আজ বিকেলে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। সাথে ছিল মাসউদুল আলম সাহেব। দেখলাম প্রাণ ও প্রকৃতি। লোকেশান চবি’র সর্ব উত্তরে। সুজানগর গ্রামের পশ্চিমে। ‌‘ফঅদি’ (শীতকালীন সবজি চাষ করাকে চট্টগ্রামের ভাষায় ফঅদি করা বলে) করার জন্য গরুটানা হালচাষ করতে দেখলাম মরিচ ক্ষেতের প্রস্তুতি হিসেবে। ছোটবেলায় হাফটায় উঠার জন্য কতো কোশেশ করতাম…! কাছেই দেখলাম, একজন না-রা কাটছেন। আমরাও শীতের শুরুতে জমিন হতে নারা কেটে ঘরের উঠানে এনে ‌‘তুছ’ দিতাম। যত বেশি কাটতে পারতাম, ফ্যামিলিতে সেদিন হতো তত বেশি কদর।

চবি’র পশ্চিমে পাহাড়। সীতাকুণ্ড-মীরেরসরাই পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্বে জোবরা আর ফতেহপুর। দক্ষিণে মাহমুদাবাদ। উত্তরে সুজা নগর। পার্শ্ববর্তী এই জাতীয় (শিক্ষা) প্রতিষ্ঠানের সাথে স্থানীয় লোকদের সম্পর্ক খুব কম। তাদের জীবন নৈমিত্তিক। সাদামাটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে তারা নিস্পৃহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরাও স্থানীয়দের দেখে বেশ কিছুটা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে।

প্রফেসর ইউনুস স্যারের প্রতি আমার সমর্থন ও ভালবাসা এজন্য নয় যে তিনি চিটাগনিয়ান। তিনি চবি’র শিক্ষক ছিলেন, এটাও আমার কাছে ততটা বড় কিছু নয়। বরং, তিনি পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেতেন। তাদের সাথে চায়ের দোকানে বসতেন। কথা বলতেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন উনার মতো করে। সেটাই আমার কাছে বড় কথা। গর্ব করার মতো ব্যাপার।

অনেকেই মনে করেন, গ্রামীণ ব্যাংকই উনার একমাত্র বা মূল উদ্যোগ। এটি ভুল। বরং তিনি জোবরা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তেভাগা খামার। বয়স্ক লোকদের সাথে কথা বলে দেখেছি, তারা উনাকে তেভাগা’র উদ্যোক্তা হিসেবে বেশি স্মরণ করে। স্যার কী করেছেন, সেটার ব্যর্থতা ও সফলতা, এমনকি সেগুলোর যৌক্তিকতা, এসব আমাকে ততটা টানে না। বরং, এই যে বললাম, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার বাইরে গিয়েছেন, কেতাবি বিদ্যাচর্চা আর সেমিনার-কনফারেন্স চর্চা হতো বের হতে পেরেছেন, প্রজেক্টজীবী হিসেবে ‌‌‘বুদ্ধিবৃত্তিক বেশ্যাগীরি’ করে জীবন কাটিয়ে দেন নাই, এসব আমাকে মুগ্ধ করে।

স্যারের মতো আমি কিছু করতে পারবো না। সেটা জানি। তবুও তিনি আমার অন্যতম অনুসরণীয় ব্যক্তি। আমার কাছে তিনি এক প্রবল ব্যক্তিত্ব। ব্যতিক্রমী। আমিও হতে চাই ব্যতিক্রমী। সেজন্য বহু আগে ছেড়েছি সুশীল জ্ঞানচর্চার আয়েশী ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন। বেছে নিয়েছি গণমানুষের কাজে লাগে এমন ধরনের বুদ্ধিজীবীতার পথ।

তাই মাঝে মাঝে আইল দিয়ে হাঁটতে বের হই। ভাল লাগে প্রকৃতির সন্তান হিসেবে কর্মরত মানুষদের দেখতে। শঠ শিক্ষিতদের চেয়ে সৎ অশিক্ষিতদের পছন্দ করি বেশি।

আজকের এই সুন্দর বিকেলের মতো কতো হিমেল বিকেল আসবে এই পৃথিবীতে। এসেছিল এর আগে। এরপরে, এই মাঠ, এই ফসল ক্ষেত, উর্বরা জমিন, এগুলোতে উঠবে বড় বড় দালান-কোঠা। মানুষজন কর্মব্যস্ত থাকবে নিজ নিজ জীবন-বৃত্তে। সেসব বিকেলে আমি থাকবো না। থাকবো এই মাটির নিচে ঘুমিয়ে।

এ জীবন যেন স্বপ্নের মতো। কীভাবে কেটে গেল এতটি বছর …! মনে হয়, এই তো সেদিন। ভর্তি হলাম চবি কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে। সেই থেকে আজ আটত্রিশ বছর। একটানা আছি এইখানে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর থেকে ক্রমাগত দক্ষিণ ক্যাম্পাসে। একদিন হয়ে যাব প্রাক্তন। শিক্ষক হিসেবে এবং এ জীবন ও পৃথিবী হতে।

এত বছর এই পাহাড়ি সবুজ দেখেও এতটুকু ক্লান্ত হই নাই। এখনো ভালোলাগে প্রিয় এই সবুজ ক্যাম্পাসকে। এইখান থেকেই হয়তোবা বের হবে আমার নিথর দেহ। এগিয়ে যাবে বাবুনগর গ্রামের উদ্দেশ্যে। কখন, কে জানে …!

কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে, (আমার দাদা ছিলেন একজন কৃষক) একজন জীবনবাদী সমাজকর্মী হিসেবে ভালবাসি মানুষকে। ভালবাসি মাটিকে। তাই তাদেরই কিছু ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছি বন্ধুত্বময় এই সময়ে সুহৃদ পরিজনদের সাথে।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *