কয়েক মাস আগে চবি সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে রাজনীতি বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক কর্তৃক আয়োজিত একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। তখনো শুরু হয় নাই। আমার পিছনে ছিল কিছু ছেলে মেয়ে। এক্সট্রোভার্ট হওয়ার কারণে অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকর্মী হওয়ার কারণে আমি আশেপাশে থাকা যে কারো সাথে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলি।
সেভাবে আমি তাদের সাথেও কথা বললাম। তারা পলিটিক্যাল সায়েন্সের ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। ক্যারিয়ার প্ল্যান নিয়ে জিজ্ঞাসা করার পরে তারা বললো, পাশ করার পরে তারা এই এই কাজ করবে। এরপর তাদের আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, তোমরা যদি পল সায়েন্সে না পড়ে, কথার কথা, সয়েল সায়েন্সে পড়তে তাহলে তোমরা কী করতে?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তারা আমাকে ঠিক সেই কাজগুলো করার কথাই বললো যা তারা পল সায়েন্স পড়ে করার চেষ্টা করবে। এ পর্যায়ে আমি তাদের কাছ হতে জানতে চাইলাম,
‘তাহলে আমাকে বলো, পল সায়েন্স আর সয়েল সায়েন্স গ্রাজুয়েটের মধ্যে তফাৎ কী?’
তারা নিরুত্তর।
আপনি যদি ফিলসফির স্টুডেন্টদের এই প্রশ্ন করেন তারা আপনাকে একই কথা বলবে। ঠিক সেইম কথা আপনি শুনবেন ফিজিক্স পড়া ছেলে-মেয়েদের কাছ হতে। ঘটনাটা কী হইলো, কাকে যে আপনি দোষ দিবেন, তা আপনি বুঝে উঠতে পারবেন না।
প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর আগের কথা। আমার বড় ভাই তখন সিলেটের ডিসি ফুড। ওনার সাথে দেখা করতে এসেছেন সিলেটের ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন অফিসার। ভদ্রলোক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। আমি উনার কাছে জানতে চাইলাম, ‘ভাই, আপনি জেলা তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। অথচ, আপনি পড়েছেন এগ্রিকালচার। আপনার পড়ালেখার সাথে আপনার কাজের কী সম্পর্ক?’ এক পর্যায়ে আমার বড় ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দেখ, আমরা যে কাজ করি, ইন্টার পাশ করা যে কাউকে ছয় মাসের ট্রেনিং দিলে সে এই কাজ করতে পারবে।’
তো, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির এই যে সীমাহীন ব্যর্থতা, এটা কেন হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বেগম রোকেয়ার কোনো একটা রচনায় উল্লেখ করা একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।
ট্রেনে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত একটা বগিতে একটা চোর উঠলো। মহিলারা ভাবলো চোরকে বাধা দিতে গেলে তো পর্দা লঙ্ঘন হবে। তারচেয়ে মালপত্র যা নেয়ার নেক, চুপ থাকাটাই শ্রেয়। মহিলাদের এই মনোভাব টের পেয়ে চোরটা ডাকাত হয়ে উঠলো। জিনিসপত্রের পাশাপাশি সেই ব্যাটা মেয়েদের গলা, হাত আর কান থেকে স্বর্ণালংকারগুলোও একে একে খুলে নিল। সবার কাছ হতে যা পারলো সব হাতিয়ে নিয়ে সে নির্বিঘ্নে পরবর্তী স্টেশনে নেমে গেল।
জাতীয় জীবনে আমাদেরও অবস্থা হয়েছে সেই ট্রেনের পর্দানশীন নারীদের মতো। একটু পার্থক্য হলো, ট্রেনের সেই কামরায় থাকা নারীরা নিষ্ক্রিয় ছিল তাদের পর্দা-চেতনার কারণে। আর আমরা নিষ্ক্রিয় আছি হক কথা বললে আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে, এই আশঙ্কায়।
কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও উপমাটি যুঁতসই। সমাজ ও সামাজিক স্বার্থকে আমরা বানিয়ে ফেলছি পাবলিক টয়লেটের মতো। সবাই নাক চেপে কাজটা সেরে কর্তৃপক্ষকে গালমন্দ করতে করতে বের হয়ে পড়ি। এরপর ভুলে যাই।
লটারি জেতার প্রেরণা যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, মাদকের নেশায় মানুষ যেমন করে তার প্রকৃত কল্যাণকে উপেক্ষা করে সাময়িক সুখের পিছনে ছোটে, তেমনি করে এজ আ গার্ডিয়ান আমরা এবং আমাদের পোষ্য ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো ছুটছে ক্যারিয়ারের পিছনে। উচ্চশিক্ষাটা এখানে নিছকই অজুহাত।
উচ্চশিক্ষার এই তোড়জোড় মাঝপথ হতে অথবা শেষ পর্যন্ত একটা বিশাল ফাঁকি, এটি জানা সত্বেও আমরা কোনো কথা শুনতে নারাজ। আমার এসব কথা অনেকের কাছে একধরনের নীতিবাক্য চর্চা। নীতিবাক্য শুনে সসম্মানে কেটে পড়াটা মানুষের স্বভাব। আমিও এভাবে দিন দিন অনেকের কাছে বিরক্তকর একজন মানুষে পরিণত হচ্ছি, বুঝতে পারছি।
আমার কিছু করার নাই।
আগেই বলেছি, আমি পপুলারিটি চাই, কিন্তু পপুলিস্ট নই। তাই, কে কতটুকু বিরক্ত হচ্ছে তার পরোয়া না করে I shall continue to voice the unspoken truths। সোশ্যাল মিডিয়ার ইকো-চ্যাম্বার বা চিপাগলি হতে বের হয়ে অপ্রিয় এই সত্য কথাগুলো আমি মানুষের সামনে চিৎকার করে বলবো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বলবো। দেশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তের ছোট বড় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লাউড স্পিকার লাগিয়ে বলবো।
মানুষ রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে জানে, সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে জানে, ধর্মীয় আন্দোলন সংগ্রাম সম্পর্কে জানে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে জানে, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না। কারণ, তারা সেটা দেখে নাই।
আমি ইনশাআল্লাহ এই কাজ শুরু করবো।
আগামীর এই সমাজ পরিবর্তন আন্দোলনে একজন অগ্রপথিক হিসেবে আপনাকে সাথে পেতে চাই। আপনার জন্য রইলো অগ্রিম বিপ্লবী অভিনন্দন।
মন্তব্য
রুবেল আহমেদ: আমি ইউরোপের যে দেশে থাকি সেখানে মাধ্যমিকে উঠার পরে একজন ক্যরিয়ার এডভাইজারের সাথে আধাঘণ্টার একটা সেশন করানো হয়। সেই রুমে শুধু একজন স্টুডেন্ট আর একজন হাসিমুখ ভদ্রমহিলা (প্রায় সব ক্ষেত্রেই) থাকেন। প্রয়োজন মনে হলে একের অধিক সেশন করানো হয়। এখানে স্টুডেন্টটি ভবিষ্যতে কী হতে চায়, তার হবিগুলা কী, কোন সাব্জেক্ট সহজ/কঠিন লাগে ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করে মাধ্যমিক শেষে সে জেনারেল না টেকনিক্যাল লাইনে যাবে এবং কোন বিষয় নিয়ে পড়বে তা ঠিক করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিকেও একই কাজ করা হয়, স্টুডেন্টকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা হয়।
আমাদের দেশের স্টুডেন্টরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে, আর কিছু না। বেশিরভাগই কী করবে তা নিজেও জানে না। আমার বোন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ওঠে বিয়ে হয়ে গেলে আর লেখাপড়া কন্টিনিউ করেনি। আমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠে বিদেশ চলে যাই। আমার পরিবারেই চার বছর তথা একজন ছাত্রের গ্রাজুয়েট হওয়ার সময়কাল এবং অর্থ নষ্ট করা হয়েছে যা থেকে কোনো ফায়দা আসেনি।