“ঈশ্বর কি মিথ্যা বলতে পারে? যদি না পারে তাহলে কি তিনি সর্বশক্তিমান থাকেন? যদি পারেন, তাহলে মানুষ কি নিশ্চিতভাবে ও অবজেক্টিভলি জানতে পারে যে তিনি মিথ্যা বলেছেন কিনা? আমার মতে, না। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের ওহির কী মূল্য থাকলো? এবং ‌‘ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়া অব্জেক্টিভ মোরালিটি হয় না’ এই ধরনের বক্তব্যের কী মানে থাকে?

euthyphro dilemma-টা জানলে এবং সেটার প্রচলিত আস্তিকীয় ডিফেন্স জানলে সহজেই বুঝবেন, এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসার কারণ।”

এক পাঠকের উপর্যুক্ত প্রশ্নের উত্তরে এই ভিডিওটি আজকে রেকর্ড করেছি।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Pinkey Chakraborty: ঈশ্বর কি ভুল করতে পারে?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: প্রশ্নটাই একটা ভুল প্রশ্ন। বৃত্তের মধ্যে কোণ খোঁজার মতো। কোনো সত্তা যদি ঈশ্বর বলতে যা বোঝায় সেটা হয়ে থাকেন (আছেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, যদি থেকে থাকেন) তাহলে তাঁর ভুল হতে পারে কিনা, সে প্রশ্নটাই তো at the very first place, মিনিংফুলি উত্থাপিত হতে পারে না। যেমন করে ব্যাচেলর মানুষ বিবাহিত হতে পারে কিনা, এমন ‌‘প্রশ্ন’ আদৌ অর্থপূর্ণ বাক্য হয়ে ওঠে না।

Pinkey Chakraborty: কিন্তু ভুল হওয়া ঈশ্বরত্বকে ভুল প্রমাণ করে কীভাবে, আমার কাছে সেটা ক্লিয়ার না৷ আমরা তাঁকে সর্বশক্তিমান বলি বলেই তিনি ভুল করতে পারে না এইটা ভাবা হচ্ছে না তো?

Khan Afif Farhan: আমরা নিজেকে দুর্বল করার ক্ষমতা রাখি, ঈশ্বর নিজেকে দুর্বল করতে পারবেন কি?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ‘ঈশ্বর সর্বশক্তিমান’ কথাটার তাৎপর্য — এই লেখাটা পড়েন। এই সাইটে এ সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু লেখা পাবেন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: তিনি যদি আসলেই সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে আমরা সর্বশক্তিমান বলি বা না বলি, তাতে কিছু আসা-যাওয়ার কথা নয়। তিনি যদি সত্যিই থেকে থাকেন এবং সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন, তার মানে তিনি হবেন fully logical and consistent from His own perspective। অর্থাৎ তাঁর শুদ্ধতা হবে স্বগত বা ইনট্রিনজিক এবং পূর্ণ পরিশুদ্ধ বা অ্যাবসোলিউটলি পারফেক্ট। এই ধরনের একজন পরম ঈশ্বরের ভুল হতে পারে কিনা, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো লজিক্যালি এন্ড কনসেপচুয়েলি একটি ভুল প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ। অনেকটা ‌‘ইচ্ছে করে কেউ ভুল করতে পারে কি না’ এমনটি জিজ্ঞাসা করার মতো।

Khan Afif Farhan: ক্লিয়ার হতে পারি নাই। তিনি যদি নিজেকে দুর্বল না করতে পারেন এটা তো একটা সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। তিনি যদি নিজেকে দুর্বল করতে না পারেন এটি কি সর্বশক্তিমান বৈশিষ্ট্যকে বাধা দেয় না? নিজেকে দুর্বল করাটা তো একটি ক্ষমতা বা শক্তি হিসাবেই আমরা জানি।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ‌‘সর্বশক্তিমান’ কথাটাকে আপনি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন। অথচ যারা ঈশ্বরকে মানে তারা তাঁকে সর্বশক্তিমান মনে করে একটা সুনির্দিষ্ট অর্থে। সেটা সম্পর্কে ভিডিও বক্তব্যে কথা আছে। সেজন্য এখানে আর বিশেষ কিছু বলছি না। তাছাড়া আপনাকে যে লেখার লিংক দিয়েছি, সেটা পড়ে দেখতে পারেন। পড়ার পরও যদি কনভিন্সড না হন তাহলে কিছু করার নাই।

নূরে এলাহী শাফাত: মানবজ্ঞানের ঊর্ধ্বেই আল্লাহ। তিনি শর্তহীনতারও শর্তমুক্ত। খোদা ওইটা হইতে পারে কি, করে কি, কেন করে না ইত্যাদি প্রশ্ন কন্ডিশনাল, অথচ তার অরিজিনাল চিরন্তনতা তিনি ছাড়া সকলের কাছে জ্ঞানাতীত। কারণ আল্লাহর জ্ঞান স্বীয়, মানুষের জ্ঞান সাপেক্ষ। সাপেক্ষ দিয়ে পরমকে বুঝা চিরন্তনভাবেই অসম্ভব।

তৎ ময়: আপনি সত্য ও মিথ্যাকে নৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ সত্য অর্থ ন্যায় এবং মিথ্যা অর্থ অন্যায় ধরে কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু যদি সত্য ও মিথ্যাকে কোনো অ্যাসারটিভ সেন্টেন্সের গুণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, তাহলে কিন্তু প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটি যথার্থ হবে।

তৎ ময়: God arbitrarily decided somethings as good and others as evil primordially. He also banded Himself to the good, instilled the sense of goodness in the creation. Thus, good and evil are objective in function while arbitrary in essence.

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বুঝতে পারছি আপনি ভিডিওটা ভালো করে শুনেন নাই। মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝতে পারতেন, কোনো কিছু arbitrary তখনই হতে পারে যখন সেটা কোনো পূর্বস্বীকৃত নিয়ম দ্বারা systematic হওয়ার কথা থাকে।

এবার বলেন, খোদা কেন তাঁর আওতাবহির্ভূত কোনো কিছু দ্বারা পরিচালিত হবেন? এমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে তো তিনি খোদাই হবেন না at the very first place।

যেই খোদা আমার-আপনার মতো সর্বস্বীকৃত সার্বজনীন নিয়ম দ্বারা পরিচালিত, তিনি খোদা বলতে যা বোঝানো হয়, সেটি তো আর থাকেন না। বরং তিনি মানুষ ক্যাটাগরির কেউ একজন, এমন অনুমানকে স্বীকার করে নিতে হয়।

ইসলাম যে ধরনের খোদার কথা বলে তিনি দেবতা বা দেবীর মতো নন। বরং তিনি পরম বা অ্যাবসোলিউট। এমন একটা পরমসত্তাকে আপনি স্বীকার করবেন কিনা, সেটা ভিন্ন কথা।

কিন্তু তিনি যদি পরমসত্তা হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে আসা কোনো কিছু arbitrary হতে পারে না।

Arbitrary না হয়ে কোনো কিছু সিস্টেমেটিক হওয়ার জন্যে সেই ‌‘সিস্টেম’কে কেন সিস্টেমেটিক হিসেবে মনে করা হবে সেটার জন্য তৎপূর্বকার অথচ গ্রহণযোগ্য এমন কিছু একটা থাকা আবশ্যক‌। এভাবে আমরা জাস্টিফিকেশনের একটা অন্তহীন পরম্পরায় পড়ে যাই, যা আমাদেরকে আরেক ধরনের arbitrary পরিস্থিতির সম্মুখীন করে।

তৎ ময়: Arbitrary বলতে absolute randomness বোঝাইনি। বুঝিয়েছি স্রষ্টা তাঁর স্বাধীন ইচ্ছাবলে কিছু বিষয়কে ন্যায় ও অন্যায় বলে নির্ধারণ করেছেন। স্রষ্টার ইচ্ছার স্বাধীনতাটাই এখানে আরবিট্রারি। আপনি বিষয়টাকে স্রষ্টার agency ও volition-এর দিক থেকে দেখছেন না বলে আমার কথায় সমস্যা পাচ্ছেন।

তৎ ময়: ‍“এবার বলেন, খোদা কেন তাঁর আওতাবহির্ভূত কোনো কিছু দ্বারা পরিচালিত হবেন?” — না, তিনি তার আওতাবহির্ভূত কিছু দ্বারা পরিচালিত হবেন না। কিন্তু তিনি নিজে কীভাবে অপারেট করবেন সেটাকে তিনি একটি নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন রাখতে পারেন, যে নিয়মটি তিনি নিজেই নির্ধারণ করবেন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: স্রষ্টা কীভাবে পরিচালিত হবেন, সেটা সৃষ্টি হিসেবে আপনি কীভাবে ডিটারমিন করতে পারেন? তিনি কীভাবে অপারেট করবেন সেটা তো তাঁর অ্যাবসোলিউট অথরিটির ব্যাপার। তা না হলে তিনি পরমসত্তা হোন কীভাবে? খোদাকে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের মতো করে জানতে পারি। অংশ যেভাবে তার সীমিত পরিসরে সমগ্রকে জানে বা জানার চেষ্টা করে। কিন্তু সামগ্রিক সত্তার যে অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য, সেটা জানা তো পার্টিকুলার সত্তার পক্ষে সম্ভবই নয়। হওয়ার কথাও নয়।

ইসলামে খোদার সিফাত এবং জাত-এর পার্থক্য দিয়ে এ বিষয়টাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। খোদাকে আমরা তাঁর সিফাত-এর মাধ্যমে জানতে পারি। তাঁর জাতি বৈশিষ্ট্য আমাদের জন্য অজ্ঞেয়। এবং সেটাই স্বাভাবিক।

এ প্রসঙ্গে ‘মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা বনাম ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব’ শীর্ষক আমার এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।

Ridhi Sheikh: বিজ্ঞান যেহেতু Evolutionary Ethics-এর মাধ্যমে নৈতিকতার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম, তাহলে নৈতিকতার জন্য ধর্ম আর দর্শনের প্রয়োজন কী? Evolutionary Ethics সম্পর্কে জানতে এই পোস্টটি পড়ুন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বিজ্ঞানবাদিতা বলে একটা জিনিস আছে। আমি এর ইংরেজি করেছি sciencism হিসেবে। সে হিসেবে যারা বিজ্ঞানবাদী তারা হলেন sciencist। প্রচলিতভাবে বিজ্ঞানবাদকে scientism বলা হয়। যারা সায়েন্টিজম করে তাদেরকে তো আর সায়েনটিস্ট বলা যাবে না। কেননা, সব সাইন্টিস্ট সায়েন্টিজম করেন না। ‌এই প্রসঙ্গে ‘বিজ্ঞানমনস্কতা, নাকি বিজ্ঞানবাদিতা?’ শিরোনামে আমার এই লেখাটা পড়তে পারেন।

Ridhi Sheikh: স্বীকার করতে হবে বিজ্ঞানের শুরুটা দৰ্শনের মাধ্যমেই হয়েছিল। বিজ্ঞানের অনেক কিছুই যা প্রাথমিক অবস্থায় দর্শনের অন্তর্গত ছিল কিন্তু বিজ্ঞান যখন ঐ বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার মতো প্রাপ্তবয়স্ক হলো তখন দৰ্শন ঐ বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানের কাঁধে চাপিয়ে দেয় বা সপে দেয়। যেমন: পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা, পরমাণুর মডেল, সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবীর আকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ ছিলো। পরবর্তীতে বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়, এর জন্য যদি ‍“বিজ্ঞানবাদী” ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়, তবে আর যাই হোক বিজ্ঞানের অগ্রগতি হবে না। পূর্ববর্তী দার্শনিক মতবাদগুলোকে যদি বিজ্ঞানের থিওরিতে পরিণত করা যায়, তবে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে দর্শনের কিছু বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে চাওয়াতে ‍“বিজ্ঞানবাদী” কেন হতে হয়?

আর কেউ কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করলে তা সরাসরি খণ্ডন না করে সে অমুক, সে তমুক তাই তার ব্যাখ্যা দুর্বল— এ রকম বলাটা কতটুকু যৌক্তিক?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বিবর্তনবাদী নৈতিকতা এথিকস তথা নীতিবিদ্যারই অংশ এবং অন্যতম ব্যাখ্যা। নীতিবিদ্যা তো বিজ্ঞান নয়, বরং দর্শনের আওতাভুক্ত।

‌‘প্রাপ্তবয়স্ক বিজ্ঞানের’ কাছে দর্শন অপ্রয়োজনীয় বা অপাংক্তেয় হয়ে পড়েনি। বরং আরও বৃহত্তর কিংবা গভীরতর ক্ষেত্রে দর্শনের নিকট বিজ্ঞান অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

স্পেসিফিক একেকটা ইস্যু ধরে আলোচনা করলে সেটা ক্লিয়ার হতো। যদিও এই ধরনের আলোচনায় এনগেইজ হওয়াটা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। এই পোস্টের সাথে এই অর্থে এটি প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়।

এ ধরনের আলোচনায় মানুষজন হয়তো যুক্তিবাদী হয় অথবা বিজ্ঞানবাদী হয়। আমার আশঙ্কা আপনার অবস্থান দ্বিতীয় পর্যায়ের।

আপনি যৌক্তিকতার কথা বলছেন। অথচ, শুদ্ধ যুক্তিনির্ভর যে জ্ঞানকাণ্ড, যাকে আমরা ফিলসফি বলে থাকি, আপনি সেটাকেই বিজ্ঞানের তুলনায় অবমূল্যায়ন করছেন‌। আপনি ফিলসফির কাজ বিজ্ঞান দিয়ে করার চেষ্টা করছেন। সেজন্য আপনার অবস্থানটাকে আমি বিজ্ঞানবাদিতা হিসেবে মনে করছি।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *