গত পর্বে আমি অধিবিদ্যাগত বাস্তবতা (metaphysical reality) এবং বস্তুগত বাস্তবতার (physical reality) ভিন্নতা নিয়ে কথা বলেছি। দ্বিরুক্তি করে বললে, যা কিছুর বস্তগত বাস্তবতা আছে তার অধিবিদ্যক বাস্তবতাও আছে। যেমন, যা বাস্তবে আছে তা সম্ভাবনা হিসেবেও আছে বা ছিল। পটেনশিয়ালি বা সম্ভাব্য হিসেবে ছিল বলেই তা উপযুক্ত সময় ও পরিবেশে actualize হতে পেরেছে। কিন্তু কোনো কিছু মেটাফিজিক্যালি থাকলে তা বস্তুগতভাবেও থাকবে, বা মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিটির একটা বস্তুগত ফর্ম থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নাই।
আল্লাহর কি আকার আছে? অথবা, তিনি কি নিরাকার? এই প্রশ্ন ও বিতর্ক প্রসঙ্গে আমার উপর্যুক্ত (ও নিম্নোক্ত) কথাগুলো কেউ যদি না বুঝেন তাহলে তিনি আমার কথার মর্ম বা বেসিক পয়েন্টটাই ধরতে পারবেন না।
সংবেদন ও প্রত্যক্ষণ
যখন আমরা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কোনো ‘কিছু’কে পাই তখন তা সংবেদন বা sensation। যেমন, আমরা যখন একটা কলমকে দেখি, তখন কলম থেকে আমরা যে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত পাই তা হলো সংবেদন। আমাদের সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় এই সংবেদকে ধারণ করার পরে নানা ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন তা আমাদের মস্তিষ্কে জ্ঞান উৎপন্ন করার জন্য উপস্থাপিত হয় তখন সেটাকে বলা হয় প্রত্যক্ষণ বা perception। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: গম হলো সংবেদন, খামি হলো প্রত্যক্ষণ, রুটি হলো জ্ঞান। ভাত-রুটি খাওয়া যদি হয় সংবেদন, সে ক্ষেত্রে ভাত-রুটি থেকে আমাদের রক্তে যে পুষ্টি তৈরী হয় তা হলো প্রত্যক্ষণ।
যখন আমরা একটা কলমকে দেখি তখন কলম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান উৎপন্ন হয়। তো, কলমটা তো বাইরেই থেকে যায়। কলমটার থেকে পাওয়া কিছু উপাত্ত যখন আমাদের ব্রেইনে উপস্থাপিত হয় তখন আমরা বুঝতে পাারি, বাহিরে একটা ‘বস্তু’ আছে এবং স্মৃতি, বুদ্ধিসহ নানা ধরনের স্ট্যান্ডার্ডের সাথে মিলিয়ে আমরা ‘জানতে পারি, বাহিরের এই বস্তুটি হলো আমাদের চেনাজানা অমুক ক্যাটাগরির একটা জিনিস, এবং এ ক্ষেত্রে তা হলো ‘কলম’।
আমাদের প্রত্যক্ষণের আদি রূপ তথা সংবেদনের উৎস হিসেবে বাহিরের জগতের বস্তুটির স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে কিনা, তা নিয়ে ফিলসফিতে দুটি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব আছে: বাস্তববাদ (realism) ও ভাববাদ (idealism)।
আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে বাইরে কোনো কিছু আদৌ নাই, কিন্তু কেন জানি কীভাবে আমার জ্ঞানকেন্দ্র তথা মস্তিষ্কে সেই জিনিসটা সত্যিই থাকলে যে ধরনের প্রত্যক্ষণ আমার হতো, হুবহু সেই perception-ই তৈরি হয়ে গেছে; অথবা, আমার অজান্তেই কেউ এমন আইডেন্টিক্যাল পারসেপশান আমার মধ্যে পুশ করে দিয়েছে? তখন কিন্তু আমি জাস্টিফায়েবলি মনে করবো, আমি সত্যিই সেই জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি। যেমন করে, কোনো কিছু হাজির থাকা সত্ত্বেও সেটাকে perceive করতে না পারার কারণে আমি যুক্তিসংগতভাবেই মনে করি, সে জিনিসটা আদৌ নাই।
ভাববাদীদের মতে, কোনো কিছু সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষণ থাকাটাই মূল কথা, বাস্তবে সেটি আছে কিনা, তা মুখ্য বিষয় নয়। অপরদিকে, বাস্তববাদীদের মতে, কোনো কিছু by-itself অস্তিত্বশীল হলেই তবে আমরা সেটা সম্পর্কে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণ তথা জ্ঞান লাভ করতে পারি। ইন আইদার সিচুয়েশান, আমরা ‘কোনো কিছু’ সম্পর্কে আমাদের সংবেদন-উপাত্ত ও প্রত্যক্ষণকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি। এগুলোর ভিত্তিতে আমরা অনুমান করি, বাইরের জগত বলে কিছু একটা আছে, নচেৎ আমরা এই ডাটাগুলো কোত্থেকে পেয়ে থাকি?
কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো বাইরের জগতে বাস্তবে নাই, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও সেগুলোকে জাগতিক বাস্তবতার চাইতেও অধিকতর বাস্তব হিসেবে আমরা গ্রহণ করি। সেগুলো আমাদের conceptual construct। একটু আগে যেগুলোকে আমরা মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিটি হিসেবে বলেছি।
যেমন, জগতে নৈঃশব্দ বা সাইলেন্স বলে কোনো কিছু ফিজিক্যালি বা সায়েন্টিফিক্যালি নাই। আমার শুনতে না পেলে বলি silence is there। তেমন করে, জগতে সমতল বা প্লেইন বলে কোনো সারফেইস বা তল নাই। আমাদের সাবজেক্টিভিটির প্রেক্ষাপট হতে আমরা কোনো সারফেইসের বক্রতা নির্ণয় করতে না পারলে বা কাজের সুবিধার জন্য উপেক্ষা করলে তখন সেটাকে সমতল হিসেবে মনে করি।
যেমন, জাগতিক বাস্তবতায় বা বস্তুগতভাবে ‘নাই হয়ে কোনো কিছু থাকে না’। আছে তো আছে। নাই তো নাই। অথচ, গণিতে ব্যবহৃত নেগেটিভ নাম্বারগুলোকে আমরা কল্পনা করি ‘নাই হয়ে থাকা’ কিছু বাস্তবতা হিসেবে। বাস্তবে তথা বস্তুগতভাবে শূন্য বলে কিছু নাই। বিশুদ্ধ শূন্যতা হলো আমাদের ধারণাগত বাস্তবতা বা মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিটি। তেমনি করে অসীমের ধারণাও একটা মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিটি।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিটিগুলো না থাকলে ফিজিক্যাল রিয়ালিটির কোনো অস্তিত্ব বা বৈধতা থাকে না। আমরা জানি, সায়েন্স বায়াসড এবং রিলিজিয়ন বায়াসড, এই উভয় পক্ষ পরস্পর জানি দুশমন। অথচ, মেটাফিজিক্সকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার ব্যাপারে উভয়পক্ষ সমানভাবে আগ্রহী। উভয় পক্ষই নিজেদের সুবিধানুযায়ী ফিলসফিকে ইউজ করে। যদিও তারা মূলত ফিলসফির বিরোধী। অথচ, বাস্তবতা হচ্ছে, বিজ্ঞান হয়ে দর্শন, দর্শন হয়ে ধর্ম, এভাবেই মানুষের জীবনবোধ গড়ে উঠে।
সে যাই হোক।
এইটুকু ফিলসফিক্যাল আইডিয়ার সাথে যদি আপনি ইতোমধ্যে একমত হয়ে থাকেন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন, খোদা হলেন আমাদের জন্য একটি শুদ্ধতম অধিবিদ্যাগত বাস্তবতা। অধিবিদ্যাগত বাস্তবতার সীমানা হতে খোদাকে বস্তুগত বাস্তবতার মধ্যে টেনে আনা হলো অবতারবাদ, মূর্তিপূজা কিংবা সর্বেশ্বরবাদ। অন্যান্য ধর্মে যা আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে যা পরিত্যাজ্য। ভুল।
বস্তুগত বাস্তবতাকে আমরা জীবনধারণের জন্য কাজে লাগাই এবং এই ধরনের জাগতিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হতে আমরা খোদার অস্তিত্বগত অধিবিদ্যক জ্ঞানের স্তরে উপনীত হই। এবং জাগতিক যে কোনো কিছুর জ্ঞান হতেও একে অধিকতর নিশ্চিত হিসেবে গ্রহণ করি। ঈমান আনা বলতে যা বোঝায়।
এ ব্যাপারে পরবর্তী কথা হলো, কোরআন-হাদীস যদি উৎকৃষ্টমানের সাহিত্য হয়ে থাকে, তাহলে তাতে সাহিত্যে ব্যবহৃত উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদির যথোচিত ব্যবহারও থাকার কথা। বলাবাহুল্য, আমরা জানি, এ ধরনের আলঙ্কারিক বিষয়াদির সুনিপুণ ব্যবহার, বিশেষ করে, কোরআনের মধ্যে লক্ষ করা যায়। সেক্ষেত্রে এ ধরনের অ-প্রত্যক্ষ অর্থবোধক বর্ণনার কোনো বিষয় যদি কোরআনেরই অপরাপর প্রত্যক্ষ অর্থবোধক বর্ণনাকে অপোজ করে, তাহলে আমরা সহজ সরলভাবে অনুধাবনযোগ্য ওয়ান-টু-ওয়ান মিনিং সম্বলিত বর্ণনাটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে নিয়ে এর সাথে সাংঘর্ষিক বর্ণনাগুলোকে রূপক অর্থে বলা হয়েছে বলে ধরে নিবো। সূরা আলে ইমরানের শুরুতে মুহকাম ও মুতাশাবেহ আয়াতের পার্থক্য নিয়ে ঠিক এই কথাগুলোই কোরআনে বলা হয়েছে।
বেহেশতের ফলগুলো দেখতে দুনিয়ার ফলের মতো মনে হলেও এর স্বাদ হবে অকল্পনীয় ভালো। এক্ষেত্রে আমরা অন্তত এটি বুঝতে পারি, স্বাদে অতুলনীয় হলেও ক্যাটাগরি হিসেবে তা ফল শ্রেণিরই অন্তর্গত। এভাবে কোনো কিছুর গুণগত উৎকর্ষতা সম্পর্কে সঠিক আন্দাজ করতে না পারলেও আমরা বুঝতে পারি, এটি হলো ওই ক্যাটাগরির জিনিস। এইভাবে শ্রেণিবিন্যাসকরণ বা categorization-এর মাধ্যমে আমরা সেই জিনিসটাকে একটা বস্তুগত ও জ্ঞানগত সীমানার মধ্যে সীমিত করে সেটিকে আমাদের জ্ঞান-ভাণ্ডারে সামিল করে নেই। এটি অনিবার্য। মানুষের চিন্তার ধরনটাই এমন সুনির্দিষ্ট বাইনারি ফরমেটের। law of identity এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ল অব আইডেন্টিটি হলো, কোনো শর্ত বা প্রেক্ষাপট পরিবর্তন ছাড়া কোনো কিছু একই সাথে সত্য ও মিথ্যা হবে না, একই সাথে বৈধ ও অবৈধ হবে না, একই সাথে অস্তিত্বশীল ও অনস্তিত্বশীল হবে না।
“আল্লাহর আকার আছে, যদিও এর স্বরূপ আমরা জানি না”— এই ধরনের কথার সাথে যখন পরকালে আল্লাহকে দেখার বিষয়টিকে মেলানো হয় তখন মানব মনে সুপ্তভাবে খোদার একটা অবয়বের কল্পনা চলে আসে। যদি বলা হয়, আকার আছে, কিন্তু কোনো আকার কল্পনা করা যাবে না, তাহলে তা হবে পানির মধ্যে লবণ বা চিনি দিয়ে গলতে নিষেধ করার মতো ব্যাপার। তারমানে, অকল্পনীয় আকার আদতে আকার নয়, বরং এক ধরনের বস্তু-অতিরিক্ত বাস্তবতা বা সত্য। মেটাফিজিক্যাল বা এক্সট্রা-ফিজিক্যাল একজিস্টেন্স বলতে যা বোঝায়। কল্পনার অযোগ্য কোনো ‘আকারসম্পন্ন’ অস্তিত্বকে আকারসম্পন্ন বা সাকার না বলে, আকারহীন বা নিরাকার বলাই শ্রেয়। এতে করে ভাষাগত সহজবোধ্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকে।
‘তাঁর মতো করে আল্লাহ তায়ালার আকার আছে’— এই কথার সাথে যখন হাদীসের সংশ্লিষ্ট phenomenal বর্ণনাগুলোকে আমরা মিলিয়ে দেখি, তখন আমাদের কাছে মনে হতে পারে, খোদা হচ্ছেন যেন (নাউজুবিল্লাহ) একজন প্রবল পুরুষ। যুগে যুগে সব বাতিল ধর্ম কর্তৃক খোদাকে এভাবে একজন ডমিনেন্ট মেইল পারসন হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। খোদাকে এরকম alpha male হিসেবে মনে করাকে ইসলাম ভুল মনে করে।
তাই এ ধরনের বর্ণনাগুলোকে নিতে হবে, পরমসত্তা সম্পর্কে জানার ব্যাপারে সীমিত সত্তার ভাষাগত সীমাবদ্ধতার নিরিখে। আমাদের দিক থেকে আমরা খোদাকে জানতে পারি আমাদের পরিচিত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। আমরা বুঝবো না এমন ভাষায় যদি আমাদেরকে বলা হয় তাহলে তো আমরা কিছুই বুঝবো না। তাই আমরা খোদাকে জানি বা জানতে পারি তাঁর সিফাত তথা গুণবাচক বৈশিষ্ট্যসমূহের মাধ্যমে। অতীন্দ্রিয় কোনো সত্তা যখন ইন্দ্রিয়জ জ্ঞাননির্ভর কোনো সত্তার সাথে ইন্টারেক্ট করবেন, তখন তিনি সেই সসীম সত্তার মতো করেই নিজেকে উপস্থাপন করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। যদিও স্বরূপগতভাবে তিনি কেমন বা কী রকম তা আমাদের অজানা এবং জানার আওতা বহির্ভূত। unknowable বলতে যা বোঝায়। খোদার স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের এই sort of divine agnosticism খুবই যুক্তিসংগত।
ইসলাম যেভাবে বলে সে অনুসারে, খোদা হচ্ছেন এমন এক REALITY যিনি হলেন always in beyond। তিনি তাঁর অনুপম সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের সাথে কানেক্টেড। তিনি প্রত্যাদেশ পাঠিয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছেন। তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে হয়ে উঠেছেন বাঙময়। সুরের অন্তরালের এই সুর, দেখার অন্তরালে এই দেখা, শোনার অন্তরালের এই মর্মকথা, এগুলো যারা কনসিভ করতে পারে না, কোরআনে তাদেরকে বলা হয়েছে বধির, অন্ধ, বোবা, যদিও তাদের রয়েছে আমাদের মতো শ্রবণ ইন্দ্রিয়, যদিও তাদের রয়েছে আমাদের মতো কথা বলার শক্তি, যদিও তাদের রয়েছে আমাদের মতো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন চক্ষুযুগল।
হাশরের মাঠে তিনি তাঁর কুদরতি সক্ষমতায় আমাদের সাথে সরাসরি কথা বলবেন। এজন্য প্রাণীদের মতো করে তাঁর বাকযন্ত্র থাকার আবশ্যকতা নাই। তিনি সরাসরি সবকিছু শুনছেন। সেজন্য তাঁর কোনো ধরনের শ্রবনেন্দ্রিয় থাকার আবশ্যকতা নাই। বেহেশত ও দোযখের অনন্ত জীবনে তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে তাঁর কুদরতি সক্ষমতায় সংযুক্ত হবেন, কমিউনিকেট করবেন। তাদেরকে তিনি রহমত অথবা গযব যা দেবার দিবেন। আমরা শুধু এটুকু বুঝতে পারি, এসব কিছু সম্পন্ন করার জন্য তাঁর incarnate করা বলতে আমরা যা বুঝি সেরকম কোনো অবতার রূপে হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
বস্তুগত সত্তাসমূহের সাথে কমিউনিকেট করার জন্য তিনি বস্তু হয়ে উঠবেন না। বস্তু হয়ে উঠা ছাড়াই তিনি নিজের সম্বন্ধে বস্তুগত জ্ঞানের চেয়েও অধিকতর নিশ্চিত জ্ঞান আমাদের দান করতে পারেন। ইসলাম যে ধরনের খোদার ধারণা দেয় সে ধরনের খোদার পক্ষে এটি সম্ভব, এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বস্তুরূপে আভির্ভূত না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ‘সান্নিধ্য’ পেতে, তাঁকে দেখতে আমাদের অসুবিধা হবে না। এই দুনিয়ার জীবনেই তো আমরা এমন অনেক কিছুকে মেটাফিজিক্যালি জানি যেগুলোকে আমাদের বস্তুগত চাক্ষুষ জ্ঞানসমূহ হতেও বেশি বিশ্বাস করি, যেগুলোকে আমরা অনেক বেশি অনুভব করি আমাদের জ্ঞানের পরিমণ্ডলে ও ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের আত্মার ভিতরে। জগত ও জীবনের বৃহত্তর (ও অতীন্দ্রিয়) সত্যগুলোর বাস্তব উপস্থিতি আমাদের হৃদয়মনকে ভরিয়ে তোলে। আশা করি, এ পর্যায়ে এসে সেগুলোর আর নতুন করে বর্ণনা দিতে হবে না, যদি আপনি/আপনারা এই আলোচনার শুরুতেই মেটাফিজিক্যাল বনাম ফিজিক্যাল রিয়ালিটির সম্পর্ক ও পার্থক্য সম্পর্কে আমি যা বলেছি তা ঠিক মতো বুঝে থাকেন।
দেখেছি, কেউ কেউ মনে করে, পরজীবনে আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো তথা আমাদের ইন্দ্রিয় সক্ষমতা এতটাই বর্ধিত ও উন্নত হবে, যাতে করে আমরা আল্লাহর দিদার লাভ করতে পারি। আল্লাহ মাফ করুক, ব্যাপারটা যেন চোখে দেখতে না পারলেও মাইক্রোস্কোপ বা হাবল টেলিস্কোপ ব্যবহার করে দেখার মতো। আমার মতে, আল্লাহর দিদার লাভ করা মানে আল্লাহ সম্পর্কে আমরা যা ধারণা করি তা আরো সুনির্দিষ্ট কিংবা আরো ব্যাপকতর হওয়া। আল্লাহকে দেখা মানে, তাঁর মহান সত্তা সম্পর্কে নিরন্তর glimpse of knowledge লাভ করা।
এটি শরীরী বৈশিষ্ট্যের ব্যাপার নয়। এটি অস্তিত্বগত নৈকট্য, জ্ঞানগত গভীরতা ও অনুভরের অনির্বচনীয়তার ব্যাপার। আল্লাহ যেহেতু অসীম, তাই অংকের নিয়মের মতো করেই অসীমের পানে সসীমের যাত্রা অসীম সময়ব্যাপী চলমান থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অসীমের সাথে সসীমের দূরত্ব সমপরিমাণে অসীম-ই থেকে যাবে। সসীমের অনন্ত প্রাপ্তি ও যাত্রা কখনো অসীমকে অতিক্রম করা তো দূরের কথা, ছুঁতেও পারবে না। অনন্তকাল ধরে এই ছুটে চলা অব্যাহত থাকবে। বেহেশতের সব নিয়ামত হবে বস্তুগত, একসেপ্ট দিস beatific vision বা দিব্য দর্শন। খোদার দিদার লাভের এই নিয়ামতটি পাওয়ার জন্য তারা উদগ্রীব হয়ে থাকবে। স্রষ্টার নৈকট্য ও ভালোবাসার চেয়ে মধুরতর আর কিছু হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
এক কথায় অসাধারণ স্যার।