গতকাল সেকেন্ড ইয়ারে নলেজ অ্যান্ড রিয়ালিটি কোর্সে একটা রিভিউ ক্লাস নিয়েছিলাম। বরাবরই যেমনটা ঘটে, দেড় ঘন্টা আলাপ আলোচনামূলক তথা ইন্টারেক্টিভ ক্লাস নেওয়ার পরেও কিছু কিছু স্টুডেন্ট রুমের বাইরে এসে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। তেমন একজন আমাকে রীতিমত ঘেরাও করে অ্যাবসোলিউট, রিয়াল, ইউনিভার্সাল এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করছিল। ওর সাথে কথা বলতে বলতে করিডোরে রীতিমতো স্টুডেন্টদের একটা জটলা হয়ে গেলো। তো, সেখানে মেয়েটাকে বুঝাতে গিয়ে আমি এমন একটা কথা বলেছি, যে কথাটা আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।
ওকে আমি বলেছি, ‘রিয়েলিটি হলো এমন একটা বিষয় যেটাকে আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে ধরে নেই, তৈরী করি, নির্মাণ-বিনির্মাণ করি। in beyond, transcendental কিংবা out there অলরেডি আছে, এরকম কোনো অ্যাবসোলিউট বা ইউনিভার্সাল ট্রুথ বা রিয়েলিটি বলে কিছু নাই। এই দিক থেকে পোস্ট-মর্ডানিজমই সঠিক।
আবার অন্যদিক থেকে, আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে অতীন্দ্রিয় এবং স্বয়ং-অস্তিত্বশীল, খানিকটা বুদ্ধিগম্য একটা কিছু যে আছে সেটা অনস্বীকার্য। বাস্তব বলে কোন না কোন ধরনের কিছু একটা আছে বলেই সেটাকে আমরা ধরা, ছোঁয়া এবং নির্মাণ করার চেষ্টা করি। দূর থেকে অ-ধরা হিসাবে, থেকেও ‘নাই’ হয়ে যেটা আছে, সেটাকে নাই বা আছে প্রমাণ করার জন্য আমরা গলদঘর্ম হই। এই দিক থেকে সার্বজনীন সত্যতার উপস্থিতি ও মানবীয় বুদ্ধির সক্ষমতা সম্পর্কে মডার্নিজমের দাবীকেই সঠিক বলে মনে হয়।
যে কথাটা আমার ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে, মেয়েটাকে আমি প্রসঙ্গক্রমে বলেছি– “তোমাকে দেখে বেশ স্মার্ট এবং প্রগ্রেসিভ মাইন্ডেড বলে মনে হচ্ছে। তাই তোমাকে বলছি। (পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পর্দানশীন কয়েকজনকে দেখিয়ে বললাম) ওদের মতো তোমাকে রক্ষণশীল মনে হলে অন্তত এই উদাহরণটার কথা বলতাম না।
দেখো, পূর্ণ গর্ভবতী কোনো নারী যখন তার অনাগত সন্তান সম্পর্কে কিছু একটা বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করে বা বাচ্চাটার কোনো ছবি আঁকে, বা বাচ্চাটা সম্পর্কে কিছু একটা ভাবে তখন যে অবস্থা, বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের অবস্থাও ঠিক তেমনি।
রিয়েলিটি হলো একই সাথে রিয়েলি রিয়েল বাট কনস্ট্রাক্টেড এজওয়েল।”
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Farid Gazi: বিষয়টি আরও পরিষ্কার হলে ভালো হতো।
Sabuj Kabir: অস্তিত্ব বা বস্তু ছাড়া বাস্তবতা নির্মাণ বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করবেন
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সব বাস্তবতা হলো তালেগোলে, আমাদের বানানো বাস্তবতা। অনড় কোনো বাস্তবতা নাই। যেটাকে আমরা অনড় বা ফিক্সড হিসাবে মেনে নেই, সেটাই (আমাদের জন্য) অনড় বা ফিক্সড বাস্তবতা। মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার সত্তা বা সাবজেক্টিভিটির যে ভূমিকা, আমি সেটার ওপর ফোকাস করেছি। বলাবাহুল্য, subjectivity এবং objectivity’র পারস্পরিক সম্পর্ক হলো অনস্বীকার্য তথা ontologically necessary। সাবজেক্টিভিটি না থাকলে অবজেক্টিভিটি মিনিংলেস। আবার অবজেক্টিটিভিটি আছে বলেই সাবজেক্টিটিভিটি, সাবজেক্টিভিটি হয়ে উঠে।
Nure Elahi Shafat: এই প্যারা ক্লিয়ার না স্যার–
“যে কথাটা আমার ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে, মেয়েটাকে আমি প্রসঙ্গক্রমে বলেছি– “তোমাকে দেখে বেশ স্মার্ট এবং প্রগ্রেসিভ মাইন্ডেড বলে মনে হচ্ছে। তাই তোমাকে বলছি। (পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পর্দানশীন কয়েকজনকে দেখিয়ে বললাম) ওদের মতো তোমাকে রক্ষণশীল মনে হলে অন্তত এই উদাহরণটার কথা বলতাম না।”
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: পর্দানশীন নারীদের মধ্যে মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ওভার পারসোনাল সেনসিটিভিটি লক্ষ করা যায়। তাই তাদের সাথে কথা বলার সময়ে ভাষার ‘শালীনতার’ ব্যাপারে অতিরিক্ত মনযোগী হতে হয়। ‘সাধারণ মেয়েদের’ সাথে যেটার দরকার পড়ে না।
Nure Elahi Shafat:Thank you ?
আনারুল ইসলাম: বাস্তবতা তৈয়ার করা যায় ?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সব বাস্তবতাই তো তৈরি বাস্তবতা। এমন কোনো বাস্তবতা নাই, যা স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষভাবে সত্য বা বাস্তব। বাস্তবকে বাস্তব হিসাবে স্বীকার করে নেয়ার পরে ব্যক্তির জন্য তা বাস্তব হিসাবে উদ্ভূত হয়।
we make reality and at the same time, reality is out there, that’s why we can make it, and claim it as real.
সূর্যটা উদিত হয় বলেই আমরা বলি, সূর্যটা আছে। যদিও আমরা জানি, উদিত হওয়াটা সূর্যের থাকা না থাকার কোনো শর্ত না। একই সাথে, আমাদের জন্য, সূর্য থাকার জন্য উদিত হওয়াটা শর্ত বটে। না হলে, আমরা কীভাবে জানতাম, সূর্যটা আছে?
Raiyan Dip: স্যার, একই বিষয়টি কি ‘সত্য’ বিষয়টির বেলায়ও প্রযোজ্য? যদি আমরা ধরে নেই objective reality বলে কিছু নেই সেটি কি objective morality’র বেলায়ও সত্য?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: অবজেক্টিভ রিয়েলিটি নাই, আমি কি এমন কনক্লুসিভ কথা বলেছি? যা বলার চেষ্টা করেছি, তা হলো, সাবজেক্টিভিটি বাদ দিয়ে পিউরলি অবজেক্টিভ কিছু হতে পারে না। নাই। আবার অবজেক্টিভিটি আাছে বলেই সারজেক্টের সাবজেক্টিভিটি অবজেক্টিভ হয়ে উঠে।
Sahadath Hossin: আমাদের ধারণাগত বস্তুজগত বা মানসিকজগত সবকিছুই আপেক্ষিক। আমাদের অতি সীমিত জ্ঞান আজ যাকে বাস্তব ও সত্য বলে কতদিন পর নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে অনেক বড় অসত্য মনে হয়। সুতরাং সসীম জ্ঞান দিয়ে মানুষ কখনো চূড়ান্ত সত্য ও ব্স্তবতায় পৌছাতে পারে না। এজন্য নিশ্চিত জ্ঞান ও বাস্ততবতা লাভে তাকে অসীমের মুখাপেক্ষী হতে হয়। এটাই চরম বাস্তবতা ও বিশুদ্ধ চিন্তা।
পান্থজন জাহাঙ্গীর: মডার্নিজম এবং পোস্ট-মডার্নিজম কী, তাও বুঝি না; অথবা আমি যা বুঝি তা আপনি যা বোঝাবেন তা এক নয়। আপনি আমাকে একটু সংক্ষেপে বুঝালে খুশি হবো স্যার। আপনার পোস্টগুলো আমি সেইভ করে রাখি। কারণ আমার ভালো লাগে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সত্যতা অ-আপেক্ষিক তথা চিরন্তন। এটি হচ্ছে আধুনিকতার মূল কথা। এবং বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা সেই চিরন্তন বা সার্বিক সত্যতাকে জানতে পারি।
অন্যদিকে উত্তরাধুনিকতার মূলকথা হলো সার্বজনীন বা চিরন্তন সত্য বলে কোনো কিছু নাই। সব সত্য, সব জ্ঞান ও সব কিছুই হচ্ছে এক ধরনের সাপেক্ষমূলক বা আপেক্ষিক। আমাদের বুদ্ধি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা যে ধরনের সত্যতা ও জ্ঞানকে পাই, এর বাইরে পরম সত্য বলে কোনো কিছু নাই।
Muhammad Sajal বাস্তবতা দুই ধরনের। একটা হচ্ছে মহাবিশ্বের পরম সামগ্রিকতা। এই পরম বাস্তবতার কিছুটা অংশ আমাদের সামনে পড়ে গেলে আমরা আমাদের অনুভূতিতে তার যতটা অনুধাবন করতে পারি, ততটাকে নিজেদের গড়ে ওঠা বিশ্ববীক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে যে প্রতিচ্ছবি নিজের অনুভুতির জগতে আঁকি, সেটা হলো আমাদের নিজ নিজ আপেক্ষিক বাস্তবতা। এটা ব্যক্তি, স্থান ও কাল ভেদে ব্যাপকভাবে পরিবর্তনশীল।
এটা একান্তই ব্যক্তিগত মত স্যার, কনফিডেন্সের সাথে সংজ্ঞায়িত করে শেয়ার করার ধৃষ্টতা দেখালাম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: I strongly agree with your opinion
Muhammad Sajal বাস্তবতার সীমা সম্পর্কে আমার ভিন্ন ভিন্ন বন্ধুর ধারণা দেখতে দেখতে এই সিদ্ধান্তে এসেছি স্যার, আমার আসলে এ ব্যাপারে কোনো পড়াশোনা নেই। আপনি একমত হওয়াতে আরো আত্মবিশ্বাসী হলাম।
শামীম সৈকত: স্যার, আমার প্রশ্নটি খুব ছোট। কোনটা বাস্তব নয়? এর একটা উদাহরণ…।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ‘অবাস্তব’-এর কোনো ‘বাস্তব’ উদাহরণ হতে পারে না। অবাস্তব হলো বাস্তবতার বিপরীতে একটি ধারণা মাত্র।
শামীম সৈকত: তাহলে এটাও সত্য যে বাস্তব বলে যা জানি, তাও ধারণা মাত্র। তাহলে ‘ইজম’-এর প্রয়োজনটা কোথায়?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সব ‘বাস্তবতাই’ আদতে ধারণা মাত্র। True source of knowledge is intuition.Bottom of Form