যেসব ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, রাসূল (স.) ধর্ম ও রাজনীতিকে স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন তার অন্যতম হলো মক্কা বিজয়ের পরে সেখানে থেকে না গিয়ে তিনি মদিনায় ফিরে গিয়েছেন। খুব সম্ভবত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) ছাড়া পূর্বের ও পরের কোনো খলিফা/আমীর মক্কাকে খেলাফতের রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেননি।

‌‍“মক্কা সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন জায়গা, পবিত্রতম ভূমি, যেখানে এক রাকাআত নামাজ পড়লে এক লক্ষ রাকাআত নামাজ পড়ার সওয়াব পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (স.) তাঁর জন্মভূমি মক্কা নগরীতে না থেকে গিয়ে মদিনায় ফেরত গেলেন কেন?”

এক সুধীজনের এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে ইউটিউবে ‘সামাজিক আন্দোলন’ চ্যানেলে আজ এই ভিডিওটি পাবলিশ করেছি। প্রশ্নটি গতানুগতিক হলেও এ প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনটা সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শুনলেই বুঝতে পারবেন।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কিছু পদ্ধতিগত এবং মৌলিক বিষয়ে কনসেপ্ট ক্লিয়ার না থাকলে বা এসব বিষয়ে একমত হতে না পারলে কারো সাথে বাদবাকি বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আর আগাতে পারে না। এখানে সেরকম দুটো বিষয়ে বলছি।

(১) ধর্মের সাথে ইসলামের সম্পর্ক-
ধর্মের সাথে ইসলামের সম্পর্ক হল অংশ এবং সমগ্রের সম্পর্ক। এটা একটা নেসেসারি রিলেশন। ধর্ম হল ইসলামের অন্যতম অপরিহার্য অংশ। ধর্ম এবং ইসলামের সম্পর্ক নট আইডেন্টিক্যাল বাট নেসেসারি।

(২) ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক-
ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্কও নেসেসারি, বাট নট আইডেন্টিক্যাল।

আইডেন্টিকেল, নেসেসারি এবং অকেশনাল রিলেশনের পার্থক্য যারা বুঝবেন না, তারা আমার কথাগুলো আদৌ বুঝতে পারবেন না। ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে আমার বক্তব্য বোঝার ক্ষেত্রে যারা কনফিউজ করছেন তাদের বুঝার সুবিধার জন্য স্ক্রিনশটটি সংযুক্ত করা হলো।

ভিডিও বক্তব্যটা ভালো করে শুনতে পারেন, বিশেষ করে এগারো মিনিট হতে।

ফারদিন: ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করেছেন বললে মানুষ মনে করে সেক্যুলারিজম। আপনি এখানে ‍“ধর্ম” শব্দটার পরিবর্তে ‍“আকিদা” শব্দটা ব্যবহার করলে বিষয়টা সহজেই বোঝা যেত।

আপনার এই বক্তব্যটার মতোই উস্তাদ মীর সালমানও বলেছেন, রাজনীতি একটা আলাদা শাস্ত্র। এটাকে তার নিজস্ব শাস্ত্রের দৃষ্টিতেই পাঠ করতে হবে। আকিদার বই থেকে আমরা রাজনীতি শিখব না।

আমরা আকিদা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করব। কিন্তু আকিদাকে রাজনীতির স্ট্র্যাটেজির সাথে মিলিয়ে জল ঘোলাটে করা যাবে না। বর্তমানে আমরা রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিতে আকিদার নীতি এপ্লাই করতে গিয়েই বড় বড় সমস্যা তৈরী হয়।

যদিও আকিদার সাথে রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু মুসলিমদের সমস্যা হল তারা আকিদার বই থেকে রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি শিখতে গিয়ে ভুল করে বসে। ফলে রাজনীতি যে একটা ফ্লেক্সিবল বিষয়, আর আকিদা স্ট্রিক্ট বিষয় – এই দুইটার পার্থক্য করতে পারে না।

তারা রাজনীতি করতে গিয়ে স্বাভাবিক সময়ের নীতি-নৈতিকতা ও বিশ্বাসের স্ট্রিক্ট নিয়মের উপর অটল থাকে, রাজনীতির যে আলাদা শাস্ত্র আছে – সেটাকে উপেক্ষা করে, অপরাজনীতি মনে করে সেসবকে। অথচ আকিদা আর রাজনীতির শাস্ত্রকে আলাদাভাবে দেখতে পারলে তারা বুঝতো, ইসলামি নৈতিকতাও রাজনীতির মাঠে প্রয়োজন অনুসারে ফ্লেক্সিবল। শত্রুর সাথে ধোঁকাবাজি করা জায়েজ, প্রোপাগান্ডা ছড়ানো জায়েজ, যুদ্ধ জায়েজ – অথচ এসব সাধারণ অবস্থায় জায়েজ নয়।

এজন্য আকিদা ও রাজনীতিকে তাদের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পাঠ করতে হবে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: মুসলমানেরা যে জেনারেল দুনিয়া পরিচালনার ব্যাপারে প্যাসিভ বা নির্বিকার, অথবা শুধুমাত্র ভোক্তা, কিংবা স্বনিয়োজিত সমালোচক, এই যে সমস্যা, গ্লোবালি ডিপ রুটেড প্রবলেম, এটার কারণ হচ্ছে তারা সবকিছুকে ধর্মের দৃষ্টিতে দেখে।

তারা ধর্ম এবং রাজনীতিকে বাইনারি হিসেবে দেখে। অথচ এগুলোর সম্পর্ক হচ্ছে হায়ারআর্কিকেল এবং কমপ্লিমেন্টারি।

লোকজন দেখছি বাইনারি এবং কমপ্লিমেন্টারি রিলেশনের পার্থক্যটাই বোঝে না। আমরা দিন দিন সার্টিফিকেটধারী হচ্ছি, শিক্ষিত হচ্ছি না। আফসোস .…! তারা যে বোঝে না, এটাও তারা বোঝে না। খণ্ডিত জ্ঞান এবং বেকুবিকে সঠিক মনে করে ‌‘জিহাদে’ লিপ্ত হয়ে পড়ে…!

মোহাম্মদ ইশরাক: মূলনীতি হিসাবে এটা ঠিকই আছে। আপনি যদি হিজরতের দিকে খেয়াল করেন তাহলেও দেখবেন যারা বিনা ওজরে হিজরত করে নাই তাদেরকে ধর্মীয়ভাবে অমুসলমান ঘোষণা করা না হলেও রাজনৈতিকভাবে তাদের গোত্রীয় অবস্থান অনুসারে তাদের সাথে ব্যবহার করা হয়। যদি তারা যে গোত্রে থেকে গেছেন সে গোত্র শত্রু হয় তাহলে তাদেরকেও শত্রু গণ্য করা হয়।

এখন সমস্যা হচ্ছে, ধর্ম আর রাজনীতি পৃথক এই কথাটা বললে তার ফলাফল কী দাঁড়ায়? প্রথমত, আমরা যেটাকে ধর্ম হিসাবে চিন্তা করি সেই চিন্তাটা তো প্রটেস্টেন্ট রিফর্মেশনের পর ধর্মের যে সংজ্ঞা সেটা। দ্বীন এবং দুনিয়াবী এই দুইয়ের পার্থক্যকে অনেকে ইসলামে সেকুলারিজমের উপস্থিতির প্রমাণ হিসাবে দেখাতে চান। এনিয়ে রুহাসিন আব্বাসি এম্পিরিকাল এবং শারম্যান জ্যাকসন তাত্ত্বিক কাজ করেছেন। কিন্তু এই যে দ্বীন ও দুনিয়াবী পার্থক্য উভয়টাই কি ইসলামের সীমানার মধ্যে না?

নবীজী যখন মদীনায় থেকে যান তখন উনি স্রেফ রাষ্ট্রপ্রধান ব্যাপারটা কি এমন? নাকি ওনার ইসলামই ওনাকে মদীনায় থেকে যেতে বলছে? দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে পার্থক্য করতে বলছে? অর্থাৎ, দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য করাটাও দ্বীনেরই অংশ।

আলাপে সমস্যাটা অন্তর্গত না, ফলাফলগত। কারণ এথেকে অনেকে দাবী করেন ইসলামে রাজনীতি ও ধর্ম পৃথক, কাজেই রাজনীতিতে ইসলাম দরকার নাই। অথচ এখানে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টা। বরং রাজনৈতিক তাগিদই ইসলামে মূখ্য। আপনার রাজনীতিকে অবশ্যই ইসলাম দিয়ে ইনফর্মড হতে হবে। এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাস-কর্ম কখনোই রাজনৈতিক সঠিকতার মানদণ্ড হতে পারবে না। খালেদা রাতের বেলায় মদ খান কি খান না, হাসিনা তাহাজ্জুদ পড়েন কি পড়েন না – ভোটের মাঠে এইসবের কোন গুরুত্বই নাই। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার রাজনীতি ইসলামের পক্ষে নাকি বিপক্ষে। আপনার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জবাব আপনি আল্লাহর কাছে দিবেন। সেটা নিয়ে আমরা ভাবিত না।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তোমার সুন্দর মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। এরপরের কথা হলো, যেসব গ্রস মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং সমাজের মধ্যে আছে, লোকজনের mindset-এর মধ্যে আছে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক গণপরিসরে ডমিনেন্ট হয়ে আছে, সেগুলোকে নিরসন করার দায়িত্ব তাদের যারা তোমার-আমার মত প্রিভিলিজ্ড।

মানুষের মন-মানসিকতা মেরামত করার এই কাজটি এক ধরনের অপারেশন বা ট্রিটমেন্টের মত, যার মধ্যে কিছু তিক্ততা অবশ্যই থাকবে।

ওই যে কথাটা অনেকবার বলেছি, identification of the problem is half of the solution।

তুমি অবশ্যই ‌‘ইসলামী বইমেলা একটি সেকুলার সেটআপ’ লেখাটা পড়বা। এই পোস্টের ইমিডিয়েট আগের পোস্ট। সেখানে তুমি যে পয়েন্টগুলো তুলেছো সেগুলোর ব্যাপারে সংক্ষেপে কিছু কথাবার্তা বলা আছে।

ওয়াকি মাহমুদ: আপনার এই মতামতের ভিন্নতা নয়, কিন্তু আকাবার দ্বিতীয় বায়াতের ঘটনার দিকে আপনার দৃষ্টি কামনা করছি। এই বায়াতটা ছিল দ্বিপাক্ষিক। অংশগ্রহণকারী মদীনাবাসী যেমন বায়াত নিছিলেন যে তারা তাদের নারী, শিশুদের মতই গুরুত্বপূর্ণভাবে নবীজিকে প্রটেকশন দিবে, বিপরীতে নবীজিও সুদিন আসলে তাদের ছেড়ে যাবেন না এমন বায়াত করেছিলেন। সুতরাং, যখন মক্কা বিজয় হলো তখন কারো মধ্যে এমন কোনো ডায়কোটমি তৈরি হবার সুযোগই ছিলনা। মক্কা-মদিনা নির্বিশেষে সবাই জানতেন নবীজি তাঁর কৃত ওয়াদা পূর্ণ করবেনই।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনার দিকে মুভ করা, যাওয়ার আগে ধারাবাহিকভাবে বায়াত ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, যাওয়ার পরে ইনক্লুসিভ চার্টার তৈরী করা এবং দফায় দফায় সেটাকে আপডেট ও মডিফাই করা, শেষ পর্যন্ত সেখানে থেকে যাওয়া, এমনকি মক্কা বিজয় হয়ে যাওয়ার পরও মদিনাতে ফিরে যাওয়া, পুরো ব্যাপারটা ছিল অনেক বেশি রাজনৈতিক, সামরিক এবং কৌশলগত।

রাসূলুল্লাহ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করার পরে আকাবার বায়াত জাতীয় কোনো প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি বলবৎ না থাকা সত্ত্বেও প্রথম তিন খলিফা মদিনাতেই অবস্থান করেছেন।

চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু মদিনা থেকে কুফাতে শাসনকেন্দ্র নিয়ে গেছেন। উনার পরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফা থেকে দামেশকে শাসনকেন্দ্র স্থানান্তরিত করেন।

প্রথম তিন খলিফার পরে শাসনকেন্দ্র হিসেবে বহাল না থাকা সত্ত্বেও মদিনার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়নি। কোনো খলিফা বা আমির মক্কাকে শাসনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার না করা সত্ত্বেও ইবাদতের কেবলা হিসেবে মক্কার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়নি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুর কয়েক বছরের প্রতিদ্বন্দ্বী খেলাফত ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। (সো ফার আই নো)

পুরো ব্যাপারটা থেকে আমরা বুঝতে পারি, আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র, রাজনীতির কেন্দ্র, অর্থনীতির কেন্দ্র অথবা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কেন্দ্র, এগুলো সংশ্লিষ্ট নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে আলাদা বিষয় হিসেবে সব সময় বিবেচিত হয়েছে। একটা সেক্টরকে তারা আরেকটা সেক্টরের সাথে গুলিয়ে ফেলেননি।

ভিডিও বক্তব্যের মূল আলোচনার মধ্যে আকাবার বায়াত নিয়ে কিছু কথা বলে দিলে হয়তো ভালো হতো। তাৎক্ষণিকভাবে সেটা মনে আসেনি।

মনসুর হাল্লাজ: সুরক্ষিত নগরী করোনার সময় বন্ধ ছিল কেন? হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কাবাকে ধ্বংস করেছিল। অনেকবার কাবা ধ্বংস হয়েছে। তাইলে কাবা সুরক্ষিত নগরী হল কীভাবে?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সুরক্ষিত মানে এমন নয় যে চীনের প্রাচীরের মতো চারিদিকে একটা প্রাচীর অথবা একটা মিসাইল প্রোটেকশন সিস্টেম অথবা এ ধরনের ফিজিক্যাল কিছু। সুরক্ষিত বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে এটার যে মর্যাদা সেটা সবসময় অক্ষুণ্ন থাকবে।

যখন সেটাকে আক্রমণ করা হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে, তখনও বিশ্বাসীদের হৃদয়ে এর মর্যাদা অক্ষুণ্ন ছিল। মক্কা তখনও তাদের ইবাদতের কেবলা হিসেবেই ছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময়ে মক্কাকে যখন আক্রমণ করা হয়েছিল, সেই আক্রমণকালীন সময়েও আক্রমণকারী মক্কাকে কেবলা করেই তাদের নামাজ আদায় করেছিল।

ইনফ্যাক্ট, তারা মক্কাকে আক্রমণ করেনি, বরং সেখানকার (তাদের বিবেচনায় ‌‘বিদ্রোহী’) শাসক আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে (রা.) হামলা করেছিল। বায়তুল হারামের মধ্যে উনাকে হত্যার পর পরই সেই হামলা বন্ধ হয়ে যায়।

বিগত বিশ্বমারীর সময়েও মক্কার কেন্দ্রীয় মর্যাদা অটুট ছিল। যে কোনো পরিস্থিতিতে কিয়ামত পর্যন্তও তা অব্যাহত থাকবে।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *