প্রসঙ্গ: একজন ব্লগার লিখেছেন, নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না, তবুও তিনি আস্তিক তথা বিশ্বাসী।
যদি নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতে না পারেন, তাহলে আস্তিক হলেন কীভাবে? অর্থাৎ, নাস্তিকতাই যদি যুক্তিসঙ্গত হয় তাহলে আপনার ‘বিশ্বাসের’ কী মূল্য? আমি যতটুকু জানি, ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী আল্লাহও চান না মানুষ না বুঝে, যুক্তিসঙ্গত হিসাবে গ্রহণ করা ছাড়াই ঈমান আনুক। ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী, ঈমান বা বিশ্বাসের মধ্যে অন্তরের উপলব্ধি, মৌখিক দাবি ও কর্মগত সাদৃশ্য– এই তিনের সমন্বয় বা অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য।
তাই আমি মনে করি, নাস্তিকদের সাথে কেউ যদি যুক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে তার আস্তিক থাকার কোনো কারণ নাই। জ্ঞানবিহীন বিশ্বাস অর্থহীন, অসম্ভব।
স্মর্তব্য, নাস্তিকতাকে খণ্ডন করা আস্তিক হওয়ার অপরিহার্য শর্ত নয়। আস্তিকতার যুক্তি আছে– কেবলমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট।
আস্তিকতাকে খণ্ডন করার প্রচেষ্টা যেমন নাস্তিকদের একটা শ্রেণীগত বিভ্রান্তি (category mistake), তেমনি নাস্তিকতাকে খণ্ডন করার জন্য আস্তিকদের প্রচেষ্টাও সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীগত বিভ্রান্তি বটে।
কারণ–
‘প্রমাণ’ দিয়ে ‘বিশ্বাস’ হয় না। ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তি হলো ‘যুক্তি’। এবং ‘যুক্তিই’ হলো ‘জ্ঞানের’ ভিত্তি, উপাদান ও মৌলিক কাঠামো।
তাই–
অনুমান ছাড়া শুধুমাত্র ‘প্রমাণ’ দিয়ে ‘জ্ঞান’ হয় না। ‘প্রমাণ’ লাগে, যেটি হলো তথ্য। যা ‘জ্ঞানের’ একক। যেমন দালানের জন্য ইটের খণ্ডগুলোকে আমরা দালানের একক বলতে পারি। তথ্য ও জ্ঞানের পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। তথ্য ছাড়া জ্ঞান হয় না। তাই বলে সব তথ্য জ্ঞান নয়। তথ্যের ‘নির্দিষ্ট সমাহার’ হলো জ্ঞান। অনুমানই হলো এই ‘নির্দিষ্ট সমাহার’। শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট অনুমানকে হতে হবে যুক্তিসঙ্গত।
সকল জ্ঞানই মূলত বিশ্বাস (বা অনুমান), কিন্তু সকল বিশ্বাস জ্ঞান নয়। জ্ঞান হলো যুক্তিসঙ্গত সত্য বিশ্বাস।
অতএব, অযৌক্তিক বিশ্বাসই হলো অন্ধবিশ্বাস। কেউ যদি স্বীকার করেন, নাস্তিকদের যুক্তি অধিকতর গ্রহণযোগ্য, তাহলে তিনি একজন নাস্তিক। সামাজিক কারণে তিনি নিজেকে নাস্তিক পরিচয় না দিলেও।
আমাদের সমাজে নাস্তিকরা সাধারণত নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। মজার ব্যাপার হলো অনেকেই জানেন না যে, তিনি নাস্তিক। নাস্তিকতাকে এখানে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। জন্মগতভাবে কেউ আস্তিক বা নাস্তিক হন না। আস্তিকতা বলুন, নাস্তিকতা বলুন– এগুলো অর্জন করতে হয়।
আমাদের দেশে সবাই বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আস্তিক তো বটেই, এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানরাও ‘মুসলিম’! কারণ, ‘রাষ্ট্রধর্ম’(!) হলো ইসলাম। কী বিচিত্র! ইসলাম অন্তত ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হওয়ার কোনো ব্যাপার নয়। অবুঝ (জন্মগতভাবে) মুসলিমরাই ইসলামের বড় সমস্যা।
আস্তিক হোন আর নাস্তিক হোন – জেনে-বুঝে হোন। হঠকারী (এক্সট্রিম) হবেন না। যা কিছুর ‘যু্ক্তি নাই’ তা পরিত্যাগ করুন। যুক্তিবাদী হোন, তাহলেই সত্যিকারের বিশ্বাসী হতে পারবেন। (ভালোভাবে) বাঁচতে হলে আমাদেরকে সত্যিকারের বিশ্বাসী হতে হবে। বিশ্বাসের বিষয় যাই হোক না কেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যারা বিপরীত মতকে গালিদানে ধন্য হন, তারা দয়া করে মন্তব্যদানে বিরত থাকবেন।
নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
প্রবাসী১২: ডাকসুর বড় একজন নেতা, বর্তমানে একজন সরকারী বড় কর্মকর্তা। আমার সাথে এক ধরনের সখ্যতা আছে। আমি তাঁকে বললাম পবিত্র কোরআন সত্য হওয়ার অনেক অকাট্য প্রমাণ আছে। পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে আমার আল্লাহ আমাকে বলেছেন: তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আহারের ব্যবস্থা করেছেন, আমাকে তিনি মৃত্যু দিবেন, মৃ্ত্যুর পর তাঁর কাছে আমাকে যেতে হবে, তাঁর অবাধ্য হলে তিনি শাস্তি দিবেন এবং এ ক্ষমতা তাঁর আছে।
কার্ল মার্কস, লেনিন, যিশু, রাম, কৃষ্ণ– কেউ এমন দাবি উত্থাপন পর্যন্ত করেনি। দাবি উত্থাপন করলে আমি তুলনা করতে পারতাম কোনটা আমি মানবো আর কোনটা মানবো না। যেহেতু দাবিই মাত্র একজনের এবং অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও প্রামাণ্য, সেহেতু বিভ্রান্ত হওয়ার পথই তো দেখি না।
তিনি হেসে বললেন এভাবে কখনো ভাবিনি, ভাবলে ওপথ কখনো মাড়াতাম না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: কোরআন সত্য হওয়ার যদি প্রমাণ থাকতো তাহলে বিশ্বাসের প্রসঙ্গ আসলো কেন? প্রমাণের তো বিশ্বাসের দরকার হয় না। বিশ্বাস করতে হয় যেখানে প্রমাণের ঘাটতি আছে। আমার লেখাতেই বলেছি, নিছক প্রমাণ (মূলত তথ্য) জ্ঞান নয়।
আমার জানা মতে, কোরআনে আছে আয়াত বা নিদর্শন, হুজ্জাত তথা প্রমাণ নয়। আল্লাহ বলেছেন, আমি অনেককে বিভ্রান্ত করি, অনেককে সত্যানুসারী করি। তবে আমি এমন কাউকে বিভ্রান্ত করি না যে নিজেই বিচ্যুতিকে (ফাসেকী) পছন্দ না করে। সূরা বাকারার শুরুর দিকে।
মৃত্যু-যন্ত্রণা শুরু হলে ঈমান আনার আর অবকাশ থাকে না । কারণ, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ‘প্রমাণ’ দেখতে পান।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: প্রমাণ, যুক্তি ও বিশ্বাস– জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই তিনটির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও পার্থক্য বুঝতে হবে, মনে রাখতে হবে। না হলে, ক্যাটাগরি মিসটেক। (বৃত্তের পরিধিস্থ কোন বিন্দু বৃত্তের অধিকতর নিকটবর্তী?– এ ধরনের প্রশ্ন হলো ক্যাটাগরি মিসটেক।)
স্টাডি–ইটিই: আপনার লিখার সাথে সহমত। তবে প্রশ্ন হলো আপনার মন্তব্যের একটি বক্তব্য নিয়ে। আল্লাহ তাকে বিভ্রান্ত করেন না যে নিজে বিভ্রান্ত হতে পছন্দ করে না। আমি এমন এক ব্যক্তিকে চিনি, যিনি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। দীনের পথে সঙ্ঘবদ্ধ থাকতে তাবলীগ থেকে শুরু করে এ দেশে প্রচলিত ছোট বড় তিনটি সংগঠনে কাজ করেছেন। কোনো সংগঠন তাকে বহিস্কার করেনি। ১০ বছরের মত সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন মানুষকে ইসলামী জীবন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করে তুলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই ঈমান হারিয়ে ফেলেছেন। পরিবার ও সমাজের কারণে তিনি আগের জীবন পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন আনেননি। দৈত চরিত্রের ফলে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে মিথ্যা হলেও যা তিনি জানতেন তাকে সত্য বলে ভাববেন। এই ব্যক্তিকে আল্লাহ কেন বিভ্রান্ত করলেন? আর এ বিভ্রান্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করার পর পরকালের আজাবের দায় তাকে নিতে হবে কেন?
আশা করি আল্লাহ জানেন অথবা ইহা আল্লাহর পরীক্ষা টাইপ উত্তর দিবেন না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধন্যবাদ।
যিনি সত্যকে পেতে চান তিনি পাবেন। আপনি যে ব্যক্তির কথা বললেন তিনি ধর্মাচরণ করেছেন, ইংরেজিতে যাকে বলে রিচ্যুয়ালস, আরবিতে (কোরআনে) বলা হয়েছে নুসুক (‘ওয়া আরিনা মানাসিকানা’– হযরত ইব্রাহীম)। সুতরাং, ধর্মের বিধানাবলী চর্চা করা আর দ্বীন হিসাবে ইসলামকে গ্রহণ করা এক নয়। সোজা কথায়, যিনি নামাজ-রোজা ইত্যাদি করেন তিনি হতে পারে আচার-অনুষ্ঠান হিসাবে সেসব করছেন, হতে পারে প্রকৃত ঈমানদার হিসাবে করছেন। ব্যক্তির কর্মধারার সর্বশেষ অবস্থা তার পূর্ববর্তী মনোভাবকে প্রত্যয়ন করবে। আপনার পরিচিত এই ব্যক্তির উদাহরণ আত্মহত্যাকারী জনৈক ‘মুজাহিদের’ মতো। তবে, এই উত্তরের পরেও প্রশ্ন হতে পারে। সেই উত্তরও আমার জানা আছে। আমার হাতের লেখা খুব স্লো। তাই আপাতত এতটুকুই।
স্টাডি–ইটিই: আত্মহত্যাকারী মুজাহিদ ব্যক্তি খ্যাতি বা কষ্টের কারণে এ কাজ করেছিল। তার সাথে এই ব্যক্তির তুলনাই হয় না। আর আচার-অনুষ্ঠাননির্ভর ব্যক্তি ভাবায় বুঝলাম আমার মন্তব্য আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়েননি। প্রথমত তার শিক্ষাজীবন শুরু ধর্মীয় শিক্ষালয় থেকে। তারপর তিনি তার শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন। অর্জিত জ্ঞানের আলোকে দীনকে প্রতিষ্ঠার কাজে সমমনাদের সাথে সহযোগিতা করে গিয়েছেন। ইসলামকে মিথ্যা ভাবা তার জন্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ। এটি তার অর্জনগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে, যে অর্জনগুলো মুসলিম সমাজে মর্যাদাশীল মানুষ হিসেবে গণ্য করার কারণ। সর্বশেষ নিজের পরিবর্তনকে প্রকাশ করছেন না। যতটুকু প্রকাশ করেছেন সেটা তাদের কাছেই, যারা সমস্যাগুলো নিয়ে যৌক্তিক উত্তর দিতে পারবেন বলে তার কাছে মনে হয়েছে।
আপনি বলতে চাইছেন ব্যক্তির সর্বশেষ অবস্থা তার পূর্ববর্তী মনোভাবকে প্রকাশ করে। আপনি কি এটাই বলতে চাইছেন ব্যক্তির যে বর্ণনা আপনি পেলেন। তাতে পূর্বে তিনি বর্তমান অবস্থার মনোভাবাপন্ন ছিলেন? আপনার তুলনাটি আপনার লিখার সাথে আপনার বিরোধিতাই প্রকাশ করছে। আপনি বলেছেন, অন্ধ বা অযৌক্তিক বিশ্বাস অর্থহীন। জ্ঞানবিহীন বিশ্বাস অসম্ভব। তাই যদি হয়। অর্জিত জ্ঞানের সাথে সংঘাত হওয়ার পরেও কোনো একদিন সত্য পাব ভেবে তাতে বিশ্বাস রাখা কি অর্থহীন নয়? আহত মুজাহিদের আত্মহত্যার সাথে তা তুল্য ভাবাটাও সে অর্থহীন বিশ্বাস করে যাবার শামিল।
অলস ছেলে: ব্লগ থেকে চলে গিয়েছিলাম, অন্য কাজ করছিলাম কিন্তু আপনার লেখাটা মাথায় ঘুরছিলো।
মূল সুরের সাথে, যতটুকু বুঝেছি, দ্বিমত করার কোনো কারণই নেই। ইসলামী বিশ্বাসের প্রসঙ্গগুলোতে এমন কিছু মৌলিক বিষয় আছে যেগুলো অকাট্য প্রমাণ দিয়ে বুঝানোর কোনো সুযোগ নেই পার্থিব জীবনে। এর মাঝে ‘আলাম আল-গায়ব’ বা অপার্থিব জগতের বিষয়গুলো আছে। ফেরেশতা বা জান্নাত-জাহান্নাম কারো বোধের মাঝে আসবে না। কিংবা কোরআনে যেমন আছে, আল্লাহ আরশের উপর বসে আছেন সে বসে থাকার প্রকৃতি, তাঁর হাত, দৃষ্টিশক্তি, তাঁর জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য, এসব মানুষের বুঝতে পারার কথা না।
কিন্তু আমি যেটা জানতে চাচ্ছি, আপনার ভাষায় প্রমাণ আর যুক্তির পার্থক্য কী? কোনো ‘প্রমাণ’ কি যুক্তির অংশ নয়? একই সাথে ‘যুক্তি’ কি এক ধরনের প্রমাণ নয়?
আপনি দেখাচ্ছেন বিশ্বাসের সাথে যুক্তির ইতিবাচক এবং প্রমাণের নেতিবাচক সম্পর্ক। আমার বুঝে এটা এসেছে। আরেকটু বিস্তারিত বললে ভালো লাগতো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সত্য সবার জন্য সমান, যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমাদের ধারণাও মোটামুটি কাছাকাছি, কিন্তু বিশ্বাসের পরিধি ও প্রকরণে রয়েছে ব্যাপক মতপার্থক্য। তাই আমাদের জ্ঞানও ভিন্ন ভিন্ন। তবে বিশ্বাস তথা অনুমানের মিশ্রণ ব্যতিরেকে জ্ঞান হবে না। শুধু প্রমাণ হলো নিরেট (ইনার্ট/প্যাসিভ) তথ্য মাত্র। প্রমাণ হলো যা চোখে দেখা যায়, সরাসরি। ইন্দ্রিয়জ। জ্ঞান হলো অতীন্দ্রীয়। কেউ যদি বিশ্বাস বা মনে করে, ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানই একমাত্র সত্য, তাহলে এটিও তাকে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে বুঝতে ও বোঝাতে হবে। বুদ্ধি (স্পষ্টতই যা ইন্দ্রিয় নয়) ও যুক্তির প্রয়োগ ছাড়া ইন্দ্রিয়জ অচল। অতএব, সকল জ্ঞানের মধ্যে যুক্তি থাকবে, সত্য (যাকে আপনি প্রমাণ বলছেন, আমি তথ্য বলছি) থাকবে। এর সাথে অনুমান তথা বিশ্বাসও থাকবে। তবেই জ্ঞান হবে।
খোদার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নাই। যুক্তি আছে। না থাকার যুক্তিও আছে। আপনি মনে করতে পারেন, থাকার যুক্তি অকাট্য। অতএব, আপনি বলতে পারেন, আস্তিকতার প্রমাণ আছে। কিন্তু আপনার এই প্রমাণ মূলত যুক্তি। যাকে আপনি প্রমাণ হিসাবে বিশ্বাস করেন। প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও যুক্তিকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করাটাই বিশ্বাসী হিসাবে আপনার কৃতিত্ব।
আমার হাতের লেখা খুব স্লো। তাই আপাতত এতটুকুই।
দুরন্ত স্বপ্নচারী: “সকল জ্ঞানই মূলত বিশ্বাস (বা অনুমান), কিন্তু সকল বিশ্বাস জ্ঞান নয়।”
সকল জ্ঞান বিশ্বাস নয়। হতে পারে না। বিশ্বাস হলো যে তথ্য বা জ্ঞানের প্রামাণ্য ভিত্তি নেই।
যমুনা সেতু সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার মাঝে অবস্থিত, যার দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার। – এই বাক্যে তথ্য আছে। এটা একটি জ্ঞান। কিন্তু এটা বিশ্বাস নয় কোনোক্রমেই। এটা বাস্তবতা।
সৃষ্টিকর্তা সর্বভূতে বিরাজমান।– এই বাক্যে বিশ্বাস আছে।
বিশ্বাস শব্দটার অভ্যন্তরে রয়েছে ‘সন্দেহ’, অর্থাৎ যে বিষয়ে সন্দেহ আছে কেবল সেই বিষয়েই বিশ্বাসের প্রয়োজন পড়ে। প্রমাণিত বাস্তবের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। যেমন– আমরা ব্রহ্মপুত্র নদে বিশ্বাস করি না। সেটার প্রয়োজনও নেই। কারণ, সেটা বাস্তবতা। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি ‘জ্বীন-পরী আছে’। এটা ‘বিশ্বাস করতে হয়’। কারণ, এটা প্রমাণিত সত্য নয়। অপ্রমাণিত।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি দুটো বিষয়কে এক করে দেখছেন। আমি বলেছি, সকল জ্ঞানই মূলত বিশ্বাস, কিন্তু সকল বিশ্বাস জ্ঞান নয়। জ্ঞান হলো সে সকল বিশ্বাস যা সত্য (স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে) ও যাচাইযোগ্য তথা যুক্তিসঙ্গত। যুক্তিসঙ্গত সত্য বিশ্বাস হলো জ্ঞান। অযৌক্তিক ও মিথ্যা বিশ্বাস হলো অন্ধ বিশ্বাস যাকে আপনি বিশ্বাস বলছেন। এ সংক্রান্ত আমার আগের একটি পোস্ট পড়ে দেখতে পারেন। গুগলে সার্চ দিয়ে জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে ঘেঁটে দেখতে পারেন। জ্ঞানের চিরায়ত সংজ্ঞাটা হলো– নলেজ ইজ জাস্টিফাইড ট্রু বিলিফ (সক্রেটিস)। এই সংজ্ঞাটি অপর্যাপ্ত। কিন্তু এর কোনো বিকল্পও এখনো স্বীকৃত হয়নি।
“যমুনা সেতু সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার মাঝে অবস্থিত যার, দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার।”
আপনি কি এটি মেপেছেন? নিজে না মাপলে অন্য কারো মাপার দাবিকে আপনি যুক্তিসঙ্গত মনে করেছেন। অর্থাৎ বিশ্বাস করেছেন। আপনি জ্ঞান হিসাবে যত কিছু জানেন, সেসব কিছুকে আপনি যাচাই করেছেন, নাকি যতটুকু সম্ভব যাচাই করে অবশিষ্টটুকু (যুক্তিসঙ্গত হিসাবে) বিশ্বাস করে গ্রহণ করেছেন?
আমাদের যাচাইয়ের পরিধি খুবই সংকীর্ণ। কিন্তু সেটু্কুই আমাদের ব্যাপক জ্ঞানের ভিত্তি। ব্যাপক জ্ঞানের ভিত্তি আর (পূর্ণ বা স্বয়ং) জ্ঞান এক কথা নয়। ভিত্তির উপরের কাঠামোটি বিশ্বাস, যাকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলি। এই (স্বতঃসিদ্ধ ধরনের) বিশ্বাস হলো যুক্তিসঙ্গত ও সত্য।
তাই মূলত বিশ্বাস হওয়া সত্ত্বেও সেটি জ্ঞান, মৌলিক জ্ঞান। যুক্তিই হলো এ ধরনের জ্ঞানের ভিত্তি।
মাপকাঠির মাপ কী? যদি না থাকে তাহলে সব কিছু মাপ মতো হতে হবে– এই দাবির কী হবে?
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
কায়েস: আল্লাহ বলেছেন, আমি অনেককে বিভ্রান্ত করি অনেককে সত্যানুসারী করি।
তাহলে আল্লাহ নিজে যাদের বিভ্রান্ত করেন তাদের কেন শাস্তি দেবেন? খোদার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নাই কেন? সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমাদের আবির্ভাব ও জীবনযাপন কীভাবে সম্ভব? সৃষ্টিকর্তা যদি একমাত্র আল্লাহ হন, তবে তাকে কে সৃষ্টি করল?
এসব প্রশ্নের কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর না পেয়ে কেউ হয় নাস্তিক, কেউ করে বিশ্বাস।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: মাপকাঠির মাপ কী? যদি না থাকে তাহলে সব কিছু মাপ মতো হতে হবে– এই দাবির কী হবে? এই লাইনে ভাবতে পারেন।
আল্লাহ তাকে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ দেন, যে সত্যকে পাওয়ার জন্য পূর্ণমাত্রায় সচেষ্ট হয় না। সত্যকে আসলে খুঁজে নিতে হয়। সত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা সর্বদাই ডিসগাইজে থাকে। তাই খোদা স্বীয় অস্তিত্বের বিষয়টিকে প্রমাণের বিষয় না করে যুক্তির আবরণে ঢেকে রেখেছেন। ইসলামী মতাদর্শকে এই ধারায় বুঝতে হবে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
কায়েস: “মাপকাঠির মাপ কী?”
মাপকাঠিরও একটি মানদণ্ড আছে। মাপকাঠি আগে থেকে তৈরি বা নির্ধারণ কাউকে না কাউকে করতে হয়।
সত্যকে পাওয়ার জন্য সকলেই পূর্ণমাত্রায় সচেষ্ট, এমনকি একজন নাস্তিকও, আর ধার্মিকেরা সত্য খুঁজে না পেয়ে আল্লাহকে সত্য বলে ধরে নেয়।
খোদা অস্তিত্বের প্রমাণের উপায় সমূহ–
১. মৃত্যু
২. ভিন গ্রহবাসীর আবির্ভাব (যদি থাকে) এবং তাদের ধর্মচিন্তা
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: “মাপকাঠিরও একটি মানদণ্ড আছে।” তাহলে তা মাপকাঠি হলো কী করে!
কায়েস: ধরুন, একটি কলমের দৈর্ঘ্য মাপছেন একটি স্কেল দিয়ে, যার ফলাফল ৫ ইঞ্চি।
এখানে কতটুকু দূরত্বে ১ ইঞ্চি সেটাই মানদণ্ড। আর মাপকাঠি কেউ না কেউ তৈরি করেছে, এমনি এমনি হয়ে যায়নি।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: “আর মাপকাঠি কেউ না কেউ তৈরি করেছে, এমনি এমনি হয়ে যায়নি।”
হ্যাঁ, এটি হচ্ছে একটি আস্তিকতাবাদী যুক্তি। মাপকাঠি যেমন কেউ তৈরি করেছে যা আগে ছিল না, তেমনি সৃষ্টিকর্তা জগত সৃষ্টি করেছেন অনস্তিত্ব থেকে এবং সৃষ্টিকর্তার কোনো সৃষ্টিকর্তা নাই। কারণ, তিনি সৃষ্টিকর্তা।
আবদুল ওয়াহিদ: যুক্তি ও প্রমাণকে প্রায়শ এক করে দেখা হয়। তখন প্রমাণের সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে না। আদতে প্রমাণ সীমাবদ্ধ বিষয়। তাই এই পার্থক্যটা জেনে রাখা ভালো। তবে আরো বিষদভাবে আলোচনা হলে ভালো হতো। আশা করছি করবেন। বিশ্বাস নিজেও সীমাবদ্ধ। কিন্তু যুক্তি আর অভিজ্ঞতার আলোকে এর প্রসারণ ঘটে। যখন প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন ফিক্সড হয়ে যাওয়ার সমস্যা থাকে। তাই পরিবর্তনশীল জগতে যুক্তিকে নানান মাত্রায় ধারণ করতে হয়।
সবকিছুকেই কি জ্ঞানরূপে হাজির করতে হবে? যদি হয়, কেন? জ্ঞানতত্ত্বের টেক্সটে ধর্মীয় জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, নৈতিক জ্ঞান এমন কিছু টার্ম ও তার ব্যাখ্যা আছে। যদি প্রচলিত সংজ্ঞার কথা বলা হয়। যার ভুলভাল নিয়ে গ্যাটিয়ার সমস্যার মতো নানা কেচ্ছা আছে। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান দুরূহ। এখানে প্রশ্ন হলো, প্লেটোর সংজ্ঞায়িত জ্ঞানের সীমা এবঙ বৈধতা কতটুকু। এই বিষয়টির মীমাংসা দরকার। জ্ঞান স্বরূপত নৈর্ব্যক্তিক হলেও এর প্রকাশ আত্মগত। জ্ঞান ঐতিহাসিক বা স্থান-কালে বিরাজ করে ।
ধর্মীয় জ্ঞানের নিশ্চিয়তা মোটাদাগে দৃঢ় প্রত্যয়। বিশ্বাস আর ঈমানের মধ্যকার ফারাকটা বিচার করা দরকার। যেমন ইংরেজিতে বিলিফ আর ফেইথ একই জিনিস নয়। তাই প্রশ্ন জাগে, ঈশ্বর থাকা না থাকা আসলেই জ্ঞানের বিষয় কিনা। অথবা ঘুরিয়ে বললে, ঈশ্বরের থাকাকে জ্ঞান আকারে দেখাতে প্রচলিত সংজ্ঞা পর্যাপ্ত কিনা?
কুরআন হলো নিদর্শন। এই বিষয়টা না বুঝলে বিপদ। সেটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ব্লগে আস্তিক-নাস্তিকের যে বিতর্ক সেখানে কুতর্ক বেশি। হ্যাঁ, এতে ক্যাটাগিরক্যাল মিসটেক আছে, এর বাইরে এসে চমৎকার কিছু কথা বললেন। আশা করছি ভবিষ্যতে আরো চমৎকার লেখা পাবো।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: জ্ঞান প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা মাত্র, যদিও পরবর্তীতে এই ধারণা মাত্রকে প্রাসঙ্গিক যুক্তির ভিত্তিতে জ্ঞান হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এখানে প্রমাণ (যাকে আমি তথ্য বলেছি) থাকে সামান্যই, অংশত। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।