিশ হিসাবে তারা মানবে। সিদ্ধান্ত দেয়ার সময়ে তিনি নিজস্ব আইন তথা শরীয়াহ ল অনুসরণ করলে তাদের আপত্তি থাকবে না। এটি তারা মেনে নিয়েছিল।
কোনো মতাদর্শ বা পদ্ধতির সাথে ইসলাম লাগানোকে আমি সমর্থন করি না। গণতন্ত্র মূলত একটা পদ্ধতি। সমাজতন্ত্র একটা মতাদর্শ। অবশ্য গণতন্ত্রকেও একটা মতাদর্শ হিসাবে কেউ কেউ মনে বা দাবি করেন। পুনরুক্তি করে বলা যায়, ইসলামের সাথে সব মত-আদর্শের কিছু না কিছু মিল বা সাদৃশ্য আছে। এতদসত্ত্বেও ইসলাম হলো একটি একক, অনন্য ও স্বতন্ত্র মতাদর্শ! সব ধরনের মত ও আদর্শের সব ভালো দিকগুলো ইসলামে আছে। আর সব মন্দ দিকগুলোকে ইসলাম বাতিল করেছে। তাই, ইসলামকে ইসলামী আদর্শ বলাই ভালো। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইসলামী গণতন্ত্র কথাটা আমার ভালো লাগেনি। ধন্যবাদ।
বুলেন: অন্য কমেন্ট থেকে আলোচনার জন্য নিলাম, “গণতন্ত্র ও বিপ্লব পরস্পরকে নাকচ করে। গণতন্ত্রের গাড়িতে করে যথাসম্ভব আগানোর পরে গণজোয়ার তথা বিপ্লবের আশ্রয় নিতে হবে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার গণতান্ত্রিক পন্থায় অগ্রসর হতে হবে।”
আপনি যে ট্রানজিশন পিরিয়ডের অগণতান্ত্রিক বা বিপ্লবী পন্থা বলছেন, তা অনেকটা যুক্তিসঙ্গত হলেও তা ব্যর্থতার আগাম সম্ভাবনা বাড়াবে (আলজিরিয়ার ‘৯২ উদাহরণ)।
অন্য জায়গায় বলেছেন, “ইরান বা তুরস্কের গণতান্ত্রিক মডেল ছাড়াও ইসলাম প্রতিষ্ঠার আর একটা মডেল হতে পারে। এই প্রস্তাবিত মডেল গণতান্ত্রিক মডেল হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়, সম্পূরক। তা হলো সিস্টেম ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ইসলামপন্থীদের আধিপত্য সৃষ্টি। মালয়েশিয়াকে আমি মডেল বলবো না, উদাহরণ বলবো। তাদের জাতিগত পার্থক্যভিত্তিক পারস্পরিক সমঝোতাকে একটা ভালো কৌশল বলা যায়। এখানেও সাংবিধানিক কাঠামোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান।”
বাংলাদেশে বামপন্থীদের পজিশনে ইসলামপন্থীদের রাখলেই তো মালয়েশিয়া মডেল হয়ে যায়। মানে পলিটিক্যাল অর্ডার ১৮০ ডিগ্রি মোড় ঘুরাতে পারলেই মালয়েশিয়া মডেলে চলে আসে। নাকি ভুল বললাম?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমার মনে হয় না। বামপন্থীরা নিছক সুযোগসন্ধানী। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে হবে। যদিও নিছক সুযোগসন্ধানী হওয়া অনুচিত। বামরা আওয়ামী সেজে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এক ধরনের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বের সংকটের কারণে তারা এ পথ ধরেছে। এতে তারা এস্টাবলিশমেন্টগত কিছু সুবিধা নিতে পারলেও তাদের আদর্শিক অপমৃত্যু ঘটেছে।
আমাদেরকে কিছু নোশন বা বিষয় সামনে রেখে এগুতে হবে। এক্সাক্টলি বিষয়টা কীভাবে হবে, ময়দান তথা বিদ্যমান বাস্তবতাই তা বলে দিবে। তাই এ ধরনের মোর প্র্যাক্টিকাল বিষয়ে এক্সাক্ট বা একুরেট থিওরিটিক্যাল আলোচনা বা প্রেডিকশন করা কঠিন। যারা ময়দানবিচ্ছিন্ন, তাদের পক্ষে ঠিক মতো বুঝে উঠাও কঠিন।
যা যা করা যাবে না ও যা যা করতে হবে– তা সব একসাথে বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে হবে স্বচ্ছ, তরল ও গতিশীল (কনসিস্ট্যান্ট, ফ্লুয়িড এন্ড ডাইনামিক)। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এর স্থিতিশীলতার জন্য যা যা করা যাবে না তা হলো– নিছক ক্ষমতার রাজনীতি করে এমন বড় দলের মধ্যে অনু্প্রবেশ ঘটানো যাবে, তাদের সাথে ইস্যুভিত্তিক রাজনীতি মাঝে মাঝে করা যাবে কিন্তু দীর্ঘসময়ের জন্য তথা সার্বক্ষণিক সমঝোতার নামে লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে কূটনীতির নামে ডাবল-স্ট্যান্ডার্ট বা প্রতারণাকে স্থায়ী নীতিতে পরিণত করা যাবে না, প্রকৃত সাংগঠনিক শক্তির অতিরিক্ত প্রদর্শনী করা বা অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব নেয়া যাবে না, ইহজাগতিকতাবিমুখ তথা নিছক আধ্যাত্মবাদী হিসাবে নিজেদের চিহ্নিত করা যাবে না।
যা যা করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে তার অন্যতম হলো– বিদ্যমান সিস্টেমকে যথাসম্ভব ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করে এর ক্ষমতা-বিন্দুগুলোতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে হবে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্ধ আনুগত্যশীলতার নীতিকে পরিহার করে সর্বপর্যায়ে অবাধ বুদ্ধিবৃত্তিচর্চাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে এবং ক্যাডার পদ্ধতি বাদ দিয়ে গণনেতৃত্বের ধারায় অগ্রসর হতে হবে, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক জগতে নিজেদের প্রাধান্য সৃষ্টি ও তা বজায় রাখতে হবে এবং ট্রি মডেলের পরিবর্তে গার্ডেন মডেলে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ট্রি-মডেল হচ্ছে মূল সংগঠনের নামে-বেনামে কিন্তু প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন পার্শ্বসংগঠন কাঠামো। আর গার্ডেন মডেল হচ্ছে আদর্শিক ঐক্যবন্ধনে থাকা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংগঠনপদ্ধতি।
ঈগল: সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীর (রহ) একটি কথা পড়েছিলাম। কথাগুলো ছিল এই রকম– “যখন কোনো আদর্শ পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করে তখন দুর্বলচেতা মুসলিমরা ঐ আদর্শকে ইসলামের সাথে মিলাতে চায়। তারা এটা প্রমাণ করতে চায় যে, ইসলাম এবং ঐ আদর্শের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই।” দুর্ভাগ্যজনক যে, সাইয়্যেদ সাহেবই গণতন্ত্রকে ইসলামাইজেশন করার চেষ্টা চালিয়েছেন। গোলাম আযম (আল্লাহ তাঁকে দ্রুত মুক্তি দিন) সাহেব আরো একধাপ এগিয়েছেন ‘ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মধ্যে তিনি কোনো পার্থকই খুঁজে পাননি’। আর আপনার ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে আপনি একে ত্যাগও করতে পারছেন না, আবার গ্রহণও পারছেন না।
আপনি নিশ্চই জানেন ডেমোক্রেসি শব্দটি আরবি ভাষার কোনো শব্দ নয়। তাই এটাই কি যুক্তিযুক্ত নয় যে, যারা এটার (গণতন্ত্রের) উদ্ভাবক এবং এটার বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছে তাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েই এটা উপর ফতোয়া দিতে হবে। অর্থাৎ আগে জানতে হবে, তারা এটা কী অর্থে প্রয়োগ করে। তারপরই তো আসবে এটা গ্রহণ বা পরিত্যাগের ব্যাপারটি। তাই নয় কি?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি যেহেতু এসবি ব্লগের সর্বাধিক গণতন্ত্রবিরোধী, আশা করছিলাম আপনি আলোচনাতে আসবেন। গণতন্ত্র ইসলামিক– এ কথাটা ভুল। গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় ইসলামের মধ্যে তার কিছু নাই– এ কথাটাও ভুল। উপরের এক মন্তব্যে বলেছি, ইসলাম যেহেতু আগে এসেছে সেজন্য (পাশ্চাত্য) গণতন্ত্র হতে ইসলামের কিছু ধার করার প্রশ্ন আসে না। ইসলামে গণতন্ত্রের অনেক উপাদান ও বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে ইসলামী গণতন্ত্র জাতীয় কথাবার্তা না বলাই ভালো মনে করি। গণতন্ত্রকে একটা মতাদর্শ হিসাবে বিবেচনা করলে তা নিঃসন্দেহে একটা জাহেলী মতবাদ। প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আপনার কথামতো গণতন্ত্র মূলত একটা পদ্ধতি হওয়া সত্ত্বেও নাস্তিকতা ও ইহজাগতিকতার সাথে মিলিয়ে একে (জাহেলী) মতাদর্শ হিসাবে যখন উপস্থাপন ও চর্চা করা হচ্ছে তখন একে সম্পূর্ণ বাদ দেয়া ছাড়া একজন মুসলিমের অন্য কিছু কী করার আছে?’ এই সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের অন্তসম্পর্ক আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে।
যা কিছু জাহেলিয়াতে ছিল তার সবটুকু ইসলামে বাদ দেয়া হয়েছে– এমন নয়। কতটুকু গ্রহণ করা হয়েছে? অনেকটুকু। বিশেষ করে বাহ্যিক কাঠামোগত দিক থেকে। বাদ দেয়া হয়েছে এর অন্তর্গত মূলনীতিগত বিষয়গুলোর আপত্তিজনক অংশটুকু। যেমন– হজ্ব জাহেলী যুগেও ছিল, ইসলামেও আছে। বাদ দেয়া হয়েছে এর শিরকমূলক উপাদানকে। খায়বরের চাষাবাদ পদ্ধতিকে বহাল রাখা হয়েছে। এভাবে ইসলামী আইন ও সামাজিক পদ্ধতিসমূহকে যাচাই করলে দেখা যাবে এতে একেবারে নতুন বিষয় খুব কম। অধিকাংশ বিষয়কেই বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা হতে নিয়ে ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্ট তথা তাওহীদের ধারায় মডিফাই করা হয়েছে। আমার এ কথায় সরলপ্রাণ মুসলমান ভাইবোনেরা আহত হলেও এটা সত্যি। মদীনার সনদে তো বিদ্যমান কাঠামোকে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। রদ করা হয়েছে সাধারণ আইনের (ল অব দ্য ল্যান্ড) গোত্রীয় বৈধতাকে। অথচ সীমিত পরিসরে তথা গোত্রের অভ্যন্তরীণ ও নিজস্ব পরিমণ্ডলে গোত্রীয় আইন-কানুনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।
আপনি বলতে পারেন, এসবকে পরে বাতিল করা হয়েছে। তাদের পক্ষ হতে চুক্তিভঙ্গের কারণে স্বয়ং রাসূল (সা) যা পরে বাধ্য হয়ে বাতিল করেছেন তা প্রথমেই বাতিল করে কীভাবে আপনি সুন্নাহ তরীকায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন? ডা. জাকির নায়েকের ‘হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম’ শিরোনামের বই ও সিডি দেখে থাকবেন। ইন্ডিয়াতে দাওয়াতী কাজের এটিও একটা উপায়, যা আমরা কখনো ভাবি নাই। হিন্দুদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ করতে গেলে আপনাকে দেখাতে হবে হিন্দু ধর্মের মধ্যে যা কিছু আসলেই ভালো, তা আপনি সমর্থন করেন। এর যা কিছু ত্রুটি বা অপূর্ণতা তার উত্তম বিকল্প ইসলামে আছে। খ্রীষ্টানদের মধ্যে কাজ করতে গেলেও অনুরূপ পন্থায় অগ্রসর হতে হবে।
এটি কিন্তু নিছক কৌশল নয়। এটি হলো বাস্তবতা। ইসলাম হলো সব ভালো। অন্য যা কিছু তা আংশিক ভালো। সব ভালো অর্থেই ইসলাম হলো দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসাবে একমাত্র গ্রহণযোগ্য। মানুষকে পূর্ণ কল্যাণ তথা সব ভালোর দিকে আহ্বান করাই হলো ইসলামী দাওয়াহ, যাতে মানুষ টেকসেই কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে পারে। দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা এমন কিছু সৃষ্টি করেন নাই যা সর্বাংশে খারাপ। প্রো-অ্যাক্টিভ হওয়ার এটিই মর্মার্থ। আমি এপলজেটিক নই। আপনার জানার কথা। যেহেতু আপনার সাথে আমার অনেক দিনের যোগাযোগ। আমি প্রতিক্রিয়াশীলও নই। আমি ন্যায়সংগত সমন্বয়ের পক্ষপাতি। বাইনারি সিস্টেম বা একদেশদর্শিতায় বিশ্বাস করি না। ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
অভিযাত্রিক: “আন্তর্জাতিক তথ্যমাধ্যমে ইসলাম সবচেয়ে বেশি ভুল বুঝার শিকার হওয়া একটা ধর্ম। পাশ্চাত্য পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলিমদেরকে এক ধরনের নির্দিষ্ট মানসিকতা দিয়ে যাচাই করা হয়, যেটা ভুল। এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম থিসিস এই অবস্থাকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে।”
যখন বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামের অবস্থা নিয়ে কথা বলা হয়, উপরের বাক্যগুলো আমাদের ইসলামিস্টদের, এমনকি অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদেরও, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা বক্তব্য।
আমার মতে, ভুল বুঝার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম এবং গণতন্ত্রের অবস্থান এখন অনেক কাছাকাছি। ইসলামের মুখপাত্র যেমন এখন তালেবানরা, তেমনি গণতন্ত্রের মুখপাত্র এখন বুশ এবং রামসফেল্ডরা।
গণতন্ত্রের মূল চেতনা কী? ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়া একটা উপষঙ্গ মাত্র। বরং আধুনিক গণতন্ত্র মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করছে। ইসলামের মৌল চেতনার সাথে এর খুব একটা তফাৎ আছে কি? আল্লাহ মানুষকে বাছাই করার অধিকার দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন, রাসূল (সা) বলেছেন, ইসলাম হলো স্বভাবধর্ম। কিন্তু আমরা যখন ইসলামকে চাপিয়ে দিতে চাই, তখন আবার একই সাথে বুশের ‘গণতন্ত্র রপ্তানি’ প্রচেষ্টার নিন্দা জানানো আমাদের সাজে না।
ইসলাম কীভাবে প্রতিষ্ঠা হবে? গণতন্ত্র না জিহাদ?
ইসলাম ইসলামের মতো করেই, যা ন্যায়সঙ্গত এবং সততাপূর্ণ হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেখানো পথ অনুযায়ী, সেই কার্যপন্থায় প্রতিষ্ঠা হবে। এবং ঐ প্রক্রিয়াটা অনেক জটিল ও বিশ্লেষণযোগ্য যেটা এই প্রশ্নের মতো সরলীকরণ করে ফেললে সম্ভবত সঠিক উত্তরের দিকে আমাদেরকে নিয়ে যাবে না। ইসলামের আরও বেশি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে (আমি মনে করি, এখন পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত নেই, এ কথা বলাটাও অতি সরলীকরণ) সত্যিকার গণতান্ত্রিক চেতনা (আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনে পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রভাবমুক্ত) যেমন অনিবার্য একটা উপাদান, তেমনি অন্যায় ও অনৈসলামিকতার প্রতিরোধ ছাড়াও ঐ প্রক্রিয়ার চিন্তা করাটা বোকামী।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যারা নামাজ পড়েন না, তাদের কাউকে কাউকে দেখেছি নামাজ পড়ার কথা মাঝে মাঝে ভাবেন। যখন কোনো ওয়াক্তের নামাজ পড়তে যান তখন এমনকি নফলও মিস করেন না। টুপি তো মাস্ট। তাদের বক্তব্য হলো পড়লে একেবারে পারফেক্ট করেই পড়বো! এত পারফেকশনকে নিশ্চিত করতে যেয়ে এমন লোকদের প্রায়ই নামাজ কাযা হয়ে যায়।
কথাটা এজন্য বললাম যে, অনেকের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্র মানে যেন এক এক টুকরো বেহেশত। এতে নাই, থাকবে না, থাকতে পারে না কোনো অন্যায়, শোষণ, অবিচার, ব্যভিচার, জুলুম! বেহেশতের মতো শুধু সালামান সালামা! এই ধরনের অবাস্তব ইসলামী রাষ্ট্রের গঠনকাঠামো হলো খলিফা আবু বকর (রা) ও ওমরের (রা) সময়কার।
সেজন্যই ‘ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা’ শীর্ষক পোস্টে প্রশ্ন তুলেছিলাম, মদীনাতে ১ম হিজরীতে মদীনা সনদ স্বাক্ষরকালীন শাসন-কর্তৃত্বকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে কিনা? উত্তর যদি ইতিবাচক হয় তাহলে বিবেচনা করতে হবে, সুদ, মদ হারাম না হওয়া ও হিজাব, মিরাস ইত্যাদি ফরজ না হওয়া সত্ত্বেও তা ইসলামী রাষ্ট্র হলো কী করে? আপনার ‘পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত নেই, এ কথা বলাটাও অতি সরলীকরণ’ কথাটা আমার বেশ ভালো লেগেছে। সেজন্য এ কথাগুলো বললাম।
বিংশ শতাব্দীতে যুগের প্রয়োজনে প্রফেসর ড. ইসমাইল ফারুকীর প্রদত্ত জ্ঞানের ইসলামীকরণের আহ্বান এখন দু’ধারায় ক্রিয়াশীল। একটা ধারায় ইসলামাইজেশনকে মূলত কারিকুলাম রিফর্মের গঠনমূলক প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্য ডমিন্যান্ট ধারাটা একটা নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে আগাচ্ছে। ভাবখানা এমন যে, (পাশ্চাত্য) জ্ঞান অতি-অনৈসলামিক(?)। একে ইসলামীকরণ করতে হবে। পরিবর্তনের কিছু না পেলে ইসলামী সিলটা অন্তত লাগিয়ে দিতে হবে। যেমন– ইসলামী গণিত ইত্যাদি। কিছু না কিছু আরবীকরণ করে হলেও ইসলামাইজ করতে হবে!?
গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলামী বিপ্লবের কথা যারা বলেন তারা জেনে হোক না জেনে হোক– একটা মারাত্মক ভুল করেন। ভুলটা খুবই মোটা দাগের। গণতন্ত্র ও বিপ্লব পরস্পরকে নাকচ করে। গণতন্ত্রের গাড়িতে করে যথাসম্ভব আগানোর পরে গণজোয়ার তথা বিপ্লবের আশ্রয় নিতে হবে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার গণতান্ত্রিক পন্থায় অগ্রসর হতে হবে। শুধু গণতন্ত্র দিয়ে কোথাও কোনো বিপ্লব হয় নাই। ইসলামী বিপ্লব নিছক গণতান্ত্রিক পন্থায় করার কথা যারা বলেন, তারা হতে পারে বিষয়টা নিয়ে আদৌ ভাবেন না। কিছু একটা বলা দরকার, তাই বলেন। অথবা জনগণ ও নিজ কর্মী বাহিনীকে কৌশলের নামে প্রতারণা করেন। ইসলামে স্বচ্ছতার সর্বাগ্রাধিকার। কোনো গোপন এজেন্ডা নিয়ে ইসলামী সংগঠন করা বা এতে সত্যিকারের সফলতা লাভ সম্ভবপর নয়।
ইসলামী বিপ্লবের জন্য যারা জিহাদের কথা বলেন তারা না জানার কারণে সাংঘাতিক ভুল করেন। শ্রী গবুচন্দ্রকে (?) যতই শহীদ হিসাবে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হোক না কেন, তিনি যেমন ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ নন তেমনি রাষ্ট্রীয় তথা ভূ-রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে কিতাল অর্থে জিহাদ দাবি করা হলে তাও শরয়ী জিহাদ হতে পারে না।
হারব বা যুদ্ধ মাত্রই কিতাল অর্থে জিহাদ নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো (মুসলিম-অমুসলিম) অপরাধীচক্রকে দমন করার জন্য পরিচালিত অভিযান জিহাদ হবে না। কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে অপর কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা ইসলামী রাষ্ট্রশক্তির সংঘর্ষ হলে তা জিহাদ হবে না, যদিও এর একটি দল নিশ্চিতভাবে ভুলের উপর রয়েছে। আলী (রা) ও মুয়াবিয়ার (রা) মধ্যকার সংঘর্ষ, আলী (রা) ও আয়িশার (রা) মধ্যকার যুদ্ধ এর উদাহরণ। কিতাল অর্থে জিহাদ একটি বিশেষ শরয়ী পরিভাষা। কোনো ব্যক্তি বা দল বিশেষ তা আমল করতে পারে না। এর জন্য রাষ্ট্রশক্তির উপস্থিতি ও অনুমোদন অপরিহার্য।
কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা দল আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে মোকাবিলা করলে তা জিহাদতুল্য হবে, জিহাদ হবে না। এ ধরনের নিছক আত্মরক্ষামূলক মোকাবিলা হবে নিতান্ত ক্ষুদ্র পরিসরে, সাময়িক ও বিদ্যমান আইন-ব্যবস্থাপনার অকার্যকর পরিস্থিতিতে। এমতাবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র বা আমীর/খলিফা উপস্থিতি বা অনুমোদনের শর্ত লাগবে না। শাসন-কর্তৃত্ব ছাড়া জিহাদের উদাহরণ বা স্বীকৃতি রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাহতে আছে কি? ইসলামী শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নবী মুহাম্মদ (সা) প্রদর্শিত পদ্ধতি হলো দাওয়াতী কাজ করে যাওয়ার সাথে সাথে সম্ভাব্য কোনো কর্তৃত্ব বা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ঢুকে পরে এর নেতৃত্ব গ্রহণ করা। এজন্য নিজেদেরকে ব্র্যান্ড হিসাবে গড়ে তোলা ও উপস্থাপন করতে হবে। উপযুক্ত সময়ে গণজাগরণের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় এ কাজে সহায়ক হতে পারে বটে। কিন্তু শুধু নির্বাচনী বিজয় দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন হতে পারে না।
ঈগল: আমি আপনার জবাব পড়লাম। চমৎকার যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনি যুক্তির উল্টো পিঠে নজর দেননি। আপনি হজ্জের কথা বলেছেন। আমাদের মনে রাখা দরকার হজ্জের বিধিবিধান আল্লাহ নাজিল করেছেন। অতঃপর কিছু মানুষ আল্লাহর বিধি-বিধানের উপর নিজেদের কিছু বিধান আরোপ করে। মহান আল্লাহ মানুষ কর্তৃক আরোপিত বিধানগুলো বাতিল করেছেন মাত্র। চাষাবাদের ব্যাপারটিও একই রকম, ওটাতে কল্যাণ আছে, তাই তিনি তা বহাল রেখেন।
এবার খেয়াল করুন, মদের মধ্যেও কিছু উপকারিতা আছে, কিন্তু আল্লাহ মদকেই হারাম করে দিলেন।
শব্দের মারপ্যাচে আমাদের নাবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাফিরা বিব্রত করতে চেয়েছিলো। শব্দটি ছিল ‘রায়েনা’। ভালো খারাপ দুটি অর্থই ছিল, কিন্তু কাফিরা মন্দ অর্থ নিত। আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের জন্য শব্দটিই নিষিদ্ধ করে দিলেন। ধর্মগ্রন্থের দিকেও নজর দেওয়া যেতে পারে। ইঞ্জিল কিতাবে অনেক কিছুই ভালো আছে, তাই বলে আল্লাহ সর্বশেষ আসমানী কিতাবের নাম ইঞ্জিল রাখেননি। এটা হলে বিভ্রান্তির চরম আশংকা থাকত।
আপনি এক জায়গায় লিখেছেন ‘দাওয়াতী কাজ স্বয়ং একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয় কি?’ মদের ভিতর পানিও থাকে, তাই বলে আমি বলতে পারি না, মদ খাওয়া মানে পানি খাওয়া। তাই নয় কি? আমি যখন মদের উপর লেকচার দিব তখন মদের উপকারিতার আলোচনাও করতে পারি, কিন্তু সর্বশেষ ফায়সালা হবে মদ হারাম। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও অনেক কল্যাণ আছে কিন্তু সর্বশেষ ফায়সালা আসবে এটা হারাম। ধর্মগ্রন্থের আলোচনার ক্ষেত্রেও তাই। ভালো দিক আলোচনা করবো কিন্তু শেষে বলবো, কুরআনকে মেনে নিন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: মদের মধ্যে পানির উপাদান আছে। তাই যখন আপনি পানি খান তখন আপনি মদের একটা অন্যতম প্রধান উপাদানকে গ্রহণ করেন, ব্যাপারটা তাই? দুনিয়াতে কোনো জিনিসই সম্পূর্ণ আলাদা নয়। সবকিছুর মধ্যে ওভারলেপিং বৈশিষ্ট্য থাকে। ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের যেমন কিছু মৌলিক সাদৃশ্য আছে তেমনি সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মৌলিক পার্থক্যও আছে। সেজন্য ইসলাম ও (পাশ্চাত্য) গণতন্ত্রকে অভিন্ন বলা বা মনে করাটা যেমন ভুল তেমনি ইসলাম মানতে হলে গণতন্ত্রকে শেষাবধি (সম্পূর্ণ) বাদ দিতে হবে– এ ধারণাটাও ভুল। ইসলামের সাথে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শ হিসাবে গণতন্ত্রের ধারণাকে আপনি বিরোধিতা করছেন। প্রায়োগিক পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রকে নয়। অতএব, প্রেক্ষিত বিবেচনা ছাড়া এক কথায় বলা যাবে না যে, গণতন্ত্র ইসলামসম্মত বা ইসলামবিরোধী। আমার মনে হয় এ বিষয়ে আমার বক্তব্যকে আমি যতটুকু চেয়েছি ততটুকু স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি। ধন্যবাদ।
আয়নাশাহ: সময় করে পড়ার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। আজ সবগুলো মন্তব্য এবং আপনার জবাবসহ পড়লাম। মাথায় থাকা অনেক প্রশ্ন আবারও উদয় হলো। লেখা এবং জবাবগুলো খুবই যৌক্তিক লেগেছে। এই ধরনের আলোচনা করে আমাদেরকে আরো সমৃদ্ধ করবেন আশা করি। আল্লাহ আপনার জ্ঞান আরো বাড়িয়ে দিন এবং তা থেকে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করুন। ধন্যবাদ।
একটি কথা। ব্লগার সখি হয়তো ভালো লিখেন, ভালো প্রশ্নও করতে পারেন, কিন্তু ইসলামকে তিনি প্রচলিত অর্থে নিছক একটা ধর্মই মনে করেন এবং এই ধারণা থেকে তিনি সরে আসবেন না জেনেও তার সাথে সময়ক্ষেপনের যুক্তি কী? এদেরকে এড়ানোই ভালো নয় কি? যার মাঝে এই ধারণাটাই নাই, মূর্তিকে অপসারণই হলো মুহাম্মদের (সা) মিশন, সেগুলোকে ঐতিহাসিক নিদর্শন করে না রাখাটা নাকি তার অপরাধ? এই মৌলিক জিনিসটা যার মাথায় ঢুকে না, তার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা কি চলে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমার ধারণায় তিনি একজন রিভার্স প্লেয়ার। এত লম্বা লেখা কষ্ট করে পড়েছেন। সেজন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি যে কনসেপ্ট গ্রুপের কথা বলি তার যৌক্তিকতা নিয়ে আজ একটা লেখা দিয়েছি। সময় করতে পারলে দেখবেন। ভালো থাকুন। দোয়া করবেন।
মেগামেন: সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইসলাম ও কোরআনে ইসলামের রাজনীতির ধরন কী হবে তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া নাই। এবং এই না বলাটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট রহমত। এই সিয়াসাহ বিষয়গুলোর ফিকাহ পুরাটাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সময়ের উপর নির্ভরশীল। অনেক আলেমের মতে, সময় ও পরিবেশ অনুযায়ী মাঝে মাঝে রাজতন্ত্রও জায়েজ হতে পারে, আবার একই কারণে গণতন্ত্র। মূল উদ্দেশ্য, ‘খাইর বা ভালো সবচেয়ে বেশি বিকশিত হওয়া।’
I am an ordinary man. i can’t draw conclusion from this article. it should be more clear. Only then it will be helpfull.