“আপনি এক লেখায় বলেছেন যে আপনি প্রাচ্যের পুরুষতন্ত্রের বিরোধী। এখানে ‘পুরুষতন্ত্র’ বলতে আসলে কী বুঝিয়েছেন? পুরুষতন্ত্রের বিকল্প হিসাবে কী ধরনের সোসাইটিকে আপনি ইন্সপায়ার করেন?” – এক পাঠকের প্রশ্ন।

হ্যাঁ, আমি পুরুষতন্ত্রের বিরোধী। এটি প্রাচ্য দেশগুলোতে ডমিনেন্ট। একই সাথে আমি নারীবাদেরও বিরোধী, যা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ডমিন্যান্ট সোশল ট্রেন্ড। পাশাপাশি, এই দুই প্রান্তিকতার প্রভাবে নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে সৃষ্ট এক ধরনের সুবিধাবাদিতারও আমি বিরোধী।

এসব কিছুর পরিবর্তে আমি সামাজিক মানবিকতার পক্ষ-সমর্থক। আমি অত্যন্ত কঠোরভাবে নারী-পুরুষ সমতায় বিশ্বাসী। নারী অধিকারের যারা বিরোধী, আমি তাদের বিপক্ষ। এই জন্মগত মৌলিক মানবিক সমতার বাস্তবায়নে যে ধরনের ন্যায্যতা প্রয়োজনীয়, আমি স্বভাবতই সেটার পক্ষপাতি।

এসব কথা আমি খুব ক্লিয়ারলি বলছি। সবসময়ই বলে থাকি। অবশ্য, কে কী মনে করে তাতে কার কী আসে যায়? আমি তো এমন কেউ নই যার কথায় কারো কিছু একটা আসে যায়। যে কথায় যুক্তি নাই, যে কথায় বাস্তবতার যথার্থ প্রতিফলন নাই, সে লেখায় আপনার বা তেমন সেন্সিবল কারো কী আর আসে যায়?

সেজন্য যারা একমত হতে পারবেন না, তাদের উচিত আমাকে আগেভাগেই বাদ দেয়া। এড়িয়ে চলা। তবে, এখানে একটা ‘তবে’ আছে। তা হলো, আমি যা বলি তা কিন্তু যুক্তি দিয়েই বলি। তাই, আমার কথাকে নাকচ করতে হলে যে কাউকে যুক্তির ময়দানে আসতে হবে। প্রপারলি প্রসিড করতে হবে। অযথা কিছু খণ্ডিত রেফারেন্স আর আবেগের ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে যুক্তির মাপকাঠিতে উতরানো যায় না।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে আমি অনেক লেখালেখি করেছি। যারা এক কথায় কোনো কিছু জানতে চান, তাদের জন্য আমার লেখাগুলো বেশ বড়। আবার কোনো বিষয়কে যারা ভালো করে বুঝতে চান তাদের কাছে আমার লেখাগুলোকে মনে হবে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সে যাই হোক, এই পোস্টে আমি প্রাচ্য পুরুষতন্ত্র, পাশ্চাত্য নারীবাদ, নারীদের সুবিধাবাদ – এই তিনটা বিষয়ে কিছু বলবো।

এখানে একটা কথা বলে দিতে চাই, সুবিধাবাদিতার দিক থেকে নারী-পুরুষ কিন্তু ভাই-বোন সমান সমান। এই পোস্টে যেহেতু নারীদের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, সে জন্য ‘নারীদের সুবিধাবাদ’ এভাবে কথাটা বলা হয়েছে। আশা করি কেউ ভুল বুঝবেন না।

এর পূর্বে এ কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কোনো টার্মের অর্থ সেটির উৎপত্তিগত অর্থের পরিবর্তে হালনাগাদের প্রচলিত অর্থেই সেটাকে আমি বুঝে থাকি। সে কারণে জীবনাদর্শ বুঝাতে আমি কখনো ধর্মকে বুঝি না। বুঝাই না। বরং ধর্মকে জীবনাদর্শের একটি অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হিসাবে বুঝে থাকি।

এর মানে হলো, পুরুষতন্ত্র মানে পরিবারের প্রধান হবে পুরুষ, এভাবে আমি পুরুষতন্ত্রকে বুঝি না। পরিবার নামক এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমি যা বুঝি তা হলো, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনো না কোনো পুরুষই হবে একটি পরিবারের প্রধান নির্বাহী। এ অর্থে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের তুলনায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজকেই আমি সমর্থন করি। যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত মনে করি। মানব সভ্যতার ইতিহাস এটাই আমাদেরকে বলে। বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ বা ইতিহাস হতে পারে না। হয় না।

এখানে অবশ্য একটি ব্যাপার খেয়াল করতে হবে। তা হলো, ফ্যামিলি সিনিয়রিটির ক্ষেত্রে জেন্ডার আইডেন্টিটি নয়, পজিশনই বড় কথা। যেমন, পরিবারের সিনিয়রিটির তালিকায় বাবার অনুপস্থিতে মা-ই হলো মোস্ট সিনিয়র। সিনিয়রিটির ক্রনোলজি অনুযায়ী এমতাবস্থায় পুত্র সন্তান মায়ের অধীনস্ত। কিন্তু উপার্জন করা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য দায়ী হিসাবে ছেলে হচ্ছে নির্বাহী প্রধান। পুরুষ ছাড়া কেউ কোনো পরিবারের প্রধান হতে পারবে না, ধর্মের নিয়ম যদি এমন হতো, তাহলে ছেলের সংসারে মা, ছেলের অধীনস্ত হয়েই থাকতো। এই দৃষ্টিতে দেখলে বুঝবেন, ফ্যমিলিতে সিনিয়রিটি আর এক্সিকিউটিভ ডিউটি, এই দুইটা স্বতন্ত্র বিষয়।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজেও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব কিন্তু পুরুষরাই পালন করে বা করেছে। বিচার-সালিশও কিন্তু পুরুষ সমাজপতিরাই করে। যদিও মা হয় পরিবারের প্রধান। অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব মায়ের উপরে ন্যস্ত। উপার্জনের প্রাথমিক দায়িত্ব কোনো না কোনো নারীকেই পালন করতে হয়। বড় মেয়ে সব সম্পত্তির মালিক হয়। এ ধরনের তথাকথিত মাতৃতান্ত্রিক সমাজে উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তি বণ্টিত হয় তা সব বোনেরা পায় না কেন, ছেলেরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত কেন হবে, এই ধরনের প্রশ্ন না-ইবা করলাম আজ।

বুঝতেই পারছেন, পরিবার ও সমাজ কি মাতৃতান্ত্রিক হবে, নাকি পিতৃতান্ত্রিক হবে, এই প্রশ্নে আমি পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার পক্ষে। এরমানে এই নয় যে আমি পুরুষতন্ত্রের পক্ষে। পুরুষতন্ত্র আর পিতৃতান্ত্রিকতা এক নয়। পুরুষতন্ত্র হলো পিতৃতান্ত্রিকতার অপপ্রয়োগ বা বিকৃত রূপ। বলাবাহুল্য, সব ভালো কিছুরই বিকৃতি হয়েছে বা হতে পারে।

পুরুষতন্ত্র হলো সবল কর্তৃক দুর্বলের উপর অত্যাচারের সামাজিক বৈধতা দেয়ার তন্ত্র। ক্ষমতার অপপ্রয়োগমাত্রই তাই এক ধরনের পুরুষতন্ত্র। এ অর্থে একজন অত্যাচারী নারীও হতে পারে পুরুষতান্ত্রিক।

যে নারীবাদের আমি বিরোধী তা হলো, পুরুষতন্ত্রের প্রভাবাধীন সামাজিক ব্যবস্থায় পুরুষদের যে ক্ষমতা সেটার সমক্ষমতায় নারীদের ক্ষমতায়নের ধারণাকে প্রমোট করার তন্ত্র হলো নারীবাদ। নারীবাদের নানান পর্যায় ও ভিন্ন ভিন্ন ভার্শন রয়েছে। এক অর্থে, নারীর মানবাধিকারের সমর্থক ও ডিফেন্ডারদেরকেও নারীবাদী বলা যায়। সে হিসাবে আমিও নারীবাদী। প্রফেট মুহাম্মদও (সা) ছিলেন নারীবাদী।

নারীবাদ পাশ্চাত্যে এখন যেভাবে প্রমোট করা হচ্ছে, যেটাকে থার্ড ওয়েব অব ফেমিনিজম বলা হয়, তা নিতান্তই অযৌক্তিক। এটি বাহ্যত পুরুষবিদ্বেষী। অন্তর্গতভাবে এটি পুরুষবাদী। পুরুষতন্ত্রের প্রাবল্য দেখা যায় সমকালীন প্রাচ্য সমাজ ব্যবস্থায়। আর নারীবাদের নামে যত্তসব অযৌক্তিক ননাইয়া কাজকর্ম ও লাফঝাফ দেখা যায় সমকালীন পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থাতে। এতদুভয় প্রান্তিকতার পাশাপাশি আমি নারীদের সুবিধাবাদিতার কেন ও কোন অর্থে বিরোধী, সেটা নিয়ে খানিকটা বলছি।

মেয়েদের মধ্যে এক গ্রুপ প্রাচ্য পুরুষতন্ত্রকে সাপোর্ট করার মাধ্যমে বিদ্যমান স্ট্যাটাস-কো’র সুবিধা ভোগ করে। দৃশ্যত এরা সুশীল পর্দানশীন অনুগত নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে এরা ‘আদর্শ নারী’। যদিও যতসব আরোপিত বিধানের তারা ঘোর বিরোধী। এ নিয়ে ডিটেইলস আলাপে এখন যাচ্ছি না।

ইউরোপ, আমেরিকাসহ ‘উন্নত’ দেশগুলোর নারীরা নারীবাদকে দৃশ্যত সমর্থন করে। এর মাধ্যমে তারা সেখানকার ডমিন্যান্ট ট্রেন্ডের সাথে নিজেদের আইডেন্টিফাই করে এবং সিস্টেমের ডিফেন্ডার হিসাবে সিস্টেম থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে। ওখানকার হাফ-নেংটু, কোয়ার্টার-নেংটু, লিভিং পার্টনার নারীদের সবাই যে নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও পরিবার সংক্রান্ত বিষয়ে বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী, তা তো নয়। তাদের বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয়ই তারা বুঝে– কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল। কিন্তু বিদ্যমান সুবিধাগুলোর প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করার জন্য, আমার ধারণায়, তারা এনমাস নারীবাদের সমর্থক।

আমাদের এখানকার অধিকাংশ নারী দৃশ্যত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে। কোলাবরেটর। কেউ কেউ বিরোধী, তথা নারীবাদী। তেমনি করে ওখানকার নারীরা ওভারহোয়েমিংলি নারীবাদের সমর্থক, কেউ কেউ যদিও নারীবাদবিরোধী। আসলে, এগেইন উইথ এক্সেপশন, উভয় জায়গাতেই তারা প্রিভেইলিং স্ট্যাটাস-কো’র পক্ষে। মূলত সুযোগ সুবিধা যথাসম্ভব বেশি পাওয়ার পক্ষে। অরাজনৈতিক মেজরিটি শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের মতো। যুক্তিতর্কের ঝামেলা ও বাদ-প্রতিবাদ-সংঘর্ষের ঝুঁকিতে না গিয়ে যতটুকু সম্ভব নিজের ইন্টারেস্টকে ম্যাক্সিমাইজ করা।

নারী-পুরুষের সমন্বয়ে সমতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক এক মানবিক সমাজ নির্মাণের জন্য পুরুষতন্ত্র, নারীবাদ ও সুবিধাবাদ নামক এই তিন ইভিলের বিরুদ্ধেই আমাদের সোচ্চার হতে হবে। একসাথে। আজকে। এখন থেকে। অবিলম্বে। সর্বোত ও সম্মিলিতভাবে। নো কম্প্রোমাইজ। লেটস ফাইট ফর দ্যা কমন গুড। লেটস বিল্ড এন আনবায়াসড সোসাইটি। Let’s help people to get rid of each illogical and unjustified cultural burden.

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *