ক. প্রচলিত ভর্তি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা
(১) কেন্দ্র সংক্রান্ত সমস্যা: একটু পরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের অধীনে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের জন্য বের হবো। কোথায় ডিউটি পরেছে দেখার জন্য চিঠিটা পড়তে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম! নিয়োগ পত্রে পরীক্ষা কেন্দ্রসমূহের উল্লেখ রয়েছে। তাতে দেখলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা চট্টগ্রাম শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্বস্থ সকল কলেজেও অনুষ্ঠিত হবে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পরিদর্শনে বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি ভবনে যেই মানে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, কলেজ পর্যায়ে সেই মানে পরীক্ষা অনুষ্ঠান কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। সে সব কলেজে প্রতি রুমে একজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিদর্শক দেয়ার চেষ্টা করা হয়। অথচ, মূল ক্যাম্পাসের একটি মাঝারি আকারের কক্ষে কমপক্ষে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন।
(২) যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে শিক্ষকদের গাফলতি: কলেজ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার মানের ব্যাপারে প্রশ্ন না থাকলে সরকারী উদ্যোগে ও কলেজ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে ভিত্তি করেই বিশ্ববিদ্যালয়েভর্তির অনুমতি না দিয়ে একটি সাপ্লিমেন্টারি ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার যৌক্তিকতা কী? এমনকি সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মহোদয়গণসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই পরীক্ষার রুমে পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সাধারণত যথাযথভাবে সচেতন থাকেন না। সত্যি কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষাসমূহে খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই পরীক্ষা চলাকালীন সময়ের অন্তত অর্ধেক সময় সংশ্লিষ্ট রুমে উপস্থিত থাকেন। বিগত বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পরীক্ষার কক্ষে শিক্ষকরা নিজেরাই নানাবিধ বিষয়ে ফ্রি-স্টাইলে কথা বলতে থাকেন।
(৩) পরিদর্শন কাজে ত্রুটির কারণে সৃষ্ট অসম প্রতিযোগিতা: প্রতিজন ভর্তিচ্ছু সংশ্লিষ্ট ইউনিটের অপরাপর সব ভর্তিচ্ছুরই প্রতিদ্বন্দ্বী। অতএব, যেই রুমে এমনকি মাত্র কিছু সময়ের জন্যও স্টুডেন্টরা কথা বলা কিম্বা দেখা-দেখির সুযোগ পাবে, তারা মেধা তালিকায় অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার ফলে অনায়াসে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাবে। বলাবাহুল্য, অনুপযুক্ত পরীক্ষার্থী ফলাফলে যতটুকু এগিয়ে যাবে, উপযুক্ত প্রার্থী ততটাই পিছিয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতির কারণেই যদি এমনটা ঘটে, (যা নিশ্চিতভাবেই হচ্ছে), তাহলে এই অন্যায় ও অসম প্রতিযোগিতা দায়ভার কে নেবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। এরচেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে অনেক রুমে কেবলমাত্র একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সাথে তিন/চার জন সম্পূর্ণ নন-একাডেমিক স্টাফকে পরিদর্শনের জন্য নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
(৪) ভর্তি ফরম ক্রয়ের অন্তত দশগুণ সাকুল্য ব্যয়: সব মিলিয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে একটা উৎসবের আমেজ! কেউ মারা গেলে চতুর্থ দিনে গরু যবাই করে মেজবান আয়োজনের মতো এই ভর্তি-উৎসব-আয়োজনকে আমার কাছে অমানবিক মনে হয়। জনপ্রতি গড়-পরতা দুই হাজার টাকার মতো করে প্রতিটি পরীক্ষায় পরিদর্শনের জন্য সম্মানী দেয়া হয়। সহকর্মীরা হিসাব করে, এবার কতটি ‘খাম’ পাওয়া যাবে! এসব দেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসাবে আমি নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত! মনে হয়, নিরীহ ছাত্র ও তাদের অসহায় অভিভাবকদের কাছ হতে এ টাকা আমার এক অর্থে হাতিয়ে নিচ্ছি! চারশ টাকায় ফরম কেনা হতে শুরু করে কয়েকবার সাইবার ক্যাফেতে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকসহ যাওয়া-আসা ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতি ভর্তিচ্ছুর বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।
(৫) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বেশি সংখ্যক ফরম বিক্রয়ের অঘোষিত টার্গেট: দেখা যায়, খারাপ ফলাফলের অধিকারী ছাত্ররা তো বটেই এমনকি টিকলেও পড়বে না এমন শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান প্রবণতা হচ্ছে যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে একোমোডেইট করা। এটি নিতান্তই ‘বৈষয়িক বিবেচনা’ প্রসূত! শুধুমাত্র বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন সম্বলিত পরীক্ষা হচ্ছে বেশ কয়েকটি ইউনিটে। বিজ্ঞানও কলা অনুষদের অধীনস্থ কয়েকটি ইনস্টিটিউট ও বিভাগের জন্য একই বিষয়ের উপরে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নের ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে স্বতন্ত্র ইউনিটের পরীক্ষা।
খ. বিকল্প প্রস্তাবনা
(১) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বর্তমান ন্যূনতম মান হচ্ছে ২.২৫, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভর্তি পরীক্ষা-পদ্ধতির ত্রুটি ব্যতিরেকে এ ধরনের নিম্নমানের স্টুডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। তাই, এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ কমপক্ষে ৩.৫০ হতে ৩.৭৫ করে পাওয়ার শর্ত আরোপ করে ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে এনে মানসম্পন্ন প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। যার ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শনের দায়িত্ব পালন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে দিয়েই সম্পন্ন করে মান বজায় রাখা সম্ভবপর হতে পারে।
(২) একই ধরনের প্রশ্ন সম্বলিত পরীক্ষাসমূহের জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষার পরিবর্তে সমন্বিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। এ ধরনের সমন্বিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণগণকে মেধা তালিকা অনুযায়ী ফ্যাকাল্টি ও সাবজেক্ট নির্বাচনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
(৩) ভর্তি পরীক্ষার ফি ন্যূনতম হওয়া উচিত। এটি অনস্বীকার্য, ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সর্বমোট খরচের একটি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে ফরম কেনার ব্যয়। তাই, ফরম প্রতি ফি একশত হতে দুইশত টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
(৪) বিভাগভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির অধীনে ভর্তি হলেও আমাদের ছাত্রজীবনের আন্দোলনের ফলে ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিট সিস্টেমে ভর্তি পরীক্ষা চালু করা হয়, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম উদাহরণ। একইভাবে নৈতিকতা ও মান বজায় রাখার স্বার্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অভিন্ন ও একযোগে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব করছি। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা আলাদাভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক উচ্চতর শিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা। সারাদেশে একযোগে যদি এই পরীক্ষা হতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কেন সেটি হতে পারবে না?
(৫) উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তির পরীক্ষাসমূহ সম্পন্ন হয়ে যাওয়া উচিত। এবং ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে অপেক্ষমান তালিকায় ভর্তি সমাপ্ত হওয়া উচিত।
আইন ও নৈতিকতার বিপরীত অনুপাত: আমরা জানি, যাহা কিছুই আইনানুগ তাহা সবই নৈতিক নয়। মনে রাখতে হবে, আইনের সর্বোচ্চ ছাড়কে গ্রহণ করা হলো প্রকারান্তরে নৈতিকতার সর্বনিম্ন মানে অবস্থান করা। নৈতিক দায়বোধ ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা ব্যতিরেকে এসব ‘আদর্শ’ প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব নয় বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসিকে এ বিষয়ে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।