একজন ছাত্র। জীবন আর সৃষ্টিকর্তার সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন মনে। যাকে দেখে, তাকেই জিজ্ঞেস করে। কেউই উত্তর দিতে পারে না। হঠাৎ একদিন দেখা হলো এক বিশ্বাসী-জ্ঞানীর সঙ্গে। বলল-
প্রথম প্রশ্ন : ‘খোদা কি আছেন? যদি থাকেন, তাকে দেখাতে পারবেন?’
২নং প্রশ্ন ‘অদৃষ্টলিখন বা ভাগ্য মানে কি?’
৩নং প্রশ্ন ‘শয়তানের দেহ তো আগুন দিয়ে তৈরী। শয়তানকে যদি দোজখের আগুনে রাখা যায় সে তো কোন ব্যথা পাওয়ার কথা না, ব্যথা পাবে না – তাই না?’
প্রশ্ন তিনটি শুনে বিশ্বাসী-জ্ঞানী ব্যক্তিটি তাকে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিলেন। চপেটাঘাত খেয়ে যুবক বলল:
– আমাকে মারলেন কেন? আপনার কি মাথা ঠিক আছে?
– আমার মাথা ঠিক আছে। এটা হলো তোমার প্রশ্নের উত্তর।
– মানে?
– আমি যখন তোমাকে থাপ্পড় দিয়েছিলাম তুমি কী অনুভব করেছিলে?
– হ্যাঁ, বেশ ব্যথা পেয়েছিলাম।
– তার মানে তুমি বিশ্বাস করো যে ব্যথা আছে?
– হ্যাঁ।
– তুমি আমাকে ব্যথা দেখাতে পার?
– না।
– এটা হলো তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর।
– যুবক হতবাক। এবার তিনি বললেন, তুমি কি গতরাতে কি আদৌ ভেবেছিলে যে আমি তোমাকে চড় মারব?
– না।
– তুমি কি কোনদিন চিন্তা করেছিলে যে তোমার মতো ছেলেকে কেউ এ রকম বিনা কারণে চড় মারতে পারে?
– না।
– এর নাম হলো ভাগ্য বা অদৃষ্টলিখন।
ছাত্রটি একদম হতভম্ব হয়ে গেল। এবার তিনি বললেন,
– আমি যে হাত দিয়ে তোমাকে মেরেছিলাম, সেটা কী দিয়ে মোড়ানো?
– চামড়া দিয়ে
– তোমার মুখ কি দিয়ে মোড়ানো?
– চামড়া দিয়ে
– তাহলে তুমি ব্যথা পেলে কেন?
এটা হলো ৩নং প্রশ্নের উত্তর।
শুধুমাত্র এই সিম্পল কোয়েশ্চন-এনসারকে এনালাইসিস করে অভিজ্ঞতাবাদ, বুদ্ধিবাদ ও স্বজ্ঞাবাদের মধ্যকার ‘বিরোধ’ মীমাংসা এবং এ সবের মাধ্যমে বস্তুবাদকে খুব সহজেই ভোগাস প্রমাণ করা যায়।
বস্তু-অতিরিক্ত ‘কিছু একটা’ আছে বলেই ‘বস্তু’, বস্তু হয়ে উঠে। এই ‘কিছু একটা’কেই আমরা মন বলি। মন বস্তু নিয়ে কাজ করে। এতে বিভ্রান্ত হয়ে বস্তুবাদীরা বলে, মন=মস্তিষ্ক=বস্তু ।
বস্তুবাদীরা বস্তুবাদে ‘বিশ্বাস’ করে। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে যে, তারা আদৌ (বস্তুবাদ বা অনুরূপ কোনো কিছুতে) বিশ্বাস করে না…!! তারা বিশ্বাস করে যে তাদের কাছে স্বীয় বিশ্বাসের পক্ষে ‘প্রমাণ’ আছে। প্রমাণই যদি থাকে তাহলে প্রমাণে বিশ্বাস করতে হয় কেন?
তারা মনে করে বিশ্বাস-এর কোনো বিশ্বাস নাই। সবই বস্তুর খেলা। কিন্তু খেলাটা খেলা হয়ে উঠে ‘খেলোয়াড়-মন’ ও ‘দর্শক-মনে’র মাধ্যমে। লুডু খেলায় সব ঘুটি লুডুর ঘরেই থাকে। এর ঘুটিগুলোর নির্দিষ্ট অবস্থানের বস্তুগত মাপের সাথে জয়-পরাজয়ের কোনো ব্যাপার নাই, যদি না খেলার নিয়ম হিসাবে সেসব আমরা ঠিক করি। তাই না?
বিশ্বাস হলো এক অমোঘ ব্যাপার। এর থেকে নিস্তার নাই। ‘বিশ্বাস করি না’ বলেও কেউ কোনো কিছুতে ‘বিশ্বাস’ করতে পারে। বরং কোনো না কোনো কিছুতে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।
যেমন বস্তুবাদীরা বিশ্বাস করে যে, বস্তুর অতিরিক্ত ‘কিছু’ নাই। যদিও ‘কোনো কিছু’ না থাকার ব্যাপারে বস্তুগতভাবে যা যা তাদের দেখা দরকার তা তারা শেষ পর্যন্ত দেখে নাই। কেউ তো আর জগতের বাইরে যেতে পারে না, যদিও সবাই-ই জগত সম্পর্কে কিছু না কিছু মনে (অর্থাৎ বিশ্বাস) করে। এমনকি যারা জগতকে মায়া মনে করে তারাও ‘মায়া হিসাবে’ জগতের অনিবার্যতা ও এর উপর বিশ্বাস করার বাইরে যেতে পারে না।
অভিজ্ঞতা অর্জন বা দেখার তো কোনো শেষ নাই। আস্তিক-নাস্তিক সবাই স্বীকার করে যে, জগতটা আমাদের দেখার চেয়েও অনেক বড়। জগত সম্পর্কে আমরা ভাবি, চিন্তা করি। এবং সেটা আমাদের দেখা বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই।
ব্যাপার হলো আমাদের দেখার বাইরে ‘কোনো কিছু’ – হোক সেটা ব্যক্তি-মন বা ঈশ্বর – আছে বা নাই বলার জন্য নিছক দেখাটা আমাদের পক্ষে যথেষ্ট নয়। এজন্য চিন্তা করতে হয়, অনুমান করতে হয়। সহজ কথায় বিশ্বাস করতে হয়।
বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত ভরসা। প্রমাণটাও দিনশেষে আদতে বিশ্বাসই বটে।
সিম্পল ব্যাপার হলো, আপনি যখন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পানির টেপটা খুলে দেন তখন আপনি জ্ঞানত নিশ্চিত থাকেন যে, পানিই পড়বে এবং তা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরম হবে না। একেবারে বিশুদ্ধ বা খুব ময়লা হবে না। এটি যে গোসলেরই পানি, আপনি তা আগেভাগে টেস্ট করেন না।
এভাবে পূর্ব-যাচাই বা টেস্ট করতে থাকলে আপনার-আমার জীবন ও জগত অচল হয়ে পড়বে।
কিছুটা অভিজ্ঞতার সাথে অনেকটা ধরে নেয়া বা বিশ্বাসকে মিলিয়ে (বা গুলিয়ে?) আমরা ‘জ্ঞান’ উৎপন্ন করি। বিশ্বাসের ভিত ও সীমানা ছাড়া যে কোনো জ্ঞান-এর দাবি শুন্য, void, বাতিল ও মিথ্যা। we have to believe to live, no matter what we believe.