কেন এই লেখা?
কিছুদিন আগে একজন ব্লগার ‘ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্রের সংশয়সমূহ’ শীর্ষক একটা লেখা ইমেইল সংযুক্তি হিসাবে প্রেরণ করেন। তার অনুরোধ, যেন এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য পাঠাই। এটি আত্-তিবয়ান পাবলিকেশন্স প্রকাশিত কোনো পুস্তিকা হতে পারে। এ-ফোর সাইজ কাগজের ২২ পৃষ্ঠা। প্রিন্ট করার পর পরই সেটি পড়েছি। লিখছি, লিখবো করে প্রায় মাস দেড়েক পরে আজ বসলাম। লেখাটা সম্পর্কে আমার মতামত জানানোর আগে কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি।
গণতন্ত্র কি একটা বাতিল দ্বীন?
ইদানীং আধুনিক শিক্ষিত ইসলামপন্থীদের একাংশের মধ্যে গণতন্ত্র বিরোধিতার একটা হুজুগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের মূলকথা হলো, গণতন্ত্র নিছক ক্ষমতা পরিবর্তন পদ্ধতি মাত্র নয়। বরং একটা স্পষ্টতই বাতিল দ্বীন বা মতাদর্শ। রাসূলুল্লাহ (সা) মাটিতে একটা সরল রেখা টানেন। এর থেকে গাছের কাণ্ডের মতো কতকগুলো রেখা আঁকেন। অতঃপর তিনি বলেন, এই সরল রেখাটি হচ্ছে দ্বীন ইসলাম। আর অপরাপর সব বক্র রেখাসমূহ হচ্ছে বাতিল দ্বীন। তোমরা এসব থেকে সাবধান থাকবে। এটি হচ্ছে হাদীসটির মূলকথা। গণতন্ত্র বিরোধী এসব খিলাফতপন্থীদের কথা হলো, গণতন্ত্র তেমনই একটি বাতিল দ্বীন বা মতাদর্শ।
রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের দায়
রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের গণতন্ত্র, বিশেষ করে আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের প্রতি (বাহ্যত) সীমাহীন মোহ ও হঠকারিতাসুলভ আনুগত্য এই বিশেষ ধরনের প্রান্তিকতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। যারা মনে করেন, ইসলাম হলো মূলত রাজনীতি, তাদের গুরুরা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উপনিবেশ হতে, পরবর্তীতে একনায়কতন্ত্র হতে বাঁচার জন্য উদীয়মান গণতন্ত্রের সবক গ্রহণ করেন। শুরুতে এটি মূলত নির্দোষ মনোভাবের কারণে বিরাজমান পরিস্থিতিতে আংশিকভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তৎপূর্ববর্তী আলেমদের অরাজনৈতিক ইসলাম-প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে এই রাজনৈতিক ইসলাম এক ধরনের সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
প্রান্তিকতা রোগে আক্রান্ত মুসলিম মানস
প্রান্তিকতা রোগে আক্রান্ত মুসলিম মানসের এই অংশটি আধ্যাত্মিকতার প্রান্তিকতার বিপরীতে রাজনৈতিকতার প্রান্তিকতায় নিজেদের সোপর্দ করেছেন। তারা অবচেতনভাবে হোক আর অঘোষিতভাবে হোক দ্বীন প্রতিষ্ঠাকামী অপরাপরদের ‘খরচের খাতায়’ ফেলে দিয়ে নিজেদের খণ্ডিত বুঝজ্ঞান মোতাবেক ‘রেজামন্দি’ হাসিলে মশগুল আছেন! রাজনৈতিকতাবাদী এই দলের ইসলামিস্টরা দল ও দেশের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ক্রমাগতভাবে মোটাদাগের সব ভুল করে চলেছেন। ইনারা নিকট বা সুদূর ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো মুহূর্তে কনসিস্টেন্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না বলেই অনেকে আশংকাবোধ করেন। গুণগত দিক থেকে প্রধান ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীটির গণতন্ত্রের নামে এহেন রাজনৈতিক হঠকারিতার ফলশ্রুতিতে গণতন্ত্র বিরোধী শ্লোগান এমনকি তাদের জনশক্তির একাংশসহ অনেকের কাছেই এখন মধুরতর ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। এটিও প্রান্তিকতা রোগের আরেকটি ধরন। যে ভাই আমার কাছে উপর্যুক্ত লেখাটি পাঠিয়ে মতামত চেয়েছেন, তিনিও গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক ইসলামিস্ট দলের একজন সক্রিয় প্রাক্তন।
‘ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র’ ধরনের আলোচনাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের (আলেম) নিরপেক্ষতা কিম্বা দোদুল্যমানতা
লক্ষ্য করেছি, ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ ‘ইসলাম’ এই নাম বা সিল না দেখলে চোখমুখ বুঁজে যে কোনো মত বা তত্ত্বকে বাতিল ঘোষণা করে ঈমানী দায়িত্ব পালনের তৃপ্তিবোধ করেন। যদিও কার্যত ইসলামের সাথে সেটির কোনো মৌলিক বিরোধ নাই। অথবা ইসলামের সাথে কিছু মৌলিক সামঞ্জস্য পেলেই কোনো কর্মপন্থা বা তত্ত্ব বিশেষকে ইসলামী হিসাবে ঘোষণা করেন। এ দৃষ্টিতে বলা যায়, ইসলামীকরণ হলো যে কোনো প্রকারে জায়েজকরণ প্রকল্প! অপরদিকে পপুলার আলেমদের বৃহদাংশ ইসলাম ও অন্যান্য মতবাদ, বিশেষ করে গণতন্ত্র নিয়ে গঠনমূলক পর্যালোচনাকে প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
প্রায় মাসখানেক আগে ‘সোনার বাংলাদেশ ব্লগের’ একজন তরুণ ও জনপ্রিয় প্রবাসী আলেম ব্লগার ‘কোন্ দলে যোগদান করা উচিত’ বিষয়ে একটা লেখা পোস্ট করেন। তাতে গণতন্ত্রপন্থী একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি উনার প্রচ্ছন্ন সমর্থন স্পষ্ট হয়ে উঠলে জনৈক গণতন্ত্রবিরোধী ইসলামিস্ট ব্লগার উনার পোস্টে গণতন্ত্রের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে বিস্তারিত কমেন্ট করেন। ভাবছিলাম গণতন্ত্র বিষয়ক আমার লেখাটার জন্য ওই কমেন্টটার সহযোগিতা নেব। ওমা! পরের দিনই দেখি তিনি (পোস্টদাতা) পুরো লেখাটাই হযফ করে দিয়েছেন! কেন তিনি পোস্টটি ডিলিট করলেন, সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আমার ধারণায় সদ্য আযহার-শিক্ষিত এই তরুণ ব্লগার উনার ‘আলেম হিসাবে নিরপেক্ষ’ অবস্থান সংরক্ষণে অধিকতর যত্নবান হয়েছেন। অথবা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেয়া (আপাতদৃষ্টিতে) জোরালো মন্তব্যের সামনে তিনি নিজেকে অসহায় মনে করেছেন!
ইতিহাস সম্পর্কে গণতন্ত্রপন্থীদের (স্ব)বিরোধ
রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের মধ্যে যারা গণতন্ত্রপন্থী তারা ‘ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র’ ধরনের আলোচনাকে নিতান্তই বাহুল্য মনে করেন। তাদের মানস গঠনটাই এমন যে, তারা মনে করেন ইসলাম ও গণতন্ত্র – এ দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নাই। গণতন্ত্রই হচ্ছে দ্বীন প্রতিষ্ঠার একমাত্র পদ্ধতি, অন্ততপক্ষে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। বর্তমানের জন্য একমাত্র (?) পদ্ধতি। তাই তাদের দৃষ্টিতে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা পদ্ধতি যে কতটা গণতান্ত্রিক সেটি ‘প্রমাণ’ করার আলোচনাই কেবলমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।
চিন্তাগত অস্বচ্ছতা (কনসেপ্চুয়্যাল অ্যাম্বিগিউটি)
রাসূলুল্লাহ (সা) যে মদীনাতে শুরুর দিকে সংখ্যালঘুদের নেতা ছিলেন, সেটি শুনলে তারা শকড হন। একেকজন খলীফা যে একেকভাবে ক্ষমতা লাভ করেছেন, তা ব্যাখ্যা করার সময়ে তারা নানান কন্ট্রাডিকটরি কথাবার্তা বলেন। এক পর্যায়ে তারা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের উদাহরণ বা অজুহাত তোলেন। অথচ, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র (মূলত গোত্রীয় ব্যবস্থা) আর আধুনিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্র সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রাক্কালে আমি এমনও বলতে শুনেছি, মদীনার সরকারই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রথম নজির!
স্থবির পাঠ্যসূচি ও চিন্তার সীমাবদ্ধতা
গণতন্ত্রকে প্লাটোর নামের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। অথচ তিনি গণতন্ত্রকে সমর্থন করেন নাই। প্রমিন্যান্ট মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবীর ‘আল মাদীনাহ আল ফা-দিলাহ’, ‘সিয়াসাহ আল মাদানিয়্যাহ’ ইত্যকার কোনো গ্রন্থেই গণতন্ত্রকে আদর্শ (ইসলামী) রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ বা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। অন্যদের তো দূরের কথা নিজেদের (ইসলামের) ইতিহাস অধ্যয়নেও উনারা আগ্রহী নন। গণতন্ত্রপন্থী ইসলামিস্টদের প্রধান দলের লোকজন স্বীয় দলের প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিককেই অঘোষিতভাবে ইসলাম, ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস ও ইসলামী আন্দোলন বুঝা ও সে মোতাবেক চলার জন্য যথেষ্ট মনে করেন। তাই আল ফারাবী বলুন, আর ইতিহাসতত্ত্বের জনক ইবনে খালদুন বলুন, হাজার বছর আগের ইমাম গাযালী বলুন, আর কয়েক দশক আগের মুহাম্মদ আল-গাযালী বলুন, (কিছুটা) ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছাড়া উনারা আর কাউকে রেফার করে কিছু বলেছেন – এমনটা শুনি নাই। আধুনিক গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট উদার হওয়া সত্ত্বেও উনারা সমকালীন প্রধান ইসলামী তাত্ত্বিক ইউসুফ কারযাভী বা তারিক রমাদানের মতো কোনো প্রলিফিক রাইটারদের কোনো বই দলীয় পাঠ্য তালিকায় রাখার প্রয়োজনবোধ করেন নাই। আশরাফ আলী থানভির নাম উনারা শুনে থাকবেন। উনার যে শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই আছে, সেটি জানার গরজও উনারা অনুভব করেন না। শিক্ষিত ইসলামপন্থীদেরও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় যে প্রান্তিকতার সৃষ্টি হয়েছে তার মূল দায়ভাগ প্রধান দাবিদার এই গণতন্ত্রবাদী রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের উপরই বর্তায়!
এবার আসুন, গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক ইসলামবাদীদের উদ্ভট বক্তব্যসমূহের অসংগতিগুলোকে যথাসম্ভব পয়েন্ট-আউট করি –
বুৎপত্তিগত অর্থ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি
বুৎপত্তিগত দিক থেকে ডেমোক্রেসি শব্দটার মধ্যে শিরক থাকুক বা না থাকুক, শব্দটির প্রচলিত অর্থে শিরক বুঝানো হয় কিনা – সেটি হলো প্রসঙ্গ। কোনো শব্দের প্রচলিত অর্থ আর বুৎপত্তিগত অর্থ যখন ভিন্ন হয় তখন প্রচলিত অর্থকেই গ্রহণ করতে হবে। নতুবা আমাদের ভাষা অচল হয়ে যাবে। ইংরেজি, বাংলাসহ সব ভাষায় আমরা এমনসব শব্দ ব্যবহার করি যার বুৎপত্তিগত অর্থ বিবেচনা করলে সেসব শব্দ আমরা ব্যবহার করতে পারবো না। এসব আপাত শিরকমূলক শব্দকে পরিহার করার লিঙ্গুয়েস্টিক পিউরিটানিজম নিয়ে ভাষা ব্যবহার করা অসম্ভব।
অ্যাক্ট এবং স্ট্যাটিউট/অর্ডিন্যান্সের পার্থক্য
আমার কর্মস্থলে দেখছি আইন বিভিন্ন পর্যায়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাক্ট হলো মূল আইন। সেটি ছোট্ট একটা পুস্তিকা। ১৯৭৩ সালে মূল আইনটি পার্লামেন্ট কর্তৃক পাস ও প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারী করা হয়। অ্যাক্টের ব্যাখ্যা হিসাবে সিনেট কর্তৃক পাসকৃত ও উপাচার্য কর্তৃক রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে জারীকৃত আইন হচ্ছে বিভিন্ন স্ট্যাটিউট/অর্ডিন্যান্স। অ্যাক্ট ও স্ট্যাটিউটের ব্যাখ্যা হিসাবে সিন্ডিকেট নিয়মিতভাবে আইন রচনা, পরিবর্তন ও প্রবর্তন করে থাকে। এতসব পর্ষদ থাকা সত্ত্বেও আমরা ডিপার্টমেন্টে একাডেমিক, প্লানিংসহ বিভিন্ন কমিটিতে বসে সময়ে সময়ে বিভিন্ন আইন তথা কর্মপন্থা নির্ধারণ করে থাকি। এই আইন বানানোর প্রক্রিয়ায় আরও রয়েছে ফ্যাকাল্টি কমিটি ও একাডেমিক কাউন্সিল, বোর্ড অব এডভান্স স্টাডিজ ইত্যাদি।
ভাবুন তো, কতজনে কতখানে কতভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য ‘আইন’ বানায়। এখানে ‘সার্বভৌমত্ব’ কার?
আসলে বুৎপত্তিগত অর্থে ডেমোক্রেসির মতো সভরেইনটি তথা সার্বভৌমত্বও একটা নিতান্তই ভ্যাগ (বহু অর্থবোধক) টার্ম। দেখেছি, নাস্তিকরাও গড শব্দটা ব্যবহার করে। এর মানে এই নয়, তারা গডকে স্বীকার করে নিচ্ছে। এটিকে তারা রূপক অর্থে ব্যবহার করে। আমি যদি ইউনিভার্স বুঝাতে ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’ বলি, আর কেউ যদি শব্দটির বৈদিক বুৎপত্তিগত অর্থ বিবেচনায় নিয়ে মন্তব্য করেন, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? আমি দিবস বোঝাতে ‘শনি’ বললে কেউ যদি হিন্দুদের শনি দেবতাকে টেনে আনেন, তাহলে কেমন লাগে বলুন? স্যাটারডেতে কেউ যদি রোমকদের স্যাটার্ন দেবতার ছায়া দেখেন তাকে কী বলা যেতে পারে? আমি যদি দায়িত্বসম্পন্ন বোঝাতে দায়িত্বশীল বলি আর এতে যদি কেউ বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শীল পরিভাষাকে আবিষ্কার করেন, তাহলে…
সভরেইনটি কত প্রকার?
আপনি এই লেখা যখন ব্লগে পড়ছেন তখন নিশ্চয় অনলাইনে আছেন। দেখুন না, ‘সভরেইনটি’ কত প্রকার এবং কী কী! এবসলিউট সভরেইনটির খোঁজ আছে কেবলমাত্র মুসলমানদের কাছে। তিনি হচ্ছেন, আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালা। কারণ মুসলমানদের আল্লাহই কেবলমাত্র সৃষ্টি থেকে শুরু করে সর্বপ্রকারের আইন দিয়েছেন, যা নবী মোহাম্মদের (সা) মাধ্যমে কোরআন হিসাবে সংকলিত অবস্থায় আমরা পেয়েছি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের গড শুধুমাত্র প্রাকৃতিক রাজ্য ও মানুষের ব্যক্তিক বিষয়ে সার্বভৌম। মানুষের সমাজ ব্যবস্থার বিশেষ ও উন্নত রূপ তথা রাজনৈতিক জীবনের বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনো ‘গড’(?) তেমন কিছু বলেননি।
বিচ্ছিন্নতাবোধ ও (ইসলামী) ধার্মিকতা
এবসলিউট সভরেইনটি ছাড়া আর সব ধরনের ও পর্যায়ের সভরেইনটি, নাস্তিকদের গড শব্দকে পদ বা টার্ম হিসাবে ব্যবহারের মতোই রেটরিক (ভাষাগত)। অতএব, মূলত ফেইক। এই সাধারণ বিষয়টি বুঝলে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের বিশেষ গলদঘর্ম হবার কারণ থাকে না। তারপরও ‘গণতন্ত্র কুফর ও শিরক’ জাতীয় কথাবার্তা থাকবে। কারণ, আমি এবং আমার যা কিছু তা ছাড়া অন্যান্য সবকিছু ও সবাইকে ক্ষতিকর আশংকা করে এক ধরনের শিশুসুলভ শত্রু শত্রু খেলাটা অনেকের কাছে ভালো লাগে। দুনিয়ার সবকিছুতে কুফর ও শিরক খোঁজার প্রাণান্তকর প্রয়াসে এক ধরনের সুখ আছে।
রাজনৈতিকতার নামে ধর্মবাদিতা
এ ধরনের প্রয়াসে রাজনৈতিকতার নামে ইসলামকে ধর্ম হিসাবেই চর্চা করা হয়। ইসলামকে রাজনৈতিকতা হতে মুক্ত (!) করার সকল (অপ)প্রয়াসের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মবাদিতা। ধর্মবাদিতার মূল লক্ষণ হলো সমাজ-ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পবিত্রতার ধারণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। ইনারা সময়ে সময়ে, কেউ কেউ সব সময়ে শ্লোগান হিসাবে সমাজ-ব্যবস্থাপনার কথা বললেও সিরিয়াসলি এর প্রায়োগিক দিকে নিয়ে ভাবেন না। উত্তেজনা, আবেগ ও ঘৃণা সৃষ্টিতে যতটা আগ্রহী, গঠনমূলক পন্থা বা বিকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবে তা করে দেখানোর বিষয়ে উনারা ততটাই অনাগ্রহী। এই মানসিকতার লোকেরা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গে ন্যূনতম মানে সন্তুষ্ট থাকার পলিসি মানলেও আকীদাগত (অ)বিশুদ্ধতার খুঁটিনাটি বিষয়ে ভীষণ অনমনীয়।
আকীদা ঠিক রাখাটা জরুরি, না আকীদাগত ভ্রান্তি খুঁজতে থাকাটা জরুরি?
আকীদাগত ভ্রান্তি প্রকাশ পেলে তা অতি অবশ্য সংশোধন করার চেষ্টা করতে হবে – এটি এক কথা। আর সমাজ জীবনে ইসলামকে আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা ও যতটুকু আছে তা কায়েম রাখার জন্য মূল শক্তি ব্যয় না করে মানুষের মধ্যে আকীদাগত পরিশুদ্ধির নামে বিভ্রান্তি ছড়ানো – সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে আকীদার পরিশুদ্ধি খোঁজা সুন্নাহর পরিপন্থী এবং একটি অতি উৎসাহী কাজ। মালিকানা তো শুধুমাত্র আল্লাহর। তাই বলে আমরা কি বলি না– এই ল্যাপটপটি আমার, আমি এটির মালিক? এই ল্যাপটপটির মালিকানা আমার হিসাবে স্বীকার করাটা কি শিরক হবে?
ইউরোপে সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে ‘ক্যাচাল’ হয়
ইউরোপে সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষোড়শ শতাব্দীর দিকে যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ হয় তাতে ‘সার্বভৌমত্ব গডের, নাকি জনগণের’ – এ ধরনের কোনো প্রশ্ন ছিল না। দ্বন্দ্ব ছিল চার্চ বনাম রাজার, রাজা বনাম জনগণের। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধুমাত্র রাজার নাকি জনগণের – এটি ছিল মূল প্রশ্ন। আগেই উল্লেখ করেছি, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম ও মতাদর্শে প্রকৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরতন্ত্রের এক ও অভিন্ন উৎসকে (আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালা) গ্রহণ করা বা করার জন্য বিবেচনা করা হয়নি। তাই পাশ্চাত্য অর্থে গণতান্তিক ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম বলতে কোনো একজন রাজা বা একনায়কের সার্বভৌমত্বের দাবিকে নাকচ করাই বুঝায়।
মার্কসবাদ, ধর্ম ও ইসলাম
আমার কাছে ‘ধর্ম সম্বন্ধে’ নামে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের প্রায় তিনশত পৃষ্ঠার একটা বই আছে, যেখানে ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের সব লেখার সংকলন করা হয়েছে। সেটিতে ইসলাম সম্পর্কে মাত্র দেড় পৃষ্ঠায় (‘মহা আরব বহির্গমন’ শিরোনামে) অতি সাদামাটা আলোচনা করা হয়েছে। তাই, মার্কস যখন ধর্ম নিয়ে কিছু বলেন তখন ইসলামিস্টদের উত্তেজিত হওয়ার কারণ দেখি না। কারণ, মার্কস ধর্ম সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন, তার সম্পূর্ণটাই তৎকালীন ইউরোপের ইহুদী-খৃষ্টবাদ সম্পর্কে। আমরা কেন অহেতুক ধর্মের পরিচয় ও দায়িত্ব গ্রহণ করবো? ইসলাম কি মূলত ধর্ম, নাকি আদর্শ? সার্বভৌমত্ব নিয়েও অনুরূপ কথা প্রযোজ্য। অ্যাক্ট, স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্সের ধারাবাহিকতায় আইন রচনার অধিকার বা ‘সার্বভৌমত্ব’ বলতে কী বুঝানো হয় – তা বুঝতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে কোনো কথা বিবেচনা করে সমর্থন বা বিরোধিতা করা কি অনুচিত ও শ্রেণীবিভ্রান্তিমূলক কাজ নয়?
হক বনাম গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা
আমাদের এক সহকর্মী রাজনৈতিক দর্শনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ও ব্যাপক পরিসরে গবেষণা করেছেন। উনার সবচেয়ে ছোট লেখাটার শিরোনাম হচ্ছে, ‘গণতন্ত্র একটি অলীক ধারণা’। এ বিষয়ে আমিসহ অন্যান্য যারাই গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন তারা সবাই যে বিষয়টি দাবি করেছেন বা স্বীকার করেছেন তা হলো – গণতন্ত্রের দাবি ও বাস্তবতার মধ্যে বিরাট ফারাক। সত্যতা (হক) আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো কখনো এক হতে পারে না। সত্যতা হচ্ছে একটা গুণ, পরিমাণ নয়। কাজেই গণতন্ত্রের কথা যারা বলেন, তারা সেটিকে মোটেও নিখুঁত মনে করেন না। তারা অন্য যে কোনো পদ্ধতির তুলনায় সেটিকে মন্দের ভালো হিসাবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করেন মাত্র। অন্য যে কোনো পদ্ধতির তুলনায় বলতে তারা স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্রকে বুঝিয়ে থাকেন।
মুসলমান হিসাবে আমরা তো হকের পক্ষে থাকার কথা। ইসলামী মতাদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক মতাদর্শ গণতন্ত্রকে অন্যতম পদ্ধতি হিসাবে অনুমোদন করার সুযোগ কোথায়?
হ্যাঁ, আমরা হকের পক্ষেই থাকবো। তাই ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র একমাত্র ব্যবস্থা নয়। হকের দাবি পূরণ সাপেক্ষে যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাই ইসলামী হতে পারে। এই হক হচ্ছে মূলত জনকল্যাণ ও ন্যায়বিচার। অন্যতম রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্র ক্ষেত্র ও কাল বিশেষে হ্ক কায়েমের তরীকা হতে পারে। এ জন্যই খিলাফত ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিকতার প্রচুর অবকাশ, উদাহরণ ও নমুনা পাওয়া যায়। অবশ্য এর মানে এই নয়, খিলাফত ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। খিলাফত ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে অভিন্ন নয় – এর মানে আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনো কোনো কালে বা কোনো জনপদে খিলাফতের পদ্ধতি হতে পারবে না – এমনও নয়।
খিলাফত ব্যবস্থার আদর্শগত সিঙ্গুলারিটি এবং প্রায়োগিক প্লুরালিটি
গণতন্ত্র যেমন আমেরিকায় এক ধরনের, বৃটেনে আরেক ধরনের, তেমনি খিলাফত সম্পর্কেও সব মুসলমান একই মতের উপরে নাই। যখন থেকে খিলাফত ব্যবস্থা কার্যত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় তখন থেকেই খিলাফতের পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিমত ও বিতর্ক ছিল। খিলাফতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো এর সিঙ্গুলারিটির ধরন কী হবে – তা নিয়ে। খিলাফত ব্যবস্থার সিঙ্গুলারিটি কি প্রশাসনিক, নাকি আদর্শিক? এসব নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা, বিতর্ক ও গবেষণা হতে পারে, হবে। এই পোস্ট লেখক মুসলিম উম্মাহ কনসেপ্টের উপর একাডেমিক গবেষণা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিষয়ের ব্যাপ্তি ও অ্যাম্বিগিউটি বিবেচনায় তা আর করা হয়নি। দুনিয়াকে যারা স্বীয় একদেশদর্শী দ্বীনদারীর কারণে সাদা-কালো হিসাবে দেখেন, তারা আমার এ ধরনের থিমেটিক এনালাইসিসে বিরক্তি, ক্লান্তি ও উষ্মাবোধ করবেন, ধারণা করছি। কী করবো, বলুন! ইসলাম নামক এই ব্যাপারটা নিজেই অল ইনক্লুসিভ অ্যান্ড ইটসেলফ অ্যা ব্র্যান্ড। তাই এটি গণতন্ত্রও না, গণতন্ত্র বিরোধীও না। গণতন্ত্রের কাঠামো অতীব নমনীয়। এক অর্থে এর অবয়ব নিতান্তই বায়বীয়।
ইসলামের রাজনৈতিক পদ্ধতি কি গণতন্ত্র? না, খিলাফাহ? খিলাফাহ কয় ধরনের?
ইসলামের রাজনৈতিক পদ্ধতি হলো খিলাফাহ। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে ৬ পদ্ধতির খিলাফাহর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে: (১) রাসূলুল্লাহর (সা) প্রবর্তিত মদীনাভিত্তিক হুকুমাত, যেখানে তিনি ‘সিস্টেম ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে’ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন ইয়াসরিবে তিনি ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য নেতৃত্ব। প্রত্যেকের ধর্মীয় ও গোত্রীয় স্বাধিকার মেনে নিয়ে তিনি ইসলামকে বিরোধ নিষ্পত্তির গ্রহণযোগ্য ভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। (২) হযরত আবু বকর (রা) তাঁর ঘনিষ্টতম সহচর কর্তৃক একতরফাভাবে খলিফা ঘোষিত হয়ে জনসাধারণ কর্তৃক অব্যবহিত পরে সমর্থিত হয়েছিলেন। (৩) হযরত ওমর (রা) তদীয় পূর্ববর্তী খলিফা কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে মনোনীত ছিলেন। (৪) হযরত উসমান (রা) একটা প্যানেল হতে স্বীয় আগ্রহ ও সম্মতি এবং পাবলিক সাপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচিত/মনোনীত হয়েছিলেন। (৫) হযরত আলী (রা) তৎপূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন খলীফার হত্যাকারী বিদ্রোহীদের মনোনীত হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। যোগ্যতম হিসাবে তাঁর প্রতি জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন বিদ্যমান ছিল। যদিও তখন হজ উপলক্ষে বিপুল সংখ্যক সাহাবী মক্কায় অবস্থান করছিলেন। (৬) খলিফায়ে রাশেদ হিসাবে বিবেচিত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) পূর্ববর্তী খলীফা নামধারী চাচা সুলাইমান কর্তৃক মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
বলপূর্বক খিলাফত ব্যবস্থা প্রবর্তন জায়েজ কিনা?
না, বলপূর্বক খিলাফত ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনো উদাহরণ না থাকায় তা জায়েয হতে পারে না। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের উদাহরণকে আপাতত উহ্য রেখেও আমরা খিলাফত ব্যবস্থার বিভিন্ন রকমের উদারহরণ পাচ্ছি, যার কোনোটিই বলপূর্বক পন্থা ছিল না। বরং বলপূর্বক ক্ষমতা গ্রহণ শুরু হয়েছিল হযরত মুয়াবিয়া (রা) কর্তৃক। সেই কারণে তাঁর নামে তৎকালীন সিরিয়া অঞ্চলে খুতবা পাঠ করা হলেও, তিনি খলিফার পদবীতে থাকলেও তাঁকে খলিফায়ে রাশেদ হিসাবে গণ্য করা হয় না। শক্তি প্রয়োগ তথা কিতাল অর্থে জিহাদের প্রয়োজন প্রতিরক্ষার কাজে। আর প্রতিরক্ষার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে মৈত্রী চুক্তি, নয়তো ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ স্ট্রাইক’। অফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স। এটি সব ধরনের রাজনৈতিকতাতেই প্রযোজ্য।
কোনো প্রতিষ্ঠিত খিলাফত ব্যবস্থার আওতায় কোনো এলাকায় শরীয়াহ জারীর জন্য উপযুক্ত সামর্থ্য থাকলে প্রয়োজন মোতাবেক সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুমোদন আছে। মনে রাখতে হবে, শরীয়াহ জারী করা যায়, কিন্তু ইসলাম সর্বদা প্রচার করতে হয় (লা ইকরাহা ফিদ্দী-ন…)।
(জীবন) আদর্শ হিসাবে গণতন্ত্র বনাম পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্র
মজার ব্যাপার হলো গণতন্ত্রবিরোধীরাই গণ শব্দটি ব্যবহার করেন সবচেয়ে বেশি! গণজাগরণ, গণবিপ্লব ইত্যাদি তাদের মুখেই হর-হামেশা শোনা যায়! তারা গণতন্ত্রকে বিরোধিতা করেন আদর্শ হিসাবে। পদ্ধতি হিসাবে কার্যত গণতন্ত্রকে গ্রহণ করেন। কেউ সূর্যকে দেবতা ভাবলে আমরা কি সূর্যকে বাদ দিবো? কোনো হতভাগা গোষ্ঠী যদি নবী মোহাম্মদকে (স) খোদা মানে (নাউযুবিল্লাহ), তার দায়দায়িত্ব আমরা কেন নিবো?
পাশ্চাত্যের কাছে ইসলামের মতো আদর্শ না থাকায় তারা রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদির মোকাবিলায় গণতন্ত্রকেই জীবনাদর্শ হিসাবে নিয়েছে বটে, যদিও মূলত এটি একটি ক্ষমতা বন্টন ও প্রয়োগ পদ্ধতি মাত্র। এর মানে এই নয়, আমরা গণতান্ত্রিক হবো। আমরা শুধু মুসলিম হবো। তাহলে আমরা গণতন্ত্রসহ অপরাপর সকল মতবাদের সব সুফল ও ভালো দিকগুলো পেয়ে যাবো। সেজন্য (গণতন্ত্র ইত্যাদি) নাম নিলেও ক্ষতি নাই, না নিলেও অসুবিধা নাই। ইসলাম নাম চায় না, কাজ চায়।
মদীনায় প্রথম হিজরী দশকে (আধুনিক ইউরোপীয় অর্থে) কোনো ‘রাষ্ট্র’ ছিল কি?
মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা আমরা বলছি বটে। রাষ্ট্র হচ্ছে (ইউরোপীয় অর্থে) মাত্র কয়েক শতাব্দী আগের ব্যাপার। তাই মদীনার খিলাফাত ব্যবস্থাকে আদৌ রাষ্ট্র বলার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি? এর কোনো বিশেষ নাম আদৌ কি ছিল? মদীনা ‘রাষ্ট্র’টির নাম ছিল না, ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে মদীনাতুন নবী, সংক্ষেপে মদীনা রাখা হয়েছিল মাত্র। মদীনাকেন্দ্রিক তৎকালীন সেই নগর রাষ্ট্রের উপর আমরা আমাদের বুঝা ও আলোচনার সুবিধার্থে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আরোপ করছি মাত্র। গণতন্ত্র হলো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থারই একটা অংশ। সুতরাং মদীনার ‘রাষ্ট্রে’ (আধুনিক) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ছিল না বিধায় গণতন্ত্র সুন্নাহ তথা ইসলামবিরোধী বলাটা ক্যাটাগরি মিসটেক। দেখতে হবে, ইসলাম অনুমোদিত রাজনৈতিকতার (সুন্নাহ) নীতিমালার সাথে সেটি কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সাংঘর্ষিক।
ইসলাম ও অন্যান্য মতবাদ
কেউ যদি ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ ধরনের কথা অপছন্দ করেন, তিনি ইসলামই বলুন। সমস্যা নাই। সমস্যা হবে তখনই যখন কেউ ইসলাম হতে গণতান্ত্রিকতাকে বাদ দিতে চাইবে। কোনো মুসলিম তো ‘ওয়া আমরুহুম শুরা বাইনাহুম’কে বাদ দিতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো ঊর্ধ্বতন পর্ষদ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষকরা যেমন বিভাগীয় একাডেমিক কমিটিতে বিতর্ক করার ও নানাবিধ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পান, তেমনি কোরআন ও সুন্নাহর কর্তৃত্বকে স্বীকার করেও এর প্রায়োগিক দিকগুলো নিয়ে কিম্বা এর যে কোনো স্থানিক প্রয়োগ অনুমোদন কিম্বা স্থগিতের বিষয়ে (ব্যক্তিগত ইবাদতের বিষয়গুলো বাদে) আহলে রায় হিসাবে বিবেচিতগণ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আদর্শ হিসাবে ইসলামের মৌলিকত্ব, নমনীয়তা, গতিশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা
‘গণতন্ত্র হারাম’ বলাটা একটা অগ্রহণযোগ্য অতিশয়োক্তি মাত্র। বরং গণতন্ত্রকে ইসলামাইজড করার সুযোগ রয়েছে। ইরানের সংবিধান এ বিষয়ে একটা ভালো উদাহরণ। কিছু সংরক্ষণ থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য বিশ্ব ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলতে পারছে না। এটি একটা মডেল। এ ধরনের মডেল আরও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইসলাম কেবলমাত্র প্রথম খৃষ্টীয় সহস্রাব্দের জন্য যেমন ছিল না, তেমনি কেবলমাত্র বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর জন্যও নয়। ইসলাম কেয়ামাত পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, যদি কেয়ামাত আরও বহু সহস্রাব্দ বৎসর পরেও হয়। অতএব, ইসলামের যে গতিশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা, সেটিকে যথাসম্ভব বজায় রাখতে হবে, মেনে চলতে হবে, এর বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অমুসলিমদের কাছে, জগতের কাছে মুসলিমগণ বিশেষ করে ইসলামপন্থীগণই প্রকৃত ইসলাম। তাদের কাছে টেক্সটের চেয়ে কমিউনিটির গুরুত্ব বিবেচনা বেশি।
অন্যান্য মতবাদের সাথে ইসলামকে সংযুক্তকরণ কতটুকু সঠিক?
ইসলামী গণতন্ত্র সম্বন্ধে কারো আপত্তি থাকতে পারে। কারণ, কাফেররা গণতন্ত্রকে একটা জীবনাদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। এভাবে দেখলে দেখা যাবে ইসলামের সাথে কোনো মত, পথ ও তত্ত্বকেই সম্পর্কিত করা যাবে না। ইসলামের সাথে পুঁজিবাদকে সমন্বয় করা যাবে না, ইসলামী পুঁজিবাদ বলা যাবে না, ইসলামী সমাজতন্ত্র বলা যাবে না, ইসলামী জাতীয়তাবাদ বলা যাবে না। ইত্যাদি। আচ্ছা, ‘ইসলামী মানবতাবাদ’ কি বলা যাবে? কারণ, অগাস্ট কোঁতের মতো পজিটিভিস্ট হতে শুরু করে পাশ্চাত্য দর্শনে যতজনই মানবতাবাদের কথা বলেছেন তারা অ-ইসলামী অর্থেই তা বলেছেন এবং এখনো বুঝে বা বুঝিয়ে থাকেন। জাতীয়তাবাদ খারাপ হতে পারে। কিন্তু জাতি চেতনা তো আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন, যা তিনি কোরআনে বলেছেন (আমি মানুষদেরকে ভাষা, গোত্র ও বর্ণে আলাদা করে পাঠিয়েছি যাতে…)। নাকি? জাতি-চেতনা হতে সাম্প্রদায়িকতা ও জাত্যাভিমানকে আলাদা করে বিবেচনা করলে, জাতীয়তাবাদ কতটুকু অনৈসলামী হয়? ইউরোপের আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধাঁচে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা আরো সক্রিয়ভাবে কার্যকর থাকলে পুঁজিবাদ কি অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের মতো অত কদর্য থাকে? সমাজতন্ত্রের প্রেক্ষিতে ইসলাম কি পুঁজিবাদকে (সীমিত পরিসরে ও নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে) অনুমোদন করে না? আর (লাগামহীন) পুঁজিবাদের প্রেক্ষিতে ইসলামী মতাদর্শের সাথে সমাজতন্ত্রের সাযুজ্যতা কি স্পষ্ট নয়?
ইসলাম সমাজে কায়েম করার পদ্ধতি নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন
আমরা ইসলামকে নির্গুণ ব্রহ্মের মতো বৈশিষ্ট্যহীন একটা অবাস্তব কল্পবিলাস বা ইউটোপিয়া হিসাবে উপস্থাপন করবো, নাকি সমন্বয়ের নীতিতে ইসলামের ছাঁচে ফেলে সব কিছুকে যথাসম্ভব আপন করে নেব? ইসলামী হুকুমত কি একেবারে আনকোরা নতুন এমন একটা কিছু, যা জগতের অপরাপর বিশাল জনগোষ্ঠী কখনো দেখে নাই, শুনে নাই, জানে নাই, বুঝতে পারে নাই? নাকি কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামোর এমন (মৌলিক ও টেকসই) সংস্কার, গভীরতা ও ব্যাপকতার কারণে যা বিপ্লব হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে? এসব প্রশ্ন খুবই মৌলিক। একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে, একজন যোগ্য মুসলিম হিসাবে আপনার কাছে এর উত্তর আছে। এ ধরনের যে কোনো মৌলিক প্রশ্নের উত্তর আমরা ব্যক্তিগতভাবে খুঁজে নিলেও তা একই উত্তর হবে। কারণ, আমরা সবাই সুন্নাহর সামগ্রিক অধ্যয়নের মাধ্যমে তাই পাই, যা আমাদের বিবেক ও বোধের মধ্যে ইতোমধ্যেই প্রদত্ত হিসাবে আছে।
বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথের শরয়ী নির্দেশনা
সর্বশেষ যে কথাটি বলবো তা অতীব হালকা কথা। আমার কাছে পাঠানো লেখাটিতে সংবিধানের অধীনে শপথের বিষয়ে আপত্তির কথা বলা হয়েছে। আচ্ছা, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার সময় তো বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না। তাহলে তারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে পুরো সংবিধানকে উল্টালেন কীভাবে? জানি, কোনো স্কুলগামী বালকও এই প্রশ্নের উত্তর জানে। সেটি হচ্ছে, সংবিধানের মধ্যেই সেটিকে সংশোধন ও পরিবর্তন এমনকি স্থগিতেরও নিয়ম ও পদ্ধতি বলা আছে, থাকে। শপথ হচ্ছে বাহ্যত সংবিধান হিসাবে ইতোমধ্যেই লিখিত, সাব্যস্ত বা সংযোজিত ধারাসমূহের প্রতি আনুগত্য। প্রকৃতপক্ষে শপথ হচ্ছে সিস্টেমটার প্রতি সমর্থন জানানো এবং সিস্টেমটা হচ্ছে সামষ্টিক রাজনৈতিকতা (পলিটি)। যার কারণে রাজনৈতিক প্রতিনিধিগণ শপথকালীন সংবিধানকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করার বৈধ সুযোগ লাভ করেন (বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যা করেছেন)। শপথ হচ্ছে নির্বাচনী রাজনৈতিকতার একটা প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ মাত্র।
শপথ হচ্ছে (নির্বাচনী এলাকার) গণইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অঙ্গীকার
সংসদ সদস্যগণ যখন শপথ নেন তখন তারা তাদের প্রতি জনগণের যে ম্যান্ডেট বা গণইচ্ছা তা পালন করারই শপথ নেন। ওথ হলো মূলত মোরাল। কীভাবে গণইচ্ছার রূপায়ণ হবে তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ডিসাইসিভ ভূমিকা ও প্রায়োগিক ক্ষমতা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচিত/মনোনীত প্রতিনিধির। ওয়াদা রক্ষা করার বাধ্যবাধকতার নিরিখে এটি বরং ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়। জনসমর্থন হিসাবে গণইচ্ছার ব্যাপ্তি যদি বাড়ানো যায় তাহলে ইসলামকেও রাষ্ট্রীয় আইন হিসাবে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হিসাবে সার্বজনীন ভোটাধিকারভিত্তিক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে একটি পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ বা অনুমোদন আছে। তাই বলে, সমকালীন পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতান্ত্রিকতা সর্বযুগে সর্বকালে ইসলামের রাজনৈতিকতা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পদ্ধতি নয়। এটি নিছক বর্তমান সময়কালের প্রেক্ষিতে শ্রেয়তর পদ্ধতি মাত্র।
ব্লগে প্রদত্ত মন্তব্য প্রতিমন্তব্য
পরমা লিখেছেন: ইসলাম ধর্মের মূলবাণী হচ্ছে “total submission to God, and there is no other God except for Allah”। সে হিসেবে ইসলামের মৌলিক শরিয়া শাসনই total submission অথাৎ কোরানের শাসন এবং কাফেরের উপর মুমিনের শাসন। এর বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগ নেই। আবার মুমিনের উপর কোন কাফেরকে আওলিয়া, অভিভাবক বানানো যাবে না, এমনকি বন্ধু হিসেবেও নেয়া যাবে না। তাহলে ইসলাম ধর্মে আধুনিক গণতন্ত্র চর্চার যে কথা আপনি বলছেন, তা কি শুধু ইসলামী শরিয়া শাসনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য? ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক লিখেছেন: ইসলামী শাসন আর ইসলামী শরীয়াহ শাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? আপনি কি বুঝিয়েছেন, তা জানার জন্য এই প্রশ্ন। আমি ইসলামকে ধর্ম মনে করি না। এটি একটা দ্বীন, যার মধ্যে ধর্মের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। ধর্মীয় নয় এমন বিষয়ও আছে। যেমন– রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিকতা। আর আমি আধুনিক গণতন্ত্র চর্চা করার কথা বলিনি। বলেছি, আধুনিক গণতন্ত্রকে ক্ষমতা অর্জন, পরিচালনা ও হস্তান্তরের পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এ অর্থে এটি ভালো। ইসলাম বনাম গণতন্ত্র – এ ধরনের প্রশ্নে আমি অতি অবশ্যই ইসলামকেই বেছে নিবো। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্নগুলো হচ্ছে এক ধরনের শ্রেণী বিভ্রান্তি। রাজনৈতিকতার অন্যতম (খেয়াল করুন, একমাত্র নয়) পদ্ধতি হতে পারে আধুনিক গণতন্ত্র। আরও বিস্তারিত উত্তর চাইলে আপনাকে কষ্ট করে পোস্টটা আবার পড়তে হবে। ধন্যবাদ।
পরমা লিখেছেন: না, ইসলামী শাসন আর ইসলামী শরিয়া শাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এটি মূলত কাফেরের উপর মুমিনের শাসন, যেখানে গণতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। কিন্তু আপনারা এ বিষয়টি খোলাসা করেন না, কৌশলে চেপে যান। যেমন– আপনি ইসলাম বনাম গণতন্ত্র অপশনে যেয়ে অগণতান্ত্রিক ইসলামকেই বেছে নেন, কিন্তু মুখে আবার গণতন্ত্রের কথাই বলেন। এটি এক ধরনের স্ববিরোধিতা। যেমন– মিসরের ব্রাদারহুড পার্টি একবিংশ শতকের প্রতিকূলতা আঁচ করতে পেরে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও অন্তরে গেঁথে থাকা অগণতান্ত্রিক ইসলামী শাসনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না। আপনিও কি তাই???
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক লিখেছেন: জনগণের সার্বভৌমত্বকে আক্ষরিকভাবে দেখলে, ইসলামী খিলাফাহ সিস্টেম তো অগণতান্ত্রিক বটে। সমস্যা হলো, জনগণের সার্বভৌমত্ব কখনো, কোনো কালে, কোনো গণতান্ত্রিক দেশেও আক্ষরিক অর্থে প্রযোজ্য ছিল না। তত্ত্বগতভাবেই তা হতে পারে না।
পরমা লিখেছেন: না, একমত নই। জনগণের সার্বভৌমত্বকে যে কোনোভাবেই দেখেন না কেন, একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই তা কেবল সম্ভব। এবং তত্ত্বগতভাবেই তা প্রমাণিত। ত্রুটি/বিচ্যুতি সামান্য থাকতেই পারে, এবং সেটার উপরও কালচার হচ্ছে।
তবে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র abuse করার দায়ভার গণতন্ত্রের উপড় বর্তায় না। ধন্যবাদ।
মনসুর লিখেছেন: +
মাশাআল্লাহ, সুন্দর লিখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, যাযাকাল্লহু খাইরান, ধন্যবাদ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বড় প্রায়োগিক শাখা গণতন্ত্র – মাশাআল্লাহ ব্যাখ্যার অভাব নাই বিভিন্ন মতের দার্শনিকদের কাছে।
তবে এই সময় যে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে – পশ্চিমা অমুসলমানদের প্রভাবিত ও কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থা সৎ মুসলমানদের জন্য কতটা উপযোগী।
আমার ধারণা, এই ধর্মনিরোপেক্ষ গণতন্ত্র সৎ মুসলমানদের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। এখানে –
১. মহান আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে ভাগাভাগি করার চেষ্টা করা হয়েছে।
২. সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে কুশিক্ষিত ও দুর্নীতিপ্রিয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে।
৩. সংসদ-মন্ত্রী-কমিটি করে আলোচনা-পর্যালোচনার নামে অযথা কালক্ষেপণ করে ন্যায্যতা/ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হচ্ছে।
মুসলিম সমাজে গণতন্ত্রের অবস্থা বুঝতে এই বিষয়গুলি আরও পর্যালোচনার দাবি রাখে, যা এই অমুসলিম/নাস্তিক সমাজে অবহেলিত।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হেদায়েত দিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] হিসাবে কবুল করে দুনিয়া ও আখেরাতে সকল নেক কামিয়াবী দান করুন। আমীন।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক লিখেছেন: তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র আর উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্র– এই দুইয়ে ফারাক আছে। আবার উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্র তাদের জন্য আর তাদের পক্ষ হতে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের জন্য– এতদুভয়ের মধ্যেও ফারাক আছে। যাহোক, আমার আলোচনাটা তাত্ত্বিক। সুতরাং আমাদের দেশে, ওদের দেশে ধরনের কথাবার্তার চেয়ে আলোচনাটা তত্ত্বমুখী হওয়াটাই ভালো।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও আমার মিশ্র অনুভূতি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে যদি জীবনাদর্শ হিসাবে গ্রহণ/দাবি করা হয়, যদি তা হয় নাস্তিকতাবাদী, তাহলে তা স্পষ্টতই অগ্রহণযোগ্য। আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে যদি নন-পার্টিজান অর্থে বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমি এতে কোনো সমস্যা দেখি না। নন-পার্টিজান মানে নাগরিকদের মধ্যে ধর্ম-পরিচিতির কারণে নাগরিক ও মৌলিক মানবিক অধিকার প্রদান ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তারতম্য না করা। সোজা কথায়, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ধর্ম পরিচিতির কারণে পক্ষপাতিত্ব না করা।
আবু জারীর লিখেছেন: আমি মোটাদাগে যেটা বুঝি তাহলো– গণতন্ত্র হলো একটা আকর্ষণীয় মোড়ক। গণতন্ত্রের আকর্ষণীয় মোড়কের ছদ্মাবরণে বর্তমান বিশ্ব ধর্মহীনতার ফেরি করে পুরা দুনিয়াকে অশান্তির দাবানলে ছারখার করে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের আকর্ষণীয় মোড়কে যদি ইসলামের তেজারত করা হয় তাহলে দোষণীয় হবে বলে মনে করি না। কারণ, গণতন্ত্রের মোড়কটা মানুষকে এমন আন্ধা করে ফেলেছে যে মানুষ অন্য কোনো মোড়কের দিকে দৃষ্টি দিতেই নারাজ।
মোড়কের ভিতরে মদ না মধু, সেটাই হলো আসল। আমরা কেউ মোড়ক খাই না বা ব্যবহারও করি না। কেউ মদ খায় আর কেউ খায় মধু। মদখোরদের কাছে যদি মধুর সওদা করা যায় একটা নিষ্প্রাণ মোড়ক ব্যবহার করে, তাতে দোষের কি? পাল্টা যুক্তি আছে, তবে তা হবে প্রান্তিক। আর প্রান্তিকতা পরিহার না করতে পারলে আজীবন বিতর্ক করা যাবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক লিখেছেন: গণতন্ত্রকে মোড়ক হিসাবে গ্রহণ করা হবে, না মধু বা মদ হিসাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা হবে – সে ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। আমার বক্তব্য হলো, ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগ হচ্ছে গণতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্রের যুগ। এগুলোকে শরীয়াহর গাইড লাইনের নিরিখে আপসকামী না হয়েও কাজে লাগানো সম্ভব। আসলে দুনিয়াতে মানুষ যত মত, পথ ও তন্ত্র বের করেছে তার প্রত্যেকটির মধ্যে কিছু না কিছু ভালো দিক আছে। কোনো কোনোটি এমন, যেটিকে আদর্শিক তত্ত্ব হিসাবে গ্রহণ না করে সহায়ক পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করা হলে তা ইসলামের সাথে কনসিস্ট্যান্ট হয়। ইসলাম মানবসমাজের মধ্যে ঐক্য তথা ইন্টিগ্রেশনের কথা বলে। বিভাজনকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। যাহোক, এসব ব্যাপারে আমাদের নিজ নিজ উপলব্ধিই শেষ উত্তর।
এক্ষেত্রে শেষ উত্তর হিসাবে আমি কোরআন-হাদীস-সুন্নাহ-শরীয়াহ এগুলো না বলে নিজ নিজ উপলব্ধির কথা এ জন্য বললাম যে, সুন্নাহকে আপনি কীভাবে বুঝছেন, ব্যাখ্যা করছেন, সামগ্রিকভাবে দেখছেন, না খণ্ডিতভাবে দেখছেন – সেসব অধিকতর ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ (ডিসাইসিভ অর্থে)। আমি পাশ্চাত্য প্রীতি ও পাশ্চাত্য ভীতি – উভয় প্রান্তিকতাকেই এড়িয়ে চলি। ভালো থাকুন।
ramir লিখেছেন: To Paroma and others,
First: spelling mistake is pardonable, not for argument rather for information. Comparing Islam to anyone or anything either any religion or Ism or any doctrine is first step mistake, to me. Since Islam is not merely a religion or doctrine or ism, its a systematic method to guide the mankind with justice from the Creator itself. So, the terms or diction you use in case of discussion, we don’t consider it as right. Besides, u pointed out that Democracy is absolutely right with some flaws and the attempts are being made to recover those.in fact, Democracy is only the election procedure to lead the nation and it requires many doctrines to lead the nation by the elected e.g. economic policy for economics, ism for national policy and religious principle for the people and so on. But in Islam everything is present by default. Just it needs to formulate the laws under the fundamental principles revealed in the Qur’an. so, to compare democracy with Islam is not considered correct, to us.
Second: The main hindrance to understand the Islamic Philosophy is to sense the fundamental principle of Islam. Always it is heard around us that everything is mentioned in the Al Qur’an and all the systems are quoted here. Here is the main fact. To me, though Qur’an is the final guide book and we also believe that every problem could be solved by following the Al Qur’an, but no any rulings are absolutely mentioned here. The Muslim scholars must do a lot to find out the right system under the principles revealed in the Qur’an. The prophet Muhammad SAAS. followed the right path during his time for the generations he belonged. But now, new systems must be way out for this time keeping the examples of Prophet and the fundamental principle of Al Qur’an before us. For ex. Prophet said to gather knowledge but mention not How, why, where …., Prophet said to establish justice in the society but specify not How …., no any constitution is before us for any purpose, excepting the two; Hudabiar Agreement and Last Hajj decleration, which simply enlighten us but not pave the way explicitly. Islam says Riba is Haram and profit is Halal, but no system was before us how we can differentiate between Riba and Proifit in case of Banking activities in the national and international level, just before the Islamic Banking flourished world wide. Same is also for economic, social, political, anthropological, archeological, scientific matters and so forth…
Its a matter of fact that though all of us are informed about the above-mentioned conditions but we feel very embarassed in admitting those. we announce that Islam is complete, Islam is complete but never we say that though the fundamental principles are complete but no any specific systems are ready to us and we never consider those as shortcomings, we would have to formulate those. We think that then Islam would be little. Just if we realize those then we also think how we can formulate the rulings and then we could think that we must read a lot both native and non-native, local and international. Since we never think the the shortcomings and the way-out policy, if anybody say anything about how we can go forward, then there raises hue and cry around him. They think that person as Nastik, Murtad, Spy, Modernist (abuse), and so on…
We always think that any generation, creation, formulation by the non-muslims are unholy and impure and those are not acceptable to Muslims.
For the above reasons the initiators must take initiatives to melt the ice-berg and here is the importance of Concept group.
Welcome all the soldiers of the concept Group both from home and abroad, facebook or website, printing or electronic media.
***
[লেখাটি সোনার বাংলাদেশ ব্লগে ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ফেসবুকে আমার পূর্ববর্তী লেখাটির ধারাবাহিকতা হিসাবে এবং ব্লগটি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পুরনো লেখাটি আবার দেয়া হলো।]