বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে তিনটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
(১) যৌন সম্পর্ক:
বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে তারা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে পরস্পরের জৈবিক প্রবৃত্তি নিবারণ করে। কোরআনে বলা হয়েছে, “তারা তোমাদের পরিচ্ছদ, যেভাবে তোমরা তাদের পরিচ্ছদ”। (সুরা বাকারা ১৮৭)
এহেন সম্পর্কের পরিণতিতে তারা সন্তানের পিতামাতা হয়ে থাকেন। সংসার করা বলতে আমরা যা বুঝে থাকি।
(২) বন্ধুত্বের সম্পর্ক:
বিয়ের মাধ্যমে দু’জন নারী-পুরুষ একটা বিশেষ ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, যে ধরনের বন্ধুত্ব অন্য কারো সাথে কোনোভাবে সম্ভবপর হওয়ার নয়।
(৩) অভিভাবকত্বের সম্পর্ক:
বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ কোনো নারীর ব্যাপারে বিশেষ ধরনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব লাভ করে।
‘বিশেষ ধরনের অভিভাবকত্ব’ কথাটা এজন্য বললাম, আমাদের সমাজে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তা হল, মনে করা হয় বিয়ের পরে স্বামী হলো স্ত্রীর একমাত্র অভিভাবক।
অথচ, পারিবারিক বিষয়ের বাইরে স্ত্রী একজন স্বাধীন ব্যক্তি। শুধুমাত্র পারিবারিক বিষয়ে স্বামী হচ্ছেন স্ত্রীর অভিভাবক। স্বামীর অভিভাবকত্বের কারণে স্ত্রী হিসেবে উক্ত নারীর অপরাপর অভিভাবকদের অভিভাবকত্ব খতম হয়ে যায় না।
বরং উক্ত স্ত্রীর পিতা-মাতা বা অন্যান্য অভিভাবকগণ যেকোনো ধরনের দাম্পত্য সঙ্কটে কিংবা পারিবারিক প্রয়োজনে যথোচিত অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালন করেন, বা করার কথা। এটাই স্বাভাবিক।
দাম্পত্য সম্পর্কের উপরোক্ত তিনটি বিষয় বা বৈশিষ্ট্যসমূহ কোনোটিই কোনোটির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একেক দিক থেকে এক একটা বিষয় বা বৈশিষ্ট্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। সমবাহু ত্রিভুজের প্রত্যেকটি শীর্ষবিন্দুর মত সামগ্রিকভাবে এই তিনটা বিষয় বা বৈশিষ্ট্যই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের সমাজে ১ম ও ২য় ধরনের সম্পর্কের বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব অস্বীকার করার কারণে ৩য় বিষয় বা বৈশিষ্টটাই দাম্পত্য সম্পর্কের মূখ্য বিষয় বা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে অভিভাবকত্ব আর নিছক অভিভাবকত্বে থাকে না। বরং তা পরিণত হয় একচ্ছত্র স্বৈরাচারী কর্তৃত্বে।
নারীরা পুরুষ নেতৃত্বের অধীনে থাকার বিষয়টি প্রকৃতিসম্মত হলেও আমাদের সামাজিক সংকটের কারণে কার্যত তা হয়ে দাঁড়িয়েছে চরমভাবে নারীস্বার্থ ক্ষুণ্নকারী অপব্যবস্থা।
এ ধরনের পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থাপনায় নারী-পুরুষের দীর্ঘস্থায়ী সম্মতিমূলক যৌন সম্পর্ক হয়ে যায় একতরফা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকার। সম-মানবিক মর্যাদাভিত্তিক সহযোগিতার সম্পর্ক, এককথায় যা হলো বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক (friendly relation) হয়ে পড়ে কার্যত অচল। স্বামী তখন একতরফাভাবে স্ত্রীর ওপর পূর্ণস্বত্ব লাভ করে আক্ষরিক অর্থেই স্বামী হয়ে ওঠে।
‘দেনমোহর প্রসংগে বিয়ে বনাম লিভ-টুগেদার’ শিরোনামে একটা লেখায় আমি দেখিয়েছি, বিয়ের মাধ্যমে দু’জন মানুষ, একজন পুরুষ ও একজন নারী একটা ক্ষুদ্রতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। অপরাপার যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই ‘পরিবার’ নামক এই প্রতিষ্ঠানেও থাকে নেতৃত্বের একটা ক্রমসোপান।
পুরুষ হচ্ছে এখানে নেতৃত্বের প্রতীক।
মনে রাখবেন, এখানে আমি ‘প্রতীক’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। তারমানে, কখনো কখনো বিশেষ কোনো নারীও হতে পারে কোনো পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান; অথবা ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাহী প্রধান। যেমন, পুত্রের সংসারে মা থাকলে তিনি হবেন হেড অব দ্যা ফ্যামিলি। যদিও সেই ফ্যামিলিতে পুত্রটি হবেন নির্বাহী প্রধান। মা হবেন প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান। স্বামীহীনা কোনো নারীর সন্তানাদি থাকলে সেই পরিবারে উক্ত নারীই প্রধান; তার সন্তান কিংবা ডিপেন্ডেন্ট ভাই প্রাপ্তবয়স্ক হলেও।
মূল কথা হলো, একটা পিরামিডের নিচের ভিত্তির মতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার কনসেন্টেড এন্ড কমিটেড সেক্সুয়াল রিলেশন হচ্ছে পরিবার ব্যবস্থার ভিত্তি। এর মধ্যবর্তী অংশটুকু গঠিত হয় মিউচুয়াল এন্ড ফ্রেন্ডলি রিলেশনশিপ দিয়ে।
পরিবার ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের কাজকর্ম কীভাবে করতে হবে, সে ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “তোমরা সব কাজ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করো।”
আমাদের সমাজের পুরুষরা যখন জামাই হয়ে ওঠে তখন তাদের ভাবখানা এমন হয়, যেন এই আয়াত তখন তাদের ওপর প্রযোজ্য থাকে না।
সুরা বাকারার ২২৮ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
وَ لَہُنَّ مِثۡلُ الَّذِیۡ عَلَیۡہِنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ۪ وَ لِلرِّجَالِ عَلَیۡہِنَّ دَرَجَۃٌ
“আর নারীদের উপর তাদের স্বামীদের যেরূপ স্বত্ব আছে, স্ত্রীদেরও তাদের পুরুষদের (স্বামীর) উপর তদনুরূপ ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে; এবং তাদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।”
এই আয়াতের শেষাংশ পুরুষদের প্রিয়। অথচ, স্ত্রীদের ওপর স্বামীদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ বা মর্যাদাকে যদি লিটারেল সেন্সে নেয়া হয় তাহলে তা অব্যবহিত পূর্ববর্তী অংশের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এখানে দারাজাত বলতে আসলে সাধারণভাবে পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় পুরুষদের প্রধান কার্যনির্বাহী হিসেবে নেতৃত্বশীল হওয়াকেই বুঝায়।
যেমন, গাড়ির ড্রাইভারও নেতা। সেনাপতিও নেতা। আমাদের সমাজে পুরুষদের বৃহত্তর অংশ নারীদের ওপর পুরুষদের নেতৃত্বকে একচ্ছত্র সেনাপতিত্ব অর্থেই বুঝে থাকেন। আফসোস!
Actually, culture and mindset matter, specially in matters of gender biasness. জেন্ডার ইস্যুতে প্রাচ্যে এক ধরনের বায়াসনেস। পাশ্চাত্যে আরেক ধরনের বায়াসনেস। দিনশেষে দু’টাই বাড়াবাড়ি। দু’টাই খারাপ। দু’টাই একদেশদর্শী, প্রান্তিক, কৃত্রিম ও আরোপিত পজিশন।
সুরা তাওবার ৭১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু।”
কেন তারা মানুষ হিসেবে সমানে সমান, তার কিছু বুনিয়াদী কারণ উক্ত আয়াতে এই অংশটুকুর পরপরই উল্লেখিত হয়েছে। মানুষ হিসেবে মূলত সমান হওয়া সত্বেও এই দুই জেন্ডার সংগত কারণেই পরিবার ও সমাজে ভিন্ন ভিন্ন জেন্ডার রোল প্লে করে।
কোন ভিন্নতা কোন অর্থে, তা ঠিকমতো বুঝে নিতে যত সমস্যা।
সে যাই হোক, আমি এতক্ষণ ধরে যেসব কথা বললাম, তা মোটেও অজানা বা অভিনব কিছু নয়। কোরআন, হাদীস ও সীরাতে এসব কথা আছে সবিস্তারে। কাজীর গরু সবগুলোই আছে ঠিকঠাক মতো। তবে তা শুধু হিসেবের খাতায়। গোয়ালটা যদিওবা শূন্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমি এই লেখাটাতে কিছু কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেছি এবং ইসলাম ধর্মের প্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেছি। এতদসত্ত্বেও জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে যে কোনো ধরনের পারিবারিক ব্যবস্থাপনার জন্যে এই কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য।