আপনি কি নারী বলবেন? নাকি, রমণী বলবেন? যদি রমণী বলেন তাহলে কি তা দ্বারা ‘রমণযোগ্য কেউ’ এমনটি বোঝাচ্ছেন? যদি তা না-ও হয়ে থাকে, তবুও কেউ কি এতে আহতবোধ করতে পারে না? আপনি কি নিশ্চিত? আপনি যখন জননী শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন কি এর মধ্যে (প্র)জনন সম্পর্কিত কিছু থাকে? অথবা, লিঙ্গভিত্তিক কোনো শব্দ হতে যৌনতার আভাসকে সম্পূর্ণ মুছে দেয়া বা অস্বীকার করা কি সম্ভব?

কেন এক শ্রেণীর লোকেরা যুবক কথাটির বিপরীতে যুবতী কথাটা হরহামেশাই বলে থাকে, এবং অন্য শ্রেণীর লোকেরা কখনো যুবতী শব্দটা ব্যবহার না করে যুব-মহিলা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে? যুবতী শব্দটির প্রতি তাদের আপত্তি এবং যুবমহিলা শব্দটির ব্যাপারে তাদের এই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, এটি কি আরোপিত বা ফলস-কনশাসনেস? নাকি, স্বতঃস্ফূর্ত? কেউ যখন ইউনিভার্স শব্দটির বাংলা হিসেবে ব্রহ্মাণ্ড কথাটি বলেন তখন কি তিনি ব্রহ্মাণ্ড বলতে ‌‘ব্রহ্মের অণ্ড’ বুঝিয়ে থাকেন?

কেন মুসলিম ধর্মীয় শুদ্ধতাবাদী লোকেরা শুক্রবার না বলে জুমাবার বলতে চান? নামাজ না বলে সালাত, বা স্বলাত বলতে চান? শুক্র দেবতার নাম পরিহার যারা করতে চান তারা কি হলফ করে বলতে পারবেন, তাদের প্রস্তাবিত নামটি তৎকালীন কোনো আরবি দেবতার নাম নয়? আরবি ভাষাভাষী অমুসলিমদের কাছে আল্লাহ কি পরম-ঈশ্বর বা ব্রহ্ম কথাটার সমার্থক নয়? শিরকি শব্দকে পরিহার করতে গেলে কম্বলের লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড় হবার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে না তো?

আপনার উত্তর যা-ই হোক, আপনি কি নিশ্চিত, আপনার উত্তরটি নিখুঁত?

আচ্ছা, যারা জল বলেন আর যারা পানি বলেন, তারা উভয়েই H2O বোঝালেও জল আর পানির অর্থ ও ব্যবহারগত তাৎপর্য কি এক? মেসো আর মামা একই সম্পর্ককে বোঝালেও শব্দ দুটির সাংস্কৃতিক তাৎপর্য কি এক? ইসলামোফোবিয়া বলতে ইসলামবিদ্বেষ বোঝালেও ইসলামোফোবিয়া কি হোমোফোবিয়া ক্যাটাগরির কোনো পরিভাষা নয়? ইবাদত-বন্দেগী বলতে যা বোঝায় তার সাথে উপাসনা-অর্চনার কি কোনো পার্থক্য নাই?

শিক্ষা আর দীক্ষা কি একেবারেই সমার্থক? গুরু আর শিক্ষক কি একই অর্থ বহন করে? সমার্থক শব্দগুলো কি আসলেই সম অর্থবোধক? সেগুলো কি অভিন্ন? ‘নয়নভরা জল গো’ না বলে, নজরুল যদি ‘নয়নভরা পানি’ বলতেন, তাহলে কি সেই গান আমাদের এতো ভালো লাগতো? শিউর? এই যে ‘শিউর’ বললাম, তা না বলে যদি শুদ্ধ উচ্চারণে ‘শুয়র’ বলি তা কি শ্রুতিমধুর ও শালীন হবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন নিচের এই সংক্ষিপ্ত দিক নির্দেশনাগুলো থেকে।

১. শব্দের শাব্দিক অর্থ আর পরিভাষাগত অর্থ এক নয়। শাব্দিক অর্থে যা নির্দোষ, পরিভাষাগত অর্থে তা হতে পারে আপত্তিজনক। এর বিপরীতে, বুৎপত্তিগত দিক থেকে নেতিবাচক তথা সংবেদনশীল শব্দ, নির্দোষ পরিভাষার রূপ গ্রহণ করতে পারে। ভাষার ব্যবহার তত্ত্ব (use theory of meaning) এমন কথাই বলে। উল্লেখ্য, পরিভাষা হচ্ছে শব্দের ব্যবহারিক অর্থ।

২. কোন শব্দকে কে কোনভাবে নিচ্ছে, সেটি মূলত নির্ভর করে উক্ত ভাষা ব্যবহারকারী বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর। এই holistic cultural environment তথা প্যারাডাইম গড়ে উঠার ক্ষেত্রে জীবনবোধ, রাজনৈতিক চেতনা, ধর্ম, বিনোদন সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভৌগোলিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-ব্যবস্থা ভূমিকা পালন করে। এগুলোর কোনোটা বিচ্ছিন্ন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।

৩. যারা সমাজকর্মী ও সৃজনশীল ব্যক্তি, তাদের উচিত জনগণের (পরি)ভাষায় কথা বলা। বই-কেতাব বা প্রিভেইলিং ইন্টেলেকচুয়াল কারেক্টনেসকে ফলো করার চেয়ে তাদের উচিত মানুষ সহজ-সরলভাবে যা বোঝে, সংশ্লিষ্ট শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা খেয়াল রাখা। এটি সহজ পদ্ধতি। এর বিপরীত পদ্ধতি হচ্ছে ভাষাগত শুচিবায়ুগ্রস্ততায় (linguistic puritanism) নিপতিত হওয়া।

নেতিবাচক অতি সংবেদনশীলতা তথা অতি শুদ্ধবাদিতা হতে পারে ভাষা নিয়ে, হতে পারে ধর্ম নিয়ে, হতে পারে নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে, হতে পারে রাজনৈতিক জাতিগত পরিচয় নিয়ে। এগুলোকে আপনি ম্যানিয়া বলবেন কিনা, সেটা আপনার বিবেচনার বিষয়।

৪. ভাষা হচ্ছে মনের আয়না। প্রকৃতি কিংবা ঈশ্বরের এক আশ্চর্য সৃষ্টি এই ভাষা। ভাষার মধ্যে প্রতিফলিত হয় মানুষের বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতিসহ তাবৎ সম্পর্ক ও সভ্যতা। ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন, ভাষা এক্সক্লুসিভলি শুধু মানুষেরই অর্জন। প্রাণীদের ভাষা এত নিম্নমানের, তারা সেগুলো ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তাদের মতে প্রাণীরা কিছু ডাক (call)-এর মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে।

আমি বিশ্লেষণী দর্শনের অনুসারী। বিশ্লেষণী দর্শন নামটা হয়েছে ভাষাগত বিশ্লেষণ হতে। এনালাইটিক ফিলসফারদের মতে, ভাষার মধ্যে নিহিত আছে শুদ্ধ অর্থ ও নিগুঢ় তাৎপর্য।

ভাষা সংক্রান্ত এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে আমরা পাই কিছু বাউন্ডারি বা সীমানা-পিলার। এগুলোকে বিবেচনা করে আমাদেরকে ঠিক করতে হবে, কোন ক্ষেত্রে আমরা কোন শব্দটি ব্যবহার করবো, কোন শব্দটির ব্যবহার এড়িয়ে যাবো। এই গাইডলাইনগুলোকে সামনে রেখে আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, পক্ষ-বিপক্ষ যা-ই হোক না কেন, অন্যদের কথাগুলোকে আমরা কীভাবে বুঝবো (interpret করা অর্থে)। সাংস্কৃতিক আমেজের মতো ভাষা নিত্য পরিবর্তনশীল। এই অর্থ-প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে চলাটাকেই আমি বেহেতর মনে করি।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Mohammad Saifullah: ধন্যবাদ স্যার।

Mohammad Mozammel Hoque: আমি কোনো বিষয়ে সাধারণত হ্যাঁ/না বলি না। বরং মূলনীতি বা মানদণ্ড কী হতে পারে, তা স্মরণ করিয়ে দেই। এটিও সে রকম লেখা। লেখাটি তোমার গতকালকের স্ট্যাটাসটির প্রেক্ষিতে। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো।

Mohammad Saifullah: জি স্যার। হ্যাঁ/না এড়িয়ে যেতে পারলেই ভালো। তবে আমাদের মতো পিচ্চি এক্টিভিস্টদের অনেক বিষয়ে বলতে হয়। আমি আস্তে ধীরে এ থেকে বের হয়ে যাবো।

Mohammad Mozammel Hoque: নিজেদের ‌‘পিচ্চি’ ভাইবো না। বুইড়াদের দিয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না। এজন্য আমি তোমাদের বয়সী তরুণদের সাথে থাকার চেষ্টা করি। তোমাদের মতো বয়সে আমি যদি তোমাদের মতো এতটা মুক্তচিন্তা করতে পারতাম, তাহলে হয়তোবা আরো অনেক দূর অগ্রসর হতে পারতাম।

আমি এখন সেল্ফ-ব্র্যান্ডিংয়ে বিশ্বাস করি। মনে করি এটাই সঠিক। এটি রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা) নয়। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খোদা তায়ালা যে বিশেষ যোগ্যতা দিয়েছেন সেটির স্বীকৃতি দেয়া, শোকরিয়া আদায় করা ও স্রষ্টাপ্রদত্ত একটি বিশেষ দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়া।

মোটকথা হলো, ঔদ্ধত্য ও আত্মম্ভরিতার সাথে সাথে আমাদেরকে ওভার-সাবমিসিভ হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে হবে। ব্যক্তিত্ববোধকে দুর্বল করে কোনো আদর্শবাদ হতে পারে না। নিছক সংখ্যাবৃদ্ধি বা কোয়ান্টিটেটিভ গ্রোথ ছাড়া সে ধরনের ব্যক্তিত্বহীন আদর্শবাদিতা দিয়ে কাজের কাজ কিছু হয় না। এ ব্যাপারে আমার একটা প্রপজিশন আছে। হয়তো সেটা ইতোমধ্যে শুনেছ। তারপরও স্মরণ করিয়ে দেই: ব্যক্তিত্ব হচ্ছে সীমিত মাত্রার বেয়াদবি। personality is audacity within limit.

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

***

Mustafa Kamal: শব্দের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। মানুষই শব্দের অর্থ সৃষ্টি করে বা গঠন করে বা লেবেল প্রদান করে। এক্ষেত্রে টেরোরিস্ট ও ফ্রিডম ফ্রাইটার শব্দ দুটির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ধরুন, ULFA সদস্যদের ইন্ডিয়া টেরোরিস্ট বলে, কিন্তু ULFA-র সমর্থকরা এদের আবার ফ্রিডম ফ্রাইটার বলে। এখানে শব্দের কোনো হাত নেই, হাত হলো সাইকোলজির। সাইকোলজির পার্থক্য হওয়ার কারণেই এমনটি হয়।

মানুষ ভাষাগত প্রাণী কথাটি সঠিক। কিন্তু ‌‘একমাত্র’ শব্দটি নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে, পক্ষে-বিপক্ষে গবেষণাও আছে। যেমন আমরা (মানুষ) যে প্রাণির কথা বুঝতে পারি না, তা তো প্রাণির সমস্যা নয়। সমস্যাটা আমাদের। কারণ, আমাদের মস্তিষ্কে প্রাণিদের ভাষা বোঝার জন্য কোনো ডিভাইস দেওয়া হয়নি! কিন্তু প্রাণিরা মানুষের ভাষা বুঝে কি না সেটা এখনও গবেষণারই বিষয়।

Mohammad Mozammel Hoque: আমার প্রতিবেশি এক শিক্ষক নৃবিজ্ঞান বিভাগের। উনাদের ডিপার্টমেন্টে linguistic anthropology উনি পড়ান। উনি আমাকে এ ব্যাপারে বলেছেন। এরপর আমি খোঁজখবর নিয়ে যা পেয়েছি তা লিখেছি।

Yasir Adnan: শব্দ নিয়া আপত্তি এবং এইটাকে একটা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আখ্যা দেয়ার কাজটা জহুরী সাহেব খুব বেশি কইরা শুরু করছিলেন। ইদানীং আবার কিছু ‌‘স্বোয়াহীহ’ টাইপের লোকজন দেখি।

Mohammad Mozammel Hoque: এই ‌‘স্বোয়াহীহ’ টাইপের লোকজন মূলত genetic fallacy-তে ভোগেন। অস্তিত্ব বা সত্তাকে সেটির উৎপত্তিগত অবস্থার সাথে আইডেন্টিফাই করা হলো জেনেটিক ফ্যালাসি। মাটি থেকে গাছ হয়। গাছ থেকে ফল হয়। অতএব, ফলমূলও এক ধরনের মাটি। এমনটা মনে করবেন বা বলতে চাইবেন এহেন উৎপত্তিগত অনুপপত্তিতে ভোগা মানুষজন। এটি এক ধরনের পিউরিটানিজম বা সুচিবায়ুগ্রস্ততা। সে হিসেবে এক ধরনের রোগ। মানসিক বৈকল্য।

এই মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যগুলোর ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *