[এটি মূলত ‘ইসলামী আন্দোলনের সংস্কার: সঠিক পথ খুঁজতে গিয়ে পথ হারাতে যাচ্ছি না তো?’ শিরোনামের একটি পোস্টে আমার করা মন্তব্য। বড় হয়ে যাওয়ায় আলাদা পোস্ট হিসেবে দিলাম।]
অনেক বড় লেখা। পড়লাম। সংক্ষেপে মন্তব্য দিয়ে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য মন্তব্য না লিখতে চাচ্ছিলাম। তবু ক’লাইন লিখি–
ক। প্রায় সবার লেখাতেই প্রান্তিকতা দেখা যাচ্ছে। হয় জামায়াত, না হয় নতুন একটা কিছু। আমি জামায়াতকে ডিফেন্ড করবো না, যদিও আমি জামায়াতের নিয়মিত রিপোর্ট রাখা বহু বছরের কর্মী। আবার জামায়াত-ডিসেকশন মজলিশেও আমি উৎসাহ পাই না।
এটি স্পষ্ট, ইসলামী আন্দোলন হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর বহুবিধ সংস্কার অপরিহার্য। তবে আমার এতমিনান হচ্ছে, জামায়াত এসব বাঞ্ছিত সংস্কারের কোনোটাই করবে না। কীভাবে আমি এ রকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম, সেটি আপাতত থাক।
খ। জামায়াত যদি এ অবস্থায়ই কন্টিনিউ করে তাহলে আমি-আপনি কী করবো? ‘তায়া ওয়ানু আলাল বিররি ওয়াত তাক্বওয়া’র আলোকে পথ চলবো। পরিস্কার! আমরা কি প্রত্যেকেই আল্লাহর এক একজন খলিফা নই? তাই হালনাগাদের কোনো সংগঠনবিশেষ আমাদের জীবনের শেষ কথা হতে পারে না।
গ। আসুন, আমরা ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে নতুন করে ভাবতে থাকি, মতবিনিময় করি, জানার জন্য ও তদনুযায়ী চলার জন্য। ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে কোনো দলের ব্যানারে কারো হাশর হবে না। দুনিয়া-আখেরাত সব জায়গাতে ইসলামই সর্বাবস্থায় একমাত্র এজেন্ডা। আমি জগত ও জীবনের তথা ইসলামের টোটাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ভিত্তিতে কাজ করতে চাই। তাই হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ ছাড়া বেপথু হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত!
ঘ। হ্যাঁ, অনেকের মতো আমিও একমত– বাংলাদেশ বাংলাদেশই। একেক জায়গায় একেক পরিস্থিতি। আমরা অন্যদের কার্যক্রম অবজার্ভ করতে পারি, শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি; কিন্তু কাউকে হুবহু নকল করতে পারি না।
ঙ। তাহলে মডেল? ইসলামী মুভমেন্টের মডেল হবে কোনটি? উত্তর অতি সহজ। ইসলামী আন্দোলনের মডেল হলো ইসলামই, যা ক্লিয়ারলি আছে কোরআন ও হাদীসে।
আমাদের অনেকের একটি ভুল ধারণা হলো– ইসলামী আন্দোলনের মডেল কেবলমাত্র একটি বা এক ধরনের! ইসলাম এক, একক, অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের মডেল বহু, বহুবিধ, পরিবর্তনীয়, যথেষ্ট নমনীয় (ফ্লেক্সিবল অর্থে) ও ওপেন-এন্ডেড উইদিন দ্যা ফ্রেম অব ইসলাম।
চ। ইসলামী আন্দোলন করে, অন্তত করে বলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, এমন সবাই ইসলামকে মূলত স্পিরিচুয়্যালিটির জন্য মেনে থাকেন। ইসলামকে আধুনিক ইত্যাদি প্রমাণের বিষয়গুলো সাপোর্টিং মাত্র। যদিও স্পিরিচুয়্যালিটি ইসলামের মূল, কিন্তু এটিকে তুলে ধরতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা হিসাবে, যাতে স্পিরিচুয়্যালিটি সত্যিকার অর্থেই অন্তর্লীন থাকে/আছে।
ছ। তাহলে তো সেক্যুলারিজম চলে আসে! না, জনকল্যাণমূলক হওয়ার জন্য সেক্যুলার হওয়ার দরকার নাই, যেমন প্রয়োজন নেই গণতন্ত্রী হওয়ার। হতে হবে সাহাবীদের মতো সত্যিকারের মুসলিম। ধর্ম হিসাবে নয়, ইসলামকে গ্রহণ করতে হবে মাটি ও মানুষের অতি নিকটের জীবনাদর্শ হিসাবে, যাতে আছে সব আদর্শের সব ভালো দিকগুলো। অথচ নাই সেসবের সীমাবদ্ধতাগুলো। তাই ইসলামকে মিলিট্যান্ট, র্যাডিক্যাল, গণতন্ত্রী, একমাত্র/শ্রেষ্ঠ ধর্ম– এসব বলতে আমি নারাজ।
জ। আমাদের ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো শেখায় কোরআন ও হাদীসের রেফারেন্স। খুব কমই শেখায় এর মূলকথা ও তত্ত্ব। ধর্মীয় অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ, আনকম্প্রিহেনসিভ অথচ অথেনটিক রেফারেন্স জানা এসব শ্রদ্ধেয়গণের খণ্ডিত ইসলামজ্ঞান তাঁদেরকে চরম অসহিষ্ণু করে তোলে। অন্য ইসলাম চর্চাকারীকে বাতিল হিসাবে চিহ্নিত করার কাজে এদের প্রবল আগ্রহ। এক কথায়, রিঅ্যাক্টিভ, নট প্রোঅ্যাক্টিভ।
ঝ। টোটাল নলেজ পেতে হলে অথেনটিক রেফারেন্সগুলোকে সমন্বয় করতে হবে কম্প্রিহেনসিভলি। বাতিঘরের মতো সর্বদা সেগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। প্রদত্ত সীমানার মাঝে পথ বের করতে হবে। আমাদেরকে জ্ঞানী হতে হবে। মানুষকে ইলমের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ইলম হতে হবে অনেক বেশি। ইলমই সর্বোচ্চ আমল। আমল যাতে ইলমের বিপরীত না হয়– শুধুমাত্র এটুকু নিশ্চিত করলে চলবে। আমলের পারফেকশনের চেষ্টা ভুল পন্থা, ফ্যালাসি। নলেজ-এক্সারসাইজ ইজ দ্যা অনলি এক্সকিউজ এন্ড ফোর্স অফ ইসলাম।
ঞ। কারো যদি এটি পড়ে ভালো লাগে, ধন্যবাদ। কারো যদি খারাপ লাগে, দুঃখিত।
এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Salam: আমার মনের কথাগুলো বলেছেন একেবারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপনি চিন্তায় অনেক এগিয়ে।
পুরো সিস্টেমটাই ক্লোজড এন্ডেড, স্থির, নিশ্চল, অপরিবর্তনীয়– এই প্রান্তিক ধারণাই সকল প্রকার রং আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মূল পয়েন্ট। পুরোপুরি একমত।
আমার হিসাব খুব সোজা। একটা আইডিয়াল কন্ডিশনকে যদি ১০০ পয়েন্ট প্রদান করি, তাহলে বর্তমান কন্ডিশনকে কত মার্ক দেব? ১৫ থেকে ২০? আমার তো মনে হয় এরপর প্রতি ৩ বা ৫ পয়েন্ট অর্জন করতে হলে নতুন নতুন স্ট্র্যাটেজি/যোগ্যতা দক্ষতাকে এডপ্ট করতে হবে। ডায়নামিক লিডারশিপ না থাকলে ১৫-২০-এর গলির ভিতরেই ঘুরপাক খেতে হবে।
আপনার ‘ঝ’ নং পয়েন্টের সাথে কিছু যোগ করতে চাই। হয়তবা আমার ধারণা ভুল। মাজহাবী ইমামদের সময় ফিকাহ, ইজতিহাদের মূলনীতিকে যুগোপযুগী করা, মাসয়ালা প্রণয়নই ছিল তাজদীদ, তারপরে হাদীস কালেকশন এবং সংরক্ষণই ছিল তাজদীদ। সেই যুগ পেরিয়ে বিশুদ্ধ হাদীস ভাণ্ডারকে পৃথক করার সংস্কার কাজও প্রায় শেষ। হালাল হারাম, সুন্নাত-বিদয়াত ইত্যাদির মূলনীতি বিষয়ক গবেষণাও কম হয়নি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে এডপ্ট করা শুরু হয়েছে মাত্র। যেতে হবে অনেকদূর। তারপরও রয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক আনএডপ্টেড ইস্যু। যেমন– সাসটেইনেবল টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট, এনভায়রনমেন্টাল ইস্যু, সোস্যাল ওয়েলফেয়ার, ইন্টার-কালচারাল বিহেভিয়ার, ইন্টার-স্টেট/ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ইস্যু, ডিফেন্স/সিকিউরিটি ইস্যু, স্ট্র্যাটেজিক ইস্যু ইত্যাদি ইত্যাদি আরো বহুবিধ বিষয়, যার ধারণাই হয়ত এখনো শুরু হয়নি। যার শেষকথা বলে কিছু নেই। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, আপনার শেষ লাইনের কনসেপ্টটা ইসলামিস্টদের মধ্যে সার্বজনীন হবে কবে?– “নলেজ-এক্সারসাইজ ইজ দ্যা অনলি এক্সকিউজ এন্ড ফোর্স অফ ইসলাম।” সেইদিনই বোধহয় আমরা ২০ এর গণ্ডি থেকে বের হতে পারবো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ ভাই, আপনার সবিস্তারে করা মন্তব্য অনবদ্য হয়েছে। ধন্যবাদ।
সামাদ: ভালোই লেগেছে। তবে ইসলামে সব মতবাদই রয়েছে। অতএব, গণতন্ত্রও আছে। রাসূল (সা) জায়গা নির্দিষ্ট করে যুদ্ধের ময়দানে তাঁবু খাটাতে বললেন। সাহাবীরা বললেন– হুজুর, এখানে না হয়ে ওখানে হলে ভালো হয়। হুজুর মেনে নিলেন। হুদাইবিয়ার সন্ধিতে সাহাবীগণ খুশি হননি। তাই রাসূল (সা) পরপর তিনবার এহরাম ভেঙ্গে কুরবানী করতে বলার পরেও কেউ এগুলেন না। রাসূল (সা) মনক্ষুণ্ন হয়ে হযরত আয়েশাকে (রা) ঘটনা জানালে তিনি বললেন, আপনি নিজে আগে এহরাম ভেঙ্গে কুরবানী করেন। তখন হয়ত সকলে শুনবে। হলোও তাই। এটাই তো গণতন্ত্র। ভুল বললে বুঝবেন আমি আপনার বক্তব্য বুঝতে পারিনি। ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বিভিন্ন মানবসৃষ্ট মতবাদের সদর্থক দিকগুলো ইসলামে থাকার মানে সেসব ইসলামী হওয়া নয়। ইসলাম একেবারে স্বতন্ত্র, অনন্য।
গণতন্ত্রের মূলকথা হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব, যা স্পষ্টত এন্টি-ইসলামিক। এছাড়া পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্র সহায়ক। মূল সিস্টেমের অন্যতম উপাদান হিসাবে গণতন্ত্র অপরিহার্য। অর্থাৎ গণতন্ত্র একটি উপায় হিসাবে গ্রহণযোগ্য, লক্ষ্য (end) হিসাবে অগ্রহণযোগ্য।
ইসলামের বিভিন্ন রেফারেন্সগুলোকে বুঝতে হবে সামগ্রিকভাবে ও এর পরম্পরাকে বিবেচনায় রেখে।
ধন্যবাদ।
ঈগল: “না, জনকল্যাণমূলক হওয়ার জন্য সেক্যুলার হওয়ার দরকার নাই, যেমন প্রয়োজন নেই গণতন্ত্রী হওয়ার।”
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: গণতন্ত্র ততটাই ইসলামী যতটা হলো সেক্যুলারিজম। বিপরীতভাবে, সেক্যুলারিজম ততটা ইসলামবিরোধী যতটা গণতন্ত্র। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।