যা চলছে
গত পরশু ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শনের সময়ে এক ছাত্র পাশের জনকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছে। সেই ছাত্র কিছু একটা বলেছেও। আমি যে দেখেছি তা তারাও খেয়াল করেছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমি দু’জনেরই স্ক্রিপ্ট নিয়ে নিলাম। আর দেইনি। তখনো পরীক্ষা শেষ হতে ১৫/২০মিঃ বাকী। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম যে ছেলের কাছে তার পাশের জন জিজ্ঞাসা করেছে, সে হাতে মুখ ঢেকে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে। বাসায় এসে আমার মেয়েদেরকে ঘটনাটি বললাম। পরীক্ষা হলে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে, ‘পারবো না বা বলবো না’ – এ ধরনের কথাও যেন না বলে সে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করলাম। গতকালও কথা বলার জন্য দু’জন ছাত্রের স্ক্রীপ্ট নিয়ে নিয়েছি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার বেশ খানিকটা সময় বাকী থাকলে OMR শীটে expelled শব্দটি লিখি না। যাহোক, পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ের ১০মিনিট আগেই শুরু করেছিলাম। তাই নির্ধারিত সময়ের ১০মিনিট আগেই আমরা OMR শীটগুলো নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠিয়ে দিই। হাতে সময় থাকাতে পাশের এক রুমে যাই। সেখানে আমার এক পরিচিত সহকর্মী ডিউটি করছিলেন। গিয়ে দেখি, স্টুডেন্টরা ফাঁকতালে কথা বলে যাচ্ছে। উনারা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ক্রমাগত ‘এই’ ‘ওই’ করে যাচ্ছেন। ‘এই তোমরা কথা বলবে না’ বলে কৃত্রিম গাম্ভীর্য সহকারে তাদেরকে মৃদু বকা দিয়ে যাচ্ছেন। বলাবাহুল্য, আমি সেখানে যাওয়ার পর পরই পুরো হ-লে সুনসান নীরবতা কায়েম হয়ে গেলো!? বুঝতেই পারছেন, উনারা ‘মাইন্ড করতে পারেন’ এই ভয়ে পরীক্ষা শেষে এ ধরনের ঢিলেঢালা ইনভিজিলেশনের বিষয়ে উনাদেরকে কিছু বলার সাহস করি নাই …!
সাধারণ পরীক্ষা বনাম ভর্তি পরীক্ষা
ভাবছি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের (পূর্বতন চ.বি. কলেজ) ভিতরেই যদি পরীক্ষার এই অবস্থা হয়, না জানি, একই সময়ে বিভিন্ন বেসরকারী কলেজে নেয়া পরীক্ষাগুলোর কী অবস্থা …!! আপনারা জানেন, ভর্তি পরীক্ষা প্রচলিত পরীক্ষার মতো নয়। প্রচলিত পরীক্ষায় প্রত্যেকে নিজের নম্বর/গ্রেডটুকুই পায়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পজিশনগুলো মূলত: প্রতীকি। অথচ ভর্তি পরীক্ষায় প্রত্যেক পরক্ষার্থীই বাদবাকী সব পরীক্ষার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী। যে ছাত্র বা ছাত্রী পাশের জন হতে এমনকি ১টিও সঠিক উত্তর জেনে নিতে পারে সে মূল মেধা তালিকায় এমনকি কয়েকশত ভর্তিচ্ছুকে অতিক্রম করে যায়। অংকের বিপরীত অনুপাতের মতো, যখনই কোনো undeserving স্টুডেন্ট অবৈধভাবে ‘ভালো’ করে এগিয়ে যায় তখনই বিপুল সংখ্যক deserving স্টুডেন্ট সমপরিমাণে পিছিয়ে যায়। আপনি দেখবেন, পরীক্ষায়, বিশেষ করে কোনো ভর্তি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের ব্যাপারে পরিদর্শকদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিই একমাত্র বৈধ ও নৈতিক অবস্থান।
ডিউটি পাওয়া/করা সুবিধামাত্র (প্রিভিলিজ) নয়
পরিদর্শকগণ কর্তৃক নিজ-বিবেচনায় কাউকে মাফ করে দেয়ার মাধ্যমে তারা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সাথে কৃত gentleman agreement-এর লংঘন করেন। এপয়নমেন্ট লেটারের অপর পৃষ্ঠায় লিখিত নিয়মাবলী মেনে চলার জন্য প্রত্যেক পরিদর্শক আইনত ও নৈতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এও দেখা যায় যে, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ অনেক দিন পরে দেখা-সাক্ষাতের প্রেক্ষিতে (এক ঘন্টার) মূল পরীক্ষা চলার সময়েও উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলতে থাকেন। বিশেষ করে সিনিয়র টিচারেরা এই কাজ বেশি করেন। [দুঃখিত, এ ধরনের হার্শ মন্তব্য করার জন্য!] আমরা অনেকেই এটি মনে রাখতে ব্যর্থ হই যে, ভর্তি বা যে কোনো পরীক্ষায় পরিদর্শনের দায়িত্বপালন একটা অর্পিত দায়িত্ব, ‘প্রাপ্ত ক্ষমতা’ নয়! টাকা যা দেয়া হয় তা সম্মানী মাত্র। কোনো মতে বিল-ফরমে সই করে দু’ ঘন্টা ডিউটির জন্য নগদ দু’হাজার টাকার যে বানিজ্য আমরা হাতিয়ে নিচ্ছি, আমরা কি একবারও ভেবেছি, এই টাকা আমাদের পকেট থেকেই প্রাকারান্তরে খসানো হচ্ছে? প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষার সময়ে আমরা অনেকেই আত্মীয়-স্বজনদের ছেলে-মেয়েকে ফরম কিনে দেই। এক একটা স্টুডেন্ট চার-পাঁচটা ইউনিট থেকে ফরম কিনে। বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে কয়েকটা ইউনিটে আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হয়। একই বিষয়ে আলাদা আলাদা পরীক্ষা নেয়ার মানে কী? স্পষ্টত:ই ‘বানিজ্য’ করার মানসিকতা ছাড়া? বিভাগভিত্তিক পরীক্ষা-পদ্ধতির পরিবর্তে একসময়ে ৪টি ইউনিটের মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষদভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা-পদ্ধতিতে এখন ১৮টি ভর্তি-ইউনিটের ব্যবস্থা !? [দ্রষ্টব্য: চ.বি. ভর্তি পরীক্ষার নোটিশ]
এতো ভর্তিচ্ছুর কী দরকার?
মনে পড়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের সর্বপ্রথম অনুষদভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়। সেটি ছিলো আমাদের ছাত্রজীবনে করা আন্দোলনের ফল। তখন উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হারও কম ছিলো। গণহারে A+ পাওয়ার এ সময়েও ন্যূনতম গ্রেড নিয়ে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে চ.বি.তে ভর্তির আবেদন করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। নিছক ‘বানিজ্যিক বিবেচনা’র বাহিরে এভাবে ভর্তিচ্ছুদের মেলা (applicant-boom) বসানোর মানে কী? উচিত ছিলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে নেয়া পাবলিক একজামের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা। নিছক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অসদিচ্ছার কারনে এটি করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশটাকে তালুকদারী বরাদ্দ নেয়ার মতো করে নানাবিধ সুবিধা-অঞ্চলে (opportunity hunting zone এ) ভাগ করে আমরা যে যার মতো করে ফ্রি-স্টাইলে পরীক্ষা-পূণঃপরীক্ষা করছি, নিচ্ছি। যারা আদৌ ভর্তি হতে পারার কথা না, পারবেনা, তাদেরকেও ভর্তির টাকা জমা দেয়ার সুযোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের সর্ববিধ ভোগান্তির মুখে ফেলার কী মানে? বিশ্বাস করুন, ভর্তি পরীক্ষা সময়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাইজভাণ্ডারের ওরশের মতো’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। [উল্লেখ্য, মাইজভান্ডারের কাছেই আমাদের গ্রামের বাড়ি।]
সর্বদলীয় ভজঘট
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এতসব ভজঘটের জন্য দায়ী কে? বর্তমান রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসন? মোটেও না। এতদপূর্ববর্তী ভিন্নমতাবলম্বী প্রশাসন আমলের চিত্রও ছিলো অনুরূপ। এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ভিন্নতর কোনো প্রশাসনের রাজত্বকালীন চিত্রও এ রকমই হবে। নানা রকমের অনৈতিকতার এই মহোৎসবকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে মূলধারার রাজনৈতিক দল/গ্রুপসমূহ যেমন আওয়ামী-বিএনপি-জামাত এবং সুবিধাবাদী ‘অরাজনৈতিক’ সুশীলমহল, সবাই এক। যে কলেজসমূহে নেয়া পাবলিক একজামের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আস্থা না থাকায় অতিরিক্ত একটা পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, তাদেরই ক্যাম্পাসে তাদের ইনভিজিলেশনের সমন্বয়ে কীভাবে একটি উন্নততর পরীক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হতে পারে? কয়েকদিন আগে দেয়া সীট-প্লানের ওপর ভিত্তি করে সেসব কেন্দ্রে কোনো ধরনের ‘ম্যাকানিজম’ হওয়াটা কি অসম্ভব? যারা শিক্ষকতায় নিয়োজিত নয়, I mean, অফিসারেরা, হিসাব দপ্তরের কর্মকর্তাগন, প্রকৌশল দপ্তরের লোকজনদের পক্ষে আদৌ কি ন্যূনতম মানেও quality invigilation করা সম্ভব? ‘ডিউটি’ পাওয়ার জন্য, দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের তাবৎ কর্মকর্তাবৃন্দ সময়কালের ‘প্রভাবশালী শিক্ষকদের’ কাছে নানাভাবে ধর্ণা দ্যান! শুধুমাত্র প্রশ্নের সেট-কোড না লেখার কারণে প্রতিবছর এক একটা ইউনিটে ৫০/৬০টা হতে পাঁচ-সাত শ’ সংখ্যক OMR বাতিল হয়। ওসব ওএমআর-এ স্বাক্ষরকারী ইনভিজিলেটরদের খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। এ পর্যন্ত, এ ধরনের গাফলতির জন্য কারো শাস্তি কি হয়েছে? না। চ.বি.’র বহুল নন্দিত ‘ফেয়ার এডমিশন টেষ্টে’ ফি বছর এ ধরনের অমানবিক ঘটনা ঘটে। রেজাল্ট তৈরীর কাজ যারা করেছেন তাদের বাহিরে অনেকেই এটি জানেন না
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাই সময়ের দাবী
দেশের যে কোনো স্থান হতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধানুযায়ী যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা কি অসম্ভব? এখনই এটি করা না গেলে অন্ততপক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাত্র সমন্বিত পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করাও কি অসম্ভব? ভর্তির আবেদন করার জন্য রিকোয়ারড গ্রেড বাড়িয়ে দিয়ে একদিনে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোয়ালিটি-একজাম নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রয়োজনে জোড় রেজিস্ট্রেশন নম্বরের পরীক্ষার্থীদের সকালে আর বেজোড় রেজিস্ট্রেশন নম্বরধারী পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা বিকালে নেয়া যেতে পারে। তদুপরি, ভর্তি পরীক্ষা অব্যবহিত পূর্বে ইনভিজিলেটরদেরকে নিয়ে ফ্যাকাল্টিভিত্তিক প্রস্তুতি-সমাবেশের আয়োজন করা হলে ন্যূনতম মাত্রায় হলেও কোয়ালিটি একজাম নিশ্চিত করা সম্ভব। ভর্তি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন রোধ করতে গিয়ে কখনো কখনো মানবিকবোধ ও ন্যায়বোধ মুখোমুখি অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। অভিজ্ঞতায় দেখেছি। সেক্ষেত্রে একজন পরিদর্শকের করণীয় কী হওয়া উচিত তা ইউনিট কর্তৃপক্ষের পক্ষ হতে পূর্বাহ্নেই ঠিক করে দিতে হবে। এ রকম একটি নাজুক বিষয়ে পরিদর্শকের সিনিয়রিটি একমাত্র শর্ত বিবেচিত হওয়া কাঙ্খিত নয়। আমার এ ‘তাত্ত্বিক’ কথাগুলো অনেক সমকর্মীর কাছে তিতা মনে হবে। জানি। তবুও বলছি, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসাবে আমাদের নৈতিক মান’ বজায় রাখার স্বার্থে এহেন অনৈতিক ‘ভর্তি-উৎসব’ পরিবর্তনের জন্য এখনই চিন্তা-ভাবনা শুরু করা দরকার। চবি’র বর্তমান শিক্ষক সমিতিকে নানা পেশাগত বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় ও সোচ্চার হতে দেখছি। আশা করছি, এ বিষয়ে তারা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গঠন, সেমিনার আয়োজন, দাবী-দাওয়া পেশ ইত্যাদির মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের শিক্ষকবৃন্দকে সাথে নিয়ে একটা নেশন-সেভিং ব্রেক-থ্রু’র উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
এ সম্পর্কিত আরেকটি আর্টিকেল: আইন ও নৈতিকতার মিথষ্ক্রিয়া বনাম বিপরীত অনুপাত সম্পর্ক