বিষয়টা কী হওয়া উচিত, বা আমি আসলে কী বলতে চাইছি তা আমার কাছেই ততটা পরিষ্কার নয়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়টার বিপরীত মনে করে যা কিছুকে আমি পর্যালোচনা-সমালোচনা করছি তা ততধিক সুনির্দিষ্ট বা প্রেসাইজ – এমন অবস্থা কোনো বিষয়ে একজন নবীন শিক্ষার্থী বা কমনার-বিগিনারদের জন্য কোনো সমস্যার ব্যাপার নয়।
একজন ‘জ্ঞান পথের যাত্রী’ যখন নিজেকে ক্রিটিক হিসাবে দাবী করে প্রস্তাবনার দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে চান তাতে দোষের কিছু দেখি না। শিশুরা যেমন প্রশ্ন করে। কী হবে তা ঠিক না জেনেই তারা প্রশ্ন তোলে। একজন নবীন ‘জ্ঞান পথের যাত্রী’, যেমন একজন শিশু বা কিশোর, কোনো উত্তরকেই কনক্লুসিভলি গ্রহণ করে না। সে যাচাই করে। এমনকি তার নিজের অনেক ‘নিশ্চিত সঠিক জ্ঞান’ যে আসলে এডহক-নলেজ বা ‘আপাতত (সঠিক) জ্ঞান’ তা সে নিজেই জানে না।
শিশু-কিশোর কিংবা কোনো বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের আগ্রহীদের জন্য এ ধরনের ক্রিটিক্যাল এপ্রোচ বেশ কার্যকরী। জ্ঞানের প্রতি নির্মোহ আবেগ ও সত্যকে খুঁজে নেয়ার কমিটমেন্টের কারণে তারা উদ্ভাসিত সত্যকে চট করেই ধরে ফেলে। সে জন্য নিজের ইগোকে সে কখনো বড় করে দেখে না। বড়রা যা করে।
যারা বয়সে বড়, যারা মনে করে তারা কোনো সত্যকে পুরোপুরি জেনে গেছে, কোনো আদর্শকে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, যারা মনে করে, তাদের এখন দায়িত্ব হচ্ছে অন্যদের আলোকিত করা, জ্ঞান দান করা, সঠিক পথে চলার জন্য সহযোগিতা করা, তাদেরও মাঝে মাঝে মারাত্মক ইগো প্রবলেমে ভুগতে দেখা যায়।
প্রতিটা জ্ঞানী তথা জ্ঞানদানকারীই জ্ঞানগত সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এমনকি নবী-রাসূলগণের মতো ব্যক্তিরাও ওহীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা কীভাবে বুঝবো, আমরা ঠিক পথে আছি, অলরেডি বেপথু হয়ে যাই নাই?
সঠিক পথে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য আত্ম উপলব্ধির গভীরতা ও দৃষ্টিভংগীর স্বচ্ছতা থাকা জরুরী। দুটো জিনিস এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে: (১) বেসিক টেক্সটের রিপেটেড, রিনিউড, কনসিসটেন্ট এন্ড কন্টিনিউড আন্ডারস্ট্যান্ডিং, (২) আশেপাশের লোকজনের সহযোগিতা। এর দ্বিতীয়টা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
দেখুন, আমি কিন্তু বিজ্ঞজনদের সহযোগিতা বা গাইডেন্সের প্রয়োজনীয়তাকে হাইলাইট করি নাই। দেখা যায়, মাঝে মাঝে কেন জানি অতি বিজ্ঞজনেরাও সামষ্টিকভাবে ভুল করে। কোনো সহজ বিষয়েও তারা কেন জানি অনর্থক কনফিউজ করে। একটা পুচকে বাচ্চা নেংটু রাজাকে আসল কথাটা বলে দেয়ার মতো কোনো আনাড়ি, অপরিণামদর্শী ও নগন্য ব্যক্তি অতীব জরুরী কথাটা পরিষ্কার করে বলতে পারে। অত্যন্ত কার্যকরী সমাধান ফেলনা টাইপের কোনো লোকের কাছ হতে আসতে পারে। এমনটা হয়।
সে জন্য যেসব আদর্শবাদী আগামী দিনের সমাজ গড়ার কাজে স্বনিয়োজিত আছেন তাদের উচিত নিজেদের কাজ ও কথার বিরুদ্ধ-সমালোচনার দ্বারটা উন্মুক্ত রাখা।
কীভাবে বুঝবেন আপনার মন, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির দ্বার উন্মুক্ত?
তিনি বুদ্ধিজীবী হিসাবে স্বীকৃত হন বা না হন, যখন একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি বিরোধীমতকে স্বাগত জানাবেন, ধৈর্য্য সহকারে শুনবেন, গঠনমূলক সমালোচনাকে অকপটে গ্রহণ করবেন, অগ্রহণযোগ্য কথাকে যুক্তি দিয়ে শালীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করবেন, তর্কে জিতার মানসিকতা পরিহার করে দরদী মন নিয়ে নিজের কথাকে নতুন করে সাজিয়ে বলবেন, হোক তা সংক্ষেপে অথবা বিস্তারিতভাবে, তখনই বুঝা যাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আসলেই আদর্শবাদী। একজন ভালো মানুষ। তিনি হতে পারেন একজন ভালো মুসলমান।
দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষ বলেছেন, একজন মুসলমানের হাত ও মুখ হতে অন্যরা নিরাপদ থাকবে। অন্যায়ভাবে একজন মুসলমান কখনো অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না।
সমস্যা হলো, আমাদের তরুণ এগ্রেসিভ চিন্তাশীল ও জ্ঞানীরা ন্যায় মনে করেই তাবৎ ‘অন্যায়ের’ দাঁতভাংগা জওয়াব নিয়ে ‘বিরোধীদের’ উপর ঝাপিয়ে পড়েন। ‘হক্ব’ প্রতিষ্ঠার নেক নিয়তেই তারা ‘কী-বোর্ড জেহাদে’ পার্টটাইম-ফুলটাইম আমলরত থাকেন। কোনো বলকেই তারা ছাড়তে রাজি না। প্রতিটা বলেই তাদের ছক্কা মারা চাই।
ইনাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই নিজেকে ‘ক্রিটিক’ দাবী করেন। যদি বলেন, বুঝলাম, (অমুক) কথাটা ঠিক না। সঠিক কথাটা কী হবে তা আপনিই বলুন। না, উনারা তা বলব্নে না। burden of proof বা প্রমাণের দায়িত্বকে তারা এড়িয়ে চলেন। তার কিছু বললেও এতো মারপ্যাঁচ দিয়ে বলবেন, যাতে শেষ পর্যন্ত আসল পয়েন্টটাই আপনি ধরতে পারবেন না। এ ধরনের মাল্টিলেয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে আরগু করার ‘বাংলা প্রফেট’ হচ্ছেন হাল নাগাদের ‘রাইটিং মডেল’ শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহার।
একটা কথাকে নানাভাবে শক্তিশালী করা এক জিনিস আর কোনো কথাকেই কনক্লুসিভলি না বলা এবং শেষ পর্যন্তও নিজের অবস্থানকে কনক্রীটলি আইডেন্টিফাই না করা, দু’টা ভিন্ন জিনিস। প্রথমটা নির্দোষ ও সতত স্বাগত। দ্বিতীয়টা নিঃসন্দেহে খারাপ ও পরিত্যাজ্য। এই দ্বিতীয় ধরনে আরগুমেন্ট করার সমস্যা শুধুমাত্র মজহারীয় সমস্যা না, এটি মোটাদাগে বামপন্থার পদ্ধতিগত সমস্যা। অথচ, মার্কস এই ক্রিটিককারীদেরও ক্রিটিসিজম করেছেন। সমস্যাটা তাই মার্কসের নয়, মার্কসবাদীদের। এটি তাদের অন্যতম গ্লোবাল সমস্যা।
নাস্তিকদেরও একই সমস্যা। নাস্তিকরা প্রকাশ্যেই বলে, আস্তিকতার বিরোধিতা করাই নাকি নাস্তিকতার বুৎপত্তিগত অর্থ ও প্রচলিত এপ্রোচ। এদের মূল পুঁজি হলো আস্তিকতার পক্ষে ব্যবহৃত বিভিন্ন দাবীকে ‘খণ্ডন’ করা। আগ্রাসী নিউ-এথিস্টরা তো বিরোধিতাকেই একমাত্র ‘ধর্ম’ বা পদ্ধতি মনে করে।
এতবড় একটা জগত, এই যে জীবন, প্রাণ প্রবাহ, এসব নিয়ে তাদের যৌক্তিক প্রস্তাবনা খুবই দুর্বল। তাদের সামগ্রিক আলোচনার সদর্থক দিক অতি সামান্য। এমনকি পরিমাণগত দিক থেকেও এটি সত্য। যে কোনো তথাকথিত ‘মুক্তমনা’ লেখকের সবগুলো লেখাকে যাচাই করলে এটি বুঝা যাবে।
কোনো আদর্শ অনুসারীদের জন্য এমন অবস্থা ভয়াবহ। কম্যুনিস্টদের দেখবেন, দিনরাত ‘পুঁজিবাদের বিরোধিতায়’ লিপ্ত। নিজেদের কথা কী? তথাকথিত সাম্যবাদে ‘সাম্যে’র ধারণাটা ঠিক কী রকম? শ্রেণীহীন সমাজ কেন হবে, কীভাবে হবে, আদৌ কি হবে? রাষ্ট্রের বিকল্প কী? রাষ্ট্রবিহীন সমাজে রাজনীতি কী হবে? মানুষ ও জগতকেই বা তারা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে? এসব প্রশ্নের বিষয়ে আমি কোনো মার্কবাদীর কাছে থেকেই সহজ সরল কোনো উত্তর আজ অবধি পাই নাই। সমালোচনায় তারা যতটা পারঙ্গম, প্রস্তবনায় তারা ততটাই দুর্বল।
সমালোচনাই এদের মূল এপ্রোচ। যতটুকু বুঝেছি তাতে পরিষ্কার, এটি হলো নৈরাজ্যবাদী ও অজ্ঞেয়তাবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। সব মত, পথ, তত্ত্ব ও আদর্শের মতো নিহিলিজম ও এগনস্টিসিজমের পক্ষেও কিছু যুক্তি আছে বৈকি। ব্যাপার হলো, যুক্তি সব পক্ষেই আছে। আমাকে আপনাকে বা যে কাউকে সর্বোপরি দেখতে হবে, কোন পক্ষের যুক্তি অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী। কোনো আদর্শকে গ্রহণ করার জন্য এটি ন্যূনতম শর্ত।
তাই সংগত কারণেই, নিজেদের শিশু-কিশোর কিংবা ‘জ্ঞান-নবীণ’ স্বীকার করতে নারাজ অথচ দিনরাত নানা জনের সমালোচনাতেই ব্যস্ত, তাদের সাথে আমি নাই। আমার পরামর্শ, এমন মুখর সমালোচকদের আপনারাও এড়িয়ে চলুন। তাদের অতীত ব্যাকগ্রাউন্ড ও বর্তমান ইন্টেচেকচুয়্যাল এসটাবলিশমেন্টকে মুখ বুঁজে অস্বীকার করুন। জাস্ট এভয়েড করুন। যাদের লেখা পড়ে এটি লিখছি তাদেরকে আমি কিছু বলছি না। কারণ বোকাদেরকে বোকা বলা হলো অধিকতর বোকামী। বরং এই ভুল প্রবণতার ব্যাপারে নিরীহ কিন্তু আগ্রহীদেরকে সতর্ক করছি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে লেখক-পাঠক তৈরীর এই উচ্চফলনশীল সময়ে সমালোচনা ও আত্মগঠনের এই দিকটার ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরী।
সমালোচনা না করে শুধুমাত্র গঠনমূলক কথা বলা ও নিজের মতো কাজ করে যাওয়অ – এটি অন্যতম ভুল ও প্রান্তিক চিন্তা। আবার সারাক্ষণ এর ওর সমালোচনাই করে যাওয়া – এটিও ভুল ও প্রান্তিক চিন্তা।
সমালোচনা করতে হয়। না হলে আপনার কথা ও অবস্থান সম্পর্কে অন্যরা ভুল বার্তা গ্রহণ করতে পারে। নতুন কিছু পুরনোকে অগ্রাহ্য করেই গড়ে উঠে। সে জন্য এ ধরনের অগত্যা সমালোচনাকে গঠনমূলক সমালোচনা বলা হয়। যার নিজের কথা স্পষ্ট নয় তার সমালোচনা করা মানে হলো নিছক সমালোচনার জন্য সমালোচনা। এটি একটা মানসিক রোগ। বলতে পারেন, এক ধরনের সুলভ বুদ্ধিবৃত্তিগত বিকার।
যারা শুধু ভাংগতে পারঙ্গম। ভাংগার আগে বা সাথে সাথে গড়ার চিন্তায় যারা আনাড়ি ও অনাগ্রহী তাদের অবস্থা শিশুদের চেয়েও খারাপ। শিশুরা ভাংগতে মজা পায়। এটি সত্য। আবার তারা গড়তেও পছন্দ করে। সর্বোপরি, তাদের থাকে নিষ্কলুষ মন, সত্যান্বেষী মনোভাব। আজকালকার নবীণ ও প্রবীণ অনেক রিসোর্স পারসনের মধ্যে যা দেখা যায় না।
যারা জানে না, বা কম জানে তারা বড় বড় বিষয়ে ভুল করে। সাধারণেরা ভুল করে উচ্চতর বিষয়ে। আর যারা জানে, অথবা বেশি জানে, তারা ভুল করে ছোট ছোট কিন্তু সিগনিফিকেন্ট সব বিষয়ে।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি বড়দের বড় ভুলগুলো আদতে তুচ্ছ। তারা ছোট ছোট নৈতিক প্রপজিশনকে কখন যে মাড়িয়ে চলতে শুরু করেন তা তারা নিজেরা বুঝতে পারেন না। ভাবেন, আমি তো অমুক অমুক বড় বড় সমস্যা নিয়ে এনগেইজড আছি। ভাবখানা এমন, তারা দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করছেন। ইসলামিস্ট হলে ভাববেন, আমি তো উম্মাকে ঐতিহাসিক ও গুরুতর সংকট হতে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। অথচ, কখন যে তিনি পরমত সহিষ্নুতার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান, স্বাভাবিক মানবিক বোধ ও সাধারণ সৌজন্যতাকেই হারিয়ে ফেলেছেন, কখন যে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’-এর চোরাবালিতে ডুবে গেছেন, তা টেরই পান নাই। আফসোস…!
এ ধরনের একদেশদর্শী অলস বুদ্ধিজীবীতা হতে আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আ-মীন।