যারা সাহিত্য পড়ে তারা, ব্যতিক্রম বাদে, নিছক পড়ার জন্যই পড়ে। তারা সাহিত্য সম্পর্কে অনেক তথ্য মুখস্থ করে। সাহিত্য যতটা না বুঝে তারচেয়ে বেশি রপ্ত করে সাহিত্যের ইতিহাস। যারা দর্শন পড়ে তাদের প্রায় সবাই দর্শনের তত্ত্বগুলোকে তথ্য হিসেবে মুখস্থ করে। যারা ইতিহাস পড়ে তারা ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য আপনাকে দিতে পারবে।
সমস্যা হলো, সাহিত্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানা আর সাহিত্যকে আত্মস্থ করা, দু’টো এক কথা নয়। সাহিত্য পড়ে সাহিত্যিক হতে না পারলেও সাহিত্যমনা হয়ে উঠাটা সাহিত্য পড়ার দাবী। বাস্তবে যা হয় না। সাহিত্য সম্পর্কে তারা তথ্য মুখস্থ করে, মোস্টলি অ্যান্ড বেসিকেলি।
দর্শন সম্পর্কে অনেককিছু জানা এককথা, আর দর্শনের প্রচলিত ডিসকোর্সের সাথে নিজের চিন্তাভাবনাকে রিলেট করতে পারাটা ভিন্ন কথা। কথার কথা, কেউ আধুনিক দর্শনের জনক ফরাসী পণ্ডিত রেনে ডেকার্ট সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারলো। এই বলতে পারার মানে সে ডেকার্ট কেন এমনটা বলেছেন, ডেকার্টের এই বক্তব্য নিয়ে আমি কী করবো বা আমরা কী করতে পারি, এইগুলোও সে জানে, এমন তো নয়; অথবা এমনটা হয় না। দর্শনের ইতিহাস কেউ জানে, এরমানে এই নয় যে সে দর্শন সম্পর্কে জানে।
দর্শনের সংশ্লিষ্ট সমস্যাটার সাথে নিজেকে পক্ষে বা বিপক্ষে রিলেট করে জানাকে আমি knowing Philosophy হিসেবে বলেছি। এর বিপরীতে, দার্শনিকদের পাল্টাপাল্টি প্রপজিশন ও রিফিউটেশন সম্পর্কে কেউ জানে অথচ সংশ্লিষ্ট তর্কযুদ্ধটা কেন, এটাই যদি সে সার্বিকভাবে না জানে, আলোচনার থিম বা লাইন অব কনসিস্টেন্সিটা ধরতে না পারে তাহলে আমরা বলতে পারি, দর্শন সম্পর্কে সেই শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান হলো তথ্যমূলক জ্ঞান বা knowing about Philosophy।
আধুনিক শিক্ষার মডেল (bloom’s taxonomy) অনুসারে শিক্ষার নিচের দিকে জ্ঞানচর্চা হবে অধিকতর মুখস্থনির্ভর (knowing about) এবং উচ্চস্তরে তা ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠবে বিশ্লেষণমূলক (knowing that)।
এই যে লেখাটা, এটাকে সব মানুষেরা কি সমানভাবে দেখবে? গুহামানবের কাছে এগুলো কিছু আঁকিবুঁকি। অন্য ভাষার লোকদের কাছে এটা একটা ‘অন্যভাষার লেখা’। এমনকি বাংলাভাষী সবাই এটাকে সমানভাবে পড়বে না। একটা পেন-ড্রাইভকে কেউ কাঠি মনে করবে, কেউ যন্ত্র মনে করবে, আবার কেউ একটা পেন-ড্রাইভ হিসেবেই চিনতে পারবে। কোনো সায়েন্স ল্যাবের যন্ত্রপাতি দেখে এক একজন সেগুলো সম্পর্কে এক একধরনের ধারণা করবে।
জ্ঞানতত্ত্বে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা কথা আছে। কোনো কিছুকে শুধুই দেখা হলো objectual seeing, সেটাকে শ্রেণিভূক্ত করে আইডেন্টিফাই করতে পারা হলো seeing as, আর সেই জিনিসটা সম্পর্কে কার্যকর জ্ঞান লাভ করতে পারা হলো seeing that।
জ্ঞানতত্ত্ব অনুসারে, জানা হতে পারে ৩ ধরনের: পরিচিতিমূলক জ্ঞান, দক্ষতামূলক জ্ঞান আর বিশ্লেষণমূলক জ্ঞান। আমি আপনার নাম জানতে পারি। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, এটা জানতে পারি। এই ধরনের জ্ঞান পরিচিতিমূলক জ্ঞান। আমি গাড়ি চালাতে জানি, সাঁতার কাটতে জানি। এ’গুলো হলো দক্ষতামূলক জ্ঞান। এই দুই ধরনের জ্ঞানের কোনোটাই উচ্চশিক্ষা বা দর্শনের জ্ঞান নয়।
জ্ঞানতত্ত্বের জটিল (?) আলোচনার দিকে না গিয়ে আমি শুধু এ’টুকু বলতে চাচ্ছি, কী ধরনের জ্ঞান আমাদের শিক্ষার্থীরা অর্জন করছে সেই বিষয়টা বিবেচেনা করলে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের দেশে প্রচলিত উচ্চশিক্ষা সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ। কেউ মরে গেলে তাকে যেমন শত বেদনা নিয়েও সসম্মানে দাফন করে ফেলতে হয়, তেমনি করে আজ সময় এসেছে এই ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার, বিশেষ করে শিক্ষা-সংস্কৃতির, আমূল পরিবর্তন ঘটানোর।
শিক্ষা সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামক জাতীয় তামাশাটা বন্ধ করা জরুরী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গাদাগাদা স্টুডেন্ট ভর্তি করার কোনো দরকার নাই। অপ্রয়োজনীয় শিক্ষার যে বিরাট বোঝা আমরা তরুণ প্রজন্মের ওপরে চাপিয়েছি সেটা হতে তাদের মুক্তি দিতে হবে। তদস্থলে Knowing about তথা দক্ষতা অর্জনমূলক জ্ঞানের, সোজা কথায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
কীভাবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এই ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন করা সম্ভব তা আমার ঠিক বুঝে আসছে না। তবে এতটুকু বুঝি, identification of the problem is half of the solution। উচ্চশিক্ষার নামে যে উচ্চ পর্যায়ের ফাঁকি চলছে, তা জনপরিসরে প্রতিষ্ঠিত করা হলো আশু করণীয়। কাজের কাজ। কিছু করতে পারি আর না পারি, আসুন, স্বীকার করে নেই, আমাদের উচ্চশিক্ষা মোটের উপরে ব্যর্থ। জ্ঞান অর্জনকে এখানে নিছক অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে সকল সাবজেক্টের পড়াশোনা মূলত ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনমূলক সে সকল সাবজেক্টে ফাঁকিবাজির সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদভূক্ত সাবজেক্টগুলো তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণমূলক হওয়ার কারণে সেগুলোতে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ বেশি। ল্যাবে স্টুডেন্টদের জায়গা দেয়ার ব্যাপার থাকার কারণে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিপার্টমেন্টগুলো লটে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে পারে না। আর্টস, সোশ্যাল সায়েন্স ও কমার্সে এ ধরনের ‘সীমাবদ্ধতা’ না থাকার কারণে সেখানে এক একটা ক্লাস যেন একেকটা গড়ের মাঠ। শ’ দেড়েক স্টুডেন্ট এর ক্লাসে কীভাবে কোয়ালিটি এডুকেশন সম্ভব, তা আমার মাথায় ঢুকে না।
অপ্রিয় সত্য হলো, অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার ব্যাপারে অনুচ্চারিত মূলনীতি হলো, ‘দ্যা মোর স্টুডেন্টস দ্যা মোর মানি!’ এজন্য আজ পর্যন্ত কোনো প্রফেসর টিএ (teaching assistant) দেয়ার দাবী তুলেনি। টিএ’র কাজগুলোকে তারা প্রায়োরিটি দিয়ে করে। কারণ সহজেই অনুমেয়!
কথা হচ্ছিলো, knowing about এর সাথে knowing that or knowledge of এর পার্থক্য নিয়ে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে নোয়িং এবাউট-এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এখানে কেউ যদি সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করতে চায়, প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সে ধরা খেয়ে যাবে। অথচ, নোয়িং এবাউটের জন্য রোবটই যথেষ্ট। মানুষের জ্ঞান হলো knowledge of ….।
আম গাছ হতে যেমন করে কাঁঠাল হয় না, তেমন করে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা মানুষ হিসেবে ভর্তি হয়ে মোর কোয়ালিফায়েড মানুষ হিসেবে বের হতে পারে না। তারা এক একজন রোবট বা জম্বি হিসেবে বের হয়। এমনকি ছাত্রজীবনের শুরুতেই তারা নিজেদেরকে রোবটে ট্রান্সফরমেশন করা শুরু করে দেয়। জ্ঞান দূর ছাই, ক্যারিয়ারই তাদের কাছে সবকিছু, এমন একটা মানসিকতাকে তারা হোল হার্টেডলি সাবস্ক্রাইব করে।
লাস্টলি, এতবড় একটা লেখা পড়েছেন, তাই সোশ্যাল মিডিয়ার একজন ধৈর্যশীল পাঠক হিসেবে আপনাকে জানাই একরাশ শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন, বেঁচে থাকুন, মিথ্যার বেসাতির মাঝে একজন সত্যের কাণ্ডারি হিসেবে।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Mohammed Shah Alam: শুধু উচ্চশিক্ষা কেন! নিচু শিক্ষা আরো ব্যর্থ। নিচু “শিক্ষা”টায় থাকে “শিক্ষা”, তারপরের ধাপে শিক্ষার সাথে “দক্ষতা” যুক্ত হয়। সে সাথে স্বাধীন “চিন্তা” সক্ষমতার স্ফুরণ। অর্থাৎ চিন্তার অভিযাত্রা। উচ্চ ধাপে চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশ এবং “জ্ঞান উৎপাদন”।
আমাদের চলছে “বিদ্যার সঞ্চারণ” (transferring knowledge)। সে সাথে যেখানে সম্ভব শিক্ষকদের নিজস্ব মত গিলিয়ে দেওয়া। জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো বিশেষ মতে দিক্ষীত করা (indoctrination)।
বস্তুত “শিক্ষা” বলতে কোথাও কিছু নাই। শিক্ষার ফল ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক রূপান্তর (Polished transformation of personality)। ব্যক্তিকে পরিশীলিত করে, যার প্রকাশ ঘটে আচরণে, ভাষায়, ভঙ্গিতে, চলনে, বলনে, কথনে, চিন্তায়, মননে, মূল্যবোধে। সেটা কি আছে!
Md. Tanbir Rahman: স্যার, শুধু উচ্চশিক্ষাই নয় বরং আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার স্তরটাও দিনদিন অধ্বঃপতনের দিকেই গেছে এবং অনেকটা মৃতপ্রায়। আমাদের সময়, মানে ২০০৬-২০১৪ এই সময়েও, দেখেছি প্রাইমারির শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শেখানোর অনেক চেষ্টা করতো। এখন আমার এলাকার কথা বলতে পারি সেই সময়ের রেশ নাই। এখন স্যাররা করে চাকরি। সকালে আসে দুপুরের পর বাসায় যায়। পড়াশোনার মান অনেকটা নিচে। এমনকি এমনও শোনা যায় বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে স্যার-ম্যাডামরা দুপুরে রান্নাবান্না করে পিকনিকের আয়োজন বসায়। কতটুকু শিক্ষা দিতে পারলো তা মুখ্য নয়।
পুরো সিস্টেমেই তো সমস্যা। আর এদেশে পাবলিক বলেন আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উভয় জায়গাতেই উচ্চশিক্ষা এখন তামাশাই।
Sharmin Rima: খুব সুন্দর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবতা তুলে ধরলেন। সাহিত্যের নানা তথ্য মুখস্থ করতে গিয়ে আমি নিজেও এসব ভাবি। আমার তো সাহিত্য পড়তে ভালো লাগে। তথ্য মুখস্থ করতে ভালো লাগে না। সাহিত্যকে আত্মীকরণ করতে ভালো লাগে, পরীক্ষায় পারার জন্য যন্ত্রের মত মুখস্থ করতে নয়। সব সাবজেক্টের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এই অনুভূতি।
Abdullah Al Mahmud: ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝি, ইউনিভার্সিটিতে ছাত্ররা যায়, কারণ একটা বেঁচে থাকার মত চাকরি পেতে হলে অনার্সের সার্টিফিকেট দরকার। সামাজিকভাবেও ইন্টারমিডিয়েট পাশকে শিক্ষিত বলে গণ্য করা হয় না। যদি এমন হতো, বিশেষজ্ঞ ধরনের কাজগুলো বাদে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারমিডিয়েটের সার্টিফিকেট উপযুক্ত বলে গণ্য করা হতো তাহলে ছাত্ররা কেবল জ্ঞানচর্চার জন্য ইউনিভার্সিটিতে যেত। অবশ্য তার আগে ইন্টারমিডিয়েটকে আরো ব্যবহারিক দক্ষতা তৈরির দিকে জোর দিতে হবে।