সামহোয়ার ইন ব্লগে ফারজানা মাহবুবার লেখা পড়তাম। এরপর সোনার বাংলাদেশ ব্লগে। ‘ব্রেকিং দ্যা ট্যাবু’ এরকম শিরোনামে উনার লেখায় আমি সোৎসাহে মন্তব্য করেছিলাম। উনার সাথে ফেইসবুক ফেন্ডশিপ ছিল। কিন্তু, উনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শীঘ্রই আমি ব্যর্থ হলাম। কারণটা সুস্পষ্ট। আমি হলাম স্ব-স্বীকৃত মডারেট। লক্ষ করলাম, শি ইজ হাইপার রিএকটিভ। কখন যে আমরা পরস্পর আনফ্রেন্ডেড হলাম, তা এখন ঠিক মনে নাই।
ফেইসবুকে আমার একটা গ্রুপ আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে কোনো না কোনোভাবে পরিচিতদের নিয়ে এই গ্রুপ। আমি যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়ে কাজ করি, তাই স্বভাবতই সেখানে কিছু নন-মুসলিম সদস্যও আছে। সেখানকার একজন সদস্য কিছুদিন আগে ফারজানা মাহবুবার লেখা নিয়ে Tuhin Khan-এর একটা পর্যালোচনামূলক লেখা শেয়ার করেন। উক্ত গ্রুপের প্রত্যেকটা পোস্টে আমি কোনো না কোনোভাবে এনগেইজ হওয়ার চেষ্টা করি। সেই সূত্রে উক্ত পোস্টেও আমি একটি মন্তব্য করি। মন্তব্যটি হুবহু উদ্ধৃত করছি:
“কেউ যখন কোনো কথা বলে তখন তার কথাকে শুধুমাত্র সেই বিষয়ে যদি সমর্থন করা যায়, সেটা করা যেতেই পারে। কিন্তু প্রায়শ দেখা যায়, কোনো কোনো ব্যক্তি একটি ভুল অনুমান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য কোনো সঠিক তথ্য বা একুরেট পয়েন্টকে ব্যবহার করছেন। সেই ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির এই সামগ্রিক যুক্তি প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। যেভাবে সচেতন হতে হবে এই পোস্টে যা বলা হয়েছে সেটার ব্যাপারে।
আজওয়াজ বলতে সঙ্গী বোঝানো হচ্ছে, এটা যেমন ঠিক, তেমনি করে, কুরআনের বর্ণনাগুলো সামগ্রিকভাবে পুরুষসুলভ বর্ণনা, এইটাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। পুরুষসুলভ বর্ণণাগুলো সম্পর্কে যদি আমরা মনে করি, এগুলো আমাদের ভাষার এক ধরনের সীমাবদ্ধতা অথবা প্যাটার্ন, তাহলে কোনো সমস্যা নেই।
এর পাশাপাশি, পুরুষসুলভ বর্ণনাগুলোকে যদি আমরা পাশ্চাত্য নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি এবং সেইভাবে সেগুলোকে কারেক্ট করার চেষ্টা করি, তাহলে তা হবে সম্পূর্ণভাবে ভুল। আশা করি আমি কী বলতে চেয়েছি সেটা আপনারা বুঝতে পারবেন। থ্যাংক্স ফর দ্যা শেয়ারিং।”
উল্লেখ্য, আমি ফারজানা মাহবুবা’র মূল লেখাটা পড়ি নাই। আমার কাছে উনার লেখাজোখা আসে না। আমার কিছু কাছের মানুষ, বিশেষত Ismail Chowdhury মাঝে মাঝে উনার লেখা আমাকে পাঠিয়ে থাকেন। তাতে করে আমি উপকৃত হই। লেখার ধাঁচ ভালো না লাগার কারণে মাঝে মাঝে খানিকটা বিরক্তও হই।
এই যে বললাম, লেখার ধাঁচ, এটা কী?
খেয়াল করলে দেখবেন, অনেকেই কোনো একটা জেনুইন সমস্যাকে ফোকাস করে সেটার জন্য দায়ী পক্ষকে ক্রমাগত ভিলেনাইজ করতে থাকেন। এই ধরনের ক্রিটিকদের মধ্যে আছে রাজনৈতিক দলের লোকজন, আছে ধর্মীয় সংগঠন বা গ্রুপের লোকজন, আছে বামপন্থী তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীগণ। সম্প্রতি এর সাথে যোগ হয়েছে নারীবাদের পক্ষ-বিপক্ষ সব ফেইসবুক-যোদ্ধা (Social Justice Warrior) লোকজন।
সমালোচনার ব্যাপারে আমার নীতি হলো, সমালোচনা চাই। তবে, তা হতে হবে গঠনমূলক বা ভারসাম্যপূর্ণ। ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ কথাটা আমাদের শুনতে যতটা ভালো লাগে, যত দ্রুত আমরা এরসাথে একমত হই, ততটাই বুঝি না এর তাৎপর্য। আমার দৃষ্টিতে, গঠনমূলক সমালোচনা হলো সেই প্যাকেইজ যাতে থাকে,
(১) identification of the problem,
(২) finding a consistent and sustainable solution এবং
(৩) setting up a practical work-plan and personal engagement in doing the solution।
বাহ্যত মনে হতে পারে, নিবর্তনমূলক পুরুষতন্ত্র কিংবা উগ্র নারীবাদের বিপক্ষে বলাটা নারী অধিকারের ব্যাপারে একটা বিরাট কাজ। না, ব্যাপারটা তা নয়। একতরফাভাবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) স্বনিয়োজিত সমাজ সংস্কারকরা নিজেদের অজান্তেই উগ্র পাশ্চাত্য নারীবাদ তথা যৌনতাবাদের ধারক, বাহক ও প্রচারকে পরিণত হচ্ছেন। একইভাবে একতরফাভাবে উগ্র নারীবাদের বিপক্ষে ক্রমাগত বলাবলির মাধ্যমে কিছু লোকজন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অপ্রেসিভ প্যার্ট্রিয়ার্কির রক্ষক বা ডিফেন্ডারে পরিণত হচ্ছেন। এই উভয়বিধ বাড়াবাড়ি বা সমস্যার গোড়াটা বুঝতে হবে।
আমার দৃষ্টিতে গোড়ার সমস্যা হলো, জীবন ও জগত সম্পর্কে ধ্যানধারণাগত বিরোধ। ইংরেজীতে বললে, প্যারাডাইম কনফ্লিক্ট। ভারত উপমহাদেশীয়, পাশ্চাত্য ও ইসলামিক, এই তিন প্যরাডাইমের মধ্যে আমরা বসবাস করি। এটি বাস্তবতা। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ একইসাথে একাধিক প্যারাডাইমে সমানভাবে বসবাস করতে পারে না। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় বিরাজমান প্যারাডাইমগুলোর কোনো একটি হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মূল প্যরাডাইম।
প্যরাডাইমের সাথে প্যরাডাইমের কিছু ইন্টারসেকশান বা কমন এরিয়া থাকে। যার কারণে ভিন্ন প্যরাডাইমে থেকেও কোনো ব্যক্তি ‘অপর-প্যরাডাইম’ হতে কিছু সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে পাশ্চাত্য জগতে হিজাবের অধিকার দাবী করা হলো এরকম একটা বিষয়। নারী অধিকারের নামে এ দেশে এনজিও-বাদী কার্যক্রমও অনুরূপ বিষয়ের উদাহরণ।
অপর প্যরাডাইমের সাথে সাযুজ্যতার দিকগুলোকে যেমন কাজে লাগাতে হবে, তেমনি করে আমার প্রতিবাদী কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি কার্যত ‘বিপক্ষ-প্যরাডাইম’ এর লোকদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছি কিনা, তা নিয়েও থাকতে হবে সদাসতর্ক।
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে নারীবাদ হলো পাশ্চাত্য প্যরাডাইমের প্রোডাক্ট। পুরুষতন্ত্র হলো প্রাচ্য-প্যরাডাইমের পক্ষ থেকে পাশ্চাত্য নারীবাদের ব্যাপারে বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়া।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র, এই দুটোরই ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো প্যট্রিয়ার্কি। আমি পুরুষতন্ত্রের বিরোধী, কিন্তু পিতৃতন্ত্রের সমর্থক। এটা আজকের আলোচনার বিষয় নয় বিধায় এ বিষয়ে আর কিছু বলছি না।
পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ, এই দুই প্রান্তিকতার উপজাত হিসেবে নারীদের একটা অংশের মধ্যে গড়ে উঠেছে সুবিধাবাদ। আগ্রাসী ও নির্যাতনমূলক পরিস্থিতিতে যে কোনো ভালনারেবল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের সুবিধাবাদ গড়ে উঠে। কথা লম্বা না করে সরাসরি একটা উদাহরণে চলে যাই।
যে নারীটা এই গরমের মধ্যেও আপাদমস্তক বোরকা পরে স্বাচ্ছন্দে চলছে, সবার ক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসলে, (প্রাচ্য দেশে হলে) ডমিন্যান্ট কালচারের সাথে কনফর্রমড হওয়ার জন্য, (পাশ্চাত্য দেশে হলে) তার কমিউনিটি আইডেন্টিটি হিসেবে সে এমনটি করছে। এর বিনিময়ে সে পায় উক্ত সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত বিশেষ কিছু সুযোগসুবিধা।
যে নারীটা শীত প্রধান দেশে বসবাস করেও শরীরের অধিকাংশ অংশ অনাবৃত রেখে স্বাচ্ছন্দে চলছে, সে অনায়াসে এই কাজটা করছে তার সামাজিক পরিমণ্ডলের প্রভাবশালী ধারার সাথে নিজেকে মানিয়ে চলার জন্য। নেসেসারিলি, নারীরা যে ‘ঢাকার’ জন্য বা ‘দেখানোর’ জন্য এমনটি করে, ব্যাপারটি তা নয়। এটি একটি tacit agreement with the dominant social trend।
কেন এভাবে স্তরে স্তরে নিজেকে বস্ত্রাবৃত করে রাখতে হবে, এটি নিয়ে এখানকার নারীদের অধিকাংশই ভাবে না। করতে হবে, তাই করে। কেন এভাবে উপরে নীচে এতকিছু অনাবৃত করে রাখতে হবে, সেটা নিয়ে ওখানকার ‘স্মার্ট’ নারীরা স্বাধীনভাবে কখনো ভাবে বলে মনে হয় না। মোট কথা হলো, উভয় প্রান্তিকের নারীদের কমন বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের নিজস্ব কোনো এজেন্সি নাই। দিনশেষে তারা আত্মমর্যাদালুপ্ত সোশ্যাল কনফর্মিস্ট। সুবিধা ম্যাক্সিমাইজ করে যতটা সম্ভব ভালোভাবে বেঁচে থাকা, এই হল তাদের প্র্যাকটিক্যাল পলিসি।
ইসলাম চায়, মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব তথা সেলফ-এজেন্সি গড়ে উঠুক। সে যা করবে তা বুঝে শুনে করবে।
এমন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীসমাজ গড়ে উঠার কাজে, উপরে যা বললাম, অবিরত তীর্যক মন্তব্যকারী সমালোচকদের অবদান শূন্য; বরং নেগেটিভ এন্ড ডেস্ট্রাকটিভ একচুয়েলি!
নারী-পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যমাত্রকেই ‘বৈষম্য’ হিসেবে গণ্য করে সমকালীন পাশ্চাত্য মন-মানসিকতা। তাই, যারা নারীদের ওপর পুরুষদের অত্যাচারকে মোকাবিলা করতে গিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলেন, এই এমপাওয়ারমেন্ট মুভমেন্টের পরিণতি কী হচ্ছে, ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে, সে সম্পর্কে সমাজকর্মীদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। নচেৎ, উপরের লোকেরা পানি দিচ্ছে না, তাই জাহাজের তলা ফুটা করে পানি সংগ্রহের মতো পুরো আন্দোলনটা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
এসব কথার মূল কথা হলো, নারী অধিকারের পক্ষে যারা কথা বলবেন তাদেরকে একইসাথে পুরুষতন্ত্র, নারীবাদ ও সুবিধাবাদের বিপক্ষে বলতে হবে। প্রত্যেকটি লেখাতেই যে এই তিনটা পয়েন্টে কথা বলতে হবে, এমনটা নয়। তবে, একজন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে কেউ যখন লিখবেন বা কিছু বলবেন, তার কথা ও কাজকর্মের মাধ্যমে একটা ভারসাম্যপূর্ণ তৎপরতার চিত্র ফুটে উঠবে, এমনটা আমরা আশা করতে পারি।
নারী অধিকার আন্দোলনে বিরোধিতার এই তিনটা ক্ষেত্রের পাশাপাশি নিম্নোক্ত তিনটা বিষয়কে ইতিবাচক করণীয় হিসেবে তুলে ধরতে হবে:
১. নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক, পার্থক্য ও সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাকে মেনে চলা,
২. সর্বপর্যায়ে আক্বল বা যুক্তিবুদ্ধির ব্যবহারকে নিশ্চিত করা এবং
৩. সবকিছুর উপরে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে স্থান দেওয়া।
নারী নৈতিকতা নিয়ে আমার একটা পোস্টার আছে, যেখানে আমি ‘এথিকস অব কেয়ার’ নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছি, পুরুষসুলভ ও নারীসুলভ, এতদুভয় প্রকারের বৈশিষ্ট্য নিয়েই আমাদের এই সমাজ মানুষের সমাজ হয়ে ওঠে। একটা গাছের শেকড় ও কাণ্ড; অথবা কাণ্ড ও ফুল-ফলের মতো, এগুলো পরস্পর নির্ভরশীল। Necessarily related and dependent on each other.
যারা সর্বদা সমালোচনামূলক কথা বলে, যাদের পজিটিভ কাজ খুব একটা দৃশ্যমান নয়, অথচ অন্যদের ভুল ধরিয়ে দেয়ার কাজে যারা অতিউৎসাহী, স্যাটায়ার আর সার্কাজমে যারা অভ্যস্ত, দ্বিমত হলেই যে কাউকে যে কোনো লেংথে গড়পড়তা মন্তব্য করতে যারা দ্বিধা করে না, তাদেরকে আমি এড়িয়ে চলি।
নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন বা করতে চান তাদের অন্তত দু’জনকে সম্প্রতি আমি এই কথাটা লিখে পাঠিয়েছি— চাই, হয়ে উঠেন একবিংশ শতাব্দীর একজন বেগম রোকেয়া।
নারীদের মধ্যে যারা সোশ্যাল কনফর্মিস্ট হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরিবর্তে ইন ট্রু সেন্স সোশ্যাল ওয়ার্কার হতে চান, আপনাদেরকে বেগম রোকেয়া হতে শিক্ষা নিতে হবে। তিনি শুধু বাক্য-বীর ছিলেন না। লেখালেখির পাশাপাশি একই সাথে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন কর্মবীর হিসেবে। আপনারা আয়িশা (রা.) হবার স্বপ্ন দেখেন। অথচ, বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতায় আপনাদের জন্য জরুরি হলো নিজেকে একজন খাদীজা (রা.) হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
হোন তারা বামপন্থী, ডানপন্থী বা ইসলামপন্থী, সব ঘরানার বেশিরভাগ নারী নেত্রীকেই দেখি, তারা হয়তো তাদের ব্যক্তিজীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করেন, নিজের নেগেটিভিটিকে পুরো সমাজে ছড়িয়ে দেয়া তথা প্রজেকশান করার চেষ্টা করেন; নয়তো, তাদের ব্যক্তিজীবনের সুখশান্তি ও নানা ধরনের ফ্যাসিলিটির দৃষ্টিকোণ হতে লাইফ এন্ড রিয়ালিটি সম্পর্কে এক ধরনের ফ্যান্টাসীতে ভোগেন এবং নিজের এই ফ্যান্টাসিকে সবার জীবনে ইম্পোজ করার চেষ্টা করেন। জনৈক ফরাসী সম্রাজ্ঞীর মতো, না খেয়ে থাকা প্রজাদের সম্পর্কে ভাবেন, ‘ভাত/রুটি খেতে না পারলে তারা কেক খেয়ে থাকবে। অসুবিধা কী…?’
সামগ্রিকভাবে সমাজ ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর নানা প্রসংগ নিয়ে ভাবিত হওয়া, সিরিয়াসলি ইনভলভ হওয়া, প্রয়োজনে ঝুঁকি মেনে নেয়া, নারী নেত্রীদেরকে দেখি, এগুলো তারা কখনো বিবেচনায় নেন না। নারী অধিকারের বাইরে তারা কোনো কিছু নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে, প্রয়োজনে নেতৃত্ব গ্রহ ণ করতে হবে, এসব তারা ভাবতেই পারেন না।
আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে শুধু নারীদের ব্যাপারে বার্গেইনিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করার জন্য পাঠিয়েছেন…! ফেইসবুকে চলমান ইস্যুতে দু’চারটা মন্তব্য করা মানে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা এমন বোকামিসুলভ চিন্তা না করাই ভালো। সমাজ সচেতনতার বিষয়টি ট্রেন্ড ফলোইং এবং ফ্যাশনের চেয়ে বেশি কিছু, এটি বুঝতে হবে।
সব সময়ে নারী অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলা, তাও নেতিবাচক দৃষ্টিতে, এটা স্বয়ং এক ধরনের প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়ি। এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতা।
দাবীগুলো নিতান্ত ন্যায্য হলেও প্রান্তিক অবস্থান থেকে সেই দাবী আদায়ের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় সমাজের মধ্যে একটা বিপরীত প্রান্তিকতা গড়ে উঠে ও সমান তালে তা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠে। এক সময়ে এর নেতিবাচক বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে, যাদেরকে উদ্ধার করার জন্য এই আন্দোলন, শেষ পর্যন্ত তারাই হয়ে পড়ে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এসব বিষয় ভালো করে না বুঝে “ধরো তক্তা, মারো পেরেক” – এভাবে সমাজ সংস্কারমূলক কাজ করার কোনো মানে হয় না।
সমাজকে সামগ্রিকভাবে বুঝার চেষ্টা করা, আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের এই প্রসেসকে অবিরতভাবে জারী রাখা, সমাজকর্মীদের জন্য এটা হলো এক নম্বরের কাজ। সেজন্য অন্যদের সাথে ইস্যুভিত্তিক অন রেগুলার বেসিস এনগেইজ হতে হবে। এটিকেট মেনটেইন করতে হবে। তজ্জন্য চাই পর্যাপ্ত সহনশীলতা ও আচরণের ভারসাম্যপূর্ণতা। তাই, হাইপার লোকজনকে দিয়ে সোশ্যাল মুভমেন্ট হবে না। হতে পারে তসলিমা নাসরিন জাতীয় কিছু কাজ।
নারীদের নিয়ে নারীদের সাথে কথা বলার বড় বিপদ হলো, প্রায়শই তারা বিরুদ্ধ মতপ্রকাশকারীকে ব্যক্তি-আক্রমণ করে বসে, একটা সামগ্রিক আলোচনাতে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থানকে জড়িয়ে ফেলে। তারপরও আমি আলোচনা করি। এনগেইজ হই। আমি মনে করি, নিজে পুরুষ হওয়া ছাড়া নারী অধিকার আন্দোলন করার জন্য আমি অন্য যে কারো চেয়ে সুবিধাজনক পজিশানে আছি।
আমার গ্রুপে ক’দিন আগে আমি ফারজানা মাহবুবা’র লেখা নিয়ে Ahmad Musaffa’র একটা লেখা শেয়ার দেই। আমার গ্রুপের কোনো নারী সদস্য উক্ত লেখায় কোনোভাবে এনগেইজ হন নাই। এতে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি। অথচ, মুসাফফার উক্ত লেখার শেষের অংশটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে সে বলেছে,
“বর্তমান সময়ে ইসলামী চিন্তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক ধরনের চিন্তার ফারাক লক্ষ্য করি। ছেলেদের মধ্যে পশ্চিমের লিবারেল ভ্যালুজ এবং কলোনিয়াল চিন্তা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা এবং ইসলামের ট্রেডিশনের দিকে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা সেক্যুলার লিবারেল ডগমার স্বয়ং ভিতকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এর নাগপাশ থেকে নিজেদের চিন্তাকে স্বাধীন রাখতে চায়। তাদের জিজ্ঞাসাগুলো জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং অন্টোলজিক্যাল।
আর মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ঠিক উল্টোটা। তারা আরো বেশি পশ্চিমা চিন্তার দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সেই চিন্তার লেন্স থেকে পর্যালোচনা করে ইসলামের ট্রেডিশনকে একেবারে শিকেয় তুলছেন। ইসলামে নানান আজবগুবি চিন্তা আমদানী করার কৌশিশ করছেন। এগুলো দেখলে খুব হতাশ লাগে।”
এই কথাগুলোর সাথে আমি তো মোটাদাগে একমত। সে যাই হোক, আমাদের গ্রুপের একজন নারী সদস্য গতরাতে মুসাফফার উক্ত লেখার বিরুদ্ধে ফারজানার দেয়া কাউন্টার-স্ট্যাটাস গ্রুপে শেয়ার করেছেন। তাকে বলেছি, এ ব্যাপারে আমি কিছু গুছিয়ে বলবো। সেই সুবাদে এই লেখা। প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলাম, এটি উক্ত গ্রুপেই দেবো। এখন ভাবছি, এটি টাইমলাইনেই দেবো। কী কারণে জানি না, আমার লেখার রিচ অনেক কমে গেছে। ইদানীং আমি অনলাইন একটিভিটি থেকে অফলাইন একটিভিটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। তাই, এই লেখাটা ক’জনে পড়বেন, ঠিক জানি না। তার ওপরে, এত বড় লেখা। যে ক’জনেই পড়েন না কেন, আমি ভাবছি, নারী অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে আমার চিন্তাভাবনাগুলো ওয়ান্স এগেইন, আগ্রহীদের কাছে ক্লিয়ার করে দেয়া উচিত।
একইসাথে যদি আপনি নিবর্তনমূলক পুরুষতন্ত্র, উগ্র নারীবাদ ও বিদ্যমান সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলা তথা সোশ্যালি কনফর্মিস্ট সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন, আপনি যদি নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিষয়ে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা, যুক্তিবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের ব্যবহার এবং মানবিক (humane) দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেন, তাহলে আমি আছি আপনার সাথে। আপনি চাইলেও আমি আপনার সাথে আছি, না চাইলেও আমি আপনার সাথে থাকবো একজন সক্রিয় সহায়তাকারী ও সমর্থক হিসেবে। হোন আপনি নারী অথবা পুরুষ। আদারওয়াইজ, আই এ্যম নট উইথ ইউ।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Md Arifuzzaman: “চাই, হয়ে উঠেন একবিংশ শতাব্দীর একজন বেগম রোকেয়া।” কিন্তু কেন? বেগম রোকেয়াকে নিয়ে তো নানা অভিযোগ আছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বেগম রোকেয়াকে একতরফাভাবে নেগেটিভলি চিত্রায়িত করা হয়েছে। আমি বেগম রোকেয়ার সবগুলো লেখা পড়েছি। তাতে আমি বুঝতে পারলাম, এ নিয়ে আমাদের ভালোভাবে কাজ করা উচিত। আমার ইচ্ছা আছে বেগম রোকেয়ার উপরে বই বের করার। বেগম রোকেয়ার লেখাগুলো পড়লে আমরা তিনটা চিত্র পাই। একটাকে বামপন্থীরা ইসলামবিরোধী অবস্থান হিসেবে তুলে ধরে। অবরোধবাসিনী, Sultana’s Dream এগুলো পড়লে এমনটাই মনে হতে পারে। আর একটা অংশ আছে সম্পূর্ণভাবে ইসলামের পক্ষে। বোরকা, নার্স নেলির কাহিনী ইত্যাদি সে ক্যাটাগরিতে পড়ে। এটাকে কেউ প্রজেক্ট করে না। হয়তো জানেও না। আর কিছু কিছু বিষয় হচ্ছে সমাজ সচেতনতামূলক। সেগুলাকে যে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তিনি প্রসঙ্গক্রমে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ির বিপক্ষে বলেছেন। সেসব কথাবার্তাকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে ট্রিট করার যে প্রবণতা এখনকার ইসলামপন্থীদের মধ্যে দেখা যায় সেটাকে অযৌক্তিক বলে মনে করি। সে যাই হোক, উনার লেখার এই ৩টা দিক নিয়ে আমি স্বতন্ত্রভাবে তিনটা বই প্রকাশ করার ইচ্ছা রাখি। তদুপরি আমি মনে করি তিনি তাঁর মতো করে অনেক কিছু করেছেন। যা কিছু করেছেন তা যতটা তাৎপর্যপূর্ণ, কিছু একটা করার উনার যে ডিটারমিনেশন এবং কন্সিস্টেন্ট এফোর্ট, সেটা অনেক বেশি শিক্ষণীয়।
Mohammad Ishrak: I was disappointed at you not raising the issue of paradigm in your discussions; finally, you have done that. Also, thanks for acknowledging the toxicity if the wok culture that has penetrated our (ex) Jamaati feminists and the reasons why they are and will always remain females as defined in the western social sciences rather than becoming Aisha/Khadija. The best refutation of their activism is their very own-selves. The prestige and importance that the figures like Maryam Jamila and, more importantly, Zainab Al Ghazali commanded among Islamists is well known. It would be better if they ask themselves why it is that Islamists proper today loathe them. Something surely is off and that thing is not misogyny.
Sumaya Tasnim: সোশ্যাল সাইটে সময় দেয়া হয়না বলে আপনার লেখা অনেকদিন পর পড়লাম। ইসলামী ঘরানার চিন্তাভাবনা লালন করে এমন ছেলে আর মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক যে দূরত্ব, এই ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কিছু অবজারভেশন আছে যেটা আমি শেয়ার করতে চাই।
আমরা যেহেতু সমাজে বসবাস করছি, পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী আমাদেরকে প্রভাবিত করে সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনে। ধরেন পরিবার, সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। এইখানে নারীর রোল এক সময় যা ছিল নারী তা থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে আবার একইসাথে চাচ্ছেওনা। চিন্তার একটা অসামঞ্জস্যতা খোদ নারীদের মধ্যেই বর্তমান। সংসারের অগ্রজ নারীরা চান তাদের মতই সুনিপুণ হাতে সংসারকে সাজিয়ে আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করে একজন আদর্শ স্ত্রী হয়ে উঠুক নতুন প্রজন্মের নারীরা। অপরদিকে বর্তমান জেনারেশন যারা গোটা পৃথিবীর সঙ্গে কানেক্টেড, তারা সংসারের বাইরের বিশাল জগতটাকে বাদ দিয়ে কেবল সংসার কেন্দ্রিক চিন্তা করতে আগ্রহী না।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তাহলে, মানুষের যে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে এই দুনিয়ায় আগমন, এই প্রতিনিধিত্বের একটা ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ তার যেই বান্দাকে যেই ধরনের বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী বা যোগ্যতা দিয়েছেন সে সেই গুণ ও যোগ্যতার চর্চা জারী রেখে নিজের সেসব দক্ষতাকে ব্যবহার করে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করবে৷ তো, ধরেন যে নারী গবেষণামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে মানবসভ্যতার উন্নয়নে অবদান রাখতে চায় এবং এটাকেই তার দাওয়াতি কাজের পথ হিসাবে গ্রহণ করতে চায়, তার জন্য ট্র্যাডিশনালি একটা পরিবারে নারীদের যে রোল প্লে করতে হয় এবং তাতে যেই সময়-সুযোগ ও দক্ষতার প্রয়োজন হয় তার জন্য দিনের পুরোটা সময় ব্যয় করাটা লাভজনক মনে হবেনা। আবার গেরস্থালী কাজগুলোও এতটা প্র্যাকটিক্যাল যে, এতে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রচুর সময়ের দরকার। ফলে একই ব্যক্তির জন্য দুই দিকে সমভাবে পারদর্শী হওয়াটা অনেক কঠিন। আবার এই নারীটি বাইরের জগতে কী বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সেটা সম্পর্কে কিন্তু আগের জেনারেশনের নারীরা জানতে আগ্রহী না। তারা চায় তাদের সম্মান ও সেবা, যা তারাও পূর্বের প্রজন্মকে দিয়ে এসেছে। এবং সর্বপরি জীবনভর পালন করে আসা দায়িত্ব পরের প্রজন্মের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে এই গুরুদায়িত্ব থেকে অব্যহতি। এইভাবে যখন একই পরিবারের নারীদের মধ্যে চিন্তার দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে সেখানে পুরুষের ভূমিকাটা কেমন হয়? আমার অভিজ্ঞতায় বললে দেখি, পুরুষ কিন্তু তার পরিবারের নারীটিকে “কিছুটা সুযোগ” দিতে আগ্রহী। কিন্তু পরিবারের দায়িত্বগুলো থেকে অব্যহতি দিয়ে নয়। যদি সেগুলো পালন করে বাড়তি কিছু করা সম্ভব হয় তবেই। এবং নারীর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বর্তমানে নারীদের কাছে এটার যেহেতু কোনো সার্বজনীন শেইপ নাই তাই ট্র্যাডিশনাল ছাঁচটায় ম্যাচ করতেছেনা অধিকাংশই। কিন্তু পুরুষদের কোর বিলিফ সিস্টেমে নারীর যে ছাপ, নারী বলতে যা বুঝায়, নারীর যে দায়িত্ব-কর্তব্য প্রতিষ্ঠিত, তার থেকে বের হয়ে আসা বেশিরভাগের জন্যই কঠিন। ধরেন, যেই পুরুষ কোনোদিনও কোনো নারীর গায়ে কাউকে হাত তুলতে দেখেনাই, তার জন্য নারীর গায়ে হাত তোলা যতটা বিশাল ঘটনা, যে পুরুষ ছোটবেলা থেকে নিত্যদিন কোনো না কোনো নারীকে মার খেতে দেখেছে তার জন্য কিন্তু নারীর গায়ে হাত তোলাটা অতটা বিশাল ঘটনা না। কী জন্য? তার ভেতরের কোর বিলিফে এই সম্পর্কে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত সেই ধারণার জন্যে।
এখন আমি যদি বলি, ইসলামিক ট্র্যাডিশনের দিকে ফিরে যেতে চাওয়া ছেলেরাও নারীর প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক এই সকল এক্সপেকটেশনগুলো থেকে মুক্ত না বরং অনেকক্ষেত্রে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে এগুলোকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে তা কি অযৌক্তিক হবে? আবার নারীরাও এইসব যুগযুগ ধরে অর্পিত দায়িত্বের বাইরে এসে চিন্তা করতে গিয়ে যারা আপাতদৃষ্টিতে এসব থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত তাদের জীবনযাত্রা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ছে বলে মনে হয়।
আরো অনেক কিছুই বলার ছিল কিন্তু সময়ের স্বল্পতা, তাছাড়া সংসার-সন্তান কেন্দ্রিক জীবনে চিন্তার জগতটা অতি ক্ষুদ্র হয়ে এসেছে ক্রমশই। দুয়া করবেন।
Md Saifuddin: আপনার নিজস্ব লেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তবে, কিছু জিনিস হয়তো আমি ঠিকমত বুঝতে পারি নাই।
১. শুরুতে লেখার মান নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাটা, এই লেখার ভ্যালুর মধ্যে কোনো কিছু যোগ করেছে বলে মনে হল না। তবে, লেখার মাঝে ‘ভণিতা’ থাকা জরুরী। তবে সেটা শেষে আসলে, আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার অংশ বেশি ফোকাস পেত। তাই প্রথম অংশটা শেষের ঐ কৈফিয়তের মাঝে আসলে, লেখার স্ট্রাকচারটা আরো সুন্দর হতো বলে মনে হলো। নয়তো শুধু শুধু শুরু থেকে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চলে আসে। মনে হল, তাই বললাম। গুরুত্বপূর্ণ না।
বরং, এটা ভাল লাগলো, আপনি তুলে আনতে পারলেন যে, বাস্তবতা-বাদই আসল পথ। বেগম রোকেয়ার উদাহরণটা তাই খুবই মানানসই হয়েছে। আপনার বামপন্থার বিরোধীতায় একইরকম কথাগুলো একইকারণে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হয়। যদিও এটাকে ঠিক মডারেট বলা যায় কি না নিশ্চিত না।
২. “একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে নারীবাদ হলো পাশ্চাত্য প্যরাডাইমের প্রোডাক্ট। পুরুষতন্ত্র হলো প্রাচ্য-প্যরাডাইমের পক্ষ থেকে পাশ্চাত্য নারীবাদের ব্যাপারে বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়া।”
আপনার এই এজাম্পশনটার কারণ কী? আপনি বেগম রোকেয়ার নারীবাদের সাথে এই নারীবাদের প্রগতিগত সামঞ্জস্য কেন দেখছেন না? আবার, প্রাচ্য-পুরুষবাদকে কেন আলাদা দৃষ্টিতে রিএকশনারী ঘটনা হিসাবে দেখছেন, কেন সেটা আদতে অতীতেরই ধারাবাহিকতা হিসাবে দেখা হবে না?
ধরেন, কোনো “নারীবাদী” চিন্তা করলেন, মসজিদে মেয়েদের সমানাধিকার নিয়ে কাজ করবেন। আপনি বলতে পারেন, সেটা করতে হবে, ইমামদেরকে তোয়াজ করে, তাদেরকে সেক্সিষ্ট বলে সেটা করা সম্ভব নয় – বাস্তবতা এটা। কিন্তু, ইমামরা যদি সমানাধিকারের টু-শব্দ করার মাঝেই ফেমিনিজমের ভূত দেখে, কলোনিয়ালিজমের কালো রাত স্বপ্ন দেখে ফেলেন, তাহলে সেটাকে থামানোর জন্য নারীরা তো উদ্ধত হবেই। আপনি ওই “পুরুষত্বের ভূত দেখা” ঘটনাকে রিএকশনারী উদ্ভাবন না ভেবে, কেন ভাববেন না, সেটা চলে আসা পুরুষতন্ত্রের স্বাভাবিক বহিপ্রকাশ মাত্র? এবং সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কেন পশ্চিমা প্যারাডাইমের ঘাড়ে দায় পড়বে?
৩.“বর্তমান সময়ে ইসলামী চিন্তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক ধরনের চিন্তার ফারাক লক্ষ্য করি। ছেলেদের মধ্যে পশ্চিমের লিবারেল ভ্যালুজ এবং কলোনিয়াল চিন্তা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা এবং ইসলামের ট্রেডিশনের দিকে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা সেক্যুলার লিবারেল ডগমার স্বয়ং ভিতকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এর নাগপাশ থেকে নিজেদের চিন্তাকে স্বাধীন রাখতে চায়। তাদের জিজ্ঞাসাগুলো জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং অন্টোলজিক্যাল।
আর মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ঠিক উল্টোটা। তারা আরো বেশি পশ্চিমা চিন্তার দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সেই চিন্তার লেন্স থেকে পর্যালোচনা করে ইসলামের ট্রেডিশনকে একেবারে শিকেয় তুলছেন। ইসলামে নানান আজবগুবি চিন্তা আমদানী করার কৌশিশ করছেন। এগুলো দেখলে খুব হতাশ লাগে।”
এই কথাটার সাথে আপনি কেন একমত হন? এটাতে একটা আরোপিত নারী পুরুষের পার্থক্য দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা কি লক্ষ্যণীয় নয়?
আমার তো মনে হয়, দুইটা স্টেইটমেন্টের কোনোটাই সত্য না। বরং আমি দেখি, ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যে এই পশ্চিমগামিতা আর পূর্বগামিতার লক্ষণ সমানভাবে বিরাজমান। বরং, বড় প্রশ্ন আসবে, পশ্চিমগামিতার অভিযোগ কেন শুধু পুরুষরাই করে থাকেন? নারীরা কেন পুরুষদের পশ্চিমগামিতার ব্যাপারে আওয়াজ তোলেন না?
আরও প্রশ্ন উঠা উচিত, “পশ্চিমা চিন্তার দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সেই চিন্তার লেন্স থেকে পর্যালোচনা করে ইসলামের ট্রেডিশনকে একেবারে শিকেয় তুলছেন।” এই দাবীটা তাঁরা কোত্থেকে দাঁড়ায়ে তুলছেন? তাদের এই অভিযোগের ভিত্তিটা কি আসলেই ট্রেডিশনের উপর দাঁড়ায়ে, নাকি স্রেফ “স্ট্যাটাস কুয়ো”র মধ্যে গলা ডুবায়ে?
তাদের তো আগে পরিষ্কার করতে হবে যে এখানে পশ্চিমা চিন্তার আক্রমণ রয়েছে, তারপর দেখাতে হবে, সেই স্পেসিফিক পশ্চিমা চিন্তার মধ্যে গলদ আছে, তারপর ট্রেডিশন বাঁচাতে বিপরীত চিন্তাটাকে ডিফেন্ড করতে হবে। সেগুলো না করে, স্রেফ, আপনি অমুককে সেক্সিষ্ট মনে করেন, আপনি পশ্চিমা চিন্তায় আক্রান্ত বলে ফেলার বিপদ তো আরো বেশী।
৪. যা লিখলাম, আমি জানি না, আমার জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই হয়তো হালের ইসলামী নারীবাদীদের ব্যাপারে হতাশ। আমি তো, এই “নারীবাদী”দের মধ্যে কোনো ধরনের নারীবাদ দেখতেই ব্যর্থ হই। পশ্চিমা নারীবাদ বহুত পরের বিষয়। কারণ, তারা ট্রেডিশনাল চিন্তার ভেতরেই আটকে আছেন, পূর্ব-পশ্চিমের এই বিরোধ থেকে বের হয়ে, নিরপেক্ষ জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা কখনোই উঠে আসে না।
এখন চিন্তা যে আগাচ্ছে না, এসব পূর্ব-পশ্চিমের বিরোধ মিটাতে গিয়ে, সেখানে নয়া চিন্তার উদ্ভব কি করে সম্ভব হবে? প্যারাডাইম তৈয়ার করার আগে আগের প্যরাডাইমের “তাহাফুত”গুলো দেখিয়ে দেওয়াটাকে আমরা কেন এত “উগ্র-নারীবাদ” নাম দিতে কার্পন্য করতেছি না?