[এডিটরস নোট: এই নিবন্ধটি ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়েোজিত একটি সেমিনারে ‘ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত হয়। আলোচনাটির সারমর্ম মিশরের দারুল ইফতা তথা জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের একটি গবেষণা নিবন্ধ হতে পাওয়া।]

***

সারসংক্ষেপ:

. নারীরা পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন– এটি ভুল ধারণা। নারীরা কখনো কম, কখনো বেশি এবং কখনো সমান পেয়ে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পত্তি শুধু নারীরাই পেয়ে থাকেন। যেমন– (১) ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের কেবলমাত্র চারটি ক্ষেত্রে নারী সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের অর্ধেক পান। (২) চারটি ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও পুরুষ পুরোপুরি বঞ্চিত হন। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট নারী পান, পুরুষ কিছুই পান না। (৩) ১২টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় নারী অধিক পরিমাণে সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন। (৪) ১০টি অবস্থায় নারী সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের সমান পেয়ে থাকেন।

. উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের তুলনায় সর্বমোট সম্পত্তি কম পেলেও উপার্জন ও সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব হতে মুক্ত থাকায় নারীদের উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ পর্যাপ্ত হওয়ার কথা।

. মৃত সন্তানের পরিবারের সুরক্ষার জন্য মোট সম্পত্তির অনূর্ধ্ব এক–তৃতীয়াংশ অসিয়ত করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব, যা নিশ্চিত করাটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

. ইসলামী রাষ্ট্র মানেই সবার জন্য ইসলামী উত্তরাধিকার আইন– এমনটি নয়। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন শুধুমাত্র তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা এটিকে মানতে চাইবে (যেমন– মুসলিমগণ)।

. ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূল ভিত্তি হলো নারী-পুরুষের সম্পর্কনির্ভর পরিবারব্যবস্থা, যার মূলনীতি হলো পারিবারিক দায়িত্বনির্ভর অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা।

. নারী-পুরুষের মানবিক মর্যাদা অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রাকৃতিকভাবে নারী ও পুরুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা ভিন্নতর। এই দৃষ্টিতে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

. নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে পুঁজি করে আমাদের সমাজে নারীদের উপর চলমান সকল অমানবিক বৈষম্য রোধে আমাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করা উচিত।

***

ভূমিকা:

. ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: একটি পর্যালোচনা– এই প্রবন্ধটিতে সকল আলোচনা ইসলামী উত্তরাধিকার আইনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তাই, যারা এটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করবেন না (যেমন– অমুসলিমরা), তাদের পূর্ণ অধিকার থাকবে নিজস্ব পারিবারিক আইন অনুযায়ী জীবন যাপনের।

. ইসলামের উত্তরাধিকার আইন ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। ইসলামী সমাজ পরিবারকেন্দ্রিক। পরিবার বলতে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কনির্ভর চিরায়ত পরিবার ব্যবস্থাকেই বোঝানো হয়েছে।

. ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ‘ইসলাম অনুযায়ী ঠিক আছে’– এটি দেখানো এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অগ্রহণযোগ্য– এটি দেখানোও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।

. তাই ইসলামের মূলনীতির সাথে এ বিষয়টি সুসামঞ্জস্য কি না, তা দেখার সাথে সাথে আমরা যাচাই করার চেষ্টা করব একটি প্রস্তাবনা হিসাবে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন যুক্তিসংগত কি না।

. পুরো আলোচনাটিকে প্রশ্নোত্তর ধরনে সাজানো হয়েছে।

***

প্রশ্ন: আমি যেহেতু আমার ছেলেমেয়েকে লালন পালনের সময় কোনো পার্থক্য করি না, তাহলে আমার মেয়ে কেন উত্তরাধিকার প্রাপ্তির সময় ছেলেটির অর্ধেক পাবে?

উত্তর: আপনার/আমার কন্যা শিশুটি বড় হয়ে মা হবেন। ধারণা করা যায়, তিনি একটি পরিবারে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করবেন। একটি পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়ে, এমনকি সন্তানেরাও উপার্জন করতে পারে। তৎসত্ত্বেও, উপার্জনের দায়িত্ব এককভাবে শুধুমাত্র পিতার। কন্যা সন্তানটির তাবৎ ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব কখনোই সন্তানটির উপরে বর্তায় না। তাই উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রেও তাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: পরিবার প্রতিপালনে অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব হতে পুরোপুরি অব্যাহতি দেয়ার পর কন্যা সন্তানদেরকে আদৌ সম্পদের অংশীদার করা হলো কেন?

উত্তর: ব্যক্তিত্ব ও মানবীয় মর্যাদা নিশ্চিতকরণের অন্যতম অপরিহার্য শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা (সাপোর্ট) থাকা। নারীদের ক্ষেত্রে মোহরানা (ম্যারেজ গিফট) ও মীরাসের (আত্মীয়-স্বজনদের সম্পদ-সম্পত্তিতে প্রাপ্যতা) মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী মতাদর্শই প্রথম নারীদের এই একান্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক মর্যাদা তথা মানবিক মর্যাদা দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ অবধি এর কোনো বিকল্প নাই।

প্রশ্ন: নারীদেরকে সম্পত্তির অর্ধেক দেয়ার নিয়ম কেন?

উত্তর: সর্বক্ষেত্রে কম দেয়া হচ্ছে– এই বদ্ধমূল ধারণাটা ভুল। কেবলমাত্র চারটি ক্ষেত্রে নারী সংশ্লিষ্ট পুরুষের অর্ধেক পেয়ে থাকে। যেমন–

(). মৃতের ছেলে ও মেয়ে সন্তান জীবিত থাকলে অন্য কোনো স্বজন উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবে না। তখন মৃতের মোট সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ ছেলে  সন্তান পাবে এবং ১ ভাগ মেয়ে সন্তান পাবে।

(). শুধুমাত্র মৃতের পিতা ও মাতা জীবিত থাকলে তার সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ পাবে পিতা, আর ১ ভাগ পাবে মাতা।

(). মৃতের একজন ভাই ও একজন বোন থাকলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ পাবে ভাই, ১ ভাগ পাবে বোন।

(). অনুরূপভাবে মৃতের জীবিত আত্মীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে মরহুমের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ত৩ ভাগের ২ ভাগ বৈমাত্রেয় ভাই এবং ১ ভাগ বৈমাত্রেয় বোন পাবে।

নারীদের সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় কখনো বেশি দেয়া হয়, কখনো সমান দেয়া হয়, কখনো কম দেয়া হয়। সর্বোপরি উত্তরাধিকার হিসাবে সম্পত্তি কম পেলেও অর্থনৈতিক দায়মুক্তি থাকার কারণে নারীদের মোট উদ্বৃত্ত সম্পদ (আসলে পুরোটাই উদ্বৃত্ত) তাদের সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় অবশ্যই বেশি হওয়ার কথা। আমাদের সমাজে এতদসংশ্লিষ্ট ইসলামী আইনের সুষম প্রয়োগ না থাকার বিষয়টা নিতান্তই বেদনাদায়ক। ইসলামের আইন ও এর নীতি-আদর্শভিত্তিক এই তাত্ত্বিক হিসাব এবং আমাদের বাংলাদেশে এর বিপরীত করুণ সামাজিক বাস্তবতার বিষয়টা অতি স্পষ্ট হওয়ায় এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনা নিস্প্রয়োজন মনে করছি।

প্রশ্ন: নারীরা পুরুষের বেশি পা রকম কোনো প্রমাণ কি আছে?

উত্তর: সূরা নিসার ৭, ৮, ১১ ইত্যাদি আয়াতে উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি বর্ণিত আছে। সে অনুসারে নিচের হিসাবটা দেখুন:

() মৃতের স্বামী, পিতা, মাতা, কন্যা ও ছেলের কন্যা বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তিকে ১৫ ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বামী পাবে ৩ ভাগ, পিতা পাবে ২ ভাগ, মাতা পাবে ২ ভাগ, কন্যা পাবে ৬ ভাগ, ছেলের কন্যা পাবে ২ ভাগ। এক্ষেত্রে মৃতের ছেলের ঘরের কন্যা না থেকে পুত্র থাকলে সেই পুত্র কিছুই পাবে না। তখন হিসাবটা এ রকম– মৃতের সম্পত্তির ১৩ ভাগ করে = স্বামী ৩ ভাগ + পিতা ২ ভাগ + মাতা ২ ভাগ + কন্যা ৬ ভাগ + ছেলের ছেলে ০ ভাগ।

() মৃতের জীবিত স্বজনদের মধ্যে স্বামী, সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় বোন থাকলে মৃতের সম্পত্তিকে ১৫ ভাগ করে স্বামীকে দিতে হবে ৬ ভাগ, সহোদর বোনকে দিতে হবে ৬ ভাগ ও বৈমাত্রেয় বোনকে দিতে হবে ৩ ভাগ। অথচ, মৃতের বৈমাত্রেয় বোন না থেকে বৈমাত্রেয় ভাই থাকলে, তিনি সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও কিছু পাবে না। তখন হিসাবটা হবে নিম্নরূপ:

মৃতের সম্পত্তি ২ ভাগ = স্বামী ১ ভাগ + সহোদর বোন ১ ভাগ + বৈমাত্রেয় ভাই ০ ভাগ। বাদ পড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মতো বৈমাত্রেয় ভাইও তার বৈমাত্রেয় বোনের রেখে যাওয়া সম্পত্তির কোনো অংশের উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবে না।

() মৃতের স্বজনদের মধ্যে শুধুমাত্র পিতা, দাদা ও দাদী বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৬ ভাগের ৫ ভাগ পাবে, পিতা আর দাদী পাবে ১ ভাগ। দাদা কিছু পাবে না।

() শুধুমাত্র নানা ও নানী বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তির পুরোটাই নানী পাবে। নানা কিছু পাবে না।

প্রশ্ন: উত্তরাধিকার বন্টনের নিয়ম (তথা এই বৈষম্যের (?) হেতু) কী?

উত্তর: ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে ১২ জনের অংশ নির্ধারিত। এদের ৮ জনই নারী (মা, মেয়ে, স্ত্রী, ছেলের মেয়ে, সহোদরা বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় বোন, দাদী, নানী)। নির্ধারিত উত্তরাধিকার পাবে এমন পুরুষের সংখ্যা ৪ জন (বাবা, স্বামী, দাদা ও মায়ের দিক থেকে ভাই)। এই ৪ জন পুরুষ ছাড়া সকল পুরুষ উত্তরাধিকারী ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘আসাবা’ বা অবশিষ্টাংশ ভোগী। ‘যাবিল ফুরুজ’ হিসাবে নির্ধারিত অংশসমূহ বণ্টিত হওয়ার পরে আসাবাগণ (অধিকাংশই পুরুষ) পেতেও পারেন, নাও পেতে পারেন। যেমনটি উপরের ৪টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষগণকে ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে এবং সমপর্যায়ের নারীকে প্রাধান্য বা পুরোটাই দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: নারীরা সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের অধিক পাবে কখন?

উত্তর: ৩(৮) মৃতের স্বামী, এক কন্যা ও চাচার উপস্থিতিতে মৃতের সম্পত্তি ৪ ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বামী ১ ভাগ, চাচা ১ ভাগ ও কন্যা ২ ভাগ পাবে।

() উপরের হিসাবে যদি কন্যা দুইজন হয়, তাহলে মৃতের সম্পত্তি ১২ ভাগ করা হবে। সেক্ষেত্রে কন্যারা ৪ ভাগ করে মোট ৮ ভাগ পাবে, স্বামী পাবে ৩ ভাগ ও চাচা পাবে ১ ভাগ।

(১০) মৃতের এক কন্যা ও দুই ভাই থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৪ ভাগের ২ ভাগ পাবে কন্যা, আর ভাইয়েরা পাবে ৪ ভাগের ১ ভাগ করে ২ ভাগ।

(১১) মৃতের স্বামী, দুই জন সহোদরা বোন ও মা থাকলে মৃতের সম্পত্তি ৮ ভাগ করে এর ৩ ভাগ পাবে স্বামী, ২ বোন পাবে ৪ ভাগ ও মা পাবে ১ ভাগ। তবে মৃতের স্বামী ও মায়ের উপস্থিতিতে দুই বোনের পরিবর্তে দুই ভাই থাকলে স্বামী পাবে ৬ ভাগের ৩ ভাগ, মা পাবে ১ ভাগ ও দুই জন ভাইয়ের প্রত্যেকে পাবে ৬ ভাগের ১ ভাগ করে।

(১২) অনুরূপভাবে মৃতের বৈমাত্রেয় দুই ভাই থাকলে যা পেতো, তদস্থলে বৈমাত্রেয় দুই বোন থাকলে তারা তুলনামূলকভাবে বেশি পাবে। (হিসাব: স্বামী ৩ ভাগ + বৈমাত্রেয় দুই বোন ৪ ভাগ + মা ১ ভাগ = ৮ ভাগ। # স্বামী ৩ ভাগ + বৈমাত্রেয় দুই ভাই ২ ভাগ + মা ১ ভাগ = ৬ ভাগ।]

(১৩) মৃতের স্বামী, পিতা, মাতা ও মেয়ে জীবিত থাকলে মৃতের মেয়ে সন্তান যা পাবেন, মেয়ে না থেকে ছেলে থাকলে, সেই ছেলে এর থেকে অনেক কম পাবে। [স্বামী ৩ ভাগ + পিতা ২ ভাগ + মাতা ২ ভাগ + মেয়ে ৬ ভাগ = ১৩ ভাগ। # স্বামী ৩ ভাগ + পিতা ১ ভাগ + মাতা ১ ভাগ + ছেলে ১ ভাগ = ৬ ভাগ।]

(১৪) মৃতের স্বামী, মায়ের পাশাপাশি একজন সহোদরা বোন থাকলে যা পাবে, বোন না থেকে একজন সহোদর ভাই থাকলে সে বোনের প্রাপ্য অংশের চেয়ে কম পাবে। [স্বামী ৩ ভাগ + মা ১ ভাগ + সহোদরা বোন ৩ ভাগ = ৭ ভাগ। # স্বামী ৩ ভাগ + মা ১ ভাগ + সহোদর ভাই ২ ভাগ = ৬ ভাগ]

প্রশ্ন: উপরের উদাহরণগুলোতে সংশ্লিষ্ট পুরুষ সমপর্যায়ের নয় সংশ্লিষ্ট নারী/নারীরা রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে মৃতের অধিকতর কাছের স্বজন তাই তাদের বেশি পাওয়াটা স্বাভাবিক এমন কোনো উদাহরণ আছে কি যাতে রক্তের দিক থেকে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের নারী-পুরুষের মধ্যে উত্তরাধিকার বন্টনের সময় নারীরা বেশি পা?

উত্তর: নিম্নের উদাহরণ থেকে দেখা যাবে রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে সমপর্যায়ের হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষের বেশি পায়–

(১৫) স্বামী, পিতা, মাতা ও দুইজন কন্যার বদলে কোনো মুসলিম নারী স্বামী, পিতা, মাতা ও দুইজন পুত্র রেখে মারা গেলে পুত্রদের চেয়ে কন্যারা বেশি পরিমাণে সম্পত্তি পাবে। [স্বামী ৩ ভাগ + পিতা ২ ভাগ + মাতা ২ ভাগ + কন্যাদ্বয় ৮ ভাগ = ১৫ ভাগ। # স্বামী ১৫ ভাগ + পিতা ১০ ভাগ + মাতা ১০ ভাগ + পুত্রদ্বয় ২৫ ভাগ = ৬০ ভাগ।]

(১৬) শুধুমাত্র পিতা, মাতা ও স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় মৃতের সম্পত্তিতে মা, তার বাবার দ্বিগুণ পাবে। [পিতা ১ ভাগ + মাতা ২ ভাগ + স্বামী ৩ ভাগ = ৬ ভাগ]

কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট নারী রক্তের সম্পর্কের দিক হতে দূরের হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে বেশি পরিমাণে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়। যেমন:

(১৭) ওয়ারিশ যদি হয় স্ত্রী, মা, বৈপিত্রেয় দুইজন বোন এবং দুই জন সহোদর ভাই, তখন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও বৈপিত্রেয় দুইজন বোন, মৃতের আপন দুইজন ভাইয়ের চেয়ে বেশি পাবে। [স্ত্রী ৩ ভাগ + মা ৩ ভাগ + সহোদর দুই ভাই ১ ভাগ করে মোট ২ ভাগ + বৈপিত্রেয় দুই বোন ২ ভাগ করে মোট ৪ ভাগ = ১২ ভাগ।]

(১৮) অনুরূপভাবে ওয়ারিশ যদি হয় স্বামী, দুই জন সহোদর ভাই ও দুই জন বৈপিত্রেয় বোন তখনও বৈপিত্রেয় বোনেরা সহোদর ভাইয়ের চেয়ে মৃতের সম্পত্তি পাবে কম (অর্ধেক)। [স্বামী ৬ ভাগ + সহোদর দুই ভাই ১ ভাগ করে মোট ২ ভাগ + বৈপিত্রেয় দুই বোন ২ ভাগ করে মোট ৪ ভাগ = ১২ ভাগ।]

(১৯) স্বামী, মা, দুইজন সহোদর ভাই ও একজন বৈপিত্রেয় বোন থাকা অবস্থায় মৃতের ভাইয়ের তুলনায়  বৈপিত্রেয় বোন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে মৃতের সহোদর ভাইদ্বয়ের দ্বিগুণ পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হবে। [স্বামী ৬ ভাগ + মা ২ ভাগ + সহোদর দুই ভাই ১ ভাগ করে মোট ২ ভাগ + বৈপিত্রেয় এক বোন ২ ভাগ = ১২ ভাগ।]

প্রশ্ন: কোন কোন‌ অবস্থায় নারীরা পুরুষের সমান মীরাস পা?

উত্তর: ১০ অবস্থায় নারীরা পুরুষের সমান মীরাস পেয়ে থাকে–

(২০) পিতা-মাতা সমান পায় ছেলের ঘরে নাতি থাকলে। [পিতা ১ ভাগ + মাতা ১ ভাগ + নাতি ৪ ভাগ = ভাগ।]

(২১) মৃতের শুধুমাত্র বৈপিত্রেয় দুই ভাইবোন থাকলে, তারা সমান পাবে। [বৈপিত্রেয় ভাই ১ ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ১ ভাগ = ২ ভাগ।]

(২২) মৃতের ওয়ারিশ হিসাবে অন্যান্যদের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভাইবোন থাকলে সব ধরনের বোন (সহোদরা, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রিয়) বৈপিত্রেয় ভাইয়ের সমান পাবে। যেমন: [বৈমাত্রেয় ভাই ২ ভাগ + বৈপিত্রেয় ভাই ১ ভাগ + বৈমাত্রেয় বোন ১ ভাগ + সহোদরা দুই বোন ১ ভাগ করে ২ ভাগ = ৬ ভাগ।]

(২৩) মৃতের একমাত্র কন্যা ও আপন একজন চাচার উপস্থিতিতে উভয়ে অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।

(২৪) মৃতের ছেলের ঘরে ছেলে থাকলে নানী, পিতার সমান পাবে। এক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারছি, এরা ৩ জন ছাড়া মৃতের ওয়ারিশযোগ্য আর কোনো স্বজন নাই। [ছেলের ঘরে নাতি ৪ ভাগ + পিতা ১ ভাগ + নানী ১ ভাগ = ৬ ভাগ।]

(২৫) মাতা, দুইজন বৈপিত্রেয় বোন, স্বামী ও একজন সহোদর ভাই যখন কোনো মৃতের ওয়ারিশ হয়, তখন মৃতের মাতা তদীয় সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে। [স্বামী ৩ ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ২ জন ১ ভাগ + মাতা ১ ভাগ + ভাই ১ ভাগ = ৬ ভাগ।]

(২৬) সহোদর বোন স্বামীর সাথে ওয়ারিশ হলে সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে। [স্বামী ১ ভাগ + ভাই ১ ভাগ + বোন ১ ভাগ = ৩ ভাগ।]

(২৭) মৃতের স্বামী ও মাতার উপস্থিতিতে অন্য কেউ না থাকলে বৈপিত্রেয় বোন সহোদর ভাইয়ের সমান পাবে। [স্বামী ৩ ভাগ + মাতা ১ ভাগ + সহোদর ভাই ১ ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ১ ভাগ = ৬ ভাগ।]

(২৮) মৃতের ওয়ারিশ হিসাবে মেয়ের ছেলে, মেয়ের মেয়ে, মামা ও খালা ছাড়া ওয়ারিশযোগ্য কেউ জীবিত না থাকলে সবাই সমান অংশ পাবে। [মেয়ের ছেলে ১ ভাগ + মেয়ের মেয়ে ১ ভাগ + মামা ১ ভাগ + খালা ১ ভাগ = ৪ ভাগ।]

প্রশ্ন: দাদার বর্তমানে পিতার মৃত্যু হলে তার সন্তানেরা দাদার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত এটি কি  অন্যায় নয়?

উত্তর: কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় অন্যরা তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কীভাবে হবে? এক্ষেত্রে ছেলের পরিবারের সুরক্ষার জন্য দাদা তার সম্পত্তির এমনকি এক তৃতীয়াংশও অসিয়ত করতে পারে, যা তাদের সম্ভাব্য প্রাপ্য ওয়ারিশী হিস্যার বেশিও হতে পারে।

প্রশ্ন১০: বাবার মৃত্যুর পর দাদা যদি তার মৃত পুত্রের পরিবারকে তদীয় সম্পত্তির অংশবিশেষ অসিয়ত না করে বা না করতে পারে, তাহলে?

উত্তর: রাষ্ট্র এই অছি’র ভূমিকা নিতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অসিয়তকে বাধ্যতামূলক করতে পারে বা করা হয়েছে ধরে নিতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্র তথা কল্যাণরাষ্ট্র না থাকাতে এ সমস্যা আমাদের দেশে প্রকট। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকলে ওয়ারিশ হতে বা যে কোনো প্রকারে বঞ্চিতদের দায়িত্ব গ্রহণে সরকার বাধ্য।

প্রশ্ন১১: ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরাও কি ইসলামী উত্তরাধিকারী আইন মানতে বাধ্য?

উত্তর: না, ইসলামী উত্তরাধিকার আইন শুধুমাত্র তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা এটিকে সঠিক মনে করবে। যেমন, মুসলিমরা।

প্রশ্ন১২: এই উত্তরাধিকার আইন বলবৎ করা ছাড়া কি ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে?

উত্তর: ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ে অসিয়ত বা প্রচলিত দেশীয় পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বণ্টিত হতে পারে। যেমন– তৃতীয় হিজরীর শেষের দিকে সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র পরবর্তীকালে বলবৎকৃত উত্তরাধিকার আইন ব্যতিরেকে চলছিল। তখন মৃত্যুকালে অসিয়ত করা মুসলিমদের জন্য অত্যাব্যশক ছিল, যা মীরাসী আইনের উপস্থিতিতে ঐচ্ছিক হিসাবে কার্যকর রয়েছে।

প্রশ্ন১৩: ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি কী?

উত্তরঃ ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে:

. মৃত ব্যক্তির সাথে ওয়ারিশের নৈকট্য।

. নতুন প্রজন্ম বা বংশধর প্রবীণদের তুলনায় বেশি পাবে।

. সংশ্লিষ্টের সামাজিক দায়ভার ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তা।

***

পর্যালোচনা মন্তব্য:

. উত্তরাধিকার আইনসহ ইসলামী সকল আইন ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। ইসলামী রাষ্ট্র তথা সমাজ নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক সম্পর্কনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান ও বিবাহ নামক একটি প্রথার উপর নির্ভরশীল।

. যারা প্রচলিত পরিবার নামক এই মূল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের স্থলে ‘লিভ টুগেদারকে’ স্থান দিতে চান, তাদের গ্রহণযোগ্য যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে– গে এবং লেসবিয়ান ‘বিয়ে’ আইনসিদ্ধ হলে প্রাণী কিম্বা উপযোগী কৃত্রিম ব্যবস্থার সাথে ‘ভার্চুয়াল বিয়ে’ আইনসম্মত হবে না কেন? যদি হয়, তাহলে সে ধরনের মানবীয় রুচিবিরোধী কার্যক্রমকে বিয়ে বলা হবে কেন?

. বিয়ে হচ্ছে নর-নারী সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি ও এ সম্পর্ককে সম্ভাব্য দায়বদ্ধতার সীমা স্থিত করা। এটিকে যদি আমরা মানি, প্রচলিত পরিবারব্যবস্থাকেও আমাদের মানতে হবে। তা যদি মানি, তাহলে অপরাপর যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই এর একটি স্তরবিন্যাস থাকা বাঞ্ছনীয়।

. ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী মানুষ হিসাবে নারী-পুরুষ সমান। যেসব ক্ষেত্রে নারীদেরকে দায়িত্বমুক্ত রাখা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির অনুরূপ কর্মবিন্যাস নিশ্চিতকরণ। অধিকারের সাথে দায়িত্ব সম্পর্কিত। বাইরের ভারী কাজগুলো পুরুষ করবে, আর ঘরের হালকা কাজগুলো নারীরা করবে।

. নারী-পুরুষের ভিন্নতা অলংঘনীয়। এই প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে গ্রহণ করেই আমরা সবাই মানুষ। Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW)’র (৭ এপ্রিল, ২০১১) ভূমিকার চতুর্থ প্যারার ‘As defined in article 1, discrimination is understood as any distinction, exclusion or restriction made on the basis of sex… in the political, economic, social, cultural, civil or any other field.’ এই অংশটুকু নিতান্তই বাড়াবাড়ি নয় কি?

. বৈষম্যের (ডিসক্রিমিনেশন) প্রকৃত অর্থ হওয়া উচিত নারীর উপর পুরুষ কর্তৃক একতরফাভাবে আরোপিত অন্যায্য ও বঞ্চনামূলক বিষয়াদি। আসুন, সেসব চিহ্নিত ও প্রতিরোধ করে মানবিক সমতাকে নিশ্চিত করি।

৭. সকল ক্ষেত্রে সমতা– একটি কষ্টকর কল্পনা মাত্র। মানবিক সমতা সত্ত্বেও আইনের ইক্যুইটিবল ডিস্ট্রিবিউশন একটি অপরিহার্য বিষয়। ইক্যুইটি ইজ দ্যা ট্রু সেন্স অব ইক্যুয়ালিটি। যেটি হচ্ছে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মর্মবাণী।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *