১.

সত্যতা হচ্ছে তা যা কোনোকিছুকে সত্য হিসাবে প্রতিপন্ন করে। এই অর্থে সত্যতা বলা আর সত্য বলা একই কথা।

যা কিছুকে আমরা সত্য বলি, বস্তুগত দিক থেকে তা স্বতঃই পরিবর্তনশীল। তাই, পরিবর্তনশীলতার দিক থেকে দেখলে, পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। অর্থাৎ পরিবর্তন হওয়ার সার্বিক নিয়মই জগতে একমাত্র অপরিবর্তনীয় সত্য। গতি হলো পরিবর্তনের কারণ।

অতএব, সত্যতা মাত্রই এক ধরনের স্ববিরোধিতার ব্যাপার। পার্টিকুলারলি সবকিছুই পরিবর্তনশীল। অন্টলজিকেলি, পরিবর্তন হওয়ার এই সার্বিক নিয়মটা কিন্তু স্বয়ং অপরিবর্তনশীল।

কথাটা অন্যভাবে বললে, পরিবর্তন যা আমরা দেখি, তা যদি নিয়মের অধীন হয়, তাহলে এই ‘পরিবর্তন হওয়ার নিয়মটাও’ কিন্তু তার মতো করে একটা সত্তা বটে।

তো, দেখা যাচ্ছে, অন্টলজিকেলি জগতটা প্লুরালিস্টিক। অন্তত দু’ভাগের: প্রথমত: জগতের সবকিছু, যা নিয়ত পরিবর্তনশীল। দ্বিতীয়ত: এই ‘নিয়ত পরিবর্তনশীল’ হওয়ার অপরিবর্তনীয় ‘নিয়ম’।

এর মানে হলো, পরিবর্তনই সত্য, যদিও এই সত্যতার কোনো পরিবর্তন নাই। তাই, তা আসলেই সত্য বটে।

২.

সত্যতা বা সত্যকে আমরা অভিজ্ঞতা দিয়ে পাই। কথাটা আংশিক সত্য। এর সত্যতার অংশ হলো যে ধরনেরই হোক না কেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া সত্য উৎপাদন বা প্রতিপাদন হয় না। সম্ভব না। এটিও আমরা অভিজ্ঞতাতেই পাই।

অন্যদিকে, সত্যকে আমরা অভিজ্ঞতায় পাওয়ার কথা যদি বলি, জগতে বস্তুগত সবকিছুর সতত পরিবর্তনশীলতার অভিজ্ঞতার আলোকে কোনোকিছুকে নিছক অভিজ্ঞতায় অপরিবর্তনীয় তথা সত্য হিসাবে পাওয়া অসম্ভব। আমাদের অভিজ্ঞতাতেই আমরা এই ‘ক্ষণিকত্বের’ প্রমাণ পাই।

৩.

সত্যকে আমরা নির্মাণ করি। মানলাম। তো, সত্যকে আমরা কীভাবে নির্মাণ করি? যা আছে, সে অনুসারে? নাকি আমাদের খেয়াল-খুশি অনুসারে? এখানে সাবজেক্টিভিটি-অবজেক্টিভিটির প্রশ্ন এসে পড়ে।

এমনকি আমরা যদি, সত্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা সাবজেক্টিভিটির ওপরই বেশি জোর দেই, তখনও প্রশ্ন থাকে, এই সত্যতা নির্মাণকারী ব্যক্তিসত্তার কোনো অবজেক্টিভিটি কি আছে? হ্যাঁ বললে আপনি অন্তহীন পরম্পরায় ভুগবেন, না বললে দ্বিমুখিতার সমস্যা তৈরী হবে।

৪.

দেখা যাচ্ছে, কোনোকিছুকে সত্য ধরে না নিয়ে সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ বা নির্মাণের কাজে অগ্রসর হওয়া যায় না। ধরে নিলাম, যা কিছু আমরা অগত্যা ধরে নেই, মানে assume করি, তা আসলে ‘আসল’ নয়। নিছক ধরে নেয়াই। এর বেশি কিছু নয়।

নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাব্যতা ছাড়া কোনোকিছু সম্ভাব্য হতে পারে না। হতে পারে, যা কিছুকে সম্ভাব্য বলা হচ্ছে, তা হয়তো এখানে, না হয় ওখানে, না হয় অন্য কোনোখানে আছে। সম্ভাব্যতা ও নিশ্চয়তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

ব্যাপার হলো, অনুসন্ধান শুরুর  আগে সম্ভাব্য কিছুকে আমরা কীভাবে অনুমান করি? পাওয়ার আগেই কীভাবে আমরা ধারণা করি, পেতেই হবে বা পেতেও তো পারি দেখি না চেষ্টা করে?

৫.

উপসংহারকে আমরা পরে পাই, যাচাই করে গ্রহণ করি। সমস্যা হলো, উপসংহারের পূর্ব-অনুমান, যাকে আমরা প্রস্তাবনা বা ভূমিকা বলি, তা আমরা কীভাবে ঠিক করি? নিশ্চয়তা স্বয়ং যদি আদৌ না থেকে থাকে, এর হাতছানি কেন আমাদেরকে এগিয়ে যেতে প্রলুদ্ধ করে? নিশ্চয়তা যদি অলরেডি আছে হিসাবেই থেকে থাকে, তাহলে জানা মানা কি দূরের নিশ্চয়তাকে কাছে গিয়ে নিশ্চিতভাবে দেখার মতো কেনো ব্যাপার?

দেখা যাচ্ছে, জানা বা সত্যতা নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব বা ফ্যান্টাসী কাজ করে। ব্যাপারটি কি এ রকম, যখন  আমি সত্যকে জানি, তখন আসলে যা ইতোমধ্যেই স্বনির্ভর সত্য, যা আমার মধ্যে জ্ঞান হিসাবে অগোচরে রয়ে গেছে, তাকেই আমি নতুন করে সত্য হিসাবে নির্মাণ করি বা ‘অর্জন’ করি? সোজা কথায়, আমরা কি জানাকেই নতুন করে জানি? তাহলে নতুন জ্ঞান বলে কি কিছু নাই?

৬.

সত্যতা অলরেডি আছে অথবা তা আমরা নিছক কাস্টমাইজ করি, মানে নির্মাণ করি, কথাটা যেভাবেই বলি না কেন, সত্যতাকে পাওয়ার উপায় হলো অতিন্দ্রীয়তা। তাকে আপনি বুদ্ধি বলুন, স্বজ্ঞা বলুন, সেটা আলাদা ব্যাপার।

মোদ্দা কথা হলো, হোক তা মস্তিস্ক নামক বস্তুটারই বিশেষ গুণ, আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য হলো এমন এক গুণ যা দিয়ে আমরা জগতকেই বিচার করতে পারি যদিও আমরা জগতেরই নগন্যতম অংশমাত্র।

৭.

চিন্তার এই অসাধারণ গুণ দিয়ে আমরা সত্যতা বা সত্যকে জানতে পারি। এই দৃষ্টিতে, সত্যতা বা সত্য একক চরিত্রের। এবং অপরিবর্তনীয়।

তাহলে একেক মানুষের ‘প্রাপ্ত’ সত্যতা এক এক রকমের হয় কেন?

কারণ, সব মানুষেরা সমভাবে চিন্তা করে না বা করতে পারে না।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *