মানুষ জগতের অংশ। অত্যন্ত ক্ষুদ্র, একেবারে তুচ্ছ। জগতের বিশালত্ব ও সামগ্রিকতার তুলনায়। সেই মানুষ জগত সম্পর্কে নির্দ্বিধায় মন্তব্য করে। বলে, জগতের সৃষ্টিকর্তা আছে, জগতের সৃষ্টিকর্তা নাই, জগত অসীম বা জগত সসীম। জগত এভাবে হয়েছে, ওভাবে হয় নাই। ইত্যাদি। আস্তিক, নাস্তিক বা সংশয়বাদী যা-ই হোন না কেন, তিনি দাবী করেন, তিনি জগত সম্পর্কে জানেন। যেটা বা যেটুকু জানেন না, বা জানা সম্ভব নয় মনে করেন, তারও এক ধরনের ‘অজানা অস্তিত্ব’কে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন বা দাবী করেন। সে অর্থে সেই ‘অজানা যাকিছু’, তাকেও তিনি নেতিবাচক অর্থে জানেন।

প্রাক-সমকালীন ও সমকালীন তথা জ্ঞানতত্ত্বের পুরো আলোচনাতে এটি সবাই-ই স্বীকার করেন, জ্ঞান হলো জ্ঞাতা (knower) ও জ্ঞেয় (known) এর সম্পর্ক। যেমন এই যে ল্যাপটপটা যাতে আমি লিখছি, এ ব্যাপারে জ্ঞাতা হলাম আমি আর জ্ঞেয় বস্তু হলো এই ল্যাপটা। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমি এটি জানছি। তাই, যখন আমি বলি, “এটি একটা ল্যাপটপ” – এই জ্ঞানকে বলা হবে অভিজ্ঞতার জ্ঞান (empirical knowledge)।

এই লেখাগুলো, যা আমি লিখছি, তা নিয়ে আমি চিন্তা করছি। আমি যা লিখছি, তা আমি সঠিক মনে করি। সে অর্থে এই লেখাগুলোর যে মর্মার্থ, সোজা কথায়, এই লেখাগুলোর যে অর্থ (meaning) তার সাথে আমার সম্পর্ক চিন্তা বা বুদ্ধির। তাই, যখন আমি বলি, “এই লেখাগুলো সঠিক” – তখন আমার এই উক্তিটা বুদ্ধিগত জ্ঞানকে (rational knowledge) নির্দেশ করে।

তাহলে, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তু বা বিষয়ী ও বিষয়ের মধ্যকার যোজনী বা সম্পর্ক যখন অভিজ্ঞতা তখন তা অভিজ্ঞাতগত জ্ঞান। যখন তা বুদ্ধি, তখন তা বুদ্ধিগত জ্ঞান। এভাবে জ্ঞানের দুই প্রান্তকে সংযুক্তকারী উৎসের ওপর নির্ভর করে আমরা জ্ঞানের প্রকার বা ধরন নির্ণয় করি। যে জ্ঞানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়’র সম্পর্ক কি দিয়ে হয়েছে, তা জ্ঞাতা বুঝতে পারে না, অথচ তিনি প্রাপ্ত জ্ঞান সম্পর্কে শুরু থেকেই বা হঠাৎ করে পূর্ণ নিশ্চয়তা অনুভব করেন, তখন সেই বিশেষ জ্ঞানকে স্বজ্ঞাত জ্ঞান (intuitive knowledge) বলা হয়। স্বজ্ঞাত জ্ঞান হলো সরাসরি জ্ঞান।

স্বজ্ঞাত জ্ঞানে মধ্যবর্তী প্রক্রিয়াকে জানা কোনো উৎসের সাথে চিহ্নিত করা না গেলেও এটি জ্ঞানের দ্বি-পক্ষ সম্পর্ককে (two-fold relation) অস্বীকার করে না।

জ্ঞান মাত্র দুই পক্ষের ব্যাপার। এমন কি আত্মজ্ঞানেও দুই পক্ষ। আমি জ্ঞাতা হিসাবে এবং আমি জ্ঞেয় হিসাবে। আমার ধারণাকে আমি আমার (পূর্ব)জ্ঞান দিয়ে যাচাই করি।

এই ‘পূর্ব-জ্ঞান’ যা স্বজ্ঞাত বৈশিষ্ট্যের তা আসলো কোত্থেকে? এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হচ্ছে, প্রকৃতি বা প্রকৃতির নিয়ন্তা হিসাবে ঈশ্বরের কাছ থেকে। আমাদের প্রথমত আমিত্ব এরপরে বাদবাকী যা কিছু, চেতনা (consciousness) হচ্ছে তার পূর্ব শর্ত । চেতনাকে বলা চলে মৌলিকতম পূর্ব-জ্ঞান।

এই চেতনা বস্তু থেকে উৎসরিত বিধায় বস্তুবাদীরা চেতনাকেই স্বয়ং বস্তু দাবী করে। এটি genesis fallacy’র উদ্ভব ঘটায়। জেনেসিস ফ্যালাসি হলো, কোনো কিছুকে তার উৎপত্তি বা উৎসের সাথে আইডেন্টিক্যাল মনে করা। চেতনা এবং তৎসূত্রে বুৎপত্তিগত অনুপপত্তি নিয়ে অন্য লেখায় ফোকাস করা যাবে। আমাদের বর্তমান বিবেচ্য হলো, জ্ঞান একটা দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। এমনকি আত্মজ্ঞানও এর বাইরে নায়।

এবার আসুন, জগতকে আমরা কীভাবে জানি, তা খতিয়ে দেখি। জগত ও জগতের যা কিছুকে আমরা জানি তাকে আমরা অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, অন্যদের স্বাক্ষ্য, কোনো স্বীকৃত অথরিটি, স্বজ্ঞা ইত্যাদি সোর্স থেকে জানি।

আমরা কী জানি, কীভাবে জানি, সেই জানাটা কতটুকু সঠিক – এর কোনোটাই এই প্রবন্ধের বিবেচ্য বিষয় নয়। যেভাবেই হোক না কেন, যত কমই হোক না কেন, ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক, জগতকে আমরা যার মতো করে জানি বটে। এমনকি, “জগতকে জানা সম্ভব  নয়” – এমন উক্তিতেও জগত তত্ত্বগতভাবে (ontologically) বিদ্যমান থাকে।

জগতকে অস্বীকার করলে আমরা স্বরিরোধিতার (liar paradox) মতো অস্বস্তিকর অবস্থায় পতিত হই। যখন কেউ বলে, “আমি জানি না” তখন তিনি অন্তত এতটুকু তো জানেন যে, তিনি জানেন না। এই দৃষ্টিতে “জ্ঞান সম্ভব নয়” এই ধরনের কথাবার্তাগুলো আদতে বিরোধপূর্ণ (self-refuting)।

জগতকে যখন আমরা জানি, তখন যার যার জ্ঞানগত অবস্থানের আলোকে আমরা প্রত্যেকেই এক একজন কর্তা (subject) আর জগত হলো বিষয় (object)।

জ্ঞানতত্ত্বের প্যাঁচঘোচের মধ্যে না গিয়েও আমরা বুঝতে পারি, জগত সম্পর্কে যখনই আমরা কোনো উক্তি করি তখন আমরা নিজেদেরকে জগতের উর্দ্ধে নিয়ে যাই। অথচ, আস্তিক-নাস্তিক-সংশয়বাদী নির্বিশেষে সবাই-ই এ বিষয়ে একমত যে, আমরা কখনো জগতকে বস্তুগতভাবে (physically) ছাড়িয়ে যেতে পারবো না। অর্থাৎ টেবিল-চেয়ার, গ্রহ-নক্ষত্র বা অনু-পরমানুর মতো জগতকে বিষয় (object) হিসাবে সামনে রেখে জ্ঞানচর্চা করা অসম্ভব।

তাই, জগত সম্পর্কে বিশেষ কোনো উক্তি = আমি + জগত (world or worlds or multiverses, whatever)

উপরেই বলেছি, এই বিশেষ উক্তি হতে পারে, “জগত সৃষ্ট”, এতএব “ঈশ্বর আছেন” অথবা “জগত চিরন্তন”, অতএব, “ঈশ্বর নাই” কিংবা “ঈশ্বর আছে কিনা জানি না” ইত্যাদি।

জগতের ভিতরে থেকে কীভাবে আমরা উপরোক্ত ধরনের জ্ঞানগত অভিজ্ঞতা লাভ করি?

জ্ঞান ও যাচাইয়ের (justification) দ্বি-পক্ষ সম্পর্ক অনুসারে আমরা ঈশ্বরের মতো সামগ্রিক দৃষ্টিভংগীর (birds eye view point) ভিত্তিতে এ ধরনের মৌলিক প্রশ্ন সুরাহা করি। তা ভুল-শুদ্ধ যাই হোক। এমন কি যারা নির্বিকারবাদী (irrelevantist), তারাও এই ধরনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর এভাবেই নির্ধারণ করে থাকেন।

এ ধরনের ‘মুক্ত’ চিন্তার কেউ বলতেই পারেন, আমি জগত সম্পর্কে আদৌ ভাবি না। [কেবল নিজের সম্পর্কে ভাবি – এ রকম কিছু?] তিনি ভাবেন, এ জগতই শেষ। এ জীবন নিছক মহাজাগতিক লটারী জয়ের মতো একটা আকষ্মিক ব্যাপার। যথাসম্ভব সামষ্টিক কল্যাণ (well being) এর মাধ্যমে খেয়ে পড়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকাটাই বড় কথা।

খেয়াল করে দেখুন, এ ধরনের মুক্ত-চিন্তকগণ জগতের সত্তাগত সত্য নিরূপণে বিরোধে লিপ্ত আস্তিক-নাস্তিকসহ নিজের মতের বাইরের সব পক্ষকেই বাস্তবে ভুল সাব্যস্ত করছেন। এই দৃষ্টিতে তিনি জগত সম্পর্কে তার বিশেষ ধরনের জ্ঞানেরই অনুসরণ করছেন।

হু, জ্ঞান এমন এক জিনিস, এমন এক মারাত্মক চীজ, যা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নাই। জ্ঞান সঠিক হোক বা ভুল হোক, জ্ঞান অর্জন না করে জগতে বসবাস করার কোনো উপায় নাই। ছুরি আর তরমুজের সম্পর্কের মতো। অনিবার্যভাবে মারাত্মক পরিণতির ব্যাপার। রীতিমতো ডেন্জারাস ডিলেমা। স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে ও যথাসম্ভব যাচাই করে জ্ঞান অর্জন না করলে, জোটনিরপেক্ষ পক্ষ হিসাবে এক বিবিধ খাতে আপনি অবচেতনে প্রক্ষিপ্ত (identified) হবেন। খাদ্য গ্রহণে অস্বীকার করে বিষ পানে আত্মহত্যার মতো জ্ঞান ছাড়া জীবন অসম্ভব।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিজের ঐশ্বরিক জ্ঞানগত ক্ষমতা নিয়ে আপনার কিছুটা আস্থা তৈরী হয়েছে। মানুষের জ্ঞানগত ঐশ্বরিক এই ক্ষমতার অন্যতম প্রমাণ হিসাবে সমকালীন জ্ঞানতত্ত্বে জ্ঞানের সীমা তথা সংশয়বাদ নিয়ে আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টপিক brain in vitamin (BIV) যুক্তি নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *