[ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তসলিমা নাসরিনের একটা লেখার সমালোচনা করে ক’দিন আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। যাতে ভালোবাসার নামে অবাধ যৌনতা ছড়ানোর অপচেষ্টার জন্য তসলিমা নাসরিনকে দোষারোপ করেছিলাম। ওই লেখাতেই ছিলো, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে তসলিমার সমালোচনাগুলোকে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক মনে করি। যদিও তসলিমাসহ বামপন্থী-প্রগতিশীলতার দাবিদারদের সমাধান প্রস্তাবনার অধিকাংশকেই আমার কাছে যুক্তিহীন মনে হয়। এ যেন এক প্রান্তিকতার মোকাবিলায় আরেক প্রান্তিকতা।
সে যাই হোক, এই লেখাটা উল্লেখিত লেখাটার ফলোআপ। ভাবছিলাম, বিস্তারিত লিখবো। কিন্তু সময়ের অভাবে ভাবলাম একেবারে না লেখার চেয়ে বরং আগ্রহী পাঠকদের সাথে খানিকটা রিলেটেড আইডিয়া শেয়ার করি।]
*****
নারীদের সাজসজ্জা নিয়ে বিশেষ করে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন পুরুষদের মধ্যে প্রবল আপত্তি দেখা যায়। কথা না বাড়িয়ে শুধু এতটুকু বলি, নারীদের সাজগোজের ব্যাপারটা তাদের অন্তর্গত বা মজ্জাগত। এটা শুনতে ধার্মিকদের ভালোই লাগবে। যেটা তাদের ভালো লাগবে না, তা হলো, তাদের এই মনোভাব স্বয়ং খারাপ কিছু নয়। ধর্ম এটাকে নিষেধ করে নাই।
রূপ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করতে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ‘জাহেলি যুগের মতো’ – এ রকম একটা কথাও আছে। নারীরা সর্বাঙ্গে সুন্দর। তাদের সৌন্দর্য এতটা অকৃত্রিম ও বিপুল যে, তা গোপন করা কার্যত অসম্ভব। লক্ষ করলে দেখবে, একটা ছেলেবাবুর তুলনায় একটা মেয়েবাবুকে তার চোখের সৌন্দর্য দিয়ে আলাদা করে চেনা যায়। সৌন্দর্য ঢাকার কথা যেখানে বলা হয়েছে, সেখানে ‘যা আপনাতেই প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা ছাড়া’ – এমন কথাও তো আছে।
একজন সাহাবী আল্লাহর রাসূলকে (সা) বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি চাই আমার জুতা ও কাপড়চোপড় যাতে আকর্ষনীয় হয়। এটি কি রিয়া বা প্রদর্শনী হবে?” জানেন, আল্লাহর রাসূল (সা) কী বলেছিলেন? তিনি উক্ত যুবককে ফিটফাট তথা স্মার্ট হয়ে চলার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। এই অনুমতি যুব-মহিলাদের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। মেয়েদের সাজগোজকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিবাহযোগ্য মেয়েদের সাজসজ্জাকে বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। যেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
কিছু কিছু বেকুব ও অন্ধ ধর্মবাদী পুরুষের ধারণা, মেয়েরা শুধু পুরুষদের দেখানোর জন্য সাজগোজ করে। এটি তাদের ভুল ধারণা। একটা মেয়ে যখন সাজগোজ করে তখন নেসেসারিলি সে পরপুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য তা করে, এমন নয়। আমি এখানে শুধু একটা জানা ঘটনার কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেবো।
আমরা জানি, মা আয়িশা (রা) এক যুদ্ধে লটারিতে জিতে রাসুলুল্লাহর (সা) সফরসঙ্গী হন। সফরে পড়ার জন্য তিনি কারো কাছ হতে একটা গলার হার ধার করে নিয়েছিলেন, যা কোনোক্রমে একটা উটের পিঠের নিচে চাপা পড়ে সাময়িকভাবে হারিয়ে যায়। হারটি খোঁজার জন্য উক্ত স্থানে কাফেলার বিরতি দিতে হয়। স্থানটি পানিশূন্য হওয়ায় নামাজের পূর্বশর্ত তাহারাত অর্জনে অজুর বিকল্প হিসাবে তায়াম্মুমের বিধান সংবলিত আয়াত নাযিল হয়। এ ঘটনা ইসলামপন্থীরা জানেন।
যেটা তারা খেয়াল করেন না তা হলো, কেন আল্লাহ রাসূলের (সা) স্ত্রী যুদ্ধ-সফরে এত সাজগোজের গরজ অনুভব করলেন? যুদ্ধের মাঠে উনার সেনাপতি স্বামী, (নাউজুবিল্লাহ) পরনারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারেন, সে আশংকায়? অথবা, যুদ্ধের ডামাডোলে সেনাপতি স্বামী উনার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়তে পারেন, তাই নিজেকে অধিকতর আকর্ষণীয়া মোহময়ী করে রাখার জন্য? অথবা, আল্লাহ মাফ করুক, আল্লাহ মাফ করুক, যুদ্ধ ও সফরের ফাঁকতালে, আল্লাহ মাফ করুক, অন্য পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য?
আমরা জানি, এর কোনোটাই নয়। বরং, সাজাটা হচ্ছে মেয়েদের নির্দোষ স্বভাব ও আত্মতুষ্টির ব্যাপার। বিবর্তনের ধারায় প্রজাতি রক্ষা হচ্ছে এর কারণ। ইসলাম মানুষের ফিতরাতকে ইতিবাচকভাবে দেখে যতক্ষণ না তা অন্যের অধিকার হরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যারা ভালোবাসা দিবস, কোনো জাতীয় দিবস বা ধর্মীয় কোনো উপলক্ষ্যে মেয়েদের সাজগোজ করে বেড়ানোকে নিন্দা করেন, তাদের অবস্থা হয়েছে তসলিমা নাসরিনের মতো। তসলিমা নাসরিন অবদমনের বিদ্যমান অপব্যবস্থার প্রতিবাদে উচ্ছৃঙ্খলতার এডভোকেসি করেন। আর ইনারা স্বাধীনতার নামে উঠতি উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যৌন অবদমনের পক্ষে অবস্থান নেন। প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণের দিক থেকে উভয়ই সমান।
মানুষকে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। অন্তসারশূন্য শ্রেণিস্বার্থপ্রসূত আধ্যাত্মিকতা ও অবাস্তব নৈতিকতা দিয়ে কোনো প্রকারের আদর্শ চর্চা ও প্রতিষ্ঠা হয় না। নারীদেরকে আল্লাহর ঘর তথা মসজিদে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে বুঝবেন ‘অন্তসারশূন্য শ্রেণিস্বার্থপ্রসূত আধ্যাত্মিকতা’ বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছি। নারীস্বার্থবিরোধী ধার্মিকদের টাকাপয়সা ও পদ-পদবীর প্রতি দুর্দমনীয় লোভ থেকে বুঝবেন ‘অবাস্তব নৈতিকতা’ বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছি।
একশ্রেণীর লোকদের কাজকারবার দেখে মনে হয়, নারীদের পর্দা করা না করা যেন ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদী ব্যাপার। ইসলামের বুনিয়াদী ব্যাপারগুলো আমরা হাদীসে জিবরিলের মাধ্যমে জানতে পারি। নারীবিরোধী ধর্মীয় রক্ষণশীলদের কাছে অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, জাতীয় স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার চেয়েও যেন বড় সমস্যা হলো নারীদের বেপর্দায় চলা। পর্দা যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে তা রাসুলুল্লাহর (সা) মাদানী জিন্দেগীর মাঝামাঝিতে গিয়ে নাযিল না হয়ে শুরুতেই নাযিল হতো।
এর মানে ‘পর্দার ফরজিয়াতকে’ আমি অস্বীকার করছি, এমন ভাববেন না। বরং আমি ফরজগুলোর মধ্যে বড় ফরজ আর ছোট ফরজ, এভাবে ভাগ করছি। এই ভাগাভাগি ক্লাসিক্যাল ফিকাহ অনুমোদন করুক বা না করুক, একজন সমাজকর্মী হিসাবে আমি দেখেছি, গাছের তলারটা আর আগারটা একসাথে পাওয়া যায় না। গোড়ারটা ঠিক করতে হয় আগে। এরপর উন্নতমান-উপযোগী যা কিছু তা আসবে গোড়া বা ফাউন্ডেশান ঠিক হওয়ার পরে। ইসলাম নারীদের পর্দায় রাখার জন্য আসে নাই। বরং ইসলাম এসেছে নারীদের মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতে। এই মানবিক অধিকারের অন্যতম হলো তার শালীনতা রক্ষা করার অধিকার।
শালীনতাবোধ ভিতর থেকে গড়ে উঠতে হয়। তাই পোশাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আইনের মাধ্যমে স্থিরিকৃত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সামাজিক চেতনার বিষয়কে আইন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কখনো সফল হয় না। বড়জোর কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ড্রেসকোড হতে পারে। অবাঞ্ছিত পোশাকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাই হলো একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা।
বাংলাদেশে ‘আইসিস’ মনোভাবের লোক প্রচুর। এরা ডাণ্ডা মেরে সবাইকে নামাজ পড়ানোর পক্ষপাতী। জোর করে সবাইকে বোরকা পরিধান করাতে পারলে যেন দেশে ইসলাম কায়েম হয়ে গেলো! ক্ষমতা পেলে ইসলামপন্থী আর তসলিমাপন্থী উভয় গ্রুপই নির্ঘাৎ সর্বাত্মকবাদী স্বৈরাচারী হয়ে উঠতো। মানুষকে বুঝানো কঠিন। তারচেয়ে সহজ পথ হলো টপ-ডাউন এপ্রোচে কোনোভাবে ক্ষমতা পেয়ে ‘সব ঠিক করে ফেলা’। ভাগ্যিস, ইসলামপন্থীরা বিএনপির লেজুড় হয়ে আছে, আর বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের। কোনো এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপ কখনো এ দেশের ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এ দেশ মধ্যপন্থী মডারেটদের। এ জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আমাদেরকে একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক করেছেন।
ইসলামপন্থীদের কট্টর অংশগুলো তো দুই ঈদের বাইরে আর কোনো জাতীয় দিবসকে স্বীকার করে না। তাই, শফিক রেহমানের ভালোবাসা দিবসকে না হয় বাদ দিলাম অথবা জোর করে বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু বাদবাকি দিবসগুলোর কী অবস্থা হবে? ইসলামপন্থী কট্টর মনোভাবাপন্ন ভাই ও বোনেরা, মানতে না চাইলেও শুনে রাখেন, এক একটা জাতির থাকে নিজস্ব রাজনৈতিক জাতিসত্তা। এর পাশাপাশি প্রত্যেকেরই থাকে স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা। এরই সাথে থাকে যার যার ধর্মীয় জাতিসত্তা। এগুলোর কোনোটা কোনোটার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। কোনোটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা নয়। একইসাথে আমরা বাংলাদেশি, বাঙ্গালি ও মুসলমান। ইসলাম কি এসব পরিচয়কে নাকচ করে? যদি না করে, তাহলে বলেন, এসব জাতীয় দিবস উদযাপন কী করে নাজায়েয হয়? এসব জাতীয় দিবসে আমাদের তরুণরা কী করবে? আপনাদের সে ধরনের উপযোগী কর্মসূচি ও তৎপরতা কোথায়?
মনে রাখবেন, তারুণ্য-শক্তিকে সুস্থ ধারায় প্রবাহিত করার মাধ্যমেই কোনো জাতির উন্নয়ন ঘটে। ‘ছোটবেলায় আমরা ভালো ছিলাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা খুব খারাপ’ – এ ধরনের ভণ্ডামীসুলভ মনোভাব ও কথার সাথে আমি নাই। হ্যাঁ, কেউ কেউ খারাপ বটে। অথবা, হতে পারে, এখনকার সমাজে নানা ধরনের খারাবি অধিকতর মাত্রায় ঢুকে পড়েছে।
সমাজ একটা স্রোতের মতো। এর মধ্যে কিছু খারাবি থাকবেই। সবকিছু একসাথে ভালো হলে তো ভালোই হতো। বাস্তবতা হচ্ছে, সবকিছু একসাথে অলগুড হয় না। যদিও এ লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হয়। তাতে করে সমাজটা মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। বলাবাহুল্য, যে সমাজ মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় টিকে থাকে সেটার উন্নয়ন অবধারিত।
যারা তত্ত্ববাদী, যারা সমাজকর্মী নন, কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠিত ধারায় যারা কনফাইন্ড হয়ে আছেন, তারা আমার এই লেখার আগামাথা কিছু বুঝবেন না। মানতে পারবেন না তারা আমার এইসব ‘বৈপ্লবিক’ কথাবার্তাকে। থাকেন আপনারা আপনাদের সব ইউটোপিয়ান সমালোচনা নিয়ে। আমরা যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করছি, তারা জানি, নারীদের জন্য সমাজটা এখনো কতটা বৈরী। আমরা এও জানি, ইসলামপন্থীদের হাতে নানাভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবমাননার শিকার হয়ে নারীরা গণহারে বামপন্থী-বস্তুবাদীদের সাংস্কৃতিক বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে।
মনে রাখবেন, ভেন্টিলেশন প্রিভেন্টস এক্সপ্লোশন। সবকিছু একসাথে পেতে গেলে সবকিছু হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। যে কোনো পরিবর্তন ও উন্নয়ন ধাপে ধাপে হতে হয়। নিছক সমালোচনা দিয়ে সমাজ গঠন হয় না। অবশ্য যাদের তেমন কিছু করার ক্যাপাসিটি নাই, সমালোচনা আর গীবত তাদেরকে এক ধরনের ফাঁপা আত্মতুষ্টি প্রদান করে। আমি নিজেকে নিছক সমালোচক-বুদ্ধিজীবী হিসাবে দেখতে চাই না। তাই এটি লিখলাম। নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। নারীদের মধ্যে কাজ করতে চাই। উপযুক্ত সাহায্যকারী নারীরা এগিয়ে আসলে ভালো। না আসলেও তো বসে থাকার সুযোগ নাই। নারীদেরকে সমাজ ভাঙ্গার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসলামপন্থী সমাজকর্মীদের উচিত নারীদের মধ্যে কাজ সৃষ্টি করে সামাজিক অবক্ষয় ও ভাঙ্গন প্রতিরোধে তাদের ইনার পটেনশিয়ালিটিজকে কাজে লাগানো।