আমাদের দিক থেকে মানে from worldly perspective, from human context, বস্তুগত এনটিটি মাত্রেরই যেমন কোনো না কোনো আকার থাকে। খোদা যেহেতু বস্তু নন, তাই সেভাবে খোদার কোনো আকার নাই। সে অর্থে খোদা হলেন নিরাকার। অর্থাৎ সৃষ্ট জগত ও জগতস্থ কোনো সত্তার জন্য আকারসম্পন্ন হওয়ার যে বাধ্যবাধকতা, সে ধরনের সীমাবদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত।

খোদা সম্পর্কে আমরা শুধু এটুকু জানি, তিনি তাঁর মতো করে অস্তিত্বশীল। আমাদের দিক থেকে খোদাকে আমরা জানি তাঁর সিফাত তথা আমাদের জন্য প্রযোজ্য তারঁ গুণবাচক বৈশিষ্ট্যসমূহের মাধ্যমে। খোদার দিক থেকে খোদার স্বগত বৈশিষ্ট্য বা জা’ত কী বা কেমন তা আমরা আদৌ জানতে পারি না।

কেননা, সসীম কখনো অসীমকে সঠিকভাবে জানতে পারে না; অসীম আছে, শুধু এটুকু জানা ছাড়া। সসীম কখনো অসীমের স্বরূপ জানতে পারে না। সসীমের পক্ষে অসীমের অস্তিত্বকে জানা সম্ভব, সসীম সত্তার সসীমত্বের যৌক্তিক অপরপক্ষ বা লজিক্যাল বাইনারি হিসেবে। অন্টলজিক্যাল নেসেসিটি হিসেবে।

যারা বলে, খোদার আকার আছে, কিন্তু সেটার স্বরূপ আমরা জানি না, তারা আকারের সাথে অস্তিত্বকে একাকার করে ফেলে। তাদের কথাবার্তার আন্ডারলাইয়িং এসাম্পশান হচ্ছে, existence ও form— এই দুইটা নোশন সদাসর্বদা এক ও অভিন্ন তথা identical হবে। মাস্ট।

এটি তাদের ভুল ধারণা। তারা অধিবিদ্যাগত সত্তার (metaphysical entity) সাথে বস্তুগত সত্তার (physical entity) পার্থক্য বুঝতে ভুল করেন।

ফিজিক্যাল এনটিটির অস্তিত্ব থাকে আকারের মোড়কে বা অবয়বে। কিন্তু পিউর মেটাফিজিক্যাল এনটিটির কোনো ফিজিক্যাল ফর্ম থাকে না। যেমন, গণিতের বিশুদ্ধ ধারণাসমূহ। খোদাকে যদি আমরা এরিস্টটলের মতো করে matter-less pure form বলে মনে করিও, তাহলেও তা হবে form বলতে আমরা সাধারণত যা মনে করি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও ব্যতিক্রমী কিছু। সামথিং ইউনিক।

সে অর্থে বললে বলতে হয়, খোদা হলেন একটা ‌‘আকারহীন আকার’। তো, ‌‘আকারহীন আকার’ বলার চেয়ে নিরাকার বলাই তো শ্রেয়। শুধু শুধু মানুষদেরকে কল্পনা ও চিন্তার দ্বন্দ্ব-সংকটে ফেলে দেয়ার চেয়ে মানুষ যেভাবে বুঝে সেভাবেই তাদেরকে বলা উচিত বলে আমি মনে করি। কোরআনে সেভাবেই বলা হয়েছে। সূরা ইখলাসের বর্ণনাকে যদি আমরা বেইজ হিসেবে ধরি।

মানুষ ভুল করে খোদাকে বস্তুগত রূপে কল্পনা ও আরাধনা করে। ইসলামে যাকে শিরক বলা হয়েছে। পরমসত্তাকে মানবীয় বা কোনো ধরনের মূর্তি বা রূপে কল্পনা, ধ্যান ও অর্চনা না করার কথা সিরিয়াসলি বলা হয়েছে। এবং বিকল্প হিসেবে তাওহীদের ধারণা দেয়া হয়েছে। খোদার আকার থাকা না থাকার বিতর্কে এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় থাকলে ‌‘খোদার আকার আছে’ এমন নির্বুদ্ধিতাসম্পন্ন কথা বলার কথা নয়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার তো প্রশ্নই উঠে না।

খোদার আকার-আকৃতির বর্ণনা সম্বলিত হাদীসগুলোকে সংশ্লিষ্ট মুহকাম বা দ্ব্যর্থহীন অর্থবোধক আয়াতগুলোর আলোকে বিবেচনা করতে হবে। কিছু কিছু লোকের ধারণা, মুতাশাবিহ তথা রূপক অর্থ শুধু যেন কোরআনের আয়াতেরই হবে, যেন হাদীসের বর্ণনাগুলো সব মুহকাম।

বাস্তবতা হলো, হাদীসও এক ধরনের ওহী। কোরআনের আয়াত হিসেবে সংকলিত ওহীগুলোর মতো হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) তথা অপঠিত ওহীসমূহের মধ্যেও রয়েছে মুতাশাবিহ হাদীস। থাকাটাই স্বাভাবিক। রাসূলুল্লাহ (সা) সেগুলো বর্ণনা করেছেন, যেভাবে কোরআনের রূপক অর্থবোধক আয়াতগুলোও তিনি বর্ণনা করেছেন। এগুলোর স্বরূপ তিনি জানতেন কিনা, তা আমরা জানি না।

মুতাশাবিহ আয়াতের অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। বলাবাহুল্য, গায়েবের কোনো বিষয় আল্লাহ চাইলে কাউকে জানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে সেটি তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট ‌‘অজানা’ হিসেবে গণ্য হবে না, যদিও তা অন্যদের কাছে তখনো গায়েব তথা transcendental হিসেবে গন্য হবে। মুসার (আ) কাছে যা ছিল গায়েবের বিষয়, খিজিরের (আ) কাছে তা ছিল জানা বিষয়। তেমনি করে, রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে কোনো কোনো বিষয় অলরেডি জানা হতে পারে, যা আমাদের কাছে গায়েবের বিষয়।

আল্লাহর আকার থাকা সংক্রান্ত হাদীসগুলো বর্ণনা করার সময়ে সেগুলোর গূঢ় অর্থ আল্লাহর রাসুল (স.) কতোটুকু জানতেন, সে সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রশ্নকে আমরা কীভাবে ডিল করবো, তার পথ বাতলানোর জন্য উপরের ৩টি প্যারায় কিছু কথা বললাম।

এ বিষয়ে আপাতত সবশেষ কথা হলো, আকীদাগত গ্রস মিসটেক যেমন ভয়াবহ রকমের খারাপ, তেমনি শুদ্ধতার নামে আকীদার শাখা-প্রশাখা খুঁজে খুঁজে সেগুলো নিয়ে রাতদিন চর্চা করাও মারাত্মক রকমের ক্ষতিকর। এ ধরনের অতি ধার্মিকতাসুলভ পিউরিটানিজম থেকে মুক্ত থাকা জরুরী।

‍[“আল্লাহ দেখতে কেমন? তাঁর কি হাত, পা, শরীর ও আকার আছে? ঈশ্বর কি নিরাকার?”— ইউটিউবের ‌‘যুক্তি ও জীবনচ্যানেলে সপ্তাহ তিনেক আগে আপ করা সংক্ষিপ্ত এই ভিডিওতে mehedi hasan যে প্রশ্ন করেছেন, তার উত্তরে এটি একটু আগে লিখেছি এবং সেখানে রিপ্লাই হিসেবে দিয়েছি। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে আগ্রহীদের জন্য এটি এখানেও দিলাম।]

পরবর্তী পর্ব

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *