বড় বড় লোকেরা ছোট ছোট বিষয়ে বড় বড় ভুল করে

মানুষের মধ্যে দর্শন ও ধর্মের যত পার্থক্যই থাকুক, সত্য কথা বলা, অপরের সম্পদ হরণ না করা, অত্যাচার না করা তথা ন্যায়বিচার করা, অন্যদেরকে বিশেষ করে দুর্বলকে হেয় প্রতিপন্ন না করা, আত্মম্ভরিতা না করা, বিনয়ী হওয়া, স্ববিরোধমুক্ত থাকা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকা, পরজীবী না হয়ে স্বাবলম্বী হওয়া, সন্দেহপ্রবণ না হয়ে অপরাপর মানুষ সম্পর্কে যথাসম্ভব সুধারণা পোষণ করা, প্রশংসায় বিভ্রান্ত না হওয়া, সমালোচনাকে ব্যক্তিগতভাবে না নেয়া, প্রতিবেশী ও অধিনস্তদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন থাকা ইত্যাদি ধরনের কিছু সাধারণ নৈতিকতার ধারণা সব মানুষের মধ্যেই রয়েছে।

দেখা যায়, কোন ব্যক্তি, জ্ঞানে, গুণে, ক্ষমতায়, পারদর্শীতায় কিংবা জনপ্রিয়তায় অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। কিন্তু তারমধ্যে এ ধরনের সাধারণ মানবীয় গুণাবলীর কোনোটিতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে। এসব ছোট ছোট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমস্যার কারণে সেই ‘মহান’ ব্যক্তির বড় বড় সব অর্জন প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়ে। হতে পারে, বাহ্যিক দিক থেকে অনেকে সেটা বুঝতে পারছে না। হয়তোবা তিনি নিজের এই নৈতিক-মানসিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন নন। উনার বিরাট ব্যক্তিত্বের দুর্ভেদ্য ব্যূহ ভেদ করে কেউ এই ব্যাপারে তাকে বলতেও পারছে না। অথবা, বললেও তিনি সেটা শুনছেন না। এ ধরনের চারিত্রিক সংকটাবস্থা খুবই মারাত্মক।

বড় বড় লোকেরা ছোট ছোট বিষয়েই বড় বড় ভুল করেন। বড় বড় লোকেরা বড় বড় বিষয়কে যেভাবে খেয়াল করে, ছোট ছোট বিষয়গুলোতে তারা ততটা সচেতন থাকেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছোট ছোট ভুলগুলি তাঁর বড় বড় অর্জনগুলোকে এক পর্যায়ে অনেকখানি অকার্যকর করে তোলে। হতে পারে, বড় বড় লোকেরা যেসব বিষয়কে ছোট মনে করে আসলে সেগুলো ততটা তুচ্ছ নয়। অথচ, নৈতিকতার সাধারণ স্বীকার্যগুলো নিজ গুণেই গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। ক্রমাগত অস্বীকার করে গেলে ছোট ছোট সমস্যাগুলোই একদিন অনেক বড় হয়ে অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একসময়ে সেসবের সংশোধন কঠিন হয়ে পড়ে ।

ফেসবুক লিংক

*****

রাশভারি সব কথা বা উচ্চমার্গের সব তত্ত্বের পরিবর্তে ছোট ছোট সাধারণ নৈতিক শিক্ষার ভিত্তিতে আমরা জীবনের বড় বড় সব সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি

খেয়াল করলে দেখবেন, সাধারণ নৈতিকতার কোনো ‘তুচ্ছ’ অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক সিদ্ধান্তটি আমরা নিয়েছি। বাহ্যত মনে হয়, কোন তত্ত্ব যত জটিল হবে, তত বিস্তারিত হবে। যেন তত ভালোভাবে সেটাকে বুঝা যাবে। অথচ, তা ভুল। কোনো মত, পথ, তত্ত্ব বা দর্শন যত সহজ হবে, সংক্ষিপ্ত হবে তত সেটা বোধগম্য ও গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমাদের একাডেমিক চর্চার অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সহজ কথাকে জটিল হিসাবে উপস্থাপন করা, বিশ্লেষণের নামে অনর্থক টানাটানি করা, বেহুদা রেফারেন্স দেয়া ও নানা ধরনের বর্ণনা দিয়ে রচনার কলেবর বাড়ানো। এসব না হলে যেন কোন বক্তব্য ‘একাডেমিক’ হয়ে উঠে না।

অপরদিকে সাধারণ মানুষও ভাবে– কোন মত, পথ, তত্ত্ব বা করণীয় ‘একাডেমিক মানের’ না হলে তা যেন আমাদেরকে গাইড করতে পারবে না। সাধারণ লোকেরা একাডেমিক বিষয়গুলো নিজেরা ঠিকভাবে না বুঝলেও বুদ্ধিজীবীতার বাজারি ঠিকাদারেরা কোনো কিছুকে ‘একাডেমিক মানসম্পন্ন’ হিসাবে সার্টিফাই না করলে তারা সেটা মানতে বা গ্রহণ করতে চান না। খেলার মাঠে দর্শকের মতো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক এক্সপার্টদের মধ্যে ‘খেলা’টা কোনদিকে যাচ্ছে, তারা তা খেয়াল করেন। এবং দিন শেষে রেফারিদের মধ্যস্থতায় বিজয়ী পক্ষকে তারা বরণ করে নেন। এভাবে এক একটা এলাকায় নিজস্ব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক জনপরিমণ্ডল (intellectual public sphere) গড়ে উঠে।

এ কারণেই দেখা যায়, নির্দিষ্ট কোনো এলাকার অধিকাংশ মানুষের গড়পরতা চিন্তাভাবনা একই রকমের। কিছুটা বুঝে এবং অনেকখানি না বুঝে সাধারণ মানুষ তার এলাকার ডমিনেন্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে। এখানে এলাকা বলতে একটা দেশও হতে পারে, একটা মহাদেশও হতে পারে। তো, এ ধরনের আধিপত্যশীল বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি যদি সত্যতা ও নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে সেখানকার ‘ঈমানদার উম্মতেরা’ না বুঝেও সঠিক উত্তরে দাগ দেয়ার মতো করে  একরকমে পার পেয়ে যায়। যদি তা না হয়, তখন গণহারে তারা বেপথু হয়। কিন্তু কখনো বুঝতে পারে না, আসলে তারা ভুল পথে যাচ্ছে। কারণ, ডমিনেন্ট ন্যারেটিভ তাদের খারাপ কাজকে বৈধতা দেয়। তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজপতিরা সান্তনা দিয়ে পিঠ চাপড়ে দেয়। নানাভাবে বলে, তোমরা ঠিক পথেই চলছো।

সাধারণ লোকদের জন্য এই ধরনের জাতীয়-সংকট হতে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হলো বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানের দাবি হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত ছোট ছোট নৈতিক শিক্ষাগুলোকে শক্ত করে ধারণ করা। দেশ ও জাতির অধিকাংশ লোকেরা ভুল পথে চললেও এ ধরনের ‘তুচ্ছ’ কিন্তু শুদ্ধ মানবিকবোধ-উৎসারিত নৈতিক প্রত্যয়গুলোকে অনুসরণ করে চললে যে কোনো ব্যক্তি সহজেই জীবনের সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারে।

ফেসবুক লিংক

*****

সব বাতিল মত-পথ-তত্ত্বকে খণ্ডন করে সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, ভুল। কী কী মিথ্যা, তা জানার পিছনে ছোটা হলো সংশয়বাদী প্রবণতা

‘সব বতিল মত, পথ ও তত্ত্বকে চিহ্নিত করতে পারলে অনায়াসেই আমি সঠিক পথকে খুঁজে পাবো। সব বাতিলকে খণ্ডন করলে অনায়াসেই সঠিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে।’ আদর্শবাদীদের মধ্যে এ ধরনের চিন্তা কাজ করে। অথচ, এই ধরনের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ ভুল।

তাদের ধারণাটা এমন, যেন কিছু চালের মধ্যে কিছু ছোট ছোট নুড়ি আছে। সেগুলো বেছে নিয়ে ফেলে দিলে চালগুলো ‘ভেজাল’মুক্ত হলো। অথবা, চালের মধ্যে বালি ও ময়লা আছে। চালগুলো পানিতে ধুয়ে নিলে বালি ও ময়লা তলানিতে পড়ে যাবে। এরপরে রান্না করে খাওয়া যাবে।

এই উদাহরণের আলোকে আপাতদৃষ্টিতে এই ধরনের মোকাবিলার এপ্রোচকে সঠিক মনে হলেও আদতে তা কিন্তু মারাত্মকরকমের ভুল প্রবণতা। আদর্শবাদীদের জন্য এ যেন এক প্রাণঘাতি গোলকধাঁধাঁ। কীভাবে? তা বলছি। তার আগে open ended class আর close ended class – এই দুইটা বিষয় বুঝতে হবে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘এই ঘরে কী কী আছে?’ – তাহলে তা হবে ক্লোজ এনডেড ক্লাস। কেননা, তা গণনা করা সম্ভব। একটিভ ভয়েসকে পেসিভ ভয়েসে বলার মতো একই কথাটাকে যদি একটু ঘুরিয়ে বলা হয়, ‘এই ঘরে কী কী নাই?’ – মনে হবে, একই তো কথা। কিন্তু, না। কী কী নাই, তা গণনা করা অসম্ভব। বুঝতেই পারছেন, অনির্দিষ্ট এরিয়াতে কোনোকিছুর নেতিবাচক অনুসন্ধান, অর্থাৎ কী কী নাই ধরনের প্রশ্ন ও তদসংশ্লিষ্ট বিষয় হলো ওপেন এনডেড ক্লাসের বিষয়। বালি বা কাকড়ের স্তুপে শষ্যকণা খুঁজতে থাকা হলো ওপেন এনডেড ক্লাস পর্যায়ের নেতিবাচক ও ব্যর্থ অনুসন্ধান।

এবার আপনিই বলুন, দুনিয়াতে সঠিক মত,পথ ও তত্ত্ব বেশি? নাকি, বাতিল মত, পথ ও তত্ত্ব বেশি? অবশ্যই বলবেন, ভুল চিন্তাধারাই পরিমাণ ও বৈচিত্র্যে অনেক অনেক বেশি। তাই, ভুল চিন্তাকে চিহ্নিত করে খণ্ডন করতে যাওয়া হলো অন্তহীন সংশয়বাদিতায় নিপতিত হওয়া। সংশয়বাদী চিন্তা কখনো কাউকে সত্য পথে পরিচালিত করে না। অনুসন্ধানের মধ্যে সংশয় থাকলেও অনুসন্ধিৎসা ও সংশয়বাদিতা এক না। আমরা অনুসন্ধানী হতে পারি, সংশয়ী হতে পারি না।

ওপেন এনডেড ক্লাস পর্যায়ের ‘অনুসন্ধান’ সংশয়বাদী প্রবণতা হওয়ার প্রমাণ হলো, যতো বেশিসংখ্যক বাতিল মতকে আপনি খণ্ডন করেন না কেন, শেষ পর্যন্তও আপনি নিঃসংশয় হতে পারবেন না, কোনো ভুল মত আর নাই। ভিন্ন মতের ভুল ধরতে ধরতেই আপনার জীবন কেটে যাবে। কথাটা ঘুরিয়ে বললে, সব কিছুতেই আপনি সন্দেহ-রোগে ভুগবেন। মনে হবে, বিরোধীরা এ ব্যাপারে কী যুক্তি দেয়, তা একটু দেখি। এই ‘দেখাদেখির’ কোনো শেষ নাই। এরই ফাঁকতালে আপনার জীবনের সীমিত সামর্থ্যে দেখবেন একদিন টান পড়ে গেছে। মূল বিষয়টাকেই আপনি ঠিকমতো বুঝে নেয়ার যেন যথেষ্ট সময় পাননি।

অপরকে খণ্ডন করার মধ্যে এক ধরনের মাদকতা আছে। তাই, আপদমস্তক ক্রিটিক, এমন ব্যক্তি নেশাগ্রস্তের মতো আফসোস করারও অবকাশ পাবে না। সত্য পথ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘খণ্ডনবাদী বুদ্ধিজীবী’ কখন যে মিথ্যা পথের দূরযাত্রী হয়ে গেছেন, তা তিনি কখনো টের পাবেন না। তাত্ত্বিক দুনিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খণ্ডনবাদীরা শেষ পর্যন্ত মূল আদর্শ হতে বিচ্যুত হয়েছে। ইতিহাস তা বলে।

ফেসবুক প্রদত্ত মন্তব্য

Mohammad Mozammel Hoque: “দর্শনের একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে আপনার পোস্টটি নিয়ে দুটি প্রশ্ন নিবেদন করছি।

১) অনেক সময় কোনো প্রতিপাদ্য বিষয়কে সরাসরি প্রমাণ করা যায় না। এক্ষেত্রে বিপরীতটাকে সত্য ধরে তাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে হয় (reductio ad absurdum)।

২) যৌক্তিক সম্ভাব্যতা আর বাস্তব সম্ভাব্যতার মধ্যে সম্পর্ক-কোনো কিছু যৌক্তিক দিক থেকে সম্ভব হলেও বাস্তবে অসম্ভব হতেও পারে কিন্তু তা যৌক্তিক দিক থেকে অসম্ভব হলে তা বাস্তবেও অসম্ভব হবে। সুতরাং গঠনের চেয়ে খন্ডনের ভীত বেশি মজবুত। এ ব্যপারে আপনার মতামত কী?”

– একজন পাঠকের ইনবক্স-প্রশ্ন।

আমার উত্তর: “হ‍্যাঁ, ঠিক তাই। গঠনের চেয়ে খণ্ডনের ভিত বেশি মজবুত। তবে ভিতের চেয়ে পরিমাণত দিক থেকে উপরিকাঠামো কত বড় ও কত বেশি, তা খেয়াল করেছো? I focused on priority.”

উক্ত পাঠকের উত্তর: “হ্যা আমিও বিশ্বাস করি যে ভাঙনের চেয়ে গঠনের মূল্য বেশি।”

ফেসবুক লিংক

*****

অন্ধকারের মাঝে আলোর মতো দীপ্ত সত্য নিজ গুণে প্রতিষ্ঠিত

আলো যখন জ্বলে উঠে, অন্ধকার তখন এমনিতে টুঁটে যায়। কাজের কাজ হলো আলো জ্বালানো। অন্ধকার হটানো কোনো কাজ নয়। সত্য সমাগত হলে মিথ্যা আপনাতেই দূরীভূত হয়। আলো থাকলে অন্ধকারের অবসান অনিবার্য। তাই, আমাদেরকে ছুটতে হবে আলোর পিছনে। অন্ধকারকে ধাওয়া করার দরকার নাই।  কী কী মিথ্যা, তা নিয়ে খোঁচাখুঁচি বা খোঁজাখুঁজি করার দরকার নাই। সত্যকে পেলেই হলো।

আলো জ্বালালেই দেখবেন, মুহূর্তেই অন্ধকার নাই হয়ে গেছে। অথবা, কোনো বাতির পাশে আপনি যদি অধিকতর শক্তিশালী কোনো বাতি জ্বালান, দেখবেন, কম আলোর বাতিটা আলোর পরিবর্তে ছায়া সৃষ্টি করছে। তাই, অধিকতর শক্তিশালী সত্য, দুর্বল সত্যকে ঢেকে দেয়, যেমন করে কম পাওয়ার বাতি, অধিক পাওয়ারের বাতির সমুখে অনুজ্জ্বল হিসাবে আলোর পরিবর্তে ছায়া তৈরী করে।

এই যে এত মহান সত্তা, সত্য, সেটি কী? সত্য হলো যা পরিশুদ্ধ করে, পবিত্র করে, সঠিক পথে পরিচালিত করে। অবশ্য, এসব সত্যের বৈশিষ্ট্যমাত্র। সত্য আসলে কী – তা কেউ জানে না। কিছু কিছু জিনিসকে উদারহরণ দিয়ে বুঝানো যায়, কিন্তু সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কীভাবে যেন আমরা বুঝি, সেটা কী। সত্য, ভাল, কল্যাণ – এসব টার্মগুলো সে ধরনের মৌলিক ধারণা যেগুলোকে সংজ্ঞার শিকলে বাঁধা যায় না। অথচ, এগুলোকে দিয়ে আমরা বাদবাকি সবকিছুকে সংজ্ঞায়িত করি।

ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য

Yasir Adnan: এই যে নতুন সত্য পুরাতন সত্যকে ম্লান করে দেয় – এই অধিকতর সত্যের ধারণাটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিসাব করে দেখলাম আল্লাহ সবযুগেই মানুষকে এরকম অধিকতর সত্যের মুখোমুখি করেন। এটা ব্যক্তিগত এবং জাতিগত উভয় পরিসরে আছে। শেষ বিচারে এটাই যদি বিচারের মানদণ্ড হয় তাহলে প্রচলিত হকপন্থার দাবিদার অনেকেই বিপদে পড়ে যাবেন। কারণ বেশিরভাগ মানুষই এক ধরনের সামাজিক সত্যের ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে। পরে যখন তিনি নতুন সত্যের মুখোমুখি হন তখনই তার আসল পরীক্ষাটা শুরু হয়।

ফেসবুক লিংক

*****

আত্মসত্তা, জগত ও জীবনের অখণ্ড সত্যকে জানা ও বুঝতে পারার জন্য চারপাশের নৈমিত্তিক সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলোই যথেষ্ট

ছোটবেলা থেকেই ছিলাম সত্যসন্ধানী। বড় হয়ে হয়েছি তত্ত্বসন্ধানী। তত্ত্ব নিয়ে ঘাটাঘাটি করাই আমার পেশা। পাঠকবৃন্দ জানেন, আমি দর্শনের লোক। ফিলোসফি পড়া ও পড়ানোই আমার পেশা। ব্যক্তিগত আগ্রহের পাশাপাশি পেশাগত প্রয়োজনে দিনরাত আমাকে মত, পথ ও তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। ‘দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু, দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা… দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর, একটি শিশির বিন্দু’ – এই কবিতার মতো জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হতে দেখলাম, আত্মসত্তা, জগত ও জীবনের অখণ্ড সত্যকে জানা ও বুঝতে পারার জন্য আমাদের চারপাশের​ নৈমিত্তিক সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলোই যথেষ্ট।

মানুষের বিশেষ কোনো চিন্তার পিছনে থাকে তার চিন্তাধারা বা paradigm-এর প্রভাব। কেউ যখন কোনো কথা বলে তখন সে আসলে তার দৃষ্টিভঙ্গি হতেই সেটা বলে। কোনো বিষয়ে প্রাপ্ত উত্তরকে ব্যক্তি স্বীয় মন-মানসিকতা দিয়েই যাচাই করে। আমাদের চিন্তার কাঠামো বা প্যারাডাইম অব থট গড়ে উঠে চারপাশের নৈমিত্তিক সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলোর ভিত্তিতে। সে জন্য দেখা যায়, আপনার দৃষ্টিতে একেবারে সহজ ও নিতান্তই যৌক্তিক, এমন কোনো কথা, কাউকে আপনি বুঝাতে পারছেন না। অথচ তিনি একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি। এর পাশাপাশি একই বিষয়ে তেমন শিক্ষিত নয় এমন কেউ কিন্তু খুব দ্রুতই সেটা ধরে ফেলছে। আসলে সেই অল্পশিক্ষিত বা সাধারণ মানুষের সাথে আপনার প্যারাডাইম মিলে গেছে। যার কারণে, আপনার অত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ না বুঝলেও কথাটার মূল সুরকে তিনি ধরতে পেরেছেন অনায়াসে।

আমরা সাধারণত খুঁটিনাটি বিষয়ে অনেক বেশি জড়িয়ে পড়ি। চিন্তার যে মূল কাঠামো তথা দৃষ্টিভঙ্গি তা নিয়ে তেমন এনগেইজ হই না। এটিকে ninety-ten formula দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের শতকরা নব্বই ভাগ জ্ঞানই আসে আমাদের নৈমিত্তিক জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে, যা  আমাদের অভিজ্ঞতার সর্বমোট পরিমাণের দিক থেকে শতকরা দশভাগের বেশি নয়। কথাটা অন্যভাবে বললে, আমাদের জীবনচলার পথে অন্তর্গতভাবে ক্রিয়াশীল ভিত্তিগত জ্ঞানসমূহ অর্জিত হয় আমাদের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব তথা তুচ্ছ সব অভিজ্ঞতা হতে।

মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য বড় বড় তত্ত্ব ও মতের পিছনে ছুটে। অনেককেই দেখি, বুদ্ধিবৃত্তির নামে এক ধরনের আঁতলামির রোগে আক্রান্ত। অথচ, আমাদের জন্ম, মৃত্যু, সূর্যের উদয়, চাঁদের আবর্তন, উদ্ভিদ, শষ্য, প্রাণীজগত, আমাদের খাদ্যগ্রহণ, ঘুমানো, চোখে দেখা, কানে শোনা – এসব নিতান্তই ‘তুচ্ছ’ ও নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলো হতে আমরা জগত ও জীবন সম্পর্কে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করি, জীবনবোধের সেই চশমার ভিতর দিয়েই আমরা বাদবাকি সব মত, পথ ও তত্ত্বকে যাচাই করি। আমরা যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করি, বাহ্যত এমনটা মনে হলেও নিছক যুক্তি দিয়ে আমরা কিছুই গ্রহণ করি না। যার যার মন-মানসিকতা ও রুচিতে কুলায় এমন যুক্তিগুলোকেই দিনশেষে প্রত্যেকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসাবে গ্রহণ করে।

এই অর্থে সত্যমাত্রই ‘নির্মিত সত্য’। তাহলে জগতে কি আসল সত্য বলে কিছু নাই? objective truth বলে কিছু নাই? আছে। তবে তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।

ফেসবুক লিংক

*****

জগতে কি আসল সত্য বলে কিছু নাই? objective truth বলে কিছু নাই? আছে। তবে তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ

জগতে সত্য মাত্রই একই সাথে ব্যক্তিসাপেক্ষ ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ। আসলেই যা সত্য, ব্যক্তি কর্তৃক তা সত্য হিসাবে গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে ‘সত্য’ সত্য হয়ে উঠে। সেই দৃষ্টিতে সত্যমাত্রই ব্যক্তিসাপেক্ষ বা subjective। আবার ব্যক্তি চাইলেই তার কল্পনা ও অনুমান দিয়ে সত্যকে নির্মাণ করতে পারে না। যা সত্য, তা স্বয়ং সত্য বা objective truth। এর মানে, সত্য মাত্রই নিজগুণে অর্থাৎ by-itself সত্য। অতএব, সত্য একই সাথে ব্যক্তিসাপেক্ষ ও ব্যক্তিনিরপেক্ষ।

অবজেক্টিভ একাডেমিক রিসার্চ হতে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের ব্যাপারগুলোতে সাবজেক্টিভিটি তথা ব্যক্তিসাপেক্ষতা অত্যন্ত মৌলিক ভূমিকা পালন করে। আমাদের সাবজেক্টিভিটি তথা একান্ত জীবনবোধ বা জীবনদৃষ্টি কারো কারো ক্ষেত্রে সচেতনে এবং অধিকাংশের ক্ষেত্রে অবচেতনে গড়ে উঠে।

সেজন্য দেখা যায়, জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো না কোনো ফিলোসফিকে অবচেতনে অনুসরণ করে। প্রত্যেক বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ব্যক্তিবিশেষ, কোনো বিশেষ অবস্থানকে সঠিক মনে করে। যদিও তিনি জানেন না, এ বিষয়ে ফিলোসফারগণ ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ও মতবিরোধ করেছেন। তিনি এটিও জানেন না, উনার মতের পক্ষে দর্শন শাস্ত্রে গালভরা সব টার্ম রয়েছে।

যেমন করে শাকসবজি খাওয়ার সময়ে আমরা জানি না, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে এগুলোকে কত কঠিন সব ল্যাটিন নামে চিহ্নিত করা হয় । ফল-মূল ও সবজি খাওয়ার জন্য সেগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ইত্যাদি জানার কোনো দরকার নাই। হাঁটার কাজে পদার্থবিদ্যার কী কী নিয়ম পালিত হয় তা পদার্থবিদ্যাবিদগণের বাইরে আমজনতার জানার দরকার নাই। হাঁটতে পারলেই হলো।

তাই, আমার মতে, কিছু বিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষভাবে জ্ঞান-গবেষণা ও চর্চা করুক। আমরা সাধারণ পাবলিকদের সহীহ বুঝজ্ঞান লাভের জন্য জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলোর উপলব্ধিই যথেষ্ট।

এ কারণে, আমি চিন্তার খুঁটিনাটি সংশোধনের চেয়ে মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তনে সহযোগিতা করার বিষয়ে অধিকতর আগ্রহী। এ কাজে বড় বড় তত্ত্ব বিশ্লেষণ ততটা সহায়ক নয়।

বরং দেখেছি, আদর্শ অনুসরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির মৌলিক জীবনবোধই ডিসাইসিভ রোল প্লে করে। জীবনবোধ আসে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা হতে। যুক্তি স্বয়ং সত্য নয়, বরং যুক্তি হলো সত্যে পৌঁছার উপায়। যুক্তি দিয়ে কারো জীবনবোধ করে উঠে না। যুক্তিকে মানুষ কাজে লাগায়। প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করার মাধ্যমেই কারো জীবনবোধ গড়ে উঠৈ।

নিছক তথ্য যেমন জ্ঞান নয়, তেমনি জ্ঞান থাকা মানেই উপলব্ধি থাকা, এমনও নয়। উপলব্ধিই হলো প্রকৃত জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, মানুষ, তথ্য, যুক্তি ও জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয়। না, মানুষ আসলে পরিচালিত হয় তার একান্ত উপলব্ধ প্রকৃত জ্ঞান বা প্রজ্ঞা দ্বারা। যার প্রজ্ঞা যত দুর্বল হবে, সে তত বেশি জড় ও হীন চরিত্রের হবে। মানুষের এই নৈতিক ও আদর্শগত তারতম্যের সাথে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার কোনো সম্পর্ক নাই। এ হলো নিতান্তই ব্যক্তির জীবনবোধের ব্যাপার।

কেউ অন্য কারো উপর জীবনবোধ আরোপ করতে পারে না। যেমন করে আপনি কাউকে কোনো কিছু দেখতে বাধ্য করতে পারেন না, যদি না সে নিজ থেকে তা দেখে। কেউ অন্যের চোখ দিয়ে দেখে না। প্রত্যেকে নিজের চোখ দিয়েই দেখে। যদিও সে মনে করে তার দেখার সাথে অন্যদের দেখার মিল আছে বা থাকতে পারে।

এই যে জীবনবোধ, উপলব্ধি ও প্রজ্ঞার এত গুরুত্বের কথা বলা হলো, আমাদের চারিপাশের আপাততুচ্ছ তথা নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলো হতেই কিন্তু ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গড়ে উঠে। জীবনবোধ, উপলব্ধি ও প্রজ্ঞার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত পাণ্ডিত্যের সম্পর্ক অপরিহার্য নয়, আপতিক (occasional) – এ কথাটা বুঝতে হবে। সবাই একাডেমিক পণ্ডিত হওয়ার চিন্তা বাদ দিতে হবে। একাডেমিক পণ্ডিতেরাই কেবল গাইড হতে পারবেন, এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জ্ঞানের সারাংশ (core of knowledge) তথা জীবনবোধের চাষ করতে হবে।

সুস্থ জীবনবোধে উজ্জীবিত ব্যক্তিই মূলত আদর্শবাদী হতে পারে। সুস্থ জীবনবোধে উজ্জীবিত ব্যক্তিকে যোগ্য হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এর বিপরীতে জীবনবোধে দুর্বল কিংবা জড় ব্যক্তি যতই আরোপিত মানে কৃত্রিম ‘যোগ্যতা’ অর্জন করুক, শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের বা অন্য কারো কল্যাণ সাধনে সক্ষম হবেন না।

ফেসুবক লিংক

Similar Posts

৩ Comments

  1. আসসালামু আলাইকুম…….
    আমার মনে হলো, এটি আপনার সেরা লেখাগুলোর অন্যতম একটি!
    দুবার পড়লাম, আরো পড়তে হবে!

    1. আপনার অনুরোধেই এই ব্যাখ্যামূলক লেখা। পড়েছেন, তাই ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  2. স্যার, অনেক বেশি ভাল লেগেছে। একটা অংশ কপি করে ফেসবুকে শেয়ার করলাম..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *