[‘মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য: নাস্তিকতা, তাদের চর্চিত অশ্লীলতার মতোই পরিত্যাজ্য’ শীর্ষক আমার অব্যবহিত আগের পোস্টের মন্তব্যে একজন পাঠক দুটি প্রশ্ন করেছেন। এখানে প্রশ্ন দুটির উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি।]

***

প্রশ্ন: তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদকে ইসলাম থেকে হঠাবেন কেমনে? তারাও তো টেক্সট ধরে এগুলারে জায়েজ করছে। আর কে কোন ধর্মকে কীভাবে গ্রহণ করবে তার সাথে স্থান-কাল-ইতিহাসের সম্পর্ক বিদ্যমান।

উত্তর: বিষয়টি মিসকোটেশন বা কোটেশন আউট অব কনটেক্সট সম্পর্কিত। ইসলামকে যদি ‘পুরো-ইসলামের’ আলোকে না দেখা হয় তাহলে বিভ্রান্তি হবেই। পুরো-ইসলাম বা বাস্তব-ইসলাম হলো সেই ব্যক্তির জীবন, যার কাছ হতে মানুষ ইসলাম জেনেছে। বলাবাহুল্য, তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা)। তিনি কীভাবে এই টেক্সট বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁর অনুসারীরা কীভাবে সেগুলো বুঝেছেন– সেটি জানতে ও বুঝতে হবে। ইসলামকে অনুসরণ করতে হবে নবীর (সা) আচরিত পন্থায়। তাই কোনো কাজের রেফারেন্স কোরআনে থাকলেই হবে না, রাসূল (সা) এ ব্যাপারে কী করেছেন সেটি আমাদের জানতে হবে। কোরআন হলো হেদায়াত তথা অনুপ্রেরণার উৎস। ইসলামের কাঠামো হলো মুহাম্মদের (সা) নবুয়তী জীবন তথা হাদীসে রাসূল (সা)। কোনো বিষয়ে তৎসংক্রান্ত সকল প্রাসঙ্গিক রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অতএব, কোনো রেফারেন্স সঠিক হলেই সেই কাজ করা বৈধ হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেফারেন্সসমূহকে এবং মুহাম্মদের (সা) নবুয়তী জিন্দেগীর ধারাবাহিকতার প্রেক্ষিতকে অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ইকামতে দ্বীনের অন্তর্গত ধারাবাহিকতা বা লাইন অব কনসিসটেন্সিকে বাদ দিয়ে পড়লে সমগ্র কোরআন (নাউজুবিল্লাহ) পরস্পরবিরোধী কিছু কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু মনে হতে পারে না। আবার কনটেক্সটের ধুয়া তুলে ইসলামের যেসব বিষয় সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না সেগুলোকে তৎকালীন আরব সংস্কৃতির বিষয় বলে ব্যবহারিকভাবে বাতিল করে দেয়াটাও সমর্থনযোগ্য নয়। অবশ্য নিছক আরব সংস্কৃতির অংশ হিসাবে তখন রাসূল (সা) যা কিছু করেছেন, তা সুন্নতে রাসূল (সা) হিসাবে পরিগণিত নয়। হাদীস শাস্ত্রে সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।

জঙ্গীবাদের আদি গোষ্ঠী হলো খারেজী সম্প্রদায়। ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের এ সংক্রান্ত ভালো একটি বই আছে। বাংলায়। আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে ড. ইউসুফ কারযাভীর ‘ইসলামিক অ্যাওয়েকেনিং বিটুইন রিজেকশন অ্যান্ড এক্সট্রিমিজম’ খুব ভালো একটি বই।

***

প্রশ্ন: দর্শনের যুক্তিপ্রমাণ যে কনসেপ্চুয়াল খোদার কথা বলে, সে কি ধর্মের খোদা, নাকি আলাদা?

উত্তর: দর্শনের যুক্তিপ্রমাণ যে কনসেপ্চুয়াল খোদার কথা বলে, তা ধর্মীয় অর্থে খোদা বলতে যা বোঝায় তা নয়। আলাদা। ধর্মীয় ঈশ্বর হলো ব্যক্তিগত ঈশ্বর। ব্যক্তিমানুষ ও তার জীবন এই ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল এবং ব্যক্তি এই ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ বোধ করে। আর দার্শনিক খোদা হচ্ছেন এর বাইরে। তিনি জগতের অতিবর্তী, সৃষ্টিকর্তা। মানুষ সাধারণভাবে চরম, পরম, অসীম ধরনের গুণাবলী এই সত্তার প্রতি প্রয়োগ করে। গড, ঈশ্বর, খোদা– এই ধরনের শব্দাবলী এই চরম, পরম ও অসীম সত্তাকে বোঝাতে ব্যবহার করে না। মানুষের বাস্তব, বিশেষ করে ব্যক্তিজীবন, এই দার্শনিক ঈশ্বরের সাথে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়। এই ঈশ্বর প্রকৃতই কনসেপ্চুয়াল গড, যাকে আমি বলেছি ফিলোসফিক্যাল গড। সমাজে নাস্তিক হিসাবে নিজেদের পরিচয় দানকারীরা একে বলে প্রকৃতি। বৈশিষ্ট্যগতভাবে এই ফিলোসফিক্যাল বা কনসেপ্চুয়াল গডের সাথে প্রকৃতির কোনো পার্থক্য নাই। তাই নাস্তিক হলো তারা, যারা ব্যক্তি-ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না।

ইসলামের খোদাবিশ্বাসে ব্যক্তিগত ও ফিলোসফিক্যাল উভয় অর্থ প্রযোজ্য।

ইসলাম প্রচলিত অর্থে ধর্ম নয়। তৎকালীন প্রচলিত ধর্মের অনেক কিছুকে ইসলামে বাতিল করা হয়েছে। ইসলামে ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তবে ইসলাম ধর্ম নয়। এটি একটি মতাদর্শ। জীবনাদর্শ। যদিও বর্তমানে কেউ কেউ না বুঝে, কেউ কেউ ইনটেনশনালি ইসলামকে ধর্ম হিসাবে ট্রিট করছে, বলছে, লিখছে। ইসলাম প্রচলিত অর্থে ধর্মের কী কী বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেছে, কেন ইসলামকে ধর্ম বলাটা যুক্তিসঙ্গত নয়– এ বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে লেখার ইচ্ছা আছে।

সামহোয়্যারইন ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

মাসুদ জাকারিয়া: কনসেপ্চুয়াল কোনো কিছু জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবে না– সেটা একটা ছোট তর্ক হতে পারে। কনসেপ্টের ইট দিয়ে গড়া বিরাট দার্শনিক দেয়ালটির টিকে থাকা নির্ভর করবে এই তর্কের মীমাংসার উপর। প্রফেসর খান পূর্বোক্ত বইটিতে কনসেপ্ট/কল্পনাকে জ্ঞান থেকে কী রূপে পৃথক করা যায় সেটার একটা পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব হাজির করেছেন। ওহী, ইলহাম ও ওহাম (কনসেপ্ট/কল্পনা) এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে এদের অবস্থান নির্ণয় করা না গেলে কনসেপ্ট/দর্শনের জগতেই আমাদের জ্ঞানীয় পরিসর সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বোঝা হয়ে উঠবে না কুরআনের/ওহীর জ্ঞান কী এবং ঈশ্বর কনসেপ্চুয়ালই থেকে যাবে আমাদের বোধগম্যে।

আবার আসছি।

পারভেজ আলম: ছোট লেখায় অনেক বেশি বিষয় এনেছেন। আলোচনা করা তাই কঠিন হবে। খারেজি সম্প্রদায় ইসলামের একটা কট্টর সম্প্রদায়, এটি ঠিক আছে। কিন্তু জঙ্গিবাদ বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তার সাথে খারেজিদের সম্পর্ক নাই। বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষমতাবানরা অন্যের উপরে আক্রমণ করলে তা হয় নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য যুদ্ধ, আর ক্ষমতাহীনরা ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে করলে তা হয় জঙ্গিবাদ। আর তাই আমেরিকাকে সন্ত্রাসী বলা হয় না, বলা হয় তালিবানদের। আমি তালিবানদের পজিটিভলি দেখছি না। এটা দুঃখজনক যে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসলামী চরমপন্থীরাই এখন সবচেয়ে বেশি লড়াই চালাচ্ছে। বর্তমান যুগে ইসলাম নয়; বরং, ইসলামী চরমপন্থার একটা রাইজ হচ্ছে।

ধর্মের খোদা বা ব্যাক্তিক গড খুবই সীমাবদ্ধ সত্তা এবং যৌক্তিকভাবে অপ্রমাণযোগ্য। এই কারণেই ইসলাম এবং অন্যান্য বেশ কিছু ধর্ম দিনশেষে মুক্তচিন্তকদের সাপোর্ট হারায়। ইসলাম যেমন ধর্ম নয়, তেমনি হিন্দুও কোনো ধর্ম নয়, বৌদ্ধও নয়, খ্রীষ্টান নয়, ইহুদি নয়। এই চারটাকেই যদি আমরা ধর্ম বলি, তাহলে ঠিক কোন মান বিচারে এগুলোকে আমরা ধর্ম বলতে পারি? প্রত্যেকটারই খুব দূরবর্তী এবং পুরোপুরি ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট আছে। আধুনিক যুগে এসে এই একটা শব্দ, ধর্ম শব্দটা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বিশ্ববিক্ষা এবং নৈতিক ধারণাকে এক শব্দে আবদ্ধ করা হয়েছে। এইটা আলোচনার ক্ষেত্রে একটা বিশাল সমস্যা।

আর এ কারণেই আপনি ‘ইসলাম ধর্ম নয়, মতাদর্শ, কিন্তু অন্যগুলো ধর্ম’– এই কথা বললে তা ধোপে টেকে না।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সো, আই সি! ইউ আর এ রেগুলার ভিজিটর! থ্যাঙ্কস ফর…! নট ইমপসিবল দ্যাট, ইউ নো মি পারসোনালি। এনিওয়ে।

ধর্মের বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করবে কোনটি ধর্ম, আর কোনটি মতাদর্শ। এ বিষয়টি নতুন। তাই বিস্তারিত না লিখলে এটি বোঝা যাবে না। পরে লিখব আশা রাখি।

মূল পোস্টে যে দুটো বইয়ের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো পাওয়া যাবে। আপনার মতো চিন্তাশীল লেখকের কাজে আসবে, নিশ্চিত।

মাসুদ জাকারিয়া: এই লিংকটি এই লেখার পাঠকদের জন্য জরুরি মনে হচ্ছে: ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জমানায় ইসলাম’/মুসতাইন জহির

আমি আবার আসছি অন্য আরো কিছু জিনিস নিয়ে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তোমার দেয়া লিংকটি পড়লাম। সুন্দর লেখা। টার্মগুলোও বেশ সুন্দর। তোমাদের ইসলামিক কমিউনিজম লাইনের কেউ বলে মনে হলো। তবে, বিশ্লেষণ চমৎকার। ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ টাইপের কথাবার্তার ফাঁকগুলো সম্পর্কে বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে– ইসলাম প্রচলিত অর্থে ধর্ম নয়। আর শান্তির ইসলামী ভাষ্য সবসময় যে ডিফেন্সিভ নয় তাও কোরাআন-হাদীসের রেফারেন্স ও যুক্তি সহকারে তুলে ধরতে হবে।

ফিতনা ইজ অলওয়েজ এন্ড স্ট্রিক্সটলি প্রহিবেটেড; হোয়ারএজ জিহাদ ইজ এ মাস্ট ইন ইসলাম– এটি কেন এবং কীভাবে তা জানতে হবে, জানাতে হবে।

নিদার উই ওয়ন্ড টু বি ফ্যানাটিক, নর অ্যাপলোজেটিক।

***

এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

ঈগল: বুঝলাম না। জঙ্গিবাদ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? আমেরিকা বা ইসরাইল যা বুঝিয়ে থাকে, তাই কি? জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এতদিন পরে এই পোস্ট পড়লেন! ধন্যবাদ।

মূল পোস্টের এই অংশটুকু খেয়াল করুন, “কোনো রেফারেন্স সঠিক হলেই সেই কাজ করা বৈধ হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেফারেন্সসমূহকে এবং মুহাম্মদের (সা) নবুয়তী জিন্দেগীর ধারাবাহিকতার প্রেক্ষিতকে অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।”

ইসলামের ইতিহাসে আদি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী হচ্ছে খারেজীরা। জঙ্গিবাদ বুঝার জন্য খারেজীদের সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের এ সম্পর্কিত একটা ছোট বই আছে। ইউসুফ কারযাভীর ‘ইসলামিক অ্যাওয়েকেনিং বিটুইন রিজেকশন অ্যান্ড এক্সট্রিমিজম’ও ভালো বই।

জিহাদ ফরজ, অথচ ফিতনা হারাম। তাই না? দুটোই তো বাহ্যত একই ধরনের।

সামাজিক কর্তৃত্ব ও বাস্তবতা (ল ফুল অথরিটি এন্ড সোশ্যাল ম্যাচিউরিটি)– এই দুই ফ্যাক্টরই নির্ধারণ করবে কোনটা জিহাদ, আর কোনটা ফিতনা।

তবে, আত্মরক্ষার অধিকার সবসময়ই বলবৎ থাকবে। সুতরাং, আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করা জিহাদতুল্য, জিহাদ নয়।

ধন্যবাদ।

ঈগল: মনে হলো আপনি আমার প্রশ্নট পাশ কাটিয়ে গেলেন। আমি বলতে চেয়েছি, জঙ্গিবাদ বলতে আমেরিকা বা তার মিত্ররা যা বুঝে, আপনি কি তাই বুঝিয়েছেন?

আপনি আমার জবাবের শেষ লাইনে আত্মরক্ষার জিহাদের কথা বলেছেন, তাহলে বাতিলকে উৎখাতের জন্য আক্রমণাত্মক জিহাদের কোনো অস্তিত্ব নাই?

আমার এই পোস্টটি পড়ে মন্তব্য করলে খুশি হবো।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বেশ তো ব্লগীয় লড়াই হলো দেখছি আপনার পোস্ট নিয়ে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এই পোস্টে আমার মন্তব্যগুলো দেখুন।

ধন্যবাদ।

ঈগল: জ্বী, আপনার মন্তব্যগুলো দেখলাম। আপনার সাথে আমার দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট মিল আছে।

সামহোয়্যারইন ব্লগ লিংক | এসবি ব্লগ আর্কাইভ লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *