এই করোনাতে বড়রা মারা যাবে। যাচ্ছে একে একে। এতদিন ভাবতাম, আমি অনেক বড়। আমার বয়স অনেক বেশি। নিজেকে মুরুব্বী হিসেবে জাহির করতে চাইতাম সব সময়। নিজের বয়স খানিকটা বাড়িয়ে বলতে পছন্দ করতাম।
আর, আজ …!
সত্যিকারের মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখে দাঁড়িয়ে, কী অদ্ভুত …, আজ ভাবতে ভালো লাগছে, আমি তো ছোট। হইনি ষাটোর্ধ। আমার মৃত্যুর বয়স, হয়নি এখনো।
অথচ, এই করোনা-ঝড়ে মারা যাবে, যাচ্ছে অহরহ, আমার বয়সী কিংবা অনুজ, এমন অনেকেই। বেঁচে থাকাটাই এখন সৌভাগ্যের বিষয়। যেন ব্যতিক্রমী ঘটনা।
মরবো না, এটি আশা করি। যদিও জানি, মৃত্যুটাই এখন অধিকতর সম্ভাব্য। বেঁচে যাওয়াটা বরং অনিশ্চিত বেশি।
ঘরে ঘরে বড়রা মারা যাচ্ছে। অক্সিজেনের অভাবে, অথবা অক্সিজেন নিতে না পারার কারণে। হতে পারে, আমারও আসতে পারে এমন সময়, যখন অক্সিমিটার কোনো কাজে লাগবে না। পড়ে থাকবে পূর্ণ সিলিন্ডার। প্রিয়জনের কান্নার রোল পারবে না থামাতে, মৃত্যুর অদম্য শকট। হয়তোবা। হতে পারে যেতে, সব ফেলে, ‘অসময়ে’, জীবনের চূড়ান্ত ঠিকানায়।
এই করোনায় আমি কি মারা যাব? জানি না। আমি কি বেঁচে যাব? তাও জানি না। হাস্যকর ঠেকছে নিজেকে নিজের কাছে। এতদিন নিজেকে বড় ভেবে ভেবে, এখন কেন জানি মনে হচ্ছে,
নাহ, আমি তো এখনো অনেক ছোট। নই ততটা বয়সী। নই অতটা ঝুঁকিপূর্ণ। বুড়োরা মারা যাচ্ছে। যাক। এভাবে চলতে চলতে মৃত্যুর এই মিছিল পৌঁছে যাবে ‘গোষ্ঠী-সুরক্ষা’র দ্বার প্রান্তে। অবশেষে। সেই সুবাদে, বেঁচে যাব আমি।
ভিত্তিহীন যুক্তিহীন অসহায়, অথচ প্রবল এই আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে, মনে হচ্ছে, আমি ঠিক বেঁচে যাব।
অন্ধকারের পরে অনিবার্য সূর্যোদয়ের মতো, কাটবে এই আতঙ্কের ঘোর নিশা। মহামারী-মুক্ত এক নতুন পৃথিবীতে আবার ব্যস্ত হবো প্রাত্যহিক কর্মে। ফিরবো পেশাগত জীবনে। সক্রিয় হবো আবার সামাজিক আন্দোলনের কাজে। মনে হচ্ছে যেন বেঁচে থাকবো যুগ যুগ ধরে, অনন্তকাল।
অথচ জানি, মহামারী থেকে যদিওবা বেঁচে যাই, যতদিন ছিলাম বেঁচে, আরো ততদিন বাঁচবো না আমি। আরো চূয়ান্নটি বছর হায়াত পাবো না আমি, কোনোমতে আর।
চূয়ান্নটি বছর …! কীভাবে যেন কেটে গেল … !
মনে হয়, এইতো সেদিন, ১৯৭৪ সাল। চাচাদের সাথে গণ্ডগোল হওয়ার পর, আমাদের পড়ালেখার সুবিধার জন্যে বাবা আমাদের নিয়ে আসলেন, বাবুনগর গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহরের এক প্রান্তে, নতুনপাড়া এলাকায়।
তখন আমি সদ্য শৈশব পেরোনো এক দুরন্ত কিশোর। পারতাম না একটি শব্দও ‘শুদ্ধ ভাষায়’ বলতে। তখনকার বিদ্যমান বাস্তবতায়, এক অবুঝ বালকের রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিহীন আত্মসম্মানবোধের কারণে, নিজে নিজে নিজের নাম পাল্টে ফেলে, ভর্তি হলাম একদিন চট্টগ্রাম সেনানিবাস উচ্চ বিদ্যালয়ে। চতুর্থ শ্রেণীতে।
এরপর কত ঘটনা; কাঙ্খিত, অনাকাঙ্ক্ষিত; ভালো, মন্দ; পারিবারিক, একাডেমিক, সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে, যা কিছু হতে পারে একটা মানুষের জীবনে। আমার মতো জীবন ছিল যাদের, তেমন সময়ে, তেমন ধরনের আবহ পরিবেশে।
এখন আমি শ্বেত শ্মশ্রুধারী এক বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক। অথচ, এখনো এক অবোধ আবেগে, বেঁচে থাকার এক মূঢ় স্পর্ধায় ভাবছি, এই বৈশ্বিক মহামারী ছোঁবে না আমাকে। আল্লাহর খাস রহমতে কীভাবে যেন কোনো এক অলৌকিক উপায়ে, আমি বেঁচে যাব। পরিণত হবো না, শুধু স্মৃতি আর সংখ্যায়।
ভাবছি, এখনো তো হয়নি ততটা বৃদ্ধ। প্রবোধ দিচ্ছি নিজেকে, এ জগতে আমার বেঁচে থাকার অনেক প্রয়োজন …! এখনো আমি অনেক কিছু করতে পারি। শেষ হয়ে যাইনি, ফুরায়নি আমার সব সামর্থ্য। কিছু কিছু দিক থেকে বরং বেড়েছে অনেকখানি। প্রজ্ঞা, সাহস, সম্মান আর আর্থিক সচ্ছলতার কথা বলতে পারি। উদাহরণ হিসেবে।
বোকার মতো ভাবছি, অনেক কাজ রয়ে গেছে অসম্পন্ন। যেন আমি ছাড়া এগুলো করবার, মানুষ নেই আর জগতে …! যদি পাই আরো কিছুটা সময়, তাহলে …!
অথচ, কত যে সময় নষ্ট করেছি হেলায় …! শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য পেরিয়ে, যৌবনের উত্তাপ অনেকখানি হারিয়ে, আজ এই পড়ন্ত বেলায়, জীবন হারানোর এই সমূহ শঙ্কা-মুখে, এখন অনুশোচনা হচ্ছে প্রবল। আফসোস হচ্ছে খুব, জীবনের ফেলে আসা নিহত সময়গুলোর জন্যে।
ভাবছি, যদি বেঁচে যাই, হবো খাঁটি জীবনবাদী। হবো আত্মপ্রেমী অকৃত্রিম। ভালোবাসবো নিজেকে আরও বেশি করে। নিজের কল্যাণ চিন্তা করবো নিঃসংকোচে। যাপন করবো নিজের জীবন, নির্দয়। গুছিয়ে নেব সবকিছু। হবো অধিকতর ভালোবাসাময়, নিজের প্রতি। গড়ে তুলবো নিজেকে, সহজ সরল শুদ্ধ এক মানবিক মানুষ হিসেবে।