[আপনি যেই দলই করেন না কেন, অথবা হোন আপনি দল-নিরপেক্ষ, তাতে কিছু আসে যায় না। রাজনীতি সম্বন্ধে যদি জানতে চান তাহলে আপনাকে পলিটিক্সের এই ইউনিভার্সাল বা common strategy সম্পর্কে জানতে হবে। এমনকি, আপনি যদি ‘ফিলোসফারের উর্বর চিন্তা’ বলে ‘ঝামেলা’ মনে করে রাজনীতির এই কমন ব্লু-প্রিন্টটাকে এক্সপ্লোর না-ও করেন, অসুবিধা নাই। আমি নিশ্চিত, এই ফর্মূলাকে মেনে নিয়েই আপনি রাজনীতি সচেতন নাগরিক, অথবা সক্রিয় রাজনীতিবিদ।
না জেনেও যেভাবে আমরা পদার্থবিদ্যার সূত্রানুসারে চলাফেরার সব কাজ সম্পন্ন করি, সেভাবে যারা রাজনীতি করছেন, তারা অজান্তেই রাজনীতির এই ছক মেনে রাজনীতি করছেন। ভুল পথে গেলে বা রাস্তায় ঠিকমতো না চললে যেভাবে পথিক ও যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেভাবে পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজির এই চার্ট অনুসারে যে ভূমিকাতে থাকার কথা তাতে না থেকে যারা ভুল অবস্থানে আছেন বা ভুল ছকে চলছেন, ভুলের মাত্রানুসারে তারা অনিবার্যভাবে এর পরিণতি ভোগ করছেন বা করবেন। স্থান, কাল ও পাত্র নির্বিশেষে যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এটি প্রযোজ্য। অবশ্যম্ভাবী।
কী, অতিশয়োক্তি মনে হচ্ছে? পড়েই দেখুন না …! এরপর দুয়ে দুয়ে চারের মতো নিজেই অংকটা মিলিয়ে নিতে পারবেন।]
ধরা যাক, চিন্তা-চেতনার দিক থেকে ‘ক’-এর ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে আছে ‘খ’। এর মাঝামাঝি ০ ডিগ্রী হতে ১০ ডিগ্রী বায়ে ‘গ’ আর ১০ ডিগ্রী ডানে ‘ঘ’। একে মতাদর্শগত দলীয় অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে সমীকরণটাকে এভাবে বিন্যাস করতে পারেন: ‘ক’ = র্যাডিকেল লেফট গ্রুপ, ‘খ’ = র্যাডিকেল রাইট গ্রুপ, ‘গ’ = সেন্টার লেফট গ্রুপ এবং ‘ঘ’ = সেন্টার রাইট গ্রুপ। ০ (শূন্য) ডিগ্রি হলো ক্ষমতার কেন্দ্র।
গেইম থিওরি বলুন আর সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলুন, পরস্পরের সাথে সম্পর্ক ও মোকাবিলার কৌশল হিসাবে চরম ডান আদর্শ অনুসারীদের উচিত হবে মধ্যডানদের হাতে নিয়ে, মধ্যবাম গ্রুপটাকে যথাসম্ভব নিউট্রাল রেখে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে থাকা চরম বাম গ্রুপকে মোকাবেলা করা।
একইভাবে চরম বাম গ্রুপের বেস্ট স্ট্র্যাটেজি হবে মধ্যবামকে গুড হিউমারে রেখে মধ্যডান শক্তিকে যথাসম্ভব নিউট্রলাইজ করে বিপরীত আদর্শের চরম ডান দলকে এলিমিনেইট করার চেষ্টা করা।
এর তাৎপর্য হলো, ব্যক্তিগতভাবে আমরা বিলং অর সাপোর্ট করি বা না করি, র্যাডিকেল বা ডগমেটিক প্যাটার্নে যারা আদর্শকে ধারণ করার চেষ্টা করেন এবং রাজনীতিতেও এর রিফ্লেকশান ঘটাতে চান, যাদের আমি এই অর্থে চরম ডান বা চরম বাম বলছি; তারা সরাসরি বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবেন। এটিই তাদের প্রাথমিক রাজনৈতিক সফলতা।
র্যাডিকেল লেফট বা র্যাডিকেল রাইট ফোর্স যদি স্বপক্ষীয় মধ্যবর্তী শক্তিকে স্বীয় বিরোধী শক্তির সাথে লাগিয়ে দিতে পারে, তাহলে সেটি হলো তাদের অর্থাৎ র্যাডিকেল লেফট বা র্যাডিকেল রাইট ফোর্সটির আলটিমেট রাজনৈতিক সফলতা। দ্বিরুক্তি করে বললে, র্যাডিকেল লেফট ফোর্স যদি সেন্টার লেফটের কাছে ভিড়ে সেন্টার রাইটকে নিষ্ক্রিয় করে সেন্টার লেফটকে দিয়ে র্যাডিকেল রাইটিস্ট ফোর্সকে এটাক করাতে ও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নির্মূল করতে পারে, তাহলে সেটি হলো ওই চরম বাম রাজনীতির বিরাট সফলতা। একই কথা অপজিট রেডিকেল রাইট ফোর্সের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য।
এর মানে হলো, মতাদর্শগতভাবে চরম বিরোধী পক্ষদ্বয় পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হওয়াটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক গতিপ্রবাহেরই দাবি। এবং এটি করতে পারাটা মতাদর্শগত দিক থেকে তাদের রাজনৈতিক সফলতা বটে। এর পরিণতি বা মাশুল কী, কতটুকু এবং কে কীভাবে তা শোধ করবে, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কেননা, মতাদর্শগত বৈপরীত্যের কারণে পরস্পরের সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধে লিপ্ত হওয়াটা নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু সার্বিকভাবে বিষয়গুলো এই কোর্সে প্রবাহিত না হয়ে যদি মধ্যডান ও চরম বাম কিংবা মধ্যবাম ও চরম ডান পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তা খানিকটা অস্বাভাবিক। এক্ষেত্রে তা সংশ্লিষ্ট চরম ডান বা চরম বামপন্থার চরম রাজনৈতিক ব্যর্থতা হিসাবে বিবেচিত হবে।
এর বিপরীতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো মূল বিরোধকে আড়াল করে বিপরীত পক্ষকে নন-আইডিওলজিক্যাল, বাট লোকাল ইস্যুতে মধ্যবর্তী ফোর্সকে সামনে রেখে এনগেজ করে ফেলার মতো প্র্যাগমেটিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ ও তা একজিকিউট করতে পারাটা নিঃসন্দেহে সংশ্লিষ্ট আইডিওলজিকেল ফোর্সটির সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পরিপক্কতার প্রমাণ। এটি তাদের দিক থেকে এক ধরনের মতাদর্শগত বিজয় ও সফলতা।
মধ্যবাম বা মধ্যডান ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো পারতপক্ষে মতাদর্শগত বিষয় নিয়ে সিরিয়াসলি এনগেজ হয় না। তারা প্রধানত বিভিন্ন লোকাল ইস্যু নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে। তাই মতাদর্শগত তথা গ্লোবাল আদর্শ অনুসারীদের পক্ষে তাদের সাথে কোনো স্থানীয় বিষয় নিয়ে জড়িয়ে পড়াটা এক ধরনের রাজনৈতিক পরাজয়। এতে করে তাদের ফোকাস চেঞ্জ হয়ে যায়। অর্থাৎ আদর্শটা ওভারশেডোড হয়ে যায়। এবং তদস্থলে বিশেষ কোনো জাতিগত বা সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ইস্যু লাইম লাইটে চলে আসে।
রাজনীতি হলো সার্বক্ষণিক মোকাবিলার বিষয়। এভাবে ওয়ান-টু-ওয়ান মোকাবিলা করতে করতে নিজেদের অজান্তেই আদর্শনির্ভর দলগুলো রাজনীতির ময়দানে পথ হারিয়ে ফেলে। ঝড়ের মুখে পথ হারিয়ে ফেলা কাপ্তানের মতো তাই তাদের কম্পাস ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করতে হয়। নচেৎ একটা জীবন্ত মতাদর্শগত আন্দোলন এক পর্যায়ে গতানুগতিক ধারায় নিছক পাওয়ার পলিটিক্স পার্টিতে পরিণত হতে পারে। তাই, সামগ্রিকভাবে অগ্রসর থাকতে হলে মাঝে মাঝে পিছিয়ে আসতে হয়, কিছু সহজ লক্ষ্যকে (soft target) এড়িয়ে যেতে হয়। প্রয়োজনভেদে জাহাজ বদল করতে হয়। লক্ষ্যই যেখানে মুখ্য সেখানে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিকল্পের সন্ধানে অগৌরবের কিছু নাই। বরং সেটিই মহত্বের পরিচয়। আন্তরিকতার প্রমাণ।
এখানে যা বলা হলো তা ওভারঅল স্ট্যাটেজির ব্যাপার। সংশ্লিষ্ট পক্ষের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যার বিষয় এই সার্বিক সূত্রায়নে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। আমার দৃষ্টিতে এটি হলো রাজনীতির অনিবার্য গতিধারা। খুঁটিনাটি বিষয় দিয়ে এই ওভারঅল ডিসকোর্স বা এজাম্পশানকে নাকচ করতে চাওয়াটা হবে অবাস্তব চিন্তা, বোকামি ও পলিটিক্যাল ফ্যান্টাসির পরিচায়ক।
উল্লেখ্য, মতাদর্শগত দিক থেকে অনুদার বা রক্ষণশীল কোনো দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যদি সত্যিকারের স্বনিয়ন্ত্রিত তথা স্বাধীন ‘অংগ সংগঠন’ বা পার্শ্ব-সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে তাদের পক্ষে পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব।
আদর্শবাদ ও ক্ষমতার ভারসাম্য সংক্রান্ত এই স্কেল অনুসারে, আইডিওলজিক্যালি রেডিক্যাল কোনো দল স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, যেমন উদার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, এককভাবে কখনো ক্ষমতায় যেতে কিংবা ক্ষমতাসীন থাকতে পারবে না। তার মানে, সবসময় কোনো না কোনো মধ্যপন্থী দলই ক্ষমতায় থাকবে।
মতাদর্শগত এই কর্মকৌশলে মধ্যডান ও মধ্যবামদের প্রত্যেকের অবস্থান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ০ (শূন্য) ডিগ্রি হতে সামান্য ডানে-বামে হলেও নিজেদেরকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যাওয়া ও ক্ষমতার কেন্দ্রে টিকে থাকার জন্য তারা পরস্পরের সাথে চরম বিরোধিতায় লিপ্ত থাকবে। যদিও র্যাডিকেল লেফট ও র্যাডিকেল রাইটের মধ্যকার ১৮০ ডিগ্রি পার্থক্যের তুলনায় তাদের মধ্যকার আদর্শিক অবস্থানের মধ্যে ফারাক খুবই সামান্য, মাত্র ২০ ডিগ্রি।
আদর্শবাদের পক্ষে এক্টিভিজম ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক তৎপরতার দ্বন্দ্ব বা প্রতিসমতা (counter balance) কিংবা বৈপরিত্য সংক্রান্ত এই ফর্মুলা বা স্কেলের চলকগুলোর সাথে যদি আপনি আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে হাজির পক্ষগুলোকে ইকোয়ালাইজ করে সমীকরণটা বুঝার চেষ্টা করেন, তাহলে সমসাময়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সফলতা ও ব্যর্থতার জায়গাগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন। আজকের বাংলাদেশে কারা ‘ক’ অবস্থানে, কারা ‘খ’ অবস্থানে, কারা ‘গ’ অবস্থানে এবং কারা ‘ঘ’ অবস্থানে তা আপনিই ঠিক করুন। দেখবেন, অংক মিলে গেছে। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা ‘রকেট-সায়েন্টিস্ট’ হওয়া লাগবে না।
অনভিপ্রেত বিতর্ক এড়ানোর জন্য এ বিষয়টি এখানেই আপাতত শেষ করলাম। জ্ঞানীরা বলেছেন, আক্বল মান্দ কি লিয়ে ইশারা-ই কা-ফি (বুদ্ধিমানের জন্য ইংগিতই যথেষ্ট)!
www.facebook.com/notes/1467404856609978
৬ অক্টোবর, ২০১৬
(প্রায় দু’বছর আগে এই লেখাটা পোস্ট করেছিলাম। পলিটিক্যাল স্ট্র্যটেজির এই ফর্মূলা অনুসারে সমকালীন বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল, অবস্থান ও এর কনসিকোয়েন্স নিয়ে একটা পর্যালোচনা তখনই লিখে রেখেছিলাম। নানা কারণে সেটা অদ্যাবধি সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয় নাই। ভাবললাম, লেখাটা ফেইসবুকের কোনো পাঠকের কাজে লাগতে পারে। এই লেখাটার ফলোআপ হিসাবে স্বতন্ত্রভাবে অপ্রকাশিত সেই পর্যালোচনাটা পোস্ট করা হবে।)