আমরা মানুষ। যেভাবেই হোক না কেন, আমরা সৃষ্টির সেরা। আমাদের এই শ্রেষ্ঠত্ব বুদ্ধির, জ্ঞানের, প্রযুক্তির, নৈতিকতার এবং বিশেষ করে আধ্যাত্মিকতার। এই বিশেষ মানবিক মর্যাদা নিয়ে কারো মধ্যে কোনো বিতর্ক নাই। আস্তিক, নাস্তিক কিংবা সন্দেহবাদী, প্রত্যেকে এ বিষয়ে একমত। বরং আমাদের মধ্যকার সব মতদ্বৈততা হলো এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আমাদের কী করা উচিত, কেমনভাবে চলা উচিত; কিংবা এই বিশেষ বিশেষত্বের পিছনে কোনো বিশেষ কারণ বা উদ্দেশ্য আছে কিনা, তা নিয়ে।

যারা মুসলমান তারা দাবী করে, তারা এ জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মহান আল্লাহর খলিফা তথা প্রতিনিধি। তারা আশরাফুল মাখলুকাত। তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে সুষ্ঠুভাবে জগত পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে। ন্যায়ের আদেশ দিবে। অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, একজন মানুষ যখন নিজেকে একজন ঈমানদার মুসলমান হিসেবে দাবী করে, তখন প্রাকারান্তরে সে নিজেকে লিডারশীপের জন্য ডিভাইন অথরিটি হিসেবে মনে করে।

এমতাবস্থায় যখন সে নিজেকে নাখান্দা বান্দা তথা তুচ্ছ একজন ব্যক্তি মনে করে এ ধরনের তুচ্ছার্থক শব্দ ব্যবহার করে নিজের পরিচয় দেয়, তখন সে আসলে নিজেকেই নিজে হেয় প্রতিপন্ন করে। এবং এভাবে সে স্রষ্টাকর্তৃক প্রদত্ত নেতৃত্বের যোগ্যতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

এই কথাগুলোর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, নিজেকে বড় করে না দেখার যে প্রচলিত রীতি, সেটা ভব্যতা বা বিনয় নয়; বরং এক ধরনের আত্ম-অমর্যাদাসুলভ আচরণ ও দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। নিজেকে বড় করে দেখানো মাত্রই খারাপ কিছু নয়। বরং দেখতে হবে—

(১) নিজেকে কেউ যখন কোনো একটা গূণ বা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হিসেবে দাবী করছে, আসলেই সে সেটা ধারণ করে কিনা। এর মাধ্যমে বুঝা যাবে, সে আসলে সততার কারণে এই দাবী করছে, নাকি শঠতার বশবর্তী হয়ে এমনটি বলছে।

(২) এর মাধ্যমে সে অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করছে কিনা।

(৩) এই স্ট্যাটাস লাভ করার ব্যাপারে সে যাদের কাছে ঋণী, তাদের প্রতি সে কৃতজ্ঞ কিনা। সর্বোপরি,

(৪) সে কি আত্মম্ভরি বিদ্রোহমনোভাবাপন্ন, নাকি স্রষ্টার প্রতি অনুগত ও কৃতজ্ঞ।

কেউ যদি আসলেই তা হয় যা সে দাবী করে, সে যদি এর মাধ্যমে অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন না করে, সে যদি হয় কৃতজ্ঞ চরিত্রের, তাহলে সে অহংকারী নয় মোটেও। বরং একজন আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তি। একজন মানুষ অহংকারী না হওয়া অর্থে এবং কৃতজ্ঞ হওয়া অর্থে বিনয়ী হবে। কিন্তু বিনয়ের নামে কেউ নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন করবে, এটি আমি ভাবতে পারি না। এ ব্যাপারে ‘সেল্ফ ব্র্যান্ডিং’ হলো আমার থিওরি— যেকোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে নিজের প্রকৃত অবস্থানকে তুলে ধরা, যা প্রকৃত তা দাবী করা, নিজের ব্যাপারে অপটিমিস্টিক হওয়া, কনফিডেন্ট হওয়া।

মহাকবি আল্লামা ইকবালের খুদী তত্ত্বের মূল কথাই হলো নিজের আত্মসত্তা তথা খুদীর উন্নয়ন। এই খুদী তত্ত্বের আলোকে আমরা যদি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটি বোঝার চেষ্টা করি তাহলে আমরা বুঝবো, তিনি যখন বলেন— “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন”, তখন তিনি আসলে সব ফলস ডেইটিকে চ্যালেঞ্জ করেন। ভৃগু নামক এক বীরযোদ্ধা একবার নিজেকে খোদা দাবী করা এক নকল ভগবানকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করে তার বুকের উপর পা রেখে এই কথা বলেছিলো। ‘বিদ্রোহী’র ব্যাখ্যা হিসেবে চবি বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান স্যারের কাছ হতে এই কথাগুলো আমি জেনেছি।

সে যাই হোক। কোনো মুসলিম পুরুষ যখন কোথাও দেখবে, যিনি নামাজ পড়াচ্ছেন তার তেলাওয়াত সহীহ হচ্ছে না। তখন সেই মুসলিম পুরুষ যদি উক্ত নামাজের জামায়াতে মুক্তাদী হিসেবে শরীক হয়, তাহলে সবার নামাজ ফাসেদ বা বাতিল হয়ে যাবে, যদি উক্ত পুরুষ মুসল্লীর তেলাওয়াত সহীহ হয়ে থাকে। এমতাবস্থায়, সেই ব্যক্তির করণীয় হলো উক্ত জামায়াতে শরীক না হয়ে একাকী নামাজ পড়া। নামাজ শুরুর আগে যদি কেউ কোনোভাবে বুঝতে পারে, উপস্থিত যে কারোর চেয়ে তার তেলাওয়াত ও শরয়ী জ্ঞান বেটার, তাহলে তার ওপর ওয়াজিব হবে উক্ত নামাজের ইমামতি দাবী করা। তাকে ইমামতি করতে না দেয়া সত্বেও যদি সে উক্ত জামায়াতে নামাজ পড়ার জন্য এক্তেদা করে তাহলে সবার নামাজই ফাসেদ হবে।

এই শরয়ী মাসআলা অনেকেই জানেন না। নেতৃত্বের গুরুত্ব বুঝার জন্য এটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মাসআলা।

আমার লেখাগুলো অনেক অমুসলিম ছাত্র-ছাত্রী পড়ে থাকে। সেজন্য এবং রেফারেন্স দিয়ে কথা বলার পদ্ধতিকে আমি ততটা পছন্দ না করার কারণে, এই আলোচনাতে আমি কোরআন-হাদীসের কোনো উদ্ধৃতি দিলাম না। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, রেফারেন্স মানুষকে জ্ঞান দেয় না। বরং মাঝে মাঝে বা অগত্যা পরিস্থিতিতে কোনো দোহাই বা মাননীয় উদ্ধৃতি আমাদেরকে কোনো বিষয়ে বুঝতে সহায়তা করে।

আপনি, হ্যাঁ আপনি, যিনি আমার এই লেখা পড়ছেন, ভেবে দেখেন, আপনি এ দেশের বা বিশ্বের শতকরা কতভাগ লোকের একজন। চাইলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, আপনি অতীব স্বল্পসংখ্যক সৌভাগ্যবানদের একজন। এরপরও যদি আপনি নিজেকে অবমূল্যায়ন করেন, মানুষ আপনাকে মূল্যায়ন করবে এ আশায় বসে থাকেন, তাহলে আপনি নিঃসন্দেহে ভুল করছেন।

মরুঅঞ্চল তথা আরবের গ্রাম থেকে তৎকালীন মদিনাতে এক লোক এসে প্রফেট মুহাম্মদকে (স.) বললেন, “হে মুহাম্মদ, আল্লাহ তোমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা থেকে আমাকে কিছু দাও।” তখন সেই লোকটাকে তিনি বলেছিলেন— “নেতৃত্ব যে চায় তাকে তা দেয়া হবে না।” নেতৃত্ব না চাওয়া সংক্রান্ত প্রচলিত এই হাদিসটির ‘শানুল ওয়ারুদ’ তথা প্রেক্ষাপটকে বাদ দিয়ে এই রেফারেন্সটিকে নেতৃত্ব না চাওয়ার দলীল হিসেবে দাবী করা হচ্ছে। এটি ভুল। এই ভুল কাজটি করতে গিয়ে নেতৃত্ব দাবী করা সংক্রান্ত বহুসংখ্যক সহীহ হাদিস ও সিরাতের রেফারেন্সকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি অনভিপ্রেত। এই বিষয়ে রেফারেন্স সমৃদ্ধ একটা বিস্তারিত লেখা পরবর্তীতে লেখা যেতে পারে। অবশ্য যারা বুঝদার, তারা এতটুকু থেকে বুঝে নিতে পারবেন হোয়াট ইজ হোয়াট।

ভালো থাকো, বিধাতার সেরা সৃষ্টি কিংবা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। জেগে উঠো আত্ম-অমর্যাদার পথ এড়িয়ে। দাবী করো যা কিছু পেয়েছো তুমি অথবা করেছো অর্জন। কাজে লাগাও তোমার সব সম্ভাবনা। তোমার মানবিক মর্যাদা আর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, এমন যেকোনো ভব্যতাকে করো অস্বীকার। কৃত্রিম বিনয়ের নামে কোনোভাবেই বিসর্জন দিয়ো না স্বকীয়তা। অনুসরণ করো আত্মপ্রতিষ্ঠার নীতি। সেল্ফ ব্র্যান্ডিংকে মেনে নাও তোমার নীতি আর সবার অধিকার হিসেবে। তাহলেই তুমি উপকৃত হবে, সফল হবে জীবনে। তোমার জন্য রইলো আমার শুভকামনা। এগিয়ে যাও আগামীর পথে। সূর্যের মতো জ্বলে উঠো। অনুভবের বিস্ফোরণে অবিরত ছড়াও আলো। জীবনের অপার সম্ভাবনার রূপায়নে, অদম্য ইচ্ছার অমিত উত্তাপে, সত্য হোক তোমার সব সুপ্ত সৃজনশীল স্বপ্ন!

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *