আত্মসত্তা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অপূর্ণ, কিন্তু নিশ্চিত। অর্থাৎ আমরা এটি নিশ্চিত যে আমরা অস্তিত্বশীল। অন্ততপক্ষে নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা কীভাবে যেন সবসময়ই নিঃসংশয় থাকি। এটি হচ্ছে আত্মসত্তার উপস্থিতি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাপূর্ব, কিন্তু নিশ্চিত জ্ঞান।
আত্মসত্তার এই জ্ঞান দিয়ে আমরা জগতকে জানি। নিজ ও জগত সম্পর্কে প্রাপ্ত ও অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আমরা স্রষ্টার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চয়তায় উপনীত হতে পারি।
আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী কী, তা আমরা খানিকটা জানতে পারি। কিন্তু আল্লাহর জাত কী, তা আমরা কখনো কিছুমাত্রও জানতে পারি না। তাই, আল্লাহতায়ালা তাঁর সত্তাগত দিক থেকে আমাদের কাছে অজ্ঞেয়। কথাটা অন্যভাবে বললে, আল্লাহকে জানার দিক থেকে অজ্ঞেয়তাবাদ সঠিক। এটাকে এক ধরনের “Islamic agnosticism” হিসাবেও বলা যেতে পারে।
অসীমকে যখন আমরা সসীম জানালা দিয়ে দেখি তখন অসীমকে আমরা খানিকটা সসীম করেই দেখি। কিংবা বলতে গেলে দেখতে বাধ্য হই। অসীমতাকে শুধুমাত্র কল্পনা করা যায়, বস্তুগতভাবে ধারণ করা যায় না। অসীম সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা, তা কেবলমাত্র জ্ঞানতাত্ত্বিক। এবং এই অর্থে এটিও এক ধরনের বাস্তবতা বটে। ইংরেজিতে একে আমরা epistemological objectivity হিসাবে বলতে পারি।
সসীম অসীমকে ধারণ করতে পারে না। কিন্তু অসীম সসীমকে ধারণ করতে পারে। সসীম সত্তা বহু হওয়া সম্ভব। বরং উচিত। অন্যদিকে অসীম সত্তা বহু হওয়া অসম্ভব। অযৌক্তিক। একসাথে একাধিক অসীম সত্তা অস্তিত্বসম্পন্ন ও ক্রিয়াশীল হতে পারে না। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অসীমতা এককেন্দ্রিক বা একক বা এক।
স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন, তাহলে তাঁর সাথে জগতের সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত যাতে করে তিনি হবেন জগতের উপর মুখাপেক্ষিতা হতে মুক্ত, অথচ জগত তাঁর ওপর নির্ভরশীল। কেন তিনি জগত সৃষ্টি করেছেন তা জগতের বা জাগতিক কোনো কিছুর পক্ষে জানা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? সত্তাগত এই ভিন্নতার বাস্তবতাকে কীভাবে অস্বীকার করা যেতে পারে?
সসীম কোনো সত্তার গঠনগত সসীমতানির্ভর যে জ্ঞান বা কাঠামো, সেটাকে অসীম কোনো সত্তার ওপর প্রয়োগ করা কীভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? ইসলামের দৃষ্টিতে একান্তই অসীমের বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ কোনো সসীমের পক্ষে জানা ও যাচাই করার দাবি করা হচ্ছে শিরক বা অংশীদারিত্বের দাবি। এতে করে সত্তাগত বৈপরীত্যকে অস্বীকার করা হয় এবং বিপরীতধর্মী সত্তাসমূহকে এক করে দেখা হয়। একই সমতলে নিয়ে আসা হয়।
পরমসত্তা তাঁর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেটাকে কল্যাণজনক মনে করেন, আমাদের খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেটা আমাদের কাছে অকল্যাণকর মনে হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা এও জানি, সবকিছু যিনি জানেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন যে শেষ পর্যন্ত কোনটি ভালোে, আর কোনটি মন্দ। এইটুকু অর্থাৎ বাস্তবতার সম্পর্কে সবটুকু বা বাস্তবতার সবটুকু জানতে না পারার কারণে আমাদের উচিত হলো, কোনো কিছু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর না করে সেই পরমসত্তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও জ্ঞান, নির্দেশ ও নির্দেশনাকে অনুসরণ করা। এটি বরং আমাদের যুক্তিবুদ্ধিরই দাবি।