“আসসালামু আলাইকুম স্যার। আপনাকে বিরক্ত করছি একটু। এখন অনেকের কাছেই অভ্যাস হয়ে গেছে ঈদের সময় বাইরের দেশে সফর করা। সেটা বেশিরভাগ সময়ই হয় কুরবানী ঈদের সময়। মূল উদ্দেশ্য, ঝামেলা থেকে বাঁচা। সেক্যুলার পরিবারগুলায় তা বেশি হয়। আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে পরিবারের সাথে কলকাতায় ঈদ করার। বিষয়টি নিয়ে যদি কিছু বলতেন…”
– এক তরুণ পাঠক আমার কাছে এই প্রশ্ন করেছে। এ প্রসঙ্গে তাকে আমি নিম্নোক্ত উত্তর দিয়েছি। ধারণা করছি, এ বিষয়টি অনেকের কাছেই প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তাই এখানে এই প্রশ্নোত্তরটি শেয়ার করছি।
নিজের হাতে বা নিজে উপস্থিত থেকে কোরবানী দেয়া হলো ইসলামের মূল প্রস্তাবনা। আর নিজের পক্ষ থেকে কোনো কসাইখানায় কোরবানী দেয়া হচ্ছে ইসলামী শরীয়াহ কর্তৃক অনুমোদিত বিকল্প। মানুষেরা মূল প্রস্তাবনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়ানোর জন্য যখন বিকল্প অনুমোদনকে গ্রহণ করে, কিংবা মূল প্রস্তাবনা থেকে যখন বিকল্প প্রস্তাবনাকে বেটার মনে করে, ঈমান, ইসলাম ও শরীয়তের দৃষ্টিতে সেটি হচ্ছে একটি মৌলিক সমস্যা। একান্ত অগত্যা পরিস্থিতিতে বিকল্প অনুমোদনের ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা যেতে পারে, এটি বলাই বাহুল্য।
ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষত আমাদের এখানে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ইসলামের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যবস্থা যা এখনকার সময়ে ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত ইস্যু, সমকালীন পাশ্চাত্য প্রভাবিত নারী অধিকার বিষয়ক ধ্যানধারণা ও আচার-আচরণসহ সমকালীন মুসলিম সমাজ ও মননে প্রভাবশালী এমন অনেক বিষয়কে আপনি ইসলামী শরীয়াহর মূল প্রস্তাবনা বনাম আইনসঙ্গত অনুমোদিত সীমারেখার (basic proposal versus legal permissibility) এই ধরনের স্ববিরোধী ও বিপরীতমুখী চিন্তাধারার উদাহরণ হিসাবে পাবেন।
মোট কথা হলো, কম্প্যাটিবিলিটির সাথে বেসিক কমান্ডের যে পার্থক্য, সেটাকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে এবং মেনে চলতে হবে। তার আগে এ বিষয়গুলো ভালো করে বুঝতে হবে।
ইসলামী শরীয়াহর এই মৌলিক বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য আপনি যদি প্রচলিত আলেম-ওলামাদের ওপর নির্ভর করেন, বিশেষ করে যারা ইসলাম চর্চাকে নিজেদের জীবিকা বানিয়ে নিয়েছেন, তাদের উপর যদি আপনি এই ধরনের মৌলিক বিষয়গুলো জানার জন্য নির্ভর করেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনি ঠকবেন। বিভ্রান্ত হবেন।
সে ক্ষেত্রে আপনার করণীয় হলো, স্বাধীন চিন্তাবিদ হিসেবে কাজ করেন এমন ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা। সর্বোপরি, নিজের বুঝজ্ঞান মোতাবেক যথাসম্ভব সরাসরি কোরআন-হাদীস পড়ে এবং নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুম এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নতকে জানার চেষ্টা করা।
ইসলাম শরীয়াহ কোনো আইন গ্রন্থ নয় যে আপনি সেখানকার যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো কিছু ইচ্ছা মতো চুজ এন্ড পিক করে চলতে পারবেন। বরং এখানে নিজের ইনটেনশন বা নিয়তের যে ব্যাপার, যেটার ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলা আপনার কাছ থেকে জবাবদিহিতা গ্রহণ করবেন, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজে খারাপ ইনটেনশন বা অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়তের লোকজন থাকতেই পারে। কিন্তু যখন লোকেরা অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো কিছু করে অথচ সবাই মনে করে, ‘এটি তো জায়েয’, ‘এতে তো কোনো সমস্যা নাই’– এই ধরনের অনৈতিক মানকে সমাজ কর্তৃক অনুমোদনের প্রবণতাই হলো আসল সমস্যা। বাহ্যিকভাবে সুন্দর ইসলামসম্মত জীবনযাপনের অন্তর্গত সমস্যার এই দিকটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ (সিএসসিএস) প্রকাশ করেছে নিম্নোক্ত তিনটি বেসিক এন্ড থট প্রভোকিং প্রবন্ধ। তাই, এই লেখাগুলো আপনাকে পড়তে হবে। ভালো করে পড়তে হবে। এবং বুঝতে হবে।
কেননা, you cannot compromise with your basic belief and eternal salvation, if you really do believe on Allah and in here-after. কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তায়ালাকে কোনো ভুল কাজ সম্পর্কে ওযরখাহী করতে গিয়ে আপনি বলতে পারবেন না, ‘আমাকে এটি বলা হয় নাই’ বা ‘আমাদের সমাজে এমন এমন কাজকর্মকে সঠিক মনে করা হতো’। এ ধরনের যদি আপনি বলেনও বা কেউ বলে, সেটি কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, সর্বাবস্থাতেই ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।
সেজন্য সঠিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে এবং ছলচাতুরি বাদ দিয়ে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর হুকুমকে মেনে নিতে হবে। সেটা আপাতদৃষ্টিতে যতই অসঙ্গত, ভুল, অযৌক্তিক ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থা সাথে সাংঘর্ষিক মনে হোক না কেন। এটিই হচ্ছে কোরবানীর শিক্ষা।
নিবন্ধ তিনটির লিংক:
১। ইসলামিক ফাইন্যান্স: কল্পকথা বনাম বাস্তবতা – মোহাম্মদ আকরাম নদভী
২। পুঁজিবাদের ইসলামীকরণ প্রচেষ্টার মৌলিক অসঙ্গতি – তারিক রমাদান
৩। হালাল হলেই কি ইসলামিক হবে? ইসলামী নৈতিক চেতনা গুরুত্ব – শরীফ হাসান আল বান্না
এছাড়া আমার লেখা একটি একটি নিবন্ধ এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক– আইন ও নৈতিকতার বিপরীত অনুপাত সম্পর্ক