হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে না। তারা মূর্তি বা প্রতিমার অবয়বে দেবতা বা দেবীর পূজা করে। এবং এর মাধ্যমে তারা ঈশ্বরেরই আরাধনা করে। মূর্তিকে মন্ত্রপাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে আবহন করার পরে, তারা মনে করে, মূর্তির মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেবতার বা দেবীর অধিষ্ঠান ঘটে। তখন উক্ত প্রতিমা সাক্ষাৎ দেবতা বা দেবী হয়ে উঠে। তখন তাকে তারা পূজা-অর্চনা করে। পূজা সম্পন্ন হলে তারা স্বয়ং দেবতা বা দেবীকে বিসর্জন দেয় না। বরং দেবতা বা দেবীর মূর্তিটাকে বিসর্জন দেয়।

সনাতনী ধর্মের অনুসারীদের সাথে কথা বলে এটি জেনেছি। মুসলমানদের সাথে কথা বলে দেখেছি, আবহনের এই তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে তারা সঠিক জানে না।

অপরদিকে, মুসলমানেরা কাবা ঘরকে দোয়া কালাম পড়ে বা কোনোভাবে আবহন করে না। তারা মনে করে না, খোদা এক সময়ে বায়তুল মোকাদ্দেসে ছিলেন। পরে কাবার মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছেন। মুসলমানদের বিশ্বাস, দুনিয়ার সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। ‘আল্লাহর ঘর’ মানে, আল্লাহ এখানে থাকেন বা অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন, এমন নয়।

বরং আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করার এটি খাস জায়গা। ব্যাপারটা এমন নয় যে এর বাইরে আল্লাহর এবাদত করা যাবে না। নাপাকি না থাকা সাপেক্ষে দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় নামাজ পড়া বিধিসম্মত। মুসলমানেরা মনে করে, খোদা জগতের বাইরে ‘আরশে’ সমাসীন আছেন। তবে চেয়ারে কারো বসে থাকা বলতে যা বুঝায়, খোদার আরশে আসীন থাকা সে রকম কিছু নয়।

তাহলে, কেমন সেই থাকা?

এর হালত বা প্রকৃত অবস্থা কেউ জানে না। কারো পক্ষে জানা সম্ভব না। সৃষ্ট হিসেবে বস্তুগতদিক থেকে অস্তিত্বশীল কোনোকিছুর সাথে খোদার সত্তাগত কোনো তুলনা হয় না। তিনি অদ্বিতীয় ও অনন্য।  জগতের সর্বত্র তাঁর ক্ষমতা বিরাজমান, অথচ তিনি জগতের ঊর্দ্ধে। ইংরেজীতে in beyond বা transcendental বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই।

হিন্দু ধর্মমতে দেব-দেবীরা ঈশ্বর বা ব্রহ্মা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত। মুসলমানদের কাছে ফেরেশতারা সেরকম কিছু নন। ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুম পালন করে। কোনো কিছু স্যাঙ্কশান করার ক্ষমতা তাদের নাই। মুসলমানেরা তাই সরাসরি খোদার কাছেই প্রার্থনা করে।

মুসলমানদের তাওহীদ বিশ্বাসের এই মৌলিক দিকগুলো সম্পর্কে হিন্দুরা সঠিক ধারণা রাখে না। তাই তারা কাবাকে মূর্তির সাথে তুলনা করে। হজের সময় মুসলমানেরা শয়তানকে পাথর মারে। কিন্তু তারা এটি মনে করে না যে উক্ত স্তম্ভটি স্বয়ং শয়তান বা শয়তান এর মধ্যে অধিষ্ঠিত। আবহন জাতীয় কিছু না থাকার কারণে পুরো ব্যাপারটা নিতান্তই সিম্বলিক।

ইদানীং এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে হতে পারে, গতকাল কেউ একজন জানতে চাইলেন—

আল্লাহকে আল্লাহ হিসাবে না মানলে সেটা কি শির্ক হয়? শিরক ও কুফুরি করার জন্য আল্লাহকে আল্লাহ হিসাবে জানা কি জরুরী? না জেনে শিরক কিংবা কুফুরি করলেও কি গোনাহ হয়? কেউ যদি আল্লাহকে আল্লাহ হিসেবে না মানে তাহলে সে কার সাথে শরিক করছে? যদি আল্লাহকে না জানে তাহলে অস্বীকার কাকে করছে যে কুফুরি হবে?

আমি বলেছি—

‌‘আল্লাহ’ একটা শব্দ। এবং একই সাথে একটি পরিভাষা। অধিকতর সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত শব্দকে আমরা পরিভাষা বলি, আমরা জানি।

অপরাপর সব পরিভাষা এবং শব্দের মত আল্লাহ শব্দটিরও কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে।

মুসলিমগণ যখন ‌‘আল্লাহ’ কথাটা বলে তখন এই শব্দটির দ্বারা আল্লাহ তাআলার যেসব জাত ও সিফাতের কথা ইসলাম বলে সেগুলো সামগ্রিকভাবে নির্দেশিত (claimed) হয়।

যেসব বৈশিষ্ট্য আল্লাহ শব্দের সাথে ইসলামিক সেন্সে খাস বা সুনির্দিষ্ট, সেই বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনো একটাকেও যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে সম্পর্কিত করা হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে তা হবে আল্লাহর সত্তার সাথে অংশীদারিত্ব বা শির্ক।

অনুরূপভাবে, আল্লাহ শব্দ যেসব বৈশিষ্ট্যকে রিপ্রেজেন্ট করে সেই সব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো সত্তাকে কেউ যদি এড্রেস করে, যেভাবে এবং যে ভাষাতেই করুক না কেন, তাহলে সে আল্লাহকেই মেনেছে, এমনটা বলতে হবে।

এই দৃষ্টিতে, ঈমানের জন্য ক্লিয়ারকাট সেন্স এবং সেটার ডিক্লারেশন জরুরী। ভাষাগত সুনির্দিষ্টতা অপরিহার্য শর্ত নয়।  কিন্তু ঈমানের বাস্তবায়ন তথা আমলের জন্য ভাষাগত স্পেসিফিসিটি জরুরি।

বলা বাহুল্য, ইসলাম হলো ঈমানের প্র্যাকটিক্যাল আসপেক্ট বা আমল। ঈমান হলো ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের প্রথম ও মূল স্তম্ভ। হাদিসে জিবরীল থেকে এটি আমরা বুঝতে পারি।

আশা করি এই মৌলিক কথাগুলোর মধ্যে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

ইসমাঈল ইবন ইদ্রিস: আমরা কাবার উপর দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ প্রতিমার উপর দাঁড়ায় না। আমরা কাবা সামনে না থাকলেও সিজদা দিয়ে থাকি আর তারা প্রতিমা ছাড়া মাথা নামায় না।

আমরা এক কাবাতেই সন্তুষ্ট, সারা বিশ্বেই একটা। আর মূর্তি একেক এলাকাতেই একেকটা তাও বছরে বছরে পরিবর্তন হয়৷

কাবাকে কেউ সিজদা দেয় না, কাবা মুখী হয়ে আল্লাহকে সিজদা দেই আমরা। এখানেও আছে তফাত।

কাবা মুখী সিজদার কথা আছে কুরআন সুন্নাহতে, তবে মূর্তিকে সিজদা দেয়া তাদের কিতাবেই নিষেধ।

আর কী কী বলবো? বলেন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: মানুষ যখন দাঁড়ায়, কোনো না কোনো দিকে দাঁড়ায়। একটা বাহিনী যখন দাঁড়ায় তখন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর অপরিহার্য শর্ত হলো সুনির্দিষ্ট দিক নির্ণয় করে দাঁড়ানো।

বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে যদি লোকজন একটা একক সমাবেশ হিসেবে দাঁড়াতে চায়, তখন তারা নির্দিষ্ট একটা কিছুকে কেন্দ্র করেই দাঁড়াবে। এই সিম্পল ব্যাপারটা বুঝলে, মুসলমানেরা কেন কাবাকে কেবলা করে দাঁড়ায়, তা নিয়ে আর ভুল ধারণা থাকার কথা না।

মোহাম্মদ শাহ আলম: পার্বনিক মূর্তিগুলো পূজার উদ্দেশ্যে যখন তৈরী হয়, পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরু, পাদমূলে নৈবেদ্য রাখা, প্রসাদ রাখা, দেব/বী তুষ্টির জন্য ক্রিয়াদি – নৃত্য, গীত, বাদ্য, মন্ত্র যপ ইত্যাদির আগে মূর্তিতে দেবীর অধিষ্ঠানের জন্য মন্ত্রপাঠ করা হয়।

বিশেষ বিশেষ দেব-দেবীর বিশেষ বিশেষ ক্ষমতায় বিশ্বাস করা হয়, এবং সে জন্য সে দেবদেবীর আরাধনা করা হয়। শারদীয় দূর্গাপূজা ক্ষত্রীয় পূজা। দূর্গার কাছে ক্ষাত্র শক্তি কামনা করা হয় যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত্রুর বিনাশ সাধনের জন্য। শ্রীরামচন্দ্র রাবন বধে সফল হবার জন্য শরৎকালে দূর্গার কাছে আরাধনা করেন। অন্যথায় দূর্গা পূজা বাসন্তী পূজা, বসন্তকালে হয়ে থাকে।

স্বরসতীকে বিদ্যা ও বাগদেবী মানা হয়। সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বরসতী পূজা করা হয়। লক্ষ্মীকে ধনের দেবী। গণেশ বানিজ্য দেবতা।

মুসলিমরা কাবাঘরের এমন কোনো ক্ষমতা বা গুণ আছে বিশ্বাস করে না। নামাজ পড়ার সময় নামাজের সামনে কাবার অনুকৃতি করে কোনো বস্তু রাখে না।

নামাজ পড়তে হলেতো যে কোনো একদিকে মুখ করে দাঁড়ানো দরকার এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য একটা কেন্দ্র নির্দিষ্ট করা দরকার। কাবা এর বেশী কিছু না। মক্কার এই ঘরমুখী হয়ে নামাজ পড়ার আগে জেরুজালেমের গোল্ডেন টেম্পল বা বায়তুল মোকাদ্দেসের অভিমুখী হয়ে দাঁড়ানো হতো।

কাবামুখী হয়ে নামাজ পড়ার সাথে প্রতীমা পূজার তুলনার কোনো যুক্তি নেই।

রাসেল মিয়া: ঘটনা একই রকম! মানুষ তো মানুষই। জাত ধর্ম একটি ঝগড়া ও ঘৃণার নাম।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ঘটনা যে একই রকম নয়, তা-ই আমি বলতে চেয়েছি। দুটি বিষয়কে যখন আমরা পৃথক করি তখন আমরা সে দুটির মধ্যে সাবস্ট্যান্সিয়াল ডিফারেন্সকে ফোকাস করি, সিমিলারিটিকে নয়।

এ’ ক্ষেত্রে আবাহনের ব্যাপারটা মোস্ট সিগনিফিকেন্ট।

হিন্দুরা মনে করে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। মুসলমানেরা মনে করে ঈশ্বরের ক্ষমতা একক ও অবিভাজ্য এবং জগতের সবকিছু—ইন্টারনালি এবং এক্সটার্নালি—তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধীন।

রাসেল মিয়া: ধর্মগুলোর একটা জিনিসই আমার খারাপ লাগে, নিজের মান ঠিক রাখতে বাকি সবগুলোকে ভুয়া মনে করে।

মুহাম্মদ সামিউল ইসলাম: বাকি সবগুলো যদি সঠিক মনে করে তবে নিজের ধর্মটা সঠিক হবার কোনো কারণ থাকে না।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: রাসেল মিয়া, ধর্ম হোক, বিজ্ঞান হোক বা দর্শন হোক, সত্য কিন্তু সব সময়েই একক সত্তা। দুয়ে দুয়ে চারই হবে। অন্যসব দাবী ভুল। একই সাথে খোদা আছেন আর খোদা নাই, অথবা একই সাথে খোদা এক এবং বহু, এমন কথা বলা সেলফ-কন্ট্রাডিকটরি।

হ্যাঁ, হতে পারে, কোনো বাস্তব সত্য সম্পর্কে কারো বিবৃতি ভুল, অসম্পূর্ণ অথবা খণ্ডিত। সেটা ভিন্ন বিষয়।

বাস্তবে কেউ একই সাথে জীবিত ও মৃত হতে পারে না, যদিও শ্রোইডিংগারের বিড়াল পরিসংখ্যানের হিসেবে একইসাথে ৫০% জীবিত এবং ৫০% মৃত হতে পারে।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *